ভুট্টো নয় ইয়াহিয়ার সঙ্গেই আপােস চেয়েছে বাঙালি
২২ নভেম্বর, ১৯৭১ ওয়াশিংটন স্পেশাল অ্যাকশন গ্রুপের বৈঠকে সিসকো যখন বলছিলেন, আমাদের লক্ষ্য হচ্ছে উপমহাদেশে যুদ্ধ নিরুৎসাহিত করা, জবাবে কিসিঞ্জার বলেন : এটা একটা সাধারণ কথা। আমরা তাে সেটা পারি। ভারত যা চায় সেটা পূরণ করে দিলেই হলাে। আমরা এটাও পারি, পাকিস্তান ভাঙতে সামরিক শক্তি ব্যবহারে ভারতকে নিরুৎসাহিত করার মাধ্যমে। ভারতীয়রা পূর্ব পাকিস্তানকে এমন ফ্যাশনে ভেঙে দিতে চায়, যাতে পশ্চিম পাকিস্তানও ভেঙে পড়ে। মিসেস গান্ধী প্রেসিডেন্টের সঙ্গে আলােচনায় একটা উল্লেখযােগ্য সময় ব্যয় করেছেন এ কথা বােঝাতে যে, কেন বেলুচিস্তানের কখনাে পাকিস্তানের অংশে পরিণত হওয়া উচিত হয়নি। পূর্ব পাকিস্তানে যদি একটি নতুন টিমের কাছে পাকিস্তানিরা সম্পূর্ণভাবে ক্ষমতা হস্তান্তর করে, তখন কী হবে? তারা হয়তাে সম্পূর্ণভাবে প্রতিনিধিত্বশীল হবেন না কিন্তু নতুন টিমের কাছে অন্তত এটা আশা করা যায় যে, তারা সাবেক শাসনের সঙ্গে নিজেদের বাঁধবেন না। ভারতকে এটা বলা কি অসঙ্গত হবে যে, আমাদের চার সপ্তাহ সময় দিন। দেখি আমরা কী করতে পারি। আমরা যদি একটি রাজনৈতিক সমাধানে এখনই জবরদস্তি করি তাহলে আপনি একটি ভিন্ন ধরনের জাতিসংঘ প্রস্তাব দেখতে পাবেন। প্রেসিডেন্ট এই ইস্যুতে তার দৃষ্টিভঙ্গি খুব ভালােভাবেই স্পষ্ট করেছেন।
২৩ নভেম্বর, ১৯৭১ ওয়াশিংটন স্পেশাল অ্যাকশন গ্রুপের বৈঠকে তিনটি সিদ্ধান্ত নেয়া হয়। সংক্ষেপে এগুলাে নিম্নরূপ রাষ্ট্রদূত ফারল্যান্ড, কিটিং ও বিমের কাছে টেলিগ্রাম পাঠানাে হবে। সংশ্লিষ্ট পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের কাছে তারা কূটনৈতিক স্মারক পেশের মাধ্যমে সব পক্ষকে সংযত হতে বলবেন। দ্বিতীয়ত, পররাষ্ট্র দপ্তর সাহায্য বন্ধ করে দেয়া মর্মে একটি স্মারক তৈরি করবে। তৃতীয়ত, নিরাপত্তা পরিষদে উপস্থাপনের জন্য একটি খসড়া প্রস্তাব তৈরি করা। এদিন আলােচনা শুরু হয় এভাবে
কিসিঞ্জার (কুশম্যানের প্রতি) আমরা এখন কোথায় দাঁড়িয়ে? জেনারেল কুশম্যান পূর্ব পাকিস্তান ও ভারতের সীমান্ত সন্নিহিত এলাকায় যুদ্ধের পরিস্থিতি বর্ণনা করেন। তিনি উল্লেখ করেন। পাকিস্তানি সামরিক কর্তৃপক্ষ উল্লেখ করেন, ভারতীয় সশস্ত্র বাহিনী
যশাের সীমান্ত দিয়ে পূর্ব পাকিস্তানের আট মাইল গভীরে অনুপ্রবেশ করেছে। অন্যান্য রিপাের্ট থেকে ইঙ্গিত মিলেছে যে, ভারতীয় সৈন্য ও মুক্তিবাহিনী যৌথভাবে আক্রমণ চালালেও পাকিস্তানি সৈন্যদের যশাের থেকে পুশব্যাক করতে পারেনি।
আরউইন : আমরা মাঠপর্যায় থেকে ফিডব্যাক পেতে আর কয়দিন সময় লাগবে? কুশম্যান একদিনের মধ্যেই আমাদের এটা পাওয়া উচিত। প্যাকার্ড আমরা কি সেখানে ভালাে কাভারেজ রেখেছি? কুশম্যান (দুই লাইন সাের্স টেক্সট অবমুক্ত করা হয়নি)
কিসিঞ্জার এটা কি তাহলে সীমিত অপারেশন মনে হচ্ছে? নাকি তাদের যাওয়া অব্যাহত থাকবে?
কুশম্যান তাদের থামিয়ে দিতে বিকল্প আছে, অথবা চাইলে আরাে ঢােকাতে পারে। আমাদের জন্য এটা সীমিত অপারেশন বলেই প্রতীয়মান হয়।
আরউইন একটি বার্তা বলছে যে, চালনা ও চট্টগ্রামের দিকে অগ্রবর্তী সৈন্যরা এগিয়ে আসছে। কিন্তু সেখানে কি তাদের পক্ষে অবস্থান নেয়া সম্ভব? (ফুটনােট ২৩ নভেম্বর, ১১৫৫৭ নম্বর টেলিগ্রামে ইসলামাবাদ থেকে জানানাে হয়েছে ফারল্যান্ড এদিন ইয়াহিয়ার সঙ্গে কথা বলেছেন। ইয়াহিয়া তাকে জানিয়েছেন, ভারত পাকিস্ত নের বিরুদ্ধে আক্রমণাত্মক অভিযান শুরু করেছে। ভারতের অগ্রবর্তী সৈন্য চালনা ও চট্টগ্রামের দিকে লক্ষ্য করেই অবস্থান নিচ্ছে। ইয়াহিয়া বলেছেন, চট্টগ্রাম সেক্টরে ভারতীয় সৈন্য পাকিস্তানি ভূখণ্ডের ২০ মাইলের ভেতরে ঢুকে পড়েছে। এ ঘটনার প্রেক্ষাপটে ইয়াহিয়া জাতীয় জরুরি অবস্থা ঘােষণার সিদ্ধান্ত নিয়েছেন।) | কুশম্যান তাদের সে সামর্থ্য রয়েছে।
এডমিরাল মুরার ভারতীয় নৌবাহিনী সম্পর্কে কোনাে তথ্য আছে কি? এমন রিপাের্ট পাওয়া গেছে যাতে বলা হয়েছে, ভারতীয়রা একটি ব্রিটিশ জাহাজে গােলাবর্ষণ। করেছে।
কুশম্যান এ ব্যাপারে আমাদের কিছু জানা নেই। কিসিঞ্জার (আরউইনের প্রতি) আপনার কী ধারণা?
আরউইন আমার বলার কিছু নেই। আমরা বার্তায় যা পেয়েছি জেনারেল কুশম্যান তা ইতােমধ্যেই তুলে ধরেছেন।
কিসিঞ্জার আমরা ইয়াহিয়ার কাছ থেকে একটা চিঠি পেয়েছি। এতে নতুন কিছুই নেই। (ফুটনােট ইয়াহিয়া এই তারিখবিহীন চিঠিতে নিক্সনকে জানিয়েছেন, ভারত বিনা উস্কানিতে পূর্ব পাকিস্তানে ব্যাপকভিত্তিক আক্রমণ পরিচালনা করেছে। পাকিস্তানও তার ভূখণ্ডে প্রতিরক্ষাব্যুহ গড়ে তুলেছে। ইয়াহিয়া এর পরেও ভারতের সঙ্গে একট সাধারণ যুদ্ধ এড়াতে চান। একই সঙ্গে তিনি উল্লেখ করেন যে, পূর্ব পাকিস্তানের ভারত যেভাবে হামলা করছে তাতে অবস্থা ক্রমেই পয়েন্ট অব নাে রিটানে পৌছাচ্ছে।) আপনারা কি প্রত্যেকে নয়াদিল্লি, ইসলামাবাদ ও মস্কোর জন্য
প্রস্তুত বার্তার খসড়া দেখেছেন?
স্যান্ডার্স হা। এটা প্রত্যেকের সামনেই রাখা আছে।
কিসিঞ্জার প্রেসিডেন্ট গত রাতে তিনটি বার্তা পাঠাতে বলেছেন। সােভিয়েত, ভারত ও পাকিস্তানের কাছে। খসড়াগুলাে ভালােই লেখা হয়েছে। তবে প্রেসিডেন্ট ইন্দিরার জন্য প্রস্তুত বার্তায় সামান্য পরিবর্তন আনতে চান। তিনি তাকে বলতে চান, আমরা উদ্বাস্তু পরিস্থিতির জন্য সহানুভূতিশীল। কিন্তু যুদ্ধ শুরু করা হলে তা কিন্তু বােধগম্য হবে না।’ (ফুটনােট ২৩ নভেম্বর প্রেরিত বার্তায় ফারল্যান্ডকে বলা হয়, ইয়াহিয়াকে এটা জানিয়ে দিতে যে, যুক্তরাষ্ট্র ভারতের কাছে গভীর উদ্বেগ প্রকাশ করেছে। সােভিয়েত ইউনিয়নকেও তা জানিয়েছে। ফারল্যান্ডকে বলা হয়, ইয়াহিয়ার কাছে এই আবেদন রাখতে যে, তিনি যেন সামরিক সংযমের ক্ষেত্রে বৃহত্তম মাত্রা প্রদর্শন করেন। মস্কোতে রাষ্ট্রদূত বিনকে বলা হয়, পাক-ভারত যুদ্ধে ভয়াবহতা ব্যাখ্যা করতে রুশ পররাষ্ট্রমন্ত্রী গ্রোমিকোর সঙ্গে বৈঠক করতে। বিনকে বলা হয়, এ কথা উল্লেখ করতে যে, পূর্ব পাকিস্তানের বিরুদ্ধে ভারতীয় ও মুক্তিবাহিনী আক্রমণাত্মক অভিযান পরিচালনা করছে। সােভিয়েত ইউনিয়ন যেন ভারতকে সংযত রাখতে তার প্রভাব খাটাতে সচেষ্ট হয়। দিল্লিতে রাষ্ট্রদূত কিটিংকে বলা হয়, পররাষ্ট্রমন্ত্রী শরণসিংয়ের সঙ্গে দেখা করতে। তিনি শরণসিংকে জানিয়ে দেবেন যে, পূর্ব পাকিস্তান সীমান্তে সাম্প্রতিক সামরিক সংঘর্ষের ঘটনায় যুক্তরাষ্ট্র গভীরভাবে উদ্বিগ্ন। কিটিংকে আরাে বলা হয়, তিনি যেন স্মরণ করিয়ে দেন যে, ইন্দিরা গান্ধী, নিক্সন আশ্বস্ত করেন, ভারত যুদ্ধ শুরু করবে না।
আরউইন আমরা যদি বার্তায় প্রেসিডেন্টের বরাতের উল্লেখ করি, তাহলে পররাষ্ট্রমন্ত্রীর পরিবর্তে সম্ভবত স্বয়ং প্রধানমন্ত্রীর শরণাপন্ন হওয়া উচিত। আমার সুপারিশ হচ্ছে, প্রথমে পররাষ্ট্রমন্ত্রীর কাছে যাওয়া। এর পরে যদি আরাে তথ্য পাই। তাহলে আমরা প্রধানমন্ত্রীর কাছে যেতে পারি। কিসিঞ্জার আমরা কিন্তু পররাষ্ট্রমন্ত্রীর কাছে প্রেসিডেন্টের কথা উল্লেখ করতে পারি। আমরা কি তা পারি না? এতে কি কোনাে ভুল হবে?
মুরার আমরা যদি পররাষ্ট্রমন্ত্রীর কাছে যাই এবং ততক্ষণে সামরিক তৎপরতা নাটকীয়ভাবে বৃদ্ধি পায় তখন যুদ্ধ শুরু নিয়ে মিসেস গান্ধীর সঙ্গে কথা বলার আর সুযােগ থাকবে না। সুতরাং আমাদের উচিত হবে সেনা প্রত্যাহার নিয়ে কথা বলা। ব্যক্তিগতভাবে আমি বিশ্বাস করি, ভারতীয় নিয়মিত সৈন্যরা যে জড়িত এ নিয়ে কোনাে সন্দেহ নেই।
কিসিঞ্জার মুক্তিযােদ্ধারা ট্যাঙ্ক ও এয়ারক্রাফট কিভাবে ব্যবহার করতে পারে? সেখানে তারা ব্রিগেডও গড়ে তুলেছে। আমরা আসলে কেমন পৃথিবীতে বাস করছি? যেখানে দেশগুলাে দাবি করতে পারবে, এসবই গেরিলা তৎপরতা। এর কোনাে মানে হয় না এবং আমাদেরও এমন খেলা প্রত্যক্ষ করার প্রশ্ন আসে না। আগে পররাষ্ট্রমন্ত্রী প্রধানমন্ত্রী এ নিয়ে আমার কোনাে মাথাব্যথা নেই। আমি কি প্রেসিডেন্টের কাছে এ বিষয়টি তুলব?
প্যাকার্ড পরিস্থিতির যদি অবনতি ঘটে তাহলে পরবর্তী পদক্ষেপ সম্পর্কে আমাদের সতর্কতার সঙ্গে ভাবতে হবে।
কিসিঞ্জার আমি জানি প্রেসিডেন্ট কী করবেন? তিনি সাহায্য বন্ধ করে দেবেন।
২৪ নভেম্বর, ১৯৭১ ওয়াশিংটন স্পেশাল অ্যাকশন গ্রুপের বৈঠকে আরউইন প্রশ্ন রাখেন, পূর্ব পাকিস্তানে কি আমাদের যােগাযােগ রয়েছে?
কুশম্যান হ্যা। কিসিঞ্জার তাদের বলুন পরিস্থিতির ব্যাপারে আমাদের বস্তুনিষ্ট তথ্য দরকার। কুশম্যান : আমাদের হাতে তা রয়েছে। ওয়ালার (সিআইএ) তিন লাইন সাের্স টেক্সট অবমুক্ত করা হয়নি। কুশম্যান তিন লাইন সাের্স টেক্সট অবমুক্ত করা হয়নি। আরউইন এক লাইন সাের্স টেক্সট অবমুক্ত করা হয়নি। কুশম্যান হা।
কিসিঞ্জার এই কক্ষে যারা আছেন, তাদের মনে কারাে কি সন্দেহ আছে যে, ভারতীয়রা তার নিয়মিত সৈন্যবাহিনী দিয়ে পাকিস্তান সীমান্তে আক্রমণ পরিচালনা করেছে? আর যদি কারাে তা থেকেও থাকে, তার কি আসলে কোনাে মানে আছে? আমরা কি এটা বিশ্বাস করতে পারি, মুক্তিযােদ্ধারাই সীমান্তের কয়েক শত মাইল বিস্তৃত এলাকায় আক্রমণ রচনা করেছে। এবং তার ট্যাঙ্ক ও এয়ারক্রাফট নিয়ে। এরপরও কি আমরা একে ইন্ডিজেনাস মুভমেন্ট হিসেবে আখ্যা দেব? ডিপালমা (স্টেট ডিপার্টমেন্ট) এ নিয়ে কোনাে প্রশ্ন নেই যে, মুক্তিযােদ্ধারা সশস্ত্র । এবং তাদের বাহির থেকেই অস্ত্র দেয়া হয়েছে। কিন্তু তা সত্ত্বেও জাতিসংঘে এটা আমরা সুনির্দিষ্টভাবে উত্থাপন করতে পারি না। কিসিঞ্জার প্রশ্ন হলাে আমরা যে পদক্ষেপ নিতে চাই তার স্বপক্ষে কী ধরনের নিরেট তথ্য থাকা দরকার। আমদের কোনাে সন্দেহ নেই যে, ভারত জড়িত এবং তারা সম্ভবত সীমান্ত অতিক্রম করেছে। কিন্তু তাদের তৎপরতা সম্পর্কে নির্দিষ্ট তথ্য চাই এবং তা এক বা দুদিনের মধ্যেই।
মুরার তারা সম্ভবত তাদের নিয়মিত সৈন্য ও তাদের সীমান্ত নিরাপত্তারক্ষীদের মাধ্যে একটা পার্থক্য দেখাতে চাইছে। (ফুটনােট : আড়াই লাইন সাের্স টেক্সট অবমুক্ত করা হয়নি।)
আরউইন : (মুরারের প্রতি) তাদের উদ্দেশ্য কী বলে মনে হচ্ছে। তারা কি সরবরাহ বিচ্ছিন্নের চেষ্টা করছে? তারা কি প্রাথমিকভাবে বাংলাদেশ গেরিলাদের সমর্থন দিচ্ছে? কিংবা এর পরেও অনেক দূর যেতে চায়। তারা কি তাদের সৈন্যবাহিনীকে পাকিস্তানের ভূখণ্ড জবরদখলে ফন্দি আঁটছে? নাকি রক্ষা করতে চাইছে বাংলাদেশকে? | মুরার প্রাথমিকভাবে তারা বাংলাদেশকে সমর্থন দিচ্ছে এবং পরবর্তী লক্ষ্য হচ্ছে পাকিস্তানিদের জীবন ছারখার করা। বাংলাদেশ গেরিলারা সীমান্তের দিকে অগ্রসর হচ্ছে, যেখানে পাকিস্তানিদের বিরুদ্ধে আক্রমণে ভারতীয়রা তাদের সহায়তা দিতে পারে।
কিসিঞ্জার সুতরাং আমাদের অবস্থা হচ্ছে এখন এমন যে, আমাদের কী করতে হবে তা আমরা জানি না। আর আরাে সময় পার হলে তারা পৌছে যাবে ঢাকায়। তখন কিছু করার উদ্যোগ নিতে বড্ড দেরি হয়ে যাবে। এই পরিপ্রেক্ষিতে বিলম্বের চেয়ে আমাদের দ্রুত পদক্ষেপ নেয়া উচিত। সিদ্ধান্ত নিতে দেরি হয়ে গেলে তা অকার্যকর হয়ে পড়বে। সেটাই আমাদের উভয় সংকট।…
মুরার ব্যক্তিগতভাবে আমি বিশ্বাস করি যে, ভারতীয় সৈন্যরা পূর্ব পাকিস্তানের অভ্যন্তরে অবস্থান করছে। কিন্তু তারা খুব ভেতরে ঢুকেনি। | আরউইন তবে তারা সামান্য একটু অনুপ্রবেশ করে দুটি গুরুত্বপূর্ণ সরবরাহ রুট বিচ্ছিন্ন করতে পারে। যদিও এখনাে তারা তা কিন্তু করেনি।
মুরার খুব ভেতরে অনুপ্রবেশের জন্য তাদের পর্যাপ্ত সৈন্য নেই। আমার মনে হবে তারা পাকিস্তানিদের সক্রিয় করছে, যাতে মুক্তিযােদ্ধারাই তাদের পরাজিত করতে পারে। পাকিস্তানিদের পুন সৈন্যসমাবেশ ঘটানাের সামর্থ্য খুবই কম। ভারতীয় নৌবাহিনী এটা প্রতিহত করতে সক্ষম।
কিসিঞ্জার (সিসকোর প্রতি) আপনি কী মনে করেন?
সিসকো : ভারতীয় দৃষ্টিভঙ্গির দিক থেকে এই ঘটনা রাজনৈতিক ও সামরিক লক্ষ্যের দিক থেকে গুরুত্বপূর্ণ। রাজনৈতিক লক্ষ্য হচ্ছে, মুজিবের সঙ্গে সমঝােতার জন্য ইয়াহিয়ার ওপর চাপ বৃদ্ধি। আর সামরিক উদ্দেশ্য হচ্ছে, মুক্তিবাহিনীর বিদ্রোহের তেজ বাড়ানাে। ইয়াহিয়ার দিক থেকে দেখলে ব্যাপারটি এই দাঁড়ায় যে, পরিস্থিতি থেকে হাত গুটাতে তিনি তার আগ্রহের প্রমাণ সব ক্ষেত্রেই রাখছেন। আমার ধারণা, তার এই মুহূর্তের লক্ষ্য হচ্ছে নির্বাচনের দিকে অগ্রসর হওয়া। এবং তারপর পরিস্থিতিকে ভুট্টোর দিকে ঠেলে দেয়া। ভুট্টো যদি একবার ক্ষমতায় বসতে পারে তাহলে পূর্ব ও পশ্চিমের মধ্যে এক্যের সম্ভাবনা এখন যতটুকু আছে তখন তা আরাে হ্রাস পাবে। বাঙালিরা সর্বদাই ইয়াহিয়ার সঙ্গে সমঝােতায় আগ্রহী থেকেছে, ভুট্টোর সঙ্গে নয়। ভুট্টোই কিন্তু মার্চের গণ্ডগােলের জন্য মুখ্য সমস্যা। ভুট্টোর একমাত্র উদ্দেশ্য হচ্ছে ক্ষমতা দখল। পারলে সমস্ত পাকিস্তানের আর না হলে খণ্ডিত পশ্চিম পাকিস্তানের। কিন্তু ক্ষমতা তার চাই।
কিসিঞ্জার কিন্তু তা তাে তার আছে।
সিসকো : আমি আক্ষরিক অর্থে ক্ষমতা বুঝিয়েছি। যদি নির্বাচনী তফসিল এগিয়ে যায় তাহলে ক্ষমতা তার দিকেই যাবে। ইয়াহিয়া অগ্রসর হতে চান, কারণ তিনি বিরাজমান সমস্যা ভুট্টোর কাঁধেই চাপাতে আগ্রহী। এটা যদি ঘটে তাহলে রিকন্সিলিয়েশনের সম্ভাবনা আরাে হ্রাস পাবে।
নিরাপত্তা পরিষদের উচিত হবে পরিস্থিতি বাগে আনা এবং একই সঙ্গে রাজনৈতিক আপােসের প্রশ্নটিও সুরাহা করতে হবে। ইয়াহিয়া যদি মুজিবের সঙ্গে সরাসরি কথা বলতে সক্ষম না হন, তাহলে তিনি কেন জাতিসংঘকে হাতিয়ার হিসেবে ব্যবহার করছেন না।
কিসিঞ্জার যদি তিনি এসবের কিছুই না করতে চান?
সিসকো আমি একমত। তার তিনটি বিকল্প রয়েছে। মুজিবের সঙ্গে সরাসরি আপােস, জাতিসংঘের মাধ্যমে ও তৃতীয়ত কোনাে কিছুই না করা। যদি পূর্ব ও পশ্চিম পাকিস্তান একসঙ্গে না-ই থাকতে পারে, তাহলে যুক্তরাষ্ট্র একটি স্বাধীন পূর্ব পাকিস্তানকে নিয়ে সন্তুষ্ট থাকতে পারে। | কিসিঞ্জার কিন্তু এমন একটা বাজে ব্যাপার আমরা হতে দিতে পারি না। সিসকো যা হােক ইয়াহিয়া জাতিসংঘে গেলে পরিস্থিতি একটি আন্তর্জাতিক চেহারা পাবে, যা তিনি এখনাে পর্যন্ত অভ্যন্তরীণ বিষয় বলে বর্ণনা করছেন। এমন পরিস্থিতিতে তিনি মুজিবের সঙ্গে আপােস করতে বাধ্য হবেন।
কিসিঞ্জার কেউ কি সত্যি বিশ্বাস করে যে ভারত পূর্ব পাকিস্তানের মধ্যে সমঝােতা চাইছে?
সিসকো আমি বিশ্বাস করি, ভারত রাজি হবে। যদি শান্তিপূর্ণভাবে মুজিবের কাছে ক্ষমতা হস্তান্তর করা হয়। সেক্ষেত্রে মুজিব পূর্ব পাকিস্তানে একটি সরকার গঠন করবেন এবং তা পৃথক সত্তা অথবা স্বাধীনতা লাভ থেকে তা খুব দীর্ঘ হবে না। মুজিব যদি পশ্চিম পাকিস্তানের সঙ্গে একটি কনফেডারেল সম্পর্ক স্থাপন করেন, তাহলে একটি স্বাধীন পূর্ব পাকিস্তানের মতােই ‘ওয়েস্ট বেঙ্গলি’দের কাছে আকর্ষণীয় মনে হবে।
কিসিঞ্জার আপনি বলছেন, সমঝােতার সম্ভাবনা ভুট্টোর চেয়ে ইয়াহিয়ার সঙ্গে ঘটার সুযােগ বেশি। সুতরাং ভুট্টোর শরণাপন্ন হতে ইয়াহিয়ার হাতে যে চার সপ্তাহ সময় আছে তা আমাদের কাজে লাগানাে উচিত।
সিসকো আমি বলেছি তাদের ব্যবহার করা যেতে পারে। ক্ষমতা যদি ভুট্টোর কাছে হস্তান্তর করা হয়, তাহলে উপমহাদেশে আমরা আরাে যুদ্ধ পাব। ভারতীয়রা বিরাট মওকা পাবে। তারা একভাবে না হােক অন্যভাবে পূর্ব পাকিস্তানকে পাবেই। আমরা জড়িয়ে পড়তে চাই না এবং আমি মনে করি না যে, রাশান কিংবা চীনারা এই বিরােধে জড়িয়ে পড়বে। কিন্তু এই এলাকায় আমরা কোনাে একটি শক্তির আধিপত্য দেখতে চাই না এবং পাকিস্তানের পরাজয় ঘটলে তা সােভিয়েত অবস্থানকে নিশ্চিয়ই শক্তিশালী করবে। | কিসিঞ্জার আপনি বলছেন রাজনৈতিক সমঝােতার জন্য ইয়াহিয়াকে ব্যবহার করার সুযােগ এখনাে অবশিষ্ট রয়েছে। কিন্তু আমরা এটা তাে জানি, কোনাে সমঝােতাই টিকবে না। কারণ যা কিছুই ঘটুক না কেন, মুজিব বিচ্ছিন্নতার দিকেই যাবেন। আমরা পাকিস্তানিদের বলছি, একটা রাজনৈতিক সমঝােতা করে নিন। এর পর আমরা ভারতীয়দের বলেছি কেন যুদ্ধে যাচ্ছেন? আপনাদের স্বার্থসিদ্ধি তাে হয়েই যাচ্ছে। এ অবস্থায় ইয়াহিয়া বলতে পারেন, যখন আমরা পূর্ব পাকিস্তানকে হারাতেই যাচ্ছি তখন আমি কেন? দায়িত্বটা ভুট্টোর ঘাড়েই চাপুক।
সিসকো আমার মনে হয় না এর মধ্যে ফারাক বলতে কিছু আছে। আমরা যদি সরেও দাঁড়াই, শান্তিপূর্ণ পথে নয়, পরিস্থিতির পরিণতি ঘটবে সামরিক পন্থার মধ্য দিয়ে।
| কিসিঞ্জার এটা কল্পনাপ্রসূত। প্রত্যেকেই শান্তিপূর্ণ পথের কথা বলছে। কিন্তু আপনি কি আন্তরিকভাবে বিশ্বাস করেন যে ভারতকে সামরিকভাবে নিবৃত্ত করার আদৌ কোনাে পথ খােলা আছে? পরিস্থিতি যদি উল্টে যায়, পাকিস্তানি সৈন্যরা ভারতের দিকে যাত্রা শুরু করে, তাহলে নিউইয়র্ক টাইমস, ওয়াশিংটন পােস্ট এবং সিনেট ফরেন রিলেশন কমিটি গণ আত্মহত্যা নিশ্চিত করবে। শুধু তা-ই নয়, ওয়াশিংটন অভিমুখে মার্চও শুরু হবে। যখন আপনি বলেন, আমাদের একটি শান্তিপূর্ণ সুরাহার জন্য কাজ করা উচিত, তখন কি এতে ভারত যা চাইছে, প্রকারন্তরে তা তার হাতে তুলে দেয়ার কথাই আমরা বলছি না? তবে আর যাই হােক, এ কথা যেন। বলবেন না, আমাদের শান্তি অথবা যুদ্ধ বেছে নিতে হবে।
সিসকো কিন্তু ভারত তাে অনেক এগিয়ে। তারা পাকিস্তানের চেয়ে শক্তিশালী। সুতরাং আমার পছন্দ করা না করায় কিছু আসে যায় না।
কিসিঞ্জার তাহলে আপনি আমাদের কী করা উচিত, তা বলুন। সিসকো এই মহুর্তে আমাদের কিছুই করা উচিত নয়।
কিসিঞ্জার প্রেসিডেন্ট, পররাষ্ট্রমন্ত্রী এবং আমি ভারতীয়দের জানিয়ে দিয়েছি, তারা যদি যুদ্ধ শুরু করে তাহলে তার পরিণাম ভােগ করতে হবে।
প্যাকার্ড : কিন্তু আমরা করতেটা কী পারি? আমরা ভারতের ওপর কার্যকর প্রভাব খাটাতে পারি, এমন তাে কিছুই দেখছি না।
কিসিঞ্জার আমরা সাহায্য বন্ধ করে দিতে পারি। আমরা কূটনৈতিকভাবে অগ্রসর হতে পারি।
প্যাকার্ড উত্তম। তা-ই করা উচিত। কিন্তু তাদের সাফল্যের সম্ভাবনা কতটুকু, আমরা তা জানি না। একটি বিকল্প হতে পারে, আমরা পাকিস্তানিদের মদদ দিতে পারি। কিন্তু সেক্ষেত্রে সাফল্যের সম্ভাবনা খতিয়ে দেখতে হবে। একই সঙ্গে নিরূপণ করতে হবে ব্যর্থতার মূল্যও।
কিসিঞ্জার পাকিস্তানিদের সমর্থন দিতেই হবে এমনটা কিন্তু নয়। ইয়াহিয়াকে। এটা বলা মারাত্মক হবে না যে, পূর্ব পাকিস্তানে একটি রাজনৈতিক সমাধানের উপায় খুঁজতে তাকে চার সপ্তাহ সময় দেয়া হলাে। ভারত কী করছে, তা-ও আমাদের দেখতে হবে। তারা পূর্ব পাকিস্তানের বিরুদ্ধে আক্রমণ না চালিয়ে ভিন্ন কিছু অর্জনের ফন্দি।
আঁটছে। তারা চাইছে, পশ্চিম পাকিস্তানেও যেন তারা তালগােল পাকিয়ে ফেলে সিসকো আমি একমত।
কিসিঞ্জার আমরা কিন্তু এখনাে চীনের উল্লেখ করিনি। এই প্রথম আমরা এমন একটা ঘটনা মােকাবেলা করছি, যেখানে চীন জড়িত। যুক্তরাষ্ট্র যদি কোনাে পদক্ষেপ নেয় সেক্ষেত্রে প্রভাবটা কী হবে? আপনি বলছেন, (সিসকোর প্রতি) আমাদের। রয়েছে দুটো বিকল্প । হাত-পা গুটিয়ে বসে থাকা অথবা মুজিবকে মুক্তি দিতে। ইয়াহিয়াকে চাপ দেয়া। সিসকো না। ভারতকে ব্যবহারের ক্ষেত্রে আমাদের হাতে এখনাে একটি ভারী। কামান রয়েছে।
সূত্র: ১৯৭১ আমেরিকার গোপন দলিল – মিজানুর রহমান খান – সময় প্রকাশন