পাকসেনাদের পঙ্গুত্ব শুরু যশােরের পতনে
৩০ নভেম্বর, ১৯৭১ পাকিস্তানে নিযুক্ত মার্কিন রাষ্ট্রদূত ফারল্যান্ড কিসিঞ্জারের কাছে পাঠানাে এক ব্যাক চ্যানেল বার্তায় উল্লেখ করেন, আমরা এমন কোনাে তথ্য পাইনি যে, যাতে মনে হতে পারে পাকিস্তান কাশ্মীরে হামলা চালাতে যাচ্ছে, অথবা এমন কিছু তাদের সক্রিয় বিবেচনাধীন। তবে বােঝাই যাচ্ছে, এটা তাদের কনটিনজেন্সি প্লানে নিশ্চয়ই থাকবে। ইয়াহিয়া অব্যাহতভাবে আমাকে নিশ্চিত করছেন যে, তিনি যুদ্ধ চান না এবং যুদ্ধ এখান থেকে শুরু করতেও চান না। তিনি যে কট্টর মনােভাব পােষণ করে চলেছেন, তা পূর্ব পাকিস্তানে ভারতের অব্যাহত অনুপ্রবেশের মুখে কতদূর পর্যন্ত বজায় রাখতে পারেন তা অনিশ্চিত। পাকিস্তানিরা প্রস্তুতি নিয়ে বসে আছে এবং তারা যদি চূড়ান্তভাবে এই সিদ্ধান্তে পৌছায় যে, তাদের শেষ পর্যন্ত পূর্ব-পশ্চিম দুই সীমান্তেই লড়াই করতে হবে, তাহলে কাশ্মীর আবেগগত দিক থেকে আকর্ষণীয় টার্গেট। এছাড়া আমরা সাধারণভাবে মনে করছি যে, তারা দক্ষিণে অনুপ্রবেশের ক্ষেত্রে অধিকতর উৎসাহিত হতে পারে। আপনি কি এ ব্যাপারে অনতিবিলম্বে আপনার পরামর্শ জানাবেন ফুটনােট ৩০ নভেম্বর ফারল্যান্ড কিসিঞ্জারের কাছ থেকে একটি বার্তা পান। এতে কিসিঞ্জার তার কাছে জানতে চেয়েছিলেন, পূর্ব পাকিস্তানে চাপ কমাতে পাকিস্তান কাশ্মীরে ভারতীয় সৈন্যদের ওপর হামলা চালাতে পারে কি না?
১ ডিসেম্বর, ১৯৭১ কিসিঞ্জার নিক্সনকে দেয়া এক স্মারকে উল্লেখ করেছেন, আজ সকালে রাষ্ট্রদূত কিটিং মিসেস গান্ধীর সঙ্গে সাক্ষাৎ করেছেন। আপনার বার্তা পেয়ে ইন্দিরা দ্রুত তা পাঠ করেন এবং বলেন, তিনি দ্রুততার সঙ্গে উত্তর দেবেন। তিনি কিটিংকে যেসব ধারণা দিয়েছেন তা নিম্নরূপ। এক, যুক্তরাষ্ট্রের প্রতি ভারতের অগাধ ভালােবাসা রয়েছে। কিন্তু প্রতিটি দেশকেই সর্বাগ্রে তার জাতীয় স্বার্থ দেখতে হবে। এটা তার কর্তব্য, তার দেশের জন্য তার দেশের স্বার্থের জন্য কোন পন্থা সমীচীন? দুই. পাকিস্তানই সর্বাগ্রে সীমান্তে তার সৈন্য পাঠিয়েছে এবং কেউ তাদের প্রত্যাহার করে নিতে বলেনি। ভারত সীমান্তে সৈন্য মােতায়েনের পরই প্রত্যাহারের প্রস্তাব উত্থাপন করা হয়েছে। তিন. ইয়াহিয়ার সমস্যা নিজস্ব সৃষ্টি এবং আমরা এমন অবস্থানে নেই যে, সেই সমস্যা তার জন্য সহজ করে দেব।’ ভারত কেন তার সৈন্যদের প্রত্যাহার করছে না, তার অন্যতম কারণ এটি। ভারতের প্রতি ইয়াহিয়ার অপকর্ম অনুমােদনের আহ্বান জানানাে হয়েছে। কিন্তু আমরা তা মেনে নিতে পারি না।’ চার, ভারতে তার মতাে আর কেউ যুদ্ধের অধিকতর বিরােধী নয়। আমি এই দেশকে যুদ্ধে নিয়ে যেতে চাই না।’ কিন্তু এই যুদ্ধ এবং এই পরিস্থিতি আমাদের সৃষ্ট নয়।
পাঁচ. অনেক দেশ বলেছে, তারা ইয়াহিয়ার ওপর চাপ সৃষ্টি করছে। কিন্তু তিনি প্রশ্ন রাখেন, কী ফল মিলল? ইন্দিরা জবাব দেন, কিছুই নয়। আমাদের এমন পদক্ষেপ নিতে হবে, যাতে পরিস্থিতির সঙ্গে। মােকাবেলায় ভারত শক্তিশালী হয়। ছয়, একটি রাজনৈতিক প্রক্রিয়া শুরুর নামে তিনি ‘প্রহসনের নির্বাচন সম্পন্ন করেছেন, যা পরিস্থিতিকে ভ্রান্ত পথে চালিত করছে। এসব তথাকথিত নির্বাচন পরিস্থিতির পরিবর্তন ঘটাতে কোনােভাবেই সহায়ক হবে না। সাত, কিটিং যখন উল্লেখ করে যে,তার অবস্থান খুবই সুদৃঢ়, জবাবে গান্ধী বলেন, আগের চেয়ে তার অবস্থান কিছুটা কঠোর বটে। তিনি এমনকি এই মন্তব্যও করেন যে, তার ধৈর্যের বাঁধ ভেঙে পড়ছে। তিনি জানেন না, কিভাবে তিনি ভারতকে বলবেন। তাকে অপেক্ষার প্রহর আরাে গুনতে হবে। আট, কিটিং যখন উল্লেখ করেন। যে, ভারতীয় সামরিক বাহিনী সম্প্রতি পূর্ব পাকিস্তানে আগ্রাসন চালিয়েছে তখন তিনি তাদের থামিয়ে দেন। ইন্দিরা মন্তব্য করেন, আমরা সত্যিই আর এমন উপদেশ। শুনতে অক্ষম, যা আমাদের দুর্বল করে দেয়। রাষ্ট্রদূত কিটিংয়ের মন্তব্য হচ্ছে, মিসেস গান্ধীকে তিনি এর আগে এমন স্পষ্ট করে কথা বলতে দেখেননি। তার কণ্ঠে বেদনার আভাস ছিল স্পষ্ট।
১ ডিসেম্বর, ১৯৭১ ওয়াশিংটন স্পেশাল অ্যাকশন গ্রুপের বৈঠকে সিদ্ধান্ত হয়, জাতিসংঘে নিযুক্ত মার্কিন রাষ্ট্রদূত বুশ (বর্তমান প্রেসিডেন্ট বুশের পিতা সাবেক প্রেসিডেন্ট সিনিয়র বুশ) জাতিসংঘে পাকিস্তানের স্থায়ী প্রতিনিধির সঙ্গে একটি সম্ভাব্য প্রস্তাব নিয়ে আলােচনা করবেন, এর সুবিধা-অসুবিধা খতিয়ে দেখবেন। কিন্তু পাকিস্তানকে কোনাে নির্দিষ্ট দিক অনুসরণে অনুরােধ জানাবেন না। এদিনের সংলাপ ছিল নিম্নরূপ। কিসিঞ্জার (সিআইএ’র কুশম্যানের প্রতি) বব, এখন আমরা কোথায় দাঁড়িয়ে?
কুশম্যান (কুশম্যান এ সময় একটি ব্রিফিং নােট পড়ে শােনান। কিন্তু এটি ছাপা হয়নি। কুশম্যান এতে উল্লেখ করেন যে, পূর্ব পাকিস্তানে মুক্তিযােদ্ধাদের তৎপরতা ক্রমবর্ধমান। ভারত ও পশ্চিম পাকিস্তানের সীমান্ত শান্ত রয়েছে। কিন্তু পাকিস্তানি কর্মকর্তারা ইঙ্গিত দিয়েছেন যে, যুদ্ধ শুরু হয়ে গেলে পশ্চিম সীমান্তে পাকিস্তান। রক্ষণাত্মক নয়, আক্রমণাত্মক ভূমিকা পালন করবে)।
কিসিঞ্জার মিসেস গান্ধী কি পাকিস্তানিদের পশ্চিম পাকিস্তানে কিছুটা সময়ের জন্য হলেও টিকতে দেবেন (কিসিঞ্জার এ সময় সভাকক্ষ ত্যাগ করেন)?
আরউইন (কুশম্যানের প্রতি) পশ্চিম ফ্রন্টে যদি আক্রমণ হয় তাহলে তার ফলাফল কী হতে পারে বলে আপনার মনে হয়?
কুশম্যান ভারতীয়দের সর্বক্ষেত্রে শ্রেষ্ঠত্ব রয়েছে, সুতরাং তারাই জিতবে। পাকিস্তানিদের অধিকাংশ ট্যাঙ্ক বাহিনী অবশ্য সেখানেই। তাদের বেশিরভাগ ডিভিশনও সেখানে। কিন্তু তবুও তারা টিকবে না। এডমিরাল মুরার পাকিস্তানিরা প্রাথমিক পর্যায়ে কিছুটা সাফল্য দেখাতে পারে। কিন্তু তারা শিগগিরই লজিস্টিক সংকটে পড়বে।
আরউইন কতদিন? মুরার : ৩০ দিন। ভারতীয়দের শ্রেষ্ঠত্ব হচ্ছে ৪ ১। আরউইন সরবরাহের দিক থেকেও? মুরার হ্যা। প্যাকার্ড এটা তাহলে কেমন দেশ? কুশম্যান বেশ শুকনাে । বিস্তীর্ণ অঞ্চল কার্যত মরুভূমি। প্যাকার্ড সেখানে কি কোনাে প্রাকৃতিক সীমান্ত অর্থাৎ পর্বত রয়েছে?
ওয়ালার (সিআইএ) উত্তর-পূর্বে কিছু পর্বত রয়েছে, কিন্তু অবশিষ্ট অঞ্চল মরুভূমি।
আরউইন পাকিস্তানিদের প্রাথমিক সামর্থ্য কেমন?
কুশম্যান আমি জানি না। ওয়ালার ১৯৬৫ সালে শিয়ালকোট ছিল একটি ন্যাচারাল ডিভিশন’।
আরউইন ভারতীয় ট্যাঙ্ক বাহিনীর অবস্থান কি কাছাকাছি নয়? ওয়ালার কারাে জানা নেই। আম্বালায় সম্ভবত কিছু থাকবে।
কুশম্যান পাকিস্তানিরা হয়তাে প্রাথমিকভাবে উত্তর দিক থেকে ঢুকে পড়তে পারে। কিন্তু অন্যতম বড় উদ্বেগ হচ্ছে, ভারত যদি বাংলাদেশকে স্বীকৃতি দিয়ে বসে। ইয়াহিয়া তার পাল্টা ব্যবস্থা হিসেবে ভারতীয় এয়ারক্রাফট ও সৈন্যদের অবস্থানে হামলা চালাতে পারে। যদিও তার জানা থাকবে যে, তিনি না-ও জয়ী হতে পারেন।
আরউইন সুতরাং আপনি মনে করছেন যে, এক মাসের মধ্যেই সবকিছু সাঙ্গ হবে। জেনারেল কুশম্যান ও এডমিরাল মুরার হ্যা ।
কুশম্যান একটি প্রশ্ন হচ্ছে, রাশিয়া ভারতকে কতটা সহায়তা দেয়? এটাও দেখার বিষয় যে, চীন পাকিস্তানের পাশে দাঁড়ানাের চেয়ে রাশিয়া কতটা দ্রুততায়। ভারতের পাশে দাঁড়ায়?
মুরার এমন কিছু রিপাের্ট পাওয়া গেছে যে, চীন প্রতিশ্রুতি দিয়েছে যে, সে। পাকিস্তানকে ট্যাঙ্ক সহায়তা দেবে।
কুশম্যান এমন রিপাের্টও রয়েছে যে, গেরিলারা সমুদ্র বন্দরগুলােতে মাইন।
পুঁতছে। ভারতীয় নাবিকরা রাতে সাদা পােশাকে গানবােট নিয়ে পূর্ব পাকিস্তানে টহল দিচ্ছে। মুরার পূর্ব পাকিস্তানে পাকসেনারা তাদের কার্তুজ ব্যবহারের ক্ষেত্রে রেশনিং শুরু করেছে। বিশেষ অনুমতি ব্যতিরেকে তাদের প্রতি টিউবের অনুকূলে ১০ রাউন্ড গুলি দেয়া হচ্ছে। তারা অনুভব করতে শুরু করেছে যে, তারা কোণঠাসা হয়ে পড়ছে। (কিসিঞ্জারের প্রত্যাবর্তন) কিসিঞ্জার সামরিক সহায়তা বন্ধের পরবর্তী পদক্ষেপের জন্য আমাদের নির্দিষ্টভাবে অবস্থা উপলব্ধিতে নিতে হবে। আমরা এটা অনতিবিলম্বে করতে চাই না। পাকিস্তান আর কতটা সময় টিকতে পারবে?
মুরার দুই অথবা তিন সপ্তাহ। ভারত সীমান্তে চাপ বৃদ্ধি করে চলেছে এবং পাকিস্তানিদের রুখে দাঁড়াতে বাধ্য করছে। এর ফলে মুক্তিযােদ্ধারা দেশের প্রত্যন্ত অঞ্চলে স্বাধীনভাবে বিচরণ করতে পারছে। পাকিস্তানি গােলন্দাজ বাহিনীর গােলাবারুদে টান পড়েছে। সে কারণে তাদের সৈন্য বাহিনী প্রতিস্থাপনের চিন্তা করছে। চার হাজার সৈন্যের একটি দল এ লক্ষ্যে পথে রয়েছে। পাকিস্তানিদের শক্তি ফুরিয়ে আসতে শুরু করেছে। যশােরের পতনের মধ্য দিয়ে পাকিস্তানি বাহিনী। মারাত্মকভাবে পঙ্গু হতে পারে। জেনারেল কুশম্যান কেউ একজন অনুমান করতে পারেন যে, ভারতীয়রা হয়তাে যশাের দখল এবং সেখানে বাংলাদেশের রাজধানী স্থাপনের চেষ্টা করছে।
সূত্র: ১৯৭১ আমেরিকার গোপন দলিল – মিজানুর রহমান খান – সময় প্রকাশন