You dont have javascript enabled! Please enable it!

সংখ্যালঘু নির্যাতন প্রশ্নে ইয়াহিয়া

মুক্তিযুদ্ধে সংখ্যালঘু সম্প্রদায় হিসেবে হিন্দুরা অধিকতর নিপীড়নের শিকার হন। ১৯৭১ এর ১৪ মে পাকিস্তানের দূতাবাস থেকে স্টেট ডিপার্টমেন্টে পাঠানাে এক টেলিগ্রামে উল্লেখ করা হয় যে, আমাদের সন্দেহ পাকিস্তান সরকারের সুনির্দিষ্ট পরিকল্পনা রয়েছে হিন্দু সম্প্রদায়কে পূর্ব পাকিস্তান থেকে উৎখাতে। বলাবাহুল্য, পশ্চিম পাকিস্তানে বিশেষ করে পাঞ্জাবিদের মধ্যে হিন্দুবিরােধী একটি আবেগপূর্ণ পক্ষপাত রয়েছে। এটা আরাে তীব্র হয়েছে সাম্প্রতিক পাকিস্তানি প্রচারণায়। তারা প্রপাগাণ্ডা চালাচ্ছে যে, হিন্দুরা সংকট সৃষ্টিতে ভূমিকা রাখছে। আওয়ামী লীগের নেপথ্যে হিন্দুদের ভূমিকাকে ফুলিয়ে-ফাঁপিয়ে দেখানাে হচ্ছে। সরকারিভাবে হিন্দুবিরােধী প্রপাগাণ্ডা সেনা নিষ্ঠুরতাকে তীব্র করছে। আর তার পরিণতিতে হিন্দুদের দেশ ত্যাগ বৃদ্ধি পাচ্ছে। তারা দেখছে, পূর্ব পাকিস্তানে তাদের উপস্থিতি অনিশ্চিত। এবং শারীরিকভাবে অনিরাপদ। অনেক হিন্দু তাই ধরে নিচ্ছে তার চেয়ে বরং ভারতে পালিয়ে যাওয়াই শ্রেয়।

পাকিস্তান সরকার সরকারিভাবে হিন্দুদের দেশ ত্যাগ উৎসাহিত না করলেও আমাদের সন্দেহ হিন্দুরা দেশ ছাড়ছে। পাকিস্তানি সামরিক বাহিনী সম্ভবত হিন্দুদের দেশ ত্যাগে আশীর্বাদ হিসেবে দেখছে। কারণ, তারা মনে করছে এর ফলে অবিশ্বস্ত এবং নাশকতার কাজে জড়িত হতে পারে এমন লােকের সংখ্যা হ্রাস পাবে। এ প্রসঙ্গে আমরা বিস্মিত হব না যে, পাকিস্তান সরকার যদি শিক্ষকতা পেশার মতাে সংবেদনশীল চাকরি থেকে হিন্দুদের অপসারণ করার নীতি গ্রহণ করে। তারা অব্যাহতভাবে অভিযােগ করছে, পাকিস্তানি তরুণদের বিভ্রান্ত করতে বাঙালি জাতীয়তাবাদের প্রচারণায় হিন্দু শিক্ষকরা সক্রিয়ভাবে জড়িত। এ ধরনের নীতি গ্রহণের আরেকটি উদ্দেশ্য হতে পারে হিন্দু ও মুসলিম ভােটারদের পৃথক। ভােটদান পদ্ধতি পুনরায় প্রবর্তন করা। তাদের ধারণা এর মাধ্যমে ভবিষ্যতের নির্বাচনে হিন্দুদের প্রভাব কমানাে সম্ভব হবে (ফুটনােট পররাষ্ট্র সচিব কাউল ৭ মে চার্জ দ্য এফেয়ার্স স্টোনকে তলব করেছেন। তিনি জাতিসংঘে উদ্বাস্তু ইস্যু তােলা হলে। ভারতকে সমর্থন দিতে যুক্তরাষ্ট্রের সহানুভূতি কামনা করছেন। অন্যদিকে ১৪ মে ঢাকার কনসাল জেনারেল রিপাের্ট দিয়েছেন যে, পাকিস্তানি আর্মি পদ্ধতিগতভাবে হিন্দুদের তল্লাশি এবং তাদের হত্যা করছে।)।

ফারল্যান্ড আরাে লিখেছেন, এমএম আহমেদের সফর সম্ভবত এই সুযােগ এনে দেবে যে, যুক্তরাষ্ট্র সরকার অব্যাহত হিন্দু শরণার্থীদের প্রশ্নে উদ্বেগ প্রকাশ করতে পারবে। আমরা এখানে ইতােমধ্যেই উদ্বাস্তু পরিস্থিতি নিয়ে সাধারণভাবে উদ্বেগ প্রকাশ করেছি। এখন স্টেট ডিপার্টমেন্টকে আমাদের এই অবস্থায় এগিয়ে নিতে হবে যে, পাকিস্তান সরকারের উচিত হত্যা বন্ধ করা এবং পাকিস্তানের পুনর্গঠনে মনােযােগী হওয়া। ২২ মে, ১৯৭১ করাচির কনসাল জেনারেল স্টেট ডিপার্টমেন্টকে জানাচ্ছেন, সাধারণ আলােচনা শেষে আমি ইয়াহিয়ার দৃষ্টি আকর্ষণ করলাম যে, পূর্ব পাকিস্তান থেকে উদ্বাস্তু স্রোতের কারণ দুটো। প্রথমত, মানবিক কারণ। দ্বিতীয়ত, আঞ্চলিক স্থিতিশীলতায় হুমকি। আমি আমার ব্যক্তিগত পর্যবেক্ষণ হিসেবে বললাম, পূর্ব পাকিস্তানে পরিস্থিতি স্বাভাবিক না করলে হিন্দু সম্প্রদায় তাদের দৈহিক নিরাপত্তা নিয়ে নতুন করে উদ্বিগ্ন হতে পারে (ফুটনােট ২২ মে ফারল্যান্ড ইয়াহিয়ার কাছে পাকিস্ত নি সেনাবাহিনী কর্তৃক হিন্দুদের ওপর কথিত অত্যাচার সম্পর্কিত সংবেদনশীল ইস্যু ইয়াহিয়ার নজরে আনেন।

ফারল্যান্ড সতর্ক করে দেন যে, যদি এই রিপাের্ট সত্য হয়ে থাকে, বিশেষ করে যেসব বিবরণ ইতােমধ্যে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের সংবাদপত্রে ছাপা হয়েছে তা সত্য হলে পাকিস্তানের প্রতি সমর্থন অব্যাহত রাখা নিক্সন প্রশাসনের জন্য কঠিন হয়ে পড়বে। ফারল্যান্ড বলেছেন, বৃহত্তর বিপদ হচ্ছে, সংক্ষুব্ধ হিন্দু শরণার্থীদের দুর্দশার বৃত্তান্ত পশ্চিম বঙ্গে ধূমায়িত হচ্ছে। ফারল্যান্ড সতর্ক করে দিয়েছে যে, পূর্ব পাকিস্তানে হিন্দুদের প্রতি অবিচার করা হলে তা ভারতে সেই মহলের হাত শক্তিশালী করবে। যারা পাকিস্তানের বিরুদ্ধে সামরিক ব্যবস্থা গ্রহণে উদগ্রীব। ইয়াহিয়া তার মন্তব্য শুনে বলেছেন, আপনি সম্ভবত অধিকতর উস্কানিমূল্যক মন্তব্য শুনে থাকবেন, যা কিনা ভয়েস অব আমেরিকা এবং বিবিসি প্রচার করে থাকবে। ফারল্যান্ড তাকে জানিয়েছে, তিনি যেসব তথ্য জেনেছেন তা এসেছে ঢাকার কনসাল জেনারেলের কাছ থেকে এবং তারা নির্ভরযােগ্য সূত্রেই খবর পেয়েছে। ইয়াহিয়া ফারল্যান্ডকে নিশ্চিত করেছেন যে, হিন্দুরা যদি নিগৃহীত হয়ে থাকে তা হলে তা কিন্তু সরকারি নীতি বা সরকারি কোনাে প্রশ্রয়ে তা ঘটেনি এবং তিনি এটা খতিয়ে দেখবেন)।

করাচি থেকে প্রেরিত বার্তায় আরাে উল্লেখ করা হয়, আমি ইয়াহিয়াকে বললাম উদ্বাস্তু প্রশ্নকে রাজনীতি থেকে পৃথক করতে হবে, এবং এটা আমাদের ধারণা যে, ভারতীয়রা চাইছে উদ্বাস্তুরা তাদের দেশে ফিরে যাক। ২৬ মে, ১৯৭১ রজার্স প্রেসিডেন্ট নিক্সনকে জানাচ্ছেন, ইয়াহিয়াকে বলা হয়েছে পূর্ব পাকিস্তানে শান্তিপূর্ণ অবস্থা সৃষ্টিতে উদ্যোগ নিতে। তাকে বলা হয়েছে, হিন্দু সংখ্যালঘুদের ওপর নিপীড়নমূলক ব্যবস্থা যেন বন্ধ করা হয়। ২৬ মে, ১৯৭১ ওয়াশিংটন স্পেশাল অ্যাকশন গ্রুফের বৈঠকে সিআইএ পরিচালক হেলমস তথ্য দেন যে, পাকিস্তানিরা যেভাবে সংখ্যালঘুদের প্রহার করছে তাতে শরণার্থীরা অন্তত এটুকু বুঝতে পারবে যে, তাদের মাথায় গুলি করা হবে না! জনসন বলেন, উদ্বাস্তুদের ৮০ শতাংশ সংখ্যালঘু। রাষ্ট্রদূত ফারল্যান্ড ইয়াহিয়ার কাছে এ কথা বলতেই তার কাছ থেকে ইমােশনাল প্রতিক্রিয়া পেয়েছেন। তাদের ওপর নির্যাতন চালানাে হচ্ছে সে কথা তিনি মানতেই নারাজ। তবে বলেছেন, তিনি এটা খতিয়ে দেখবেন। ভ্যান হােলেন বলেন, ইয়াহিয়ার প্রকাশ্য বিবৃতি সহায়ক। কিন্তু রাজনৈতিক সমঝােতা ছাড়া উদ্বাস্তুরা ফিরবে না এবং তারা নিশ্চিত হতে চাইবে যে হিন্দুরা টার্গেটে পরিণত হবে না। আমাদের ভাবা উচিত নয় যে, তারা শিগগিরই ফিরবে। ১৯৭১ এ ৩ জুন ওয়াশিংটনে ভারতে নিযুক্ত মার্কিন রাষ্ট্রদূত কেনেথ কিটিং, কিসিঞ্জার ও ন্যাশনাল সিকিউরিটি কাউন্সিলের হেরাল্ড স্যান্ডার্স দক্ষিণ এশিয়ার পরিস্থিতি নিয়ে আলােচনা করেন।

কিটিং উল্লেখ করেন, পূর্ব পাকিস্ত েিন যতক্ষণ হত্যালীলা অব্যাহত থাকবে ততক্ষণ সামরিক সহায়তা দেয়া চিন্তা করাও ভুল হবে। ঢাকা তুলনামূলকভাবে শান্ত রয়েছে। যদিও মাত্র অর্ধেক বাসিন্দা আছে সেখানে। পাকিস্তানি সেনাবাহিনী এখন হিন্দু জনসংখ্যার দিকে নজর দিয়েছে। ভারতে যেসব শরণার্থী এখন যাচ্ছে তাদের ৯০ শতাংশই হিন্দু। ৫ জুন, ১৯৭১ পাকিস্তান। দূতাবাস থেকে একটি টেলিগ্রাম যায় স্টেট ডিপার্টমেন্টে। এতে ফারল্যান্ড লিখেছেন, আমি রাওয়ালপিন্ডিতে প্রেসিডেন্টের সঙ্গে সাক্ষাৎ করেছি ৫ জুন দুপুর ১২টায়। ৫০ মিনিট ধরে আলােচনায় উল্লেখযােগ্য বিষয় ছিল উদ্বাস্তু ইস্যু। আমি বললাম, পূর্ব পাকিস্তানে শরণার্থী অভ্যর্থনা কেন্দ্র স্থাপনের খবরে ওয়াশিংটন উৎসাহিত। আমরা আশা করি যে এটা শিগগিরই চালু হবে। বললাম, আমি বিশ্বাস করি যে, আপনি যদি নির্দিষ্টভাবে এই নির্দেশনা দেন যে হিন্দুদের স্বাগত জানানাে হবে তাহলে তা কার্যকর। হবে। আমি তাকে এও বললাম, এটা খুবই ফলপ্রসূ হবে যদি আপনি প্রকাশ্যে এই ঘােষণা দেন যে, ধর্ম ও বর্ণ নির্বিশেষে উদ্বাস্তুদের দেশে ফিরিয়ে আনা হবে। এ ধরনের ঘােষণা ভারত সরকার সুনজরে দেখবে এবং আন্তর্জাতিক জনমতের ক্ষেত্রেও ইতিবাচক সাড়া মিলবে। আমার কথা শুনে ইয়াহিয়া বললেন, ২৪ মে তিনি যে বিবৃতি দিয়েছেন সেটা বস্তুনিষ্ঠ । মুসলমান ও হিন্দুদের মধ্যে কোনাে পার্থক্য সৃষ্টি করা হবে।

তবে তিনি বললেন, আপনি যেভাবে নির্দিষ্ট করে বলতে বলছেন, তেমন করে বলতে আমার কোনাে আপত্তি নেই। তবে তিনি কয়েক মুহূর্ত ভেবে উল্লেখ করলেন যে, আমি শিগগিরই জাতির উদ্দেশে ভাষণ দিতে যাচ্ছি। তখন না হয় এ বিষয়টি বিশদভাবে তুলে ধরা হবে। আমি তাকে জানালাম উদ্বাস্তু স্রোত কিন্তু অব্যাহত। আর সেটাই পূর্ব পাকিস্তানের গুরুতর পরিস্থিতির ইঙ্গিতবহ। আমাদের দূতাবাস অব্যাহতভাবে রিপাের্ট পাচ্ছে যে, হিন্দু অধ্যুষিত গ্রামগুলােতে সেনাবাহিনী আক্রমণ চালাচ্ছে। ভীতি ছড়িয়ে পড়ছে ভয়ানকভাবে। এমন অবস্থা যদি চলতে থাকে, তাহলে। কিছুতেই উদ্বাস্তু স্রোত বন্ধ হবে না। আমি তাকে এ কথাও সাফ জানিয়ে দিলাম, হিন্দুদের দেশ ত্যাগ যদি কোনাে পর্যায়ে নিয়ন্ত্রণ করা সম্ভব না হয়, তাহলে ভারতের সঙ্গে একটি সামরিক সংঘাত অনিবার্য হয়ে দাঁড়াতে পারে। আমি বললাম, ব্যাপক ভিত্তিতে দেশ ত্যাগের অর্থ হচ্ছে পূর্ব পাকিস্তানে বিস্ফোরণােন্মুখ অবস্থা বিরাজমান। এসব দেখে শুনে যুক্তরাষ্ট্র সরকার ভারত সরকারকে ইতােমধ্যেই সংযম প্রদর্শনে অনুরােধ করেছে। কিন্তু এই পরিস্থিতি সামাল দেয়ার আসল দায়িত্ব যে পাকিস্তানের, আমি তাকে তাও জানিয়ে দিলাম। বাস্তব অর্থেই বলছি, আমি মনে করি, পাকিস্তানি সামরিক তৎপরতা যদি নিয়ন্ত্রণ করা সম্ভব না হয়, তাহলে স্থানীয় জনগণ বিশেষ করে সংখ্যালঘুদের দেশ ত্যাগ রােধ করা প্রশ্নই আসে না। ইয়াহিয়া কিন্তু কিছুতেই নির্দিষ্টভাবে সংখ্যালঘু নিপীড়নের বিষয়টি স্বীকার করলেন না। বরং এমন ভাব দেখালেন, তিনি উদ্বাস্তু পরিস্থিতি নিয়ে সত্যিই উদ্বিগ্ন।

সূত্র:  ১৯৭১ আমেরিকার গোপন দলিল – মিজানুর রহমান খান – সময় প্রকাশন

error: Alert: Due to Copyright Issues the Content is protected !!