ভারত চেয়েছে পূর্ব পাকিস্তান হবে ভুটান
২৪ ডিসেম্বর, ১৯৭১ দুপুর সাড়ে ১২টা নিক্সন, পররাষ্ট্রমন্ত্রী রজার্স ও কিসিঞ্জার পূর্ব পাকিস্তানের পরিস্থিতি নিয়ে মতবিনিময় করেন। রজার্স আলােচনার শুরুতেই দক্ষিণ এশীয় প্রশ্নে হােয়াইট হাউস এবং পররাষ্ট্র দফতরের মধ্যে মতবিরােধের কথা অস্বীকার করেন এবং মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র কিভাবে এই সংকট মােকাবিলা করতে পারে সে ব্যাপারে তিনি তার মত দেন। প্রথমত, উভয় পক্ষের সর্বোচ্চ পর্যায়ের সংযম প্রদর্শনের জন্য কূটনৈতিকভাবে যতদূর করা সম্ভব আমাদের তা করেই যেতে হবে। দ্বিতীয়ত, আমি মনে করি, ইয়াহিয়ার সঙ্গে আমাদের সম্পর্ক ভালাে; এই সম্পর্ক ধরে রাখতে হবে, আমাদের তার ঘনিষ্ঠ হতে হবে। তৃতীয়ত, আমি মনে করি না যে, একটি রাজনৈতিক সমাধানের কোনাে মহাপরিকল্পনা প্রণয়নের চেষ্টা করা উচিত। আমি এটা কখনােই ভাবি না। আমি মনে করি না, এটা সম্ভব এবং আমার ধারণা, ইয়াহিয়া এই সিদ্ধান্তে পৌছেছেন যে, রাজনৈতিকভাবে কিছু একটা করা বাঞ্ছনীয়। রজার্স বলেন, ইয়াহিয়া কিছু একটা করতে বাধ্য হতে যাচ্ছেন। হয় তিনি এটা করবেন, না হয় তাকে চলে যেতে হবে। একটা হতে পারে, তিনি ভুট্টোর কাছে সবকিছু ছেড়ে-ছুড়ে দেবেন। কিন্তু তাকে ভালাে অগ্রগতি বলা যাবে না। আমার নিজের ধারণা, পরিস্থিতি আরাে অবনতি হতে যাচ্ছে। আমি সমাধানের কোনাে পথ দেখি না। সুতরাং আমাদের মুখ্য উদ্দেশ্য হওয়া উচিত যুদ্ধ ছড়িয়ে পড়াকে আমরা কিভাবে প্রতিহত করতে পারি। নিক্সন এই পর্যায়ে পূর্ব পাকিস্তানের যুদ্ধ সম্পর্কে খবরের কাগজের রিপাের্টের প্রতি দৃষ্টি আকর্ষণ করেন। তিনি বলেন, ভারতীয়রা কি এখনাে এটা অস্বীকার করছে যে, তাদের ডিভিশন পূর্ব পাকিস্তানের যুদ্ধে লিপ্ত ।
রজার্স বলেন, তারা এখনাে তা প্রত্যাখ্যান করছে। তবে তারা সেখানে ডিভিশন পর্যায়ে না থাকলেও ব্রিগেড পর্যায়ে অবশ্যই সক্রিয়। কিসিঞ্জার উল্লেখ করেন যে, ভারতীয় ব্রিগেডগুলাে- পদাতিক, বিমান এবং ট্যাঙ্কবাহিনী সমর্থিত। রজার্স বলেন, পূর্ব পাকিস্তানের লড়াইয়ে ভারত আরাে সক্রিয়ভাবে অংশ নেবে। এর ফলে পাকিস্তানের অবস্থান আরাে গুরুতরভাবে নাজুক হয়ে পড়বে। ‘আমি মনে করি, আমাদের এই সত্যের মুখােমুখি হতে হবে, সামরিকভাবে ইয়াহিয়ার অবস্থান খুবই দুর্বল। পূর্ব পাকিস্তানে তার লােকের সংখ্যা ৬০ থেকে ৮০ হাজার।’ নিক্সন এ কথার পিঠে আরাে বলেন, ইয়াহিয়া পূর্ব পাকিস্তানে ধ্বংস হবেন। রজার্স এ সময় পাকিস্তান বাহিনীর লজিস্টিক সমস্যার দিকে দৃষ্টি আকর্ষণ করেন। তিনি বলেন, পূর্ব পাকিস্তানের সৈন্যদের কোনাে কিছু পুনরায় সরবরাহ করতে হলে কোনাে বিমানকে আড়াই হাজার মাইল পাড়ি দিতে হবে। আর আপনি জানেন, তাদের লজিস্টিক দেয়া একটি অসম্ভব বিষয়। আমার নিজের মত হচ্ছে, এটা সম্ভবত আরাে অবনতি ঘটাবে। এ ছাড়া আমি স্টেট ডিপার্টমেন্টের কর্মকর্তাদের নির্দেশ দিয়েছি তারা যেন ভারতের প্রতি অর্থনৈতিক সহায়তার অঙ্গীকার ও কোনাে রফতানির প্রক্রিয়া বিলম্ব ঘটায়। কিন্তু তিনি মত দেন। যে, এসবই কিছু প্রতীকী পদক্ষেপ। এর মাধ্যমে ভারতকে নিবৃত্ত করা যাবে না। ‘ভারতের প্রতি আমাদের প্রভাব খাটানাের সম্ভাবনা একেবারেই সীমিত, আমরা যদি তাদের বিরুদ্ধে কিছু ব্যবস্থা নেই, যে ব্যাপারে আপনি সিদ্ধান্ত অবশ্য নিতে পারেন, তা কিন্তু প্রতীকী হিসেবেই গণ্য হবে। উল্লেখযোেগ্যভাবে কার্যকর হবে না। এ দিনের আলােচনায় পূর্ব পাকিস্তান ইস্যু জাতিসংঘ নিরাপত্তা পরিষদে নিয়ে গেলে কী ধরনের ফায়দা পাওয়া যেতে পারে, সে ব্যাপারে কোনাে মতৈক্যে পৌছানাে সম্ভব হয়নি নিক্সন এ পর্যায়ে রজার্সের এই পর্যবেক্ষণ খণ্ডন করেন যে, ভারতকে সংযত করার ক্ষেত্রে যুক্তরাষ্ট্র শুধুই প্রতীকী পদক্ষেপ নিতে পারে।
প্রেসিডেন্ট বলেন, আমি জানি এটা বলা যেতে পারে যে, এটা কোনাে সুফল বয়ে আনবে না এবং ভারতের প্রতি আমাদের কোনাে প্রভাব নেই; এবং এটা শুধুই প্রতীকী। কিন্তু অন্যদিক থেকে দেখলে আমাদের সেই প্রতীকীটাই কিন্তু ভালােভাবে কার্যকর করা উচিত। কারণ আমি বিশ্বাস করি, আমাদের কিছু প্রতীকীবাদের প্রয়ােজন রয়েছে। তিনি অবশ্য পরিস্থিতির বাস্তবতা স্বীকার করেন। সামরিক ভারসাম্যের দিক থেকে দেখলে, ভারতীয়রা। জয়লাভ করতে যাচ্ছে। পাকিস্তান ভেঙে যাবে।’ নিক্সন আরাে বলেন, এ ধরনের একটা পরিস্থিতি ধরে নিয়েও আমার কাছে প্রতীয়মান হচ্ছে যে, আমাদের নীতি যে কোনাে বিচারেই পাকিস্তান ঘেঁষাই হওয়া উচিত। ভারতঘেঁষা নয়। তবে এটা এই বিবেচনায় নয় যে, ইন্দিরা গান্ধীর চেয়ে ইয়াহিয়া আমাদের প্রতি অধিকতর বন্ধুত্বপূর্ণ মনােভাব দেখাচ্ছেন। আমি মনে করি, ভারতের অবস্থান অধিকতর ক্রটিপূর্ণ। আমার ধারণা, আমাদের পুরাে খেলাটাই খেলতে হবে। সুতরাং আপনি যদি কিছু প্রতীকীও করতে পারেন, তাহলে তা সত্যি আমাদের ( নিক্সন তার এই বাক্যটি শেষ করেননি)। এরপর বলেন, ইন্দিরা গান্দী জানতেন, তিনি যখন এখানে আমরা ফাকা গুলি ছুড়িনি। হতে পারে তা কোনাে অর্থই বহন করেনি… পরিস্থিতির গুরুত্ব অনুসারে আমরা পাকিস্তানের দিকেই ঝুঁকতে পারি। আমি তেমন খেলাকেই অগ্রাধিকার দেব । সেই বিবেচনাতেই জাতিসংঘের খেলাটা আসবে। রজার্স ধারণা দেন যে, এই ইস্যু যদি জাতিসংঘে তােলা হয়, তাহলে ভারতের চেয়ে পাকিস্তানই উপকৃত হবে। রজার্স সম্পূর্ণরূপে একমত হন যে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের পাকিস্তানের দিকেই ঝোকা উচিত। তবে প্রশ্ন ছিল, এটা কিভাবে করতে হবে? তিনি অনুভব করেন যে, এর বহু উপায় রয়েছে। একটি হতে পারে এই, এই মুহূর্তে আমরা আর কোনাে রফতানি ছাড়পত্র মঞ্জুর করব না। ভারতে প্রেরণে যা কিছু পাইপলাইনে রয়েছে, আমরা তার ওপর। নিষেধাজ্ঞা আরােপ করতে পারি।
বর্তমানে পাইপলাইনে হয়তাে ১০ থেকে ১৫ মিলিয়ন ডলারের সামরিক সরঞ্জাম রয়েছে। আমরা এটাও বলতে পারি, আমরা প্রতিশ্রুত অর্থনৈতিক সহায়তা রক্ষা করতে পারব না। এই প্রতিশ্রুতির আওতায় ১১ মিলিয়ন ডলারের সংশ্লিষ্টতা রয়েছে। এটা অনুল্লেখযােগ্য। আমি মনে করি, এমন। পদক্ষেপ ঠিক হবে না। কারণ যেভাবেই হােক আমরা তাে উদ্বাস্তুদের সাহায্য দিতে যাচ্ছি। নিক্সন বলেন, আমি এক্ষেত্রে একটি শক্ত অবস্থান নিতে চাই। কিসিঞ্জার অবশ্য রজার্সের সঙ্গে একমত হন যে, যেসব ঋণপত্র ইতােমধ্যে খােলা হয়েছে তা নিষ্পন্ন করা কঠিন হবে। কিন্তু নিক্সন পুনর্ব্যক্ত করেন যে, যত প্রতিকূলতাই হােক না কেন, | তিনি এমন কিছু পদক্ষেপ নিতে চান, যা ভারতকে সংযত করতে পারে। আমি মনে করি, আমাদের এমন কিছু করা উচিত যা প্রতীকী । আমি প্রকৃতই বিশ্বাস করি, এমন প্রতীকী পদক্ষেপ নিলেও তা ভারতকে কিছুটা হলেও সংযত করতে পারে। রজার্স। সুপারিশ রাখেন যে, ২৬ নভেম্বর নতুন করে রফতানি লাইসেন্স ইস্যুর ব্যাপারে নিষেধাজ্ঞা ঘােষণা দেয়া যেতে পারে। নিক্সন ইঙ্গিত দেন যে, ২৬ নভেম্বরের বৈঠকের আগেই তিনি তার নীতির বিকল্পগুলাে পর্যালােচনা করতে আগ্রহী তিনি এটা ভেবে চিন্তিত যে, অর্থনৈতিক নিষেধাজ্ঞা অকার্যকর বলে প্রমাণিত হতে পারে।
তিনি বলেন, তিনি এমনকিছু একটা করতে চান যা খুবই সুদৃঢ়। তবে একইসঙ্গে খুবই ইতিবাচক বিবৃতি থাকবে যে, মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র উদ্বাস্তুদের সাহায্যদানে অঙ্গীকারবদ্ধ। তারা ক্ষুধার্ত জনগণের পাশে দাঁড়াবেই। তবে তিনি বলেন, ভারতকে যে কোনাে সামরিক সহায়তা | দানের প্রক্রিয়ায় অবশ্যই বন্ধ করতে হবে। আমেরিকার অবমুক্তকৃত এসব দলিলের। সম্পাদকীয় নােটে উল্লেখ করা হয় যে, এরপর আলােচনা কিসিঞ্জার এগিয়ে নেন। তিনি ব্যাখ্যা করেন যে, এই সংকট থেকে ভারতের স্বার্থ কিভাবে উদ্ধার হতে পারে। তার কথায়, ভারত পাকিস্তানের দুই অংশকে যেভাবে খণ্ডিত করতে চাইছে তাতে পশ্চিম পাকিস্তান কালক্রমে আফগানিস্তানের মর্যাদা লাভ করবে এবং পূর্ব পাকিস্তানের মর্যাদা ভুটানের পরিণতি পাবে। এ দিনের আলােচনায় নিক্সনের এই মন্তব্যের সঙ্গে সাধারণভাবে মতৈক্য প্রতিষ্ঠিত হয় যে, ইয়াহিয়া একজন চমৎকার এবং বােধসম্পন্ন মানুষ। কিন্তু রাজনৈতিকভাবে তিনি সব সময় চৌকস নন। তিনজনই একমত হন যে, ইয়াহিয়া তার ভবিষ্যৎ নিয়ে শঙ্কিত হয়ে পড়ার কারণেই ভুট্টোর দিকে ঝুঁকেছেন। ভুট্টো সম্পর্কে নিক্সনের মূল্যায়ন হচ্ছে, তিনি সম্পূর্ণরূপে বক্তৃতাবাগীশ। নিক্সন রজার্স। ও কিসিঞ্জারের দিকে তাকিয়ে আলােচনার সমাপ্তি টানেন এই বলে যে, আমি এমন একটি অবস্থার মধ্যে ধরা পড়তে চাই না, যেখানে আমাদের একটি শােচনীয় যুদ্ধের | উত্তাপ অনুভব করতে হয় এবং যে যুদ্ধে আমাদের কিছুই করার নেই।
সূত্র: ১৯৭১ আমেরিকার গোপন দলিল – মিজানুর রহমান খান – সময় প্রকাশন