বাংলাদেশের বিজয় দরজায় কড়া নাড়ে
আজ ১ ডিসেম্বর একাত্তরের এই দিনে বাংলাদেশের বিজয় দরজায় কড়া নাড়ছে। অথচ পাকিস্তান সরকার রাজাকারসমর্থিত অখণ্ডতা রক্ষার প্রচারণায় নিজকে ব্যস্ত রাখে। এমনকি যুক্তরাষ্ট্র নিজেরা নিশ্চিত যে, মুক্তিযােদ্ধারা ক্রমেই শক্তিশালী হচ্ছে। ভারতের সঙ্গে যুদ্ধ বাধলেও পাকিস্তান পরাজিত হবে। কিন্তু মিত্র পাকিস্তানের মর্যাদা রক্ষায় তারা প্রকাশ্যে নানা তৎপরতা প্রদর্শন করে। আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ও ছিল। স্নায়ুযুদ্ধ যুগের জটিল সমীকরণে বিভক্ত। পশ্চিম পাকিস্তান রক্ষা ও কনফেডারেশন। গঠনে নিক্সন-কিসিঞ্জার সর্বাত্মক পদক্ষেপ নেন। এদিন কিসিঞ্জার তার সহকর্মীদের কাছে জানতে চান ইন্দিরা গান্ধীর কাছ থেকে জবাব মিলেছে কি না? তাকে বলা হয়, শুধু ইন্দিরা নয়, সােভিয়েত নেতা কসিগিনের কাছে দেয়া পত্রেরও কোনাে উত্তর নেই।
এদিন জাতিসংঘ থেকে দি গার্ডিয়ানের সংবাদদাতা ম্যালকম ডিন প্রেরিত রিপাের্টে বলা হয়, ১৬ সদস্যবিশিষ্ট বাংলাদেশ প্রতিনিধি দল প্রায় ১০০টি দেশের প্রতিনিধিদের সঙ্গে সাক্ষাৎ করেছে। কিন্তু জাতিসংঘের ১৩১টি সদস্য দেশের একটিও এখনাে পর্যন্ত বাংলাদেশকে স্বীকৃতি দেয়নি। বিচারপতি আবু সাঈদ চৌধুরী প্রতিনিধি দলের নেতা হিসেবে প্রদত্ত এক বিবৃতিতে বিচারপতি চৌধুরী বলেন, বর্তমানে জাতিসংঘ কর্তৃক বাংলাদেশের ব্যাপারে হস্তক্ষেপ অনুচিত মার্চে হত্যাযজ্ঞ শুরুর পর তাদের প্রয়ােজনীয় পদক্ষেপ গ্রহণ করা উচিত ছিল। মুক্তিবাহিনী এ দিন কুষ্টিয়ার দর্শনা ও সিলেটের শমশেরনগর আক্রমণ করে। ছাতকে মুক্তিবাহিনী ও পাকসেনাদের মধ্যে প্রচণ্ড সংঘর্ষে ৫০ জনের বেশি নিহত হয়। পাকসেনাদের পক্ষে এই যুদ্ধে লিপ্ত ৬৫ জন রাজাকারও খতম হয়। আবদুস সালাম সম্পাদিত পাকিস্তান অবজারভার পত্রিকায় এদিন পাঁচ কলামজুড়ে শিরােনাম ছিল শুধু সিলেটেই ১৬৮ জন ভারতীয় নিহত। ২৮টি স্থানে গুলিবর্ষণ ও হামলা। প্রথম পাতায় দুই কলামজুড়ে প্রকাশিত ছবির ক্যাপশন নিহত ভারতীয় সৈন্যদের কাছ থেকে উদ্ধারকৃত গােলাবারুদ ও ব্যাজ প্রত্যক্ষ করছেন একদল বিদেশী সাংবাদিক। ৩ ডিসেম্বরে আনুষ্ঠানিক যুদ্ধ শুরুর আগ পর্যন্ত পাক প্রচারণার অন্যতম। লক্ষ্য ছিল পূর্ববাংলায় ভারতীয় সৈন্যদের উপস্থিতি প্রমাণ করা।
রাওয়ালপিন্ডিতে একজন সরকারি মুখপাত্র আজ ঘােষণা করেন, মুজিবের বিচার শেষ হয়নি। রয়টারের এক রিপাের্ট : ওয়াশিংটনে সরকারি মুখপাত্র চার্লস ব্রে ঘােষণা করেছেন, ভারতীয় সৈন্যরা পূর্ব পাকিস্তানের সীমান্ত অতিক্রমের কারণে যুক্তরাষ্ট্র ভারতকে দেয়া অস্ত্রের ছাড়পত্র স্থগিত করেছে। গত মাসে পাকিস্তানকে প্রদত্ত খুচরা যন্ত্রাংশ সংক্রান্ত সব ছাড়পত্র স্থগিতের প্রেক্ষাপটে এই সিদ্ধান্ত নেয়া হয়। বিবিসির সংবাদদাতা রােনাল্ড রবহন যশােরে গুলিবিদ্ধ একজন ভারতীয় সেকশন কমান্ডারের সাক্ষাৎ পান এবং পাকিস্তানিদের হেফাজতে তিনি চিকিৎসাধীন রায়েছেন বলে উল্লেখ করেন।
জাতিসংঘ মহাসচিব ইউথান্ট আজ জানিয়ে দিয়েছেন ইয়াহিয়ার অনুরােধ অনুযায়ী পূর্ব পাকিস্তানে পর্যবেক্ষক পাঠাতে হলে নিরাপত্তা পরিষদের আগাম আনুষ্ঠানিক সিদ্ধান্ত ও অনুমােদন অপরিহার্য। রাওয়ালপিন্ডিতে আজ এক সরকারি মুখপাত্র দাবি করেন বিভিন্ন স্থানে আজকের সংঘর্ষে ১৩০ জন ভারতীয় সৈন্য নিহত হয়েছে। শিয়ালকোটে ভারতীয় বিমানের আকাশসীমা লঙ্নের অভিযােগও আনে তারা। ভারত তা নাকচ করে দেয়। ওই মুখপাত্র বলেন, নবনিযুক্ত রাজাকাররা এক নিবেদিত প্রাণশক্তি। তারা সুপ্রশিক্ষিত ও আত্মনিবেদিত। ঢাকার কাছে তারা এক অভিযানে ১১ জন শত্রুসেনা খতম করেছে। হেনরি কিসিঞ্জারের সভাপতিত্বে ওয়াশিংটন স্পেশাল গ্রুপের বৈঠকে উল্লেখ করা হয়, বড় উদ্বেগের বিষয় হচ্ছে ভারত যদি বাংলাদেশকে স্বীকৃতি দেয় তাহলে ইয়াহিয়া পরাজয় নিশ্চিত জেনেও ভারতীয় বিমান ও সৈন্যদের অবস্থানে হামলার নির্দেশ দিতে পারেন। লক্ষণীয়, এই বৈঠকে জয়েন্ট চিফ অব স্টাফ ও সিআইএ দপ্তর নিশ্চিত করে যে, দুই পক্ষের মধ্যে সংঘাত হলে তার নিষ্পত্তি এক মাসের মধ্যেই ঘটবে। পাকিস্তানি সৈন্যরা ইতােমধ্যেই গােলাবারুদের ব্যবহার সঙ্কুচিত করেছে। বিশেষ। অনুমতি ছাড়া টিউবপ্রতি মাত্র ১০ রাউন্ড কার্তুজ বিলি করা হচ্ছে। সীমান্তে ভারতের চাপ বৃদ্ধির কারণে পাকিস্তানিরা রক্ষণশীল হয়ে পড়ছে। আর এর ফলে দেশের প্রত্যন্ত অঞ্চলে মুক্তিযােদ্ধারা অবাধে বিচরণ করতে পারছে। এদিন নিউইয়র্ক টাইমসের এক রিপাের্টেও এ তথ্য দেয়া হয়। ওই বৈঠকে অ্যাডমিরাল মুরার মন্তব্য করেন, পাকিস্তানিরা কার্যত পিছু হটছে। যশােরকে হারিয়ে তারা মারাত্মকভাবে নিজেদের পঙ্গু ভাবছে। সিআইএর লে. জেনারেল কুশম্যান বলেন, কারাে অনুমান ভারতীয়রা যশাের করায়ত্তের চেষ্টা করছে। তাদের লক্ষ্য সেখানে বাংলাদেশের রাজধানী প্রতিষ্ঠা।
বৈঠকে তথ্য দেয়া হয় যে, পাকিস্তান সরকার নিরাপত্তা পরিষদের বৈঠক আহ্বানে উদ্যোগী হচ্ছে। পাকিস্তানের রাষ্ট্রদূতকে ভুট্টোর জন্য একটি ভাষণের খসড়া লিখতে বলা হয়েছে। চীন পাকিস্তানকে ইঙ্গিত দিয়েছে যে, পাকিস্তানের কাছে অগ্রহণযােগ্য যে কোনাে প্রস্তাবে তারা ভেটো দেবে। তবে তারা এটাও জানে যে, ভারতের অপছন্দের কোনাে প্রস্তাবেও ভেটো দেবে সােভিয়েত ইউনিয়ন। সব শুনে কিসিঞ্জার মন্তব্য করেন-একটি অনিবার্য সামরিক পরিস্থিতিতেও নিরাপত্তা পরিষদ যেখানে বৈঠকে বসতে কুণ্ঠিত, সেখানে জাতিসংঘে কেউ এ নিয়ে প্রস্তাব আনতে ভরসা না পাওয়াই স্বাভাবিক। কুশম্যান পূর্ব পাকিস্তানের পরিস্থিতি সম্পর্কে বলেন, মুক্তিযােদ্ধাদের গেরিলা তৎপরতা ক্রমবর্ধমান।
এদিন পিপিআইর এক রিপাের্টে বলা হয়, পিকিং বলেছে মস্কো আগুনে ঘি ঢালছে। পাকিস্তান অবজারভার উইকলি ফ্রন্টিয়ার অব ক্যালকাটার রাজনৈতিক সংবাদদাতা কর্তৃক ২৩ অক্টোবর সংখ্যায় প্রকাশিত একটি নিবন্ধ থেকে নির্বাচিত অংশ পুনঃমুদ্রিত করে। এতে বলা হয়, প্রত্যেকেই যুদ্ধের কথা বলছে। যেন এর মাধ্যমেই তথাকথিত বাংলাদেশ সমস্যা চিরকালের জন্য সুরাহা হবে। আসলে জেনারেল ইয়াহিয়া যুদ্ধ ছাড়া পূর্ববাংলার হাতছাড়া হওয়া হজম করতে অপারগ। ওয়াশিংটন পােস্ট পত্রিকায় লি লাসকেজের একটি রিপাের্টের বরাতে অবজারভার লিখেছে, আখাউড়া ডেটলাইনে এই সংবাদদাতা খবর দিয়েছেন যে, এক পাকিস্তানি ব্রিগেডিয়ার তাকে বলেছেন, তারা যেখানেই যাচ্ছেন, সেখানেই গ্রামবাসী স্বতঃস্ফূর্তভাবে তাদের স্বাগত জানাচ্ছে। তাদের কণ্ঠে স্লোগান-পাকিস্তান জিন্দাবাদ।
করাচি ডেটলাইনে আরেকটি রিপাের্টে বলা হয়, চীনের মন্ত্রী লি শুই-চিং ইয়াহিয়ার সঙ্গে বৈঠককালে পাকিস্তানের অখণ্ডতা ও বিদেশী আগ্রাসন প্রতিরােধে জনগণের প্রচণ্ড ইচ্ছাশক্তি দেখে অভিভূত।’ ওয়াশিংটন পােস্ট পত্রিকায় মার্কিন কলামিস্ট জোশেফ আলসােপের বরাতে পাকিস্তান অবজারভার জানায়, প্রমাণ না থাকলেও এমন ইঙ্গিত মিলছে যে, শেখ মুজিবুর রহমানকে আগেভাগেই ভারত সব রকম সহযােগিতা দিতে নিশ্চয়তা দিয়েছিল। পূর্ব পাকিস্তানে হামলা শুরুর আগেই পশ্চিমবঙ্গ সীমান্তে ভারতের ৬ ডিভিশন সৈন্য মােতায়েন করা হয়। ফেব্রুয়ারিতে এই পদক্ষেপ নেয়ার অজুহাত ছিল পশ্চিমবঙ্গের নিরস্ত্র বামপন্থিদের নিয়ন্ত্রণ করা। ওই মার্কিন নিবন্ধকারের মতে, পাকিস্তানকে আংশিকভাবে ধ্বংস করার সম্ভাব্য ফল হচ্ছে, ডুবে যাওয়ার মুহূর্তে একজন মানুষকে লাথি মারা। আর সুদূরপ্রসারী রণকৌশলগত তাৎপর্য হচ্ছে সােভিয়েত ইউনিয়নের জন্য ভারতকে উল্লেখযােগ্য সামরিক ঘাঁটিতে রূপান্তরিত করা। আন্দামান দ্বীপ ও মুম্বায়ে হবে সােভিয়েতের নৌঘাটি।
রাওয়ালপিন্ডিতে গােলাম আযম পিপিআইকে বলেন, ‘মনে হয় যেন ইন্দিরা শেখ মুজিবের কৌসুলি হিসেবে কাজ করছেন। যদি কিছুসংখ্যক আওয়ামী লিগার ভারতের সঙ্গে ষড়যন্ত্র করে থাকে তার অর্থ এই নয় যে, পূর্ব পাকিস্তানি জনগণ ইন্দিরাকে। তাদের বিষয়ে হস্তক্ষেপ করতে বলেছে। যখন ভারতীয় প্রধানমন্ত্রী রাজনৈতিক সমাধান এবং শেখ মুজিবের মুক্তির কথা বলেন, তখন আমি অত্যন্ত ক্ষুব্ধ হয়ে উঠি। পাকিস্তানের অস্তিত্ব রক্ষায় অবিলম্বে ভারতের বিরুদ্ধে জেহাদ ঘােষণা করা উচিত। (ইত্তেফাক, ২ ডিসেম্বর, ১৯৭১) মার্কিন পররাষ্ট্রমন্ত্রী রজার্স আজ দিল্লিতে মার্কিন দূতাবাসে প্রেরিত এক টেলিগ্রাম বার্তায় উল্লেখ করেন, ভারতীয় বাহিনী ক্রমেই পাকিস্তানি ভূখণ্ডে পাকিস্তানের সঙ্গে বিরােধে জড়িয়ে পড়ছে। আর সে কারণেই ভারতের কাছে আমাদের অস্ত্র বিক্রির নীতি নিয়ে আমরা কিছুটা উদ্বিগ্ন। পূর্ব পাকিস্তানে সমস্যা সৃষ্টির সূচনায় আমরা পাকিস্তানের কাছে অস্ত্র বিক্রি সীমিত করি এবং শেষ পর্যন্ত তা বন্ধ হয়ে যায়। এখন ভারতের বিরুদ্ধেও আমরা অনুরূপ সিদ্ধান্ত নিচ্ছি। প্রায় ২০ লাখ ডলারের একটি ক্রয় চুক্তি বাতিলের সিদ্ধান্ত নেয়া হয়েছে। তবে সাড়ে ১১ মিলিয়ন ডলারের অবশিষ্ট লাইসেন্সের বৈধতা বহাল থাকবে। আজই এই সিদ্ধান্ত ঘােষণা করা হবে। এবং আশা করা যায় ভারতে এর প্রতিক্রিয়া হবে তীব্র। রজার্স রাষ্ট্রদূতকে লিখেছেন, ভারতীয় কর্তৃপক্ষকে আপনি এটা জানিয়ে দেবেন যে, যুক্তরাষ্ট্র সরকার ও আমেরিকান জনগণ দৃঢ়তার সঙ্গে। বিশ্বাস করে যে, যুদ্ধের মাধ্যমে পূর্ব পাকিস্তান সংকটের সুরাহা হবে না।
আজ ওয়াশিংটন সময় বিকেল ৪টা ১৭ থেকে ৪টা ৫০ পর্যন্ত কিসিঞ্জারের সভাপতিত্বে অনুষ্ঠিত স্পেশাল গ্রুপের ওই বৈঠকে সিআইএর লে. জে. রবার্ট ই. কুশম্যান অবহিত করেন যে, পশ্চিম পাকিস্তান সীমান্তেও ভারতীয় শক্তির কাছে পাকিস্তান দুর্বল। তাদের অধিকাংশ ডিভিশনই অবশ্য সেখানে মােতায়েন রাখা হয়েছে। কিন্তু তা সত্ত্বেও সংঘাত হলে তারা ভারতের সঙ্গে টিকবে না। তাদের হাতে বড়জোর ৩০ দিনের রসদ আছে। জেনারেল নিয়াজি আজ সিলেটের এক সমাবেশে বলেন, আমরা সবসময় সংখ্যায় কম ছিলাম । কিন্তু আমাদের ইতিহাস হচ্ছে বিজয় ছিনিয়ে নেয়া। আমরা সেই ইতিহাসের পুনরাবৃত্তি ঘটাব।
সূত্র: ১৯৭১ আমেরিকার গোপন দলিল – মিজানুর রহমান খান – সময় প্রকাশন