You dont have javascript enabled! Please enable it! পশ্চিম পাকিস্তান ফ্রন্টে হামলা নিয়ে বিভ্রান্তি - সংগ্রামের নোটবুক

পশ্চিম পাকিস্তান ফ্রন্টে হামলা নিয়ে বিভ্রান্তি

আজ তিন ডিসেম্বর। কলকাতায় এক জনসভায় ভাষণ দিচ্ছিলেন ইন্দিরা গান্ধী। নানা জল্পনা তিনি কি বাংলাদেশকে স্বীকৃতি দিচ্ছেন? যুদ্ধ ঘােষণা করছেন? একটি চিরকুট এল। নতুন কোনাে ঘােষণা এল না। সভা শেষ হলাে। তিনি দ্রুত ফিরে গেলেন দিল্লি। পাকিস্তান আজ প্রথম কাশ্মীর সীমান্তে ভারতীয় ভূখণ্ডে বিমান হামলা চালায়। আনুষ্ঠানিক যুদ্ধের শুরু। এ জন্যই বলা হয়, একাত্তরে পাক-ভারতের যুদ্ধের মেয়াদ ১৪ দিন। ইন্দিরা এদিন জাতির উদ্দেশে দেয়া বেতার ভাষণে বলেন, আজ বাংলাদেশের যুদ্ধ ভারতের যুদ্ধে পরিণত হলাে। এদিন ভারতে জরুরি অবস্থাও জারি হয় । পিআইএর সব ফ্লাইট বাতিল করা হয়। ঢাকায় কাফু জারি করা হয় রাতে। ভুভো এই প্রথম বলেন, তার দল একজন পূর্ব পাকিস্তানি প্রধানমন্ত্রী এবং তিনি সহকারী প্রধানমন্ত্রী হতে রাজি আছেন। তবে তাকে পূর্ণ ক্ষমতা দিতে হবে।

পশ্চিম পাকিস্তান ফ্রন্টে কে কার বিরুদ্ধে প্রথম হামলা চালিয়েছে, তা নিয়ে ছিল। পরস্পরবিরােধী বক্তব্য। দৈনিক আজাদে ৪ ডিসেম্বরে প্রথম পাতায় ৮ কলামজুড়ে শিরােনাম ‘সারা পাকিস্তানে ভারতীয় হামলা শুরু”। দৈনিক পাকিস্তানের ৭ কলামজুড়ে ব্যানার হেডলাইন ‘এযাবৎকালের বৃহত্তম হামলা’। এপিপির রিপাের্টে বলা হয়, ভারতীয় বাহিনী আজ পশ্চিম পাকিস্তান সীমান্ত আক্রমণ করেছে। পাকিস্তান বিকেলে ভারতের অগ্রবর্তী এলাকার বিমানক্ষেত্র অমৃতসর পাঠানকোট, অবন্তিপুরা ও শ্রীনগরে বােমাবর্ষণ করে। ওয়াশিংটনের কাছে হামলার কথা স্বীকার করে পাকিস্তান। কিন্তু ওয়াশিংটন সেদিন তা প্রকাশ করেনি। এদিন ওয়াশিংটন সময় সকাল ১০টা ৪৫ মিনিটে দুজনের টেলিসংলাপ কিসিঞ্জার নিক্সনকে বলছেন, মনে হচ্ছে পূর্ব। পাকিস্তানের পতন ঘটছে। আর সে কারণেই পশ্চিম পাকিস্তান আক্রান্ত হলাে। পররাষ্ট্র দপ্তর ভারতকে সামরিক সহায়তা বন্ধের সিদ্ধান্ত ঘােষণা না দিতে এ ঘটনাকে অজুহাত হিসেবে ব্যবহারে আগ্রহী। কিন্তু আমি মনে করি, এ ঘটনার পর ভারতকে সহায়তাদান কর্মসূচি একেবারেই বাতিল করা সঙ্গত। কিসিঞ্জার আরাে বললেন, পাকিস্তান যদি যুদ্ধ। ছাড়াই তাদের দেশের অর্ধেক হারায় তাহলে তারা ধ্বংস হয়ে যাবে। এভাবেও হয়তাে তাদের বিনাশ ঘটবে। কিন্তু তারা তাে যুদ্ধ চালিয়ে যেতে পারবে। জবাবে নিক্সন। পাকিস্তানের ঘটনাবলি আপনার চিত্তকে অস্থির করে তুলছে ভারতকে আমাদের অবশ্যই অস্ত্র সরবরাহ বন্ধ করে দিতে হবে। কেন আমরা তা করব না। পশ্চিম পাকিস্তান ভারত আক্রমণ করেছে? তাদের বলে দিন, ভারত যখন দাবি করে যে, পশ্চিম পাকিস্তানই তাদের আক্রমণ করেছে। তখন মনে হয়, এ যেন রাশিয়ার দাবি, ফিনল্যান্ড তাদের আক্রমণ করেছে!

১০টা ৫৫ মিনিটে মার্কিন পররাষ্ট্রমন্ত্রী রজার্সের ফোন আসে। কিসিঞ্জার রজার্সকে বলেন, প্রেসিডেন্ট আজ দুপুরের মধ্যেই অস্ত্র সহায়তা বন্ধ সংক্রান্ত বিবৃতি প্রকাশে বেপরােয়া। তিনি চাইছেন, আমরা যেন পাকিস্তানের দিকে ঝুঁকে থাকি। রজার্স বলেন, আমিও তা-ই চাইছি। তবে ভারতকে নিন্দা জানিয়ে কোনাে বিবৃতি প্রকাশে আমি কিছুটা দ্বিধাদ্বন্দ্বে । প্রশ্ন হলাে, কে দোষী তা নির্ধারণ করে কোনাে বিচার বিভাগীয় ভূমিকা পালন কি আমাদের ঠিক হবে? আমার তাে মনে হয়, বিষয়টি নিরাপত্তা পরিষদে পেশ করাই সমীচীন হবে। কিসিঞ্জার বলেন, প্রেসিডেন্ট কিন্তু ভারতকে অর্থনৈতিক সাহায্য বন্ধ করে দেয়ার কথাও ভাবছেন।  জাতিসংঘে পাকিস্তানের স্থায়ী প্রতিনিধি (পরে জাতিসংঘের সহকারী মহাসচিব) ইকবাল আখুন্দ ১৯৯৭ সালে তার “মেমােয়ার্স অব এ বাইস্টান্ডার এ লাইফ ইন ডিপ্লোম্যাসি’ বইয়ে নিশ্চিত করেন যে, পাকিস্তানই এদিন কাশ্মীরের চম্ব সেক্টরে হামলা চালায়। এ হলাে সেই সাধারণ যুদ্ধ’, যার হুমকি গােটা বছরজুড়ে দিয়ে আসছিলেন। ইয়াহিয়া । ১৯৮৯ সালে মার্কিন সামরিক বাহিনীর গবেষণামূলক গ্রন্থ বাংলাদেশ এ কান্ট্রি স্টাডি’তে তথ্য দেয়া হয়, শেষ নভেম্বরে পূর্ব পাকিস্তানে ভারতীয় বাহিনীর অভিযানের পাল্টা ব্যবস্থা হিসেবে ৩ ডিসেম্বর পাকিস্তান ভারতের বিরুদ্ধে সিরিজ বিমান হামলা চালায়। (পৃষ্ঠা-২১০)।  কিসিঞ্জারের সভাপতিত্বে এদিন সকাল ১১টা ১৯ থেকে ১১টা ৫৫ মিনিট পর্যন্ত ওয়াশিংটন স্পেশাল অ্যাকশন গ্রুপের বৈঠক হয়।

এতে সিদ্ধান্ত হয় যে, এক, পাকরাষ্ট্রদূতের সঙ্গে আলাপের পরে নিরাপত্তা পরিষদের বৈঠকের দিনক্ষণ নির্ধারণ। দুই. আমাদের প্রস্তাবিত রেজুলেশনসহ রাষ্ট্রদূত বুশের জন্য ভাষণের খসড়া তৈরি। তিন, সােমবার পর্যন্ত ভারতকে অতিরিক্ত কোনাে ঋণপত্র ইস্যু না করতে ব্যাংকগুলােকে পরামর্শ দান। চার, কিসিঞ্জার প্রেসিডেন্টের কাছ থেকে এটা জেনে নেবেন যে, পাকিস্তানের জন্য বরাদ্দকৃত ২২ মিলিয়ন ডলারের ভাগ্যে কী জুটবে। কারণ যে ক্যাটাগরিতে ভারতকে বন্ধ করা হচ্ছে, তাতে পাকিস্তানের বিষয়েও একই সিদ্ধান্তে নিতে হয়। পাঁচ, পররাষ্ট্র দপ্তর প্রেসিডেন্টকে লেখা ইয়াহিয়ার ২ ডিসেম্বরের চিঠির জবাব তৈরি করবে। কিসিঞ্জার বৈঠকের শুরুতেই চাপা উত্তেজনায় বলতে শুরু করেন, আমি প্রেসিডেন্টের কাছ থেকে প্রত্যেক আধ ঘণ্টা অন্তর গুঁতাে খেয়ে চলেছি। তিনি বলছেন, আমরা যথেষ্ট কঠোর হচ্ছি না। তার ধারণা, পররাষ্ট্র দপ্তর কঠোর হতে চাপ দিচ্ছে, কিন্তু আমিই বাগড়া দিচ্ছি। তিনি সত্যিই বিশ্বাস করছেন না যে, আমরা তার ইচ্ছাই পূরণ করে চলেছি। তিনি চাইছেন, আমাদের নীতি ও কাজ হবে পাকিস্তানঘেঁষা। কিন্তু তা না হয়ে প্রত্যেক ব্রিফিং বা বিবৃতি প্রবাহিত হচ্ছে ভিন্নখাতে।

কিসিঞ্জারের এ বক্তব্যে এটা স্পষ্ট যে, তিনি অন্যদের ওপর চাপ সৃষ্টির কৌশল গ্রহণ করেন। নিক্সন-কিসিঞ্জার দুজনেই জানতেন স্টেট ডিপার্টমেন্টসহ প্রশাসনের একটি প্রভাবশালী অংশ বাংলাদেশ প্রশ্নে ভারতের প্রতি সহানুভূতিপ্রবণ ছিলেন। একাত্তরে নিউইয়র্ক টাইমসের সাংবাদিক জ্যাক এন্ডারসন এই বৈঠকের বিবরণীসহ বেশ কিছু দলিল প্রকাশ করতে পেরেছিলেন এদের কল্যাণেই। এ ক্ষেত্রের ‘ডিপথ্রট’ ছিলেন কিসিঞ্জারেরই সহকারী চার্লস রেডফোর্ড। তবে সেই দলিল, যা এন্ডারসন পেপারস ও ২০০২ সালে এফ এস আইজুদ্দিন সম্পাদিত “দি হােয়াইট হাউস অ্যান্ড পাকিস্তান (অক্সফোর্ড) এ মুদ্রিত হয়েছে, তার সঙ্গে ৬ মে, ২০০৫ প্রকাশিত নথিপত্রের সঙ্গে কিছু পার্থক্য লক্ষণীয়। যেমন ৩ ডিসেম্বরের বৈঠকে কিসিঞ্জারের প্রশ্ন : ভারত কি পাক ভূখণ্ড জবরদখল করছে? জবাবে সিআইএ পরিচালক রিচার্ড হেলমস বলছেন, হ্যা, ভারত নিশ্চিতভাবেই ক্ষুদ্র হলেও পাকিস্তানের ভূখণ্ড দখল করে নিয়েছে। (আইজুদ্দিন, পৃষ্ঠা-৪০০)। গত ৬ মে সরকারিভাবে অবমুক্তকৃত দলিল মতে হেলমস বলেন, ‘না, তাদের দ্বারা সামান্য অংশ ব্যতিরেকে পাক ভূখণ্ড গ্রাস বা অপদখলের কোনাে প্রশ্নই আসে না।’  এই নথি থেকে দেখা যাচ্ছে, সিআইএ জানত পাকিস্তানিরাই শ্রীনগর, অমৃতসর ও পাঠানকোটে হামলা চালিয়েছে। অ্যাডমিরাল মুরার এ মর্মে আক্ষেপও করেন, পাকিস্তানিদের এ পদক্ষেপ একেবারেই কাঁচা কাজ। ‘৬৫-র যুদ্ধের মতাে দক্ষতাও তারা দেখাতে পারেনি।

এ দিনের আলােচনা থেকে আরেকটি বিষয় পরিষ্কার যে, যুক্তরাষ্ট্র তার পররাষ্ট্রনীতির স্বার্থে কখনাে জাতিসংঘকে ব্যবহারে উদগ্রীব। বৈঠকে কিসিঞ্জারের একটি মন্তব্য, প্রেসিডেন্টের বিশ্বাস এই ইস্যুতে জাতিসংঘ যদি কিছু না করতে পারে তাহলে তার টিকে থাকা অর্থহীন। সামরিক চুক্তি : কাগুজে দলিল সাম্প্রতিক মার্কিন গােপন নথি সন্দেহাতীতভাবে এক অর্থে পুনঃপ্রমাণ করেছে যে, নিজের শক্তি না থাকলে বৃহৎশক্তির সঙ্গে প্রকাশ্য কিংবা গােপন আঁতাত প্রয়ােজন মুহূর্তে অর্থহীন মনে হতে পারে। ‘৬৫-র যুদ্ধের পরে ভুট্টো বলেছিলেন, ভারতের সঙ্গে এ যুদ্ধ চলবে হাজার বছর । ইয়াহিয়া ২ ডিসেম্বরে নিক্সনকে ১৯৫৯ সালের চুক্তির দোহাই দিয়ে মরিয়া হয়ে সাহায্য প্রার্থনা করেন। পরিহাস হচ্ছে, ৩ ডিসেম্বরে ওয়াশিংটন স্পেশাল গ্রুপের বৈঠকে শীর্ষস্থানীয় নীতিনির্ধারকরা এই চুক্তি নিয়ে দীর্ঘ আলােচনা করেন। কিন্তু এটা কেউ কবুল করেননি যে, এটা পালনে তাদের কোনাে বাধ্যবাধকতা রয়েছে। বাংলাদেশ সংকটের ৯ মাস পর স্বয়ং কিসিঞ্জারও বলছেন, আজকের আগে এ চুক্তির কথা আমি কখনাে গুরুত্ব দিয়ে ভাবিনি। দুই দেশেরই দুটো রক্ষাকবচ ছিল যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে। ভারতের সঙ্গে ১৯৬৩-তে সই হয় গােপন আকাশ। প্রতিরক্ষা চুক্তি। তবে পাক-মার্কিন সামরিক চুক্তি ছিল সুনির্দিষ্ট। ১৯৫৯ সালের ৫ মার্চ স্বাক্ষরিত এই চুক্তিতে বলা হয়, পাকিস্তানের বিরুদ্ধে আগ্রাসন হলে দুই দেশের সম্মত উপায়ে যুক্তরাষ্ট্র সামরিক সহায়তা দেবে।

আজ দিনের শেষভাগে ফ্লোরিডায় অবস্থানরত নিক্সনের সঙ্গে কিসিঞ্জারের টেলিসংলাপ চলে। কিসিঞ্জার দিব্যি নিক্সনকে বললেন, এতে আর কোনাে সন্দেহ নেই। যে, পাকিস্তান নয়, ভারতই হামলা করেছে। এদিকে আজ এপিপির এক রিপাের্টে বলা হয়, জর্ডানের বাদশা হােসেন। ইয়াহিয়াকে লেখা এক বার্তায় বলেন, বিশ্বের বৃহত্তম ইসলামি রাষ্ট্রের কোনাে ক্ষতির প্রতি কোনাে মতেই আমরা চোখ বুজে থাকতে পারি না। ডা. চৌহান লন্ডনে বলেন, স্বাধীন শিখ রাষ্ট্র গঠনে পাকিস্তানের কাছ থেকে সহায়তার আশ্বাস মিলেছে।

ইয়াহিয়া-ভুট্টোর মনােভাব রহস্যঘেরা

আজ ৪ ডিসেম্বর। পিন্ডিতে সরকারি মুখপাত্রের দাবি, পশ্চিম ফ্রন্টে ভারতীয় আক্রমণ স্তব্ধ করে দেয়া হয়েছে। হামুদুর রহমান কমিশনের রিপাের্টে ৩ ডিসেম্বরের পাকিস্তানি ‘প্রি-এম্পটিভ’ হামলা অবশ্য ‘ডি-ডে’ হিসেবে চিহ্নিত করা হয়েছে। এতে বলা হয়েছে, ভারতীয় বােমারু বিমান আজ তেজগাঁও ও কুর্মিটোলায় সর্বাত্মক হামলা চালায়। ভারতের ৯টি ও পাকিস্তানের ৩টি বিমান ভূপাতিত হয়। ভারত বিশাখাপত্তমে পাক সাবমেরিন গাজী ডুবিয়ে দিয়েছে। পাক সশস্ত্র বাহিনীর ওপর থেকে ভারতীয় ভূখণ্ডে প্রবেশের নিষেধাজ্ঞা আজ প্রত্যাহার করা হয়। কিসিংস আরকাইভস লিখেছে, ভারত আজ বলেছে, সে ইন্দো-সােভিয়েত মৈত্রী চুক্তির ৯ নম্বর অনুচ্ছেদ (আগ্রাসনের হুমকি সংক্রান্ত) প্রয়ােগের সম্ভাব্যতা খতিয়ে দেখছে।

নিরাপত্তা পরিষদে আজ বাংলাদেশ প্রসঙ্গে জরুরি বৈঠক হয়। তবে বাদানুবাদের কারণে প্রস্তাব গ্রহণ চেষ্টা ব্যর্থ হয় । কিন্তু এ নিয়ে পাক-ভারতের একটা উভয় সংকট অবস্থা চোখে পড়ে। ভারত পাক হামলার ব্যাপারে জাতিসংঘ মহাসচিবের কাছে অভিযােগ করে। কিন্তু নিরাপত্তা পরিষদে কোনাে আনুষ্ঠানিক অভিযােগ উত্থাপন করবে বলে জানিয়ে দেয়। দিল্লিতে একজন মুখপাত্র বলেন, এর কারণ ভারত কাশ্মীর প্রশ্নে ইতঃপূর্বে এক দুর্ভাগ্যজনক অভিজ্ঞতা অর্জন করেছে।  তৎকালীন পাক পররাষ্ট্র সচিব সুলতান হােসেন খান তার “মেমােরিজ অ্যান্ড রিফ্লেকশনস’ (১৯৯৭) বইয়ে লিখেছেন, নিরাপত্তা পরিষদের বৈঠক নিয়ে আজ প্রত্যুষে মার্কিন রাষ্ট্রদূত ফারল্যান্ড দেখা করেন। কিন্তু তিনি বারবার ঘড়ি দেখছিলেন। আমি জানতে চাইলে বলেন, ‘দ্রুত ফিরতে হবে। আমাদের এয়ার এটাশের নিশ্চিত ধারণা, কিছুক্ষণের মধ্যেই ভারত বিমান হামলা শুরু করবে। দেখলাম তার কথাই সত্য হলাে। সাইরেন বাজল। ইয়াহিয়া ও ভুট্টো এদিন আমাকে বােঝালেন, নিরাপত্তা পরিষদে কালক্ষেপণেই লাভ। যা খুশি প্রস্তাব পাস হােক, আমাদের কাছে গ্রহণযােগ্য না হলে মানব না। তাই এ উদ্যোগ থেকে দূরে থাকাই ভালাে।’ এই দুই নেতা তাদের এমন মনােভাব যুক্তরাষ্ট্রের কাছে প্রকাশ করেছেন বলে জানা যায় না। লক্ষণীয় হচ্ছে সুলতানের একটি মন্তব্য। তার কথায় সূক্ষ্ম আভাস মেলে যে, ইয়াহিয়া ও ভুট্টোর কোনাে রাজনৈতিক অভিসন্ধি ছিল অথবা সুলতান অন্তত এমনও বিশ্বাস করতে প্রস্তুত ছিলেন। সুলতান লিখেছেন, যুক্তরাষ্ট্র ও চীন কেউ আমাদের কোনাে ভরসা দেয়নি যে,

তারা সামরিক সহায়তা দেবে। তাহলে কেন এ দুজন নিরাপত্তা পরিষদ এড়াতে চান? পূর্বের অবস্থা বেগতিক ও পশ্চিম ফ্রন্টে সাফল্যের সম্ভাবনা ক্ষীণ। ইয়াহিয়া তাহলে কোন অজ্ঞাত জিনিসের ভরসা করছেন? ‘৬৫-র কায়দায় আমরা এখনাে ধরাশায়ী হইনি-ইয়াহিয়া খোঁচা দেন আইয়ুব খানকে। তাদের এ মনােভাবে আমি হতাশ হলাম । সুলতান এরপর মন্তব্য করেন, এই উপসংহার অকাট্য যে, হয় তারা বাস্তবতা বুঝতে অপারগ কিংবা তাদের মনে কিছু রাজনৈতিক উদ্দেশ্য রয়েছে, যা শুধু তারাই জানেন। (পৃষ্ঠা ৩৬৪-৩৬৫) মার্কিন নথিপত্র পর্যালােচনায় সুলতানের এ বক্তব্য সঠিক প্রমাণিত। হচ্ছে যে, যুক্তরাষ্ট্র ও চীন কেউ পাকিস্তানকে কোনাে কথা দেয়নি। তবে নির্দিষ্ট সামরিক সহায়তা না দিলেও নৈতিক ও রাজনৈতিক সমর্থনের ঘাটতি ছিল না। যেমন চীনের ভারপ্রাপ্ত পররাষ্ট্রমন্ত্রী চি-পেং ফি আজ বলেন, সমাজতান্ত্রিক সাম্রাজ্যবাদের (রাশিয়া) সমর্থনপুষ্ট হয়েই পাকিস্তানের বিরুদ্ধে ভারত তার আক্রমণ তীব্র করছে। চীন আজ ভারতীয় আক্রমণের নিন্দা করে। এবং পাকিস্তানের প্রতি দৃঢ় সমর্থন দেয়া সংক্রান্ত একটি খবর এপিপি প্রচার করে। জেনারেল অরােরা কলকাতায় সাংবাদিকদের বলেন, ভারতের পূর্ব সীমান্তে চীনা হস্তক্ষেপের আশঙ্কায় তিনি উদ্বেগ বােধ করছেন। আজ ফারল্যান্ড কিসিঞ্জারকে এক ব্যাক চ্যানেল বার্তায় জানান, গতকাল ইয়াহিয়া। তার কাছে আকুল আকুতি জানিয়ে বলেছেন, আপনারা যখন সরাসরি আমাদের অস্ত্র দিতে পারছেন না, তখন তৃতীয় কোনাে বন্ধু দেশের মাধ্যমে পেতে সাহায্য করুন। আল্লাহর দোহাই, কোনাে বাধা সৃষ্টি করবেন না। আমি বলেছি বটে বিষয়টি আপনার নজরে নেব। কিন্তু তাকে এটাও বুঝিয়ে দিলাম যে, ‘পাকিস্তানকে মার্কিন অস্ত্র সহায়তা দেয়ার অতীত ইতিহাসের নিরিখে আপনি যা চাইছেন তা পূরণ করা কঠিন।’

নিক্সন ও কিসিঞ্জার এদিন আলাপ করে ঠিক করেন যে, ইরানের শাহকে বলা হবে অস্ত্র দিতে। আমরা তাদের পরে পুষিয়ে দেব। নিক্সন বলেন, এ তথ্য যদি ফাস হয় তাহলে আমরা অস্বীকার করব। এদিন এ দুজন এক দীর্ঘ টেলিসংলাপ পাকিস্তানকে সহায়তাদানে নিরাপত্তা পরিষদকে ব্যবহার ও ভারতকে সব রকম সাহায্য বন্ধের মধ্যেই সীমিত রাখেন। কিসিঞ্জার নিক্সনকে আশ্বস্ত করেন যে, রাষ্ট্রদূত বুশ কঠোর বক্তব্য রাখবেন। নিউইয়র্ক টাইমস ও ওয়াশিংটন পােস্টের সম্পাদকীয় অবস্থান সম্পর্কে নিক্সন খোজ নেন। কিসিঞ্জার তাকে বলেন, টাইমস এখনাে কিছু বলেনি। পােস্টের তাগিদ নিরাপত্তা পরিষদে তুলতে। নিক্সনের প্রশ্ন, তারা কি ভারত বা পাকিস্তান বা উভয়কে দোষারােপ বা অন্য কিছু বলছে । কিসিঞ্জারের উত্তর তারা। ভারসাম্য বজায় রাখছে। সামরিক পদক্ষেপের জন্য তারা ভারতকে দুষছে। আবার উদ্বাস্তুদের দুঃখ-দুর্দশার কথাও বলছে। তবে গােড়াতে ঝোঁক ছিল ভারতের বিপক্ষে। কিসিঞ্জার আরাে বলেন, মি, প্রেসিডেন্ট, পাকিস্তান কিন্তু আমাদের সব প্রস্তাবই কবুল করেছে। আমি ভারতীয় রাষ্ট্রদূতকে বললাম এক বছরের মধ্যে রাজনৈতিক স্বায়ত্তশাসন নিশ্চিত করতে আমরা একটি পূর্ণ কর্মসূচি একসঙ্গে প্রণয়ন করতে পারি।

যদি তারা… আসলে ভারতকে সাহায্য বন্ধ করে দিলে দেখা যাবে তাদের দৌড়। তাদের উন্নয়নে রাশানরা নিশ্চয় ৭০০ মিলিয়ন ডলার দেবে না। নিক্সন আমাদের একটা কঠিন খেলা খেলা উচিত। আমি মনে করি একটা আগ্রাসী দেশকে অর্থ সহায়তা দেয়া মার্কিন জনগণ সমর্থন করবে না। কিসিঞ্জার ভাবুন তাে, বিষয়টি কত খারাপ। ওরা আমাদের টাকায় জাতিসংঘে আমাদেরই নাস্তানাবুদ করছে। আচ্ছা, বলুন তাে এই বেজম্মারা (ভারতীয়রা) কখনাে আমাদের সমর্থন করেছে? নিক্সন : কখনাে নয়। কিসিঞ্জার : তারা যদি রাশিয়ার তাবেদারই হবে, তাহলে রাশানদেরই উচিত বছরে এক বিলিয়ন ডলার তাদের পেছনে খরচ করা। আমরা বাধা দেব না। | নিক্সন : আমরা ভারতকে ১০ বিলিয়ন ডলারের সহায়তা দিয়েছি। এখন যুদ্ধ বন্ধ করা পর্যন্ত সব সাহায্য বন্ধ করে দেব।

এদিন ওয়াশিংটন স্পেশাল গ্রুপের ২৮ মিনিটের বৈঠকে জাতিসংঘে মার্কিন অবস্থান সম্পর্কে কৌশল নির্ধারণ করা হয়। বলা হয়, আমরা সাধারণভাবে রাজনৈতিক সমঝােতার কথা বলব। কিন্তু মুজিবের মুক্তির বিষয়ে নির্দিষ্ট কোনাে বাক্যের অন্তর্ভুক্তিতে রাজি হব না। এটা ছিল কিসিঞ্জারের মন্ত্রণা। বৈঠকে তিনি প্রশ্ন করেন, পূর্ব পাকিস্তানে পাকিস্তানিরা আর কতক্ষণ টিকবে। অ্যাডমিরাল জুম ওয়াল্ট বলেন, আর বেশি দিন নয়। তাদের হাতে এক বা দুই সপ্তাহের রসদ রয়েছে। ভারত কিছু জায়গা দখল করতে পারে, কিন্তু পুরােটা নয়। আর সােভিয়েতরা সম্ভবত বিসাকের নৌঘাটি স্থায়ীভাবে ব্যবহারের লক্ষ্যে ভারতকে প্রদত্ত সাহায্যের প্রতিশ্রুতির পরিবর্তন ঘটাবে। এদিন দুপুর সােয়া ১২টায় ফ্লোরিডায় অবস্থানরত নিক্সনের সঙ্গে ওয়াশিংটন থেকে ফের কথা বলেন কিসিঞ্জার । কিসিঞ্জার বলেন, নিরাপত্তা পরিষদে ভারতীয় ও সােভিয়েতরা বিলম্ব ঘটাচ্ছে। যাতে প্রস্তাব পাস না হয়। কিন্তু এই আলােচনাতেও ভারতকে ঘায়েল করতে কিসিঞ্জার সাহায্য বন্ধেরই পরামর্শ দেন। কিসিঞ্জার আরাে বলেন, বাঙালিরা যদি মনে করে থাকে পাকিস্তান নিষ্ঠুর, তাহলে তারা যেন ভারতীয় খবরদারির জন্য অপেক্ষমাণ থাকে। ভারত বাঙালি মুসলমানদের বর্তমানের তুলনায় অধিকতর সংকীর্ণ বৃত্তে ঠেলে দেবে। আর এসব কারণেই ভারত ছয় মাসের মধ্যে আহতের মতাে দৌড়াবে না। আজ থেকেই পূর্বাঞ্চলে যুদ্ধ চিত্রের আমূল পরিবর্তন ঘটে। মার্কিন পররাষ্ট্রমন্ত্রী উইলিয়াম রজার্স আইসল্যান্ড সফর স্থগিত রাখেন। কোসিগিনও তার বিদেশ সফরে পরিবর্তন ঘটান। তিনি আজ কোপেনহেগেনে বলেন, একটি পূর্ণাঙ্গ যুদ্ধ থেকে দুই দেশকে বিরত রাখতে তিনি সর্বাত্মক প্রচেষ্টা চালাবেন। যুগােস্লাভিয়ার প্রেসিডেন্ট টিটো ইন্দিরা ও ইয়াহিয়ার কাছে দুটো জরুরি তারবার্তা পাঠান। ব্রিটিশ প্রধানমন্ত্রী অ্যাডওয়ার্ড হিথ উভয় দেশের সঙ্গেই যােগাযােগ রাখেন।

সূত্র:  ১৯৭১ আমেরিকার গোপন দলিল – মিজানুর রহমান খান – সময় প্রকাশন