You dont have javascript enabled! Please enable it! সেনা প্রত্যাহারে নভেম্বরে সম্মতি ইয়াহিয়ার - সংগ্রামের নোটবুক

সেনা প্রত্যাহারে নভেম্বরে সম্মতি ইয়াহিয়ার

২৯ নভেম্বর, ১৯৭১ ওয়াশিংটন স্পেশাল অ্যাকশন গ্রুপের বৈঠকে পূর্ব পাকিস্তানের যুদ্ধ পরিস্থিতি বিস্তারিত আলােচনা হয়। কিসিঞ্জার এডমিরাল মুরারকে লক্ষ্য করে বলেন, সামরিক দিক সম্পর্কে আপনার অভিমত কী? এডমিরাল মুরার বলেন, আমরা এমনও রিপাের্ট পেয়েছি যে, ইয়াহিয়া এক পার্টিতে মন্তব্য করেছেন, ‘আপনারা আমাকে এক-দুদিনের জন্য দেখবেন না। আমি আমাদের যুদ্ধ প্রস্তুতি তদারকি করতে সীমান্তে যাচ্ছি।’ পূর্ব। পাকিস্তানে পাকিস্তানি বাহিনীর রসদপত্রের অবস্থা এমনই যে, তারা সরবরাহ সংকটে। পড়বেই। কার্তুজের মজুদ খুবই সামান্য। উপরন্তু ইয়াহিয়া পশ্চিমে নজর তীব্র করতে বাধ্য হতে পারেন। গত সপ্তাহে পরিস্থিতি সত্যিই উল্লেখযােগ্য অবনতি ঘটেছে।

আরউইন পাকিস্তানি সরবরাহের দিক থেকে তারা কতটা সক্ষম? মুরার : ৩০ দিনের চেয়েও কম। কিসিঞ্জার (সিসকোর প্রতি) কূটনৈতিক তৎপরতা সম্পর্কে আপনি আমাদের ধারণা দিন। সিসকো সবচেয়ে উল্লেখযােগ্য ঘটনা হচ্ছে, প্রেসিডেন্ট গান্ধী, কোসিগিন ও ইয়াহিয়ার কাছে বার্তা পাঠিয়েছেন। এই বার্তার মুখ্য কথা হচ্ছে উভয় সীমান্ত থেকে নিজ নিজ সৈন্যদের প্রত্যাহার এবং সর্বোচ্চ সংযম প্রদর্শন। পূর্ব পাকিস্তানে ইয়াহিয়া একতরফাভাবে জাতিসংঘ পর্যবেক্ষক নিয়ােগে রাজি হয়েছেন। রাষ্ট্রদূত কিটিংয়ের কাছ থেকে প্রাপ্ত টেলিগ্রাম পড়ে মনে হচ্ছে, ভারতের কাছ থেকে কোনাে ইতিবাচক সাড়া পাওয়া যাবে না। আমি বিশ্বাস করি, ভারত তার রাজনৈতিক উদ্দেশ্য সাধনে তার বর্তমান সামরিক অবস্থান থেকে একচুলও নড়বে না। কিসিঞ্জার আপনি কি মনে করেন যে, এই পরিকল্পনা নেয়া হয়েছিল ইন্দিরার সফরের আগেই। সিসকো সামরিকভাবে অবশ্যই। কিছু মােতায়েনের ঘটনা আগেই ঘটেছিল। কিন্তু ওয়াশিংটন সফরের পরে সবচেয়ে কার্যকর সামরিক পদক্ষেপ নেয়া হয়।

মুরার : তাদের অবশ্যই কোনাে কনটিনজেন্সি প্লান ছিল।

কিসিঞ্জার আমার নিজের জানার জন্য এ ব্যাপারে প্রশ্ন করছি। আমরা কিন্তু | গােটা গ্রীষ্মকালজুড়ে বিতর্ক করেছি যে, ভারতকে সংযত করা যাবে কী যাবে না।

তাদের পরিকল্পনা যদি আগেই থেকে থাকে তাহলে সৈন্য মােতায়েনের দিকের কথা বিবেচনায় রেখে এটা কি বলা যায় যে, তারা বর্ষকাল আসার আগেই আক্রমণ করে বসতে পারে? সিদ্ধান্ত যদি গত জুনে নেয়া হয়ে থাকে তাহলে আক্রমণের জন্য কোন সময়টা তাদের জন্য সবচেয়ে সুবিধাজনক?

মুরার : চার বা পাঁচ সপ্তাহ। উইলিয়ামস এই সময়টা বাঁধা হয় বাঙালিদের প্রশিক্ষণদানের বিবেচনায়।

কিসিঞ্জার আমি মানুষের মুখে কথা বসিয়ে দেয়ার চেষ্টা করছি না। কিন্তু কেউ একজন যুক্তি দিতে পারেন যে, ভারতীয়রা গত জুন থেকে যা কিছু করেছে তার সব কিছুর উদ্দেশ্য ছিল এটাই। পররাষ্ট্রমন্ত্রী সিং এবং মিসেস গান্ধীর সফর সবটাই শুধু ধােয়ার কুণ্ডলী পাকিয়েছে। অথবা কেউ একজন বলতে পারেন ভারতীয়রা সমস্যার সমাধানের সর্বাত্মক চেষ্টা করেছেন এবং শেষ পর্যন্ত তারা বেপরােয়া পদক্ষেপ বেছে নিয়েছেন। মুরার আমি মনে করি, বাঙালিদের প্রস্তুতি সময় নির্ধারণ করেছে। ভারতীয়রা অনেক আগেই তাদের নিয়মিত সৈন্যবাহিনী নিয়ে অগ্রসর হতে পারত। ভারতীয় লক্ষ্য হচ্ছে, পাকিস্তানি এবং গেরিলাদের আপেক্ষিক শক্তিতে পরিবর্তন সাধন করা।

কিসিঞ্জার (উইলিয়ামের প্রতি) আপনি কী ভাবছেন?

উইলিয়ামস আমার মনে হয়, ভারতীয়রা দুই অথবা তিন সপ্তাহ আগে অগ্রসর হতে পারত। এ সময়ের মধ্যে তারা বাঙালিদের প্রশিক্ষণ সম্পন্ন করতে পারত। তারা আগ্রাসন চালানাের আগে প্রায় তিন সপ্তাহের সময় নিতে চেয়েছে, যা কিনা মিসেস গান্ধীর সফরের সঙ্গে এক হয়ে যায়। আমি মনে করি, তারা শুধুই গান্ধীর ফিরে আসার জন্য অপেক্ষা করছিল।

মুরার তারা অবশ্যই গেরিলাদের প্রশিক্ষণ ও সরবরাহ সুবিধা দিয়ে যাচ্ছে।

উইলিয়ামস আমি মনে করি, তারা আশা করেছিল যে, গেরিলারা তাদের অভ্যন্তরীণ অপারেশনে অধিকতর কার্যকর ভূমিকা রাখতে পারবে। কিন্তু তারা লক্ষ্য করেছে, গেরিলারা কেবল কার্যকর হতে পারে তখনই যখন তারা ভারতীয়দের পৃষ্ঠপােষকতা লাভ করে। এটা ছিল তাদের দ্বিতীয় পর্যায়ের রণকৌশল। তারা কিন্তু অভ্যন্তরীণ অপারেশনগুলাে কেবল মুক্তিবাহিনী দিয়েই সম্পন্ন করাকে অগ্রাধিকার দিতে পারত। | কিসিঞ্জার কিন্তু এটা কি ত্রাণ সরবরাহ বন্ধ করে দিচ্ছে? সেখানে কি দুর্ভিক্ষ আসবে?

উইলিয়ামস ত্রাণ-তৎপরতা শেষ পর্যায়ে। জাতিসংঘ কর্মীদের প্রত্যাহার করে নেয়া হয়েছে। পরিস্থিতি অবনতিশীল। শস্য উৎপাদনের অবস্থা ভালােই। কিন্তু আমদানিকৃত খাদ্যশস্য মজুদ অবস্থায় আছে, বণ্টন করা সম্ভব হচ্ছে না। সুতরাং কোথাও কোথাও দুর্ভিক্ষ দেখা দেবে।

মুরার এবং গেরিলারা নৌকাগুলাে ধ্বংস করছে।

উইলিয়ামস : হ্যা। কয়েক সপ্তাহ ধরে যেসব নৌকা একত্র করা হয়েছিল তা তারা কয়েকদিনের মধ্যে সাফ করে দিয়েছে। চট্টগ্রামে ২২ জন লােক, এখন অবশিষ্ট রয়েছে। সব জাহাজ প্রত্যাহার করা হয়েছে। ট্রাকগুলাে দাঁড়িয়ে আছে। | কিসিঞ্জার (প্যাকার্ডের প্রতি) আপনি কী ভাবছেন?

প্যাকার্ড আমার যােগ করার তেমন কিছু নেই। ভারত এমন কিছুই করেনি, যাকে গঠনমূলক বলা যেতে পারে। এমন কোনাে সাক্ষ্যপ্রমাণ নেই যে, এখন যেখানে আছে সে অবস্থা থেকে সরে দাড়াতে কোনােকিছুই তারা করেছে। | কিসিঞ্জার প্রেসিডেন্টের সঙ্গে গান্ধী তার আলােচনায় পূর্ব পাকিস্তান নিয়ে কোনাে কথাই বলেননি। অথচ তিনি দিব্যি অভিযােগ করেছেন, বেলুচিস্তান ও উত্তরপশ্চিম সীমান্ত প্রদেশ নিয়ে।

প্যাকার্ড ইয়াহিয়া তার নমনীয়তা দেখিয়েছেন। আমরা সেনাপ্রত্যাহারে তার আগ্রহের কথা ভারতকে জানিয়েছি। কিন্তু কোনাে সাড়া পাইনি।

কিসিঞ্জার ভারত কিন্তু ইয়াহিয়া ও বাংলাদেশ নেতৃবৃন্দের মধ্যে আলােচনার সূত্রপাত ঘটাতে কোনাে তৎপরতাই প্রদর্শন করেনি। অথচ এই প্রক্রিয়ার পেছনে গত গ্রীষ্ম থেকে অবিরাম কাজ করেছেন জো সিসকো। সেটাই হতে পারত সূচনা। ইয়াহিয়ার সঙ্গে আলােচনায় বাংলাদেশ নেতৃবৃন্দ যদি মুজিবের মুক্তি দাবি করতেন, তাহলে আমরা হয়তাে কিছু মুভমেন্ট লক্ষ্য করতাম। সেক্ষেত্রে পরিস্থিতি স্থিতিশীল হতে পারত। আমাদের হাতে তিনটি সমস্যা রয়েছে, যা আলােচিত হওয়া দরকার।

১. সামরিক সহায়তা।

২. জাতিসংঘের কাছে প্রস্তাব।

৩. অর্থনৈতিক সহায়তা বন্ধ করে দেয়া। আপনারা প্রত্যেকে স্টেট ও ডিফেন্সের দলিলপত্রে দেখেছেন সামরিক সাহায্য বন্ধ করে দেয়া। গত বুধবার প্রেসিডেন্ট ও পররাষ্ট্রমন্ত্রী সিদ্ধান্ত নেন যে, সামরিক সাহায্য বন্ধের সিদ্ধান্ত শুক্রবার ঘােষণা করা হবে। স্টেট ডিপার্টমেন্টের সুপারিশ হচ্ছে- ইয়াহিয়া কোসিগিন ও গান্ধীর কাছ থেকে জবাব পাওয়া সাপেক্ষে এই ঘােষণা দেয়ার কথা ভাবা হয়েছিল। এখন আমরা জবাব পেয়েছি। প্রেসিডেন্ট এগিয়ে যেতে চান। আমি পররাষ্ট্রমন্ত্রীর সঙ্গে কথা বলেছি। তিনিও একমত। সুতরাং কেউ যদি শক্তিশালী কোনাে যুক্তির অবতারণা না করেন তাহলে সামরিক সহায়তা স্থগিতের প্রশ্ন মীমাংসিত। এখন প্রশ্ন হলাে, আমরা কী উপায়ে এটা বন্ধ করব? দুটো উপায় খােলা আছে। প্রথমত, আমরা নতুন লাইসেন্স প্রদান স্থগিত করতে পারি। দ্বিতীয়ত, নতুন লাইসেন্স বন্ধের পাশাপাশি বিদ্যমান সব লাইসেন্স বাতিল করতে পারি।

আরউইন : আপনার প্রশ্ন রয়েছে যে, কখন এটা বন্ধ করা হবে এবং তার পরিমাণ কী হবে?

কিসিঞ্জার এই দুয়ের মধ্যে তেমন কী আসে যায়? আরউইন আমি ঠিক জানি না, পরিমাণ কী?

সূত্র:  ১৯৭১ আমেরিকার গোপন দলিল – মিজানুর রহমান খান – সময় প্রকাশন