মুজিব নয়, ইন্দিরার কাছেই তালা-চাবি : ইয়াহিয়া
১৯ নভেম্বর, ১৯৭১ নিক্সনের জন্য প্রস্তুত এক স্মারকে উল্লেখ করা হয়, ভারতে নিযুক্ত মার্কিন রাষ্ট্রদূত কেনেথ কিটিং জানিয়েছেন, মিসেস গান্ধী যুক্তরাষ্ট্র সফর শেষে দেশে ফিরে রাজনৈতিক তাপমাত্রা অন্তত অল্প সময়ের জন্য হলেও কিছুটা কমাতে চাইছেন বলেই অধিকাংশ পর্যবেক্ষকের ধারণা। মনে হচ্ছে তিনি ভারতীয় জনগণ এবং বিশ্ববাসীকে এই মুহূর্তে এ ধারণা দিতে চান যে, তিনি একটা অনির্দিষ্ট সময়সীমা পর্যন্ত আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়কে এই সময় দিতে চান যে, তারা আওয়ামী লীগের সঙ্গে ইয়াহিয়াকে আলােচনায় আনতে সক্ষম হন কি না। এটা দেখেই তিনি পরবর্তী নীতি-নির্ধারণী সিদ্ধান্ত নিতে চান। তবে তার আগে সীমান্ত থেকে ভারতীয় সৈন্য প্রত্যাহার করে পাকিস্তানের ওপর থেকে তিনি চাপ হ্রাস কিংবা গেরিলাদের সমর্থন প্রদান করা থেকে নিবৃত্ত হতে নারাজ। ভারতীয় এবং বিদেশী পর্যবেক্ষকরা ক্রমাগতভাবে এই মন্তব্য। করে চলেছেন যে, যুক্তরাষ্ট্র সফরের পরে দৃশ্যত ইন্দিরার মনােভঙ্গিতে একটা পরিবর্তনের ছোঁয়া লক্ষ্য করা যাচ্ছে। পুরাে দেশে যে মনােভাব তা থেকে তার অবস্থান কিছুটা হলেও ভিন্ন । এবং তিনি একটি বড় ধরনের যুদ্ধ এড়িয়ে যেতে চাইছেন বলেও প্রতীয়মান হচ্ছে। দৃশ্যপটের এটুকু হচ্ছে ইতিবাচক দিক। তবে আমাদের গােয়েন্দা তথ্য হচ্ছে পূর্ব পাকিস্তানের সামরিক হস্তক্ষেপের জন্য ভারতীয় পরিকল্পনা অব্যাহত রয়েছে। মুক্তিযােদ্ধাদের প্রতি ভারতের সমর্থন আরাে বেপরােয়া। পূর্ব পাকিস্তানের সমগ্র সীমান্ত জুড়ে এটা লক্ষ্য করা যাচ্ছে। এটা উল্লেখ করা দরকার যে, যুক্তরাষ্ট্র সরকারের কতিপয় পর্যবেক্ষক বিশ্বাস করেন, ভারতীয় সৈন্য এবং মুক্তিবাহিনী সংঘাতকে এমন চরমে পৌঁছে দিচ্ছে যে, পাকিস্তান যাতে পাল্টা ব্যবস্থা নিতে বাধ্য হয়। আর তার পরিণতিতে একটি পূর্ণাঙ্গ যুদ্ধ অবশ্যম্ভাবী হয়ে ওঠে।
১৯ নভেম্বরেই ইসলামাবাদ থেকে হেনরি কিসিঞ্জারের কাছে একটি ব্যাক চ্যানেল বার্তা প্রেরণ করেন পাকিস্তানে নিযুক্ত মার্কিন রাষ্ট্রদূত ফারল্যান্ড। এতে উল্লেখ করা হয়, ইয়াহিয়া একটি রাজনৈতিক সমাধানের উদ্দেশ্যে দারুণভাবে উদগ্রীব। তিনি মনে করেন, তার কাছে একটি ভায়াবেল পরিকল্পনা রয়েছে। তবে তিনি মুজিব মনােনীত প্রতিনিধির সঙ্গে সংলাপে আগ্রহী নন বলেই জানিয়ে দিয়েছেন।
২০ নভের, ১৯৭১
কিসিঞ্জার নিক্সনকে দেয়া এক স্মারকলিপিতে উল্লেখ করেন, ইয়াহিয়া ফারল্যান্ডের কাছে নিম্নোক্ত মনােভাব প্রকাশ করেছেন, উত্তেজনা যা প্রতিদিনই ব্যাপকতা পাচ্ছে, তা প্রশমনে যুক্তরাষ্ট্রের উদ্যোগে তিনি সন্তোষ প্রকাশ করেন। তবে ইয়াহিয়া বলেছেন, রাজনৈতিক সমঝােতার জন্য মুজিব মুখ্য ব্যক্তি নন। বরং তালা এবং চাবি দুটোই রয়েছে ইন্দিরার কাছে। মুজিব মনােনীত ব্যক্তির সঙ্গে সংলাপে তিনি তার অনাগ্রহ ব্যক্ত করে বলেছেন, আগে যা উল্লেখ করেছেন সেই সব শর্তের আওতায় বাংলাদেশ প্রতিনিধিদের সঙ্গে বৈঠকে বসতে পারলে তিনি খুশি হবেন। মধ্য ডিসেম্বরে একটি সংবিধান প্রণয়নে তিনি তার ইচ্ছার কথা ব্যক্ত করেন ২৭ ডিসেম্বরে ন্যাশনাল এসেম্বলি ডেকে তার কয়েক সপ্তাহ পর ক্ষমতা হস্তান্তর করবেন। সেই নতুন বেসামরিক সরকার যদি তাদের মনে চায় তা হলে মুজিব ও বাংলাদেশের সঙ্গে সমঝােতা করবেন। যদি একান্তই দায় না ঠেকেন তাহলে তিনি যুদ্ধ এড়াতে চান এবং বলেন, তিনি যুদ্ধ শুরু করবেন না। এছাড়া উদ্বাস্তু প্রত্যাবাসনে সম্পূর্ণ দায়িত্ব তিনি জাতিসংঘের কাছে হস্তান্তরের আগ্রহ ব্যক্ত কক্লেন। তবে ফারল্যান্ডের বর্ণনায় ইয়াহিয়াকে তিনি এই প্রথম উত্তেজিত হতে দেখলেন।
২২ নভেম্বর, ১৯৭১ ওয়াশিংটন স্পেশাল অ্যাকশন গ্রুপের বৈঠকে সিআইএ’র প্রতিনিধি জেনারেল কুশম্যান তথ্য দেন, পাকিস্তান থেকে প্রাপ্ত খবরে ইঙ্গিত দেয়া হয়েছে, পূর্ব পাকিস্তানের যশোের সীমান্তে ভারতীয় বাহিনী এক বিশাল আক্রমণ পরিচালনা করেছে। এ আক্রমণে দুই ডিভিশন পদাতিক সৈন্য অংশ নেয়। সিআইএ’র মূল্যায়ন হচ্ছে, এই খবর যদি অতিরঞ্জিতও হয়ে থাকে তাহলেও এটা ধরে নিতে হবে, পূর্ব পাকিস্তানে ভারতীয় অনুপ্রবেশের মাত্রা দৃশ্যত বৃদ্ধি পেয়ে চলেছে। প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়া একটি যুদ্ধে জড়িয়ে পড়তে চান না। কারণ তিনি জানেন পাকিস্তান সম্ভবত হেরে যাবে। কিন্তু কুশম্যান মন্তব্য করেন, তবে ইয়াহিয়া শিগগিরই হয়তাে সিদ্ধান্তে পৌঁছতে পারেন যে, যুদ্ধ ছাড়া তার সামনে আর কোনাে বিকল্প নেই। এ মন্তব্য শুনে কিসিঞ্জার স্টেট ডিপার্টমেন্টের আরউইনের কাছে প্রশ্ন রাখেন- আপনার কী মত? তিনি উত্তর দেনআমাদের মনে হয়, পাকিস্তানিরা সম্ভবত পরিস্থিতিতে ওভার প্লে এবং ভারতীয়রা আভার প্লে করছে। আমাদের ধারণা, ভারতীয় নিয়মিত সৈন্যদের বর্ধিত অংশগ্রহণ অধিকতর অনুকূল রাজনৈতিক সমঝোতার জন্য ইয়াহিয়ার ওপর চাপ সৃষ্টি করার লক্ষ্যে পরিচালনা করা হয়েছে। অথবা ভারতের ওপর একটি পাকিস্তানি আক্রমণ উল্টে দেয়া হচ্ছে। যাতে পাকিস্তান এ ফাঁদে পা দিয়ে বিশ্বের চোখে আরেক দফা নাস্তানাবুদ হতে পারে। আমাদের বিশ্বাস, দ্বিতীয় সম্ভাবনার চেয়ে প্রথমটিই হয়তাে ভারতীয়দের ভাবনায় থাকবে। আমরা এ পর্যায়ে দুটো দিকে যেতে পারি। প্রথমত, ফারল্যান্ডের সঙ্গে ইয়াহিয়ার সর্বশেষ আলােচনার পরিপ্রেক্ষিতে আমরা গ্রসর হতে পারি। তবে সেক্ষেত্রে মুজিব প্রসঙ্গে ইয়াহিয়ার দৃষ্টিভঙ্গি হতাশাব্যঞ্জক বটে। দ্বিতীয়ত, আমরা যেতে পারি জাতিসংঘে।
কিসিঞ্জার : কারণ ইয়াহিয়া আক্রান্ত। এখন আপনি ইয়াহিয়ার ওপর চাপ সৃষ্টি করবেন? আরউইন না। জাতিসংঘে যেতে চাই- ভারতের ওপর চাপ সৃষ্টি করতে। আমার মনে হয়, মুজিব সম্পর্কে আমরাও আবার ইয়াহিয়ার সঙ্গে আলােচনায় বসতে পারি। কিসিঞ্জার : কিন্তু আমরা যদি সে ধরনের উদ্যোগ নিই এবং ইয়াহিয়া মুজিবের সঙ্গে আলােচনায় অনাগ্রহী থাকেন, তাহলে ইয়াহিয়াকে আমরা একটা ভুল জায়গায় নিয়ে যেতে ভূমিকা রাখব। তবে এসব কিছু প্রেসিডেন্টের বিবেচনার জন্য ছেড়ে দেয়াই উচিত হবে। |আরউইন : আসলে আমি কিন্তু সর্বশেষ বৈঠকের আলােচনার সূত্রেই এ কথাটা বলেছি।
কিসিঞ্জার : আপনি কী ভাবছেন প্যাকার্ড (প্রতিরক্ষা দফতরের প্রতিনিধি)? প্যাকার্ড : কী ঘটছে তা তাে বুঝতেই পারছি না। সর্বাগ্রে আমাদের তথ্য জানা দরকার। আরউইন যুদ্ধ এড়াতে হলে একটি পথ খােলা। কোনাে না কোনােভাবে রাজনৈতিক আপােস। কিসিঞ্জার সেটা ঠিকই আছে। যদি আমরা ধরে নিই যে, ভারতীয়দের কাজ আমরা সম্পন্ন করতে চাইছি। আরউইন : আমি কিন্তু মনে করি না যে, সেটা করার মাধ্যমে ভারতীয়দের কাজ করে দেয়া হবে। এটা যুদ্ধ এড়ানাের একটি উপায়। | কিসিঞ্জার : হ্যা। আমরা আসলে ধাপে ধাপে এমন একটা পথের দিকে এগিয়ে চলেছি যে পথে না যেতে প্রেসিডেন্ট অনেক আগেই তার অনাগ্রহ ব্যক্ত করেছেন। আপনি সর্বশেষ পদক্ষেপটি ব্যবহার করতে পারেন না। যে পদক্ষেপ প্রেসিডেন্ট শুধুই গা-ছাড়া মনােভাব নিয়ে গ্রহণ করেছেন। উপরন্তু আমরা যাকে শেষ পদক্ষেপ হিসেবে গণ্য করেছি তা ভ্রান্ত। আমরা ধরে নিয়েছিলাম ইয়াহিয়া আমাদের কাছে সুপারিশ চেয়েছেন। তিনি রাজনৈতিকভাবে কী করতে পারেন, তা তিনি জানতে চেয়েছেন। কিন্তু আমি যদি ফারল্যান্ডের বার্তা বুঝতে পারি তা হলে এটাই স্পষ্ট যে, এটা ভুল। আপনার কী ধারণা, টম (জয়েন্ট চিফ অব স্টাফের এডমিরাল মুরারের দিকে তাকিয়ে)?
মুরার : আমরা সর্বত্র বার্তা পাঠিয়ে দিয়েছি। কী ঘটে চলেছে, আমরা তা জানতে চেয়েছি। এটা নিয়ে কোনাে প্রশ্নই নেই যে, ভারতের শ্রেষ্ঠত্ব সব ক্ষেত্রে স্পষ্ট। উদাহরণস্বরূপ পূর্ব পাকিস্তান সীমান্তে ভারতের ১৫৭টি এয়ারক্রাফটের বিপরীতে পাকিস্তানের রয়েছে ১৮টি। ভারতীয়রা পশ্চিম সীমান্তজুড়ে সেনা মােতায়েন করেছে এবং তাদের যাতে অধিকতর দক্ষতার সঙ্গে নিয়ন্ত্রণ করতে পারে তাই তাদের তিনটি সেক্টরে পুনর্গঠিত করেছে। এ নিয়ে কোনাে প্রশ্ন নেই যে, একটি সংঘাত ঘটতে চলেছে। আমি ব্যক্তিগতভাবে মনে করি, ভারত পাকিস্তানিদের পশ্চিম সীমান্তে ব্যস্ত রাখতে উস্কানি দেয়ার চেষ্টা করছে। জ্বালানি ও রসদের ব্যাপারে আমার কাছে এমন কিছু তথ্য রয়েছে যা কৌতূহলােদ্দীপক বলে মনে হতে পারে। ভারতীয়দের কাছে ৩০ দিনের মতাে যুদ্ধ করার জ্বালানি, হালকা অস্ত্র, গােলাবারুদ রয়েছে। স্থানীয়ভাবে তৈরি কার্তুজের সরবরাহ তাদের নিয়ন্ত্রণে। উপরন্তু তাদের কাছে রয়েছে অতিরিক্ত ৯০ দিনের জ্বালানি মজুদ। তবে এটা আসতে হবে ইরান হয়ে এবং যুদ্ধ অবস্থায় এটা বাধাগ্রস্ত হতে পারে। পাকিস্তানের রয়েছে ৭০ দিনের জ্বালানি মজুদ। কিন্তু এর চারপঞ্চমাংশ রয়েছে করাচিতে। সুতরাং একক আক্রমণের ক্ষেত্রে তাদের এ অবস্থা নাজুক বটে। পশ্চিমে পাকিস্তানের ৩৪ দিনের বিমান জ্বালানি রয়েছে এবং বাস্তবে পূর্ব পাকিস্তানের আকাশে তাদের কোনাে অবস্থান নেই। আমি মনে করি সর্বাগ্রে আমাদের। তথ্য পেতে হবে।
সিসকো : সংঘাতের ব্যাপকতা এড়াতে হলে জাতিসংঘের মাধ্যমে একটা সংলাপ। পরিচালনা করতে পারলে ভালাে হয়। কিসিঞ্জার সংলাপ হবে কার সঙ্গে কার? সিসকো সেটাই একটা প্রশ্ন। ভারতীয়রা পূর্ব ও পশ্চিম পাকিস্তানের কাছে সংলাপের জন্য চাপ দেবে। অথচ তাদের যদি ‘পার্টি’ করার উদ্যোগ নেয়া হয়, তাহলে তারা তার প্রবল বিরােধিতা করবে। নিরাপত্তা পরিষদের বিবেচনার ভিত্তি হতে পারে বহিঃস্থ সম্পৃক্ততা। সে কারণেই ভারতীয় সৈন্যদের কোনাে সম্পৃক্ততার বিষয় তারা এত জোরের সঙ্গে প্রত্যাখ্যান করছে। এ কারণেই তারা বলছে যে, পূর্ব পাকিস্তানে শুধু মুক্তিবাহিনী জড়িত। কিসিঞ্জার এবং আমরা সেক্ষেত্রে ভারত ও পাকিস্তান এবং তার চেয়েও অধিক গুরুত্বপূর্ণ সােভিয়েত ও চীনের মধ্যে আটকা পড়ে যাব। আমি এটা ভালােই বুঝতে পারি, এই ভবন থেকে জাতিসংঘে স্বাধীনভাবে সিদ্ধান্ত নেয়ার প্রশ্নে কোনাে অনুমােদন পাওয়া যাবে না। কারণ আমরা কী চাই সে ব্যাপারে আমাদের কোনাে স্পষ্ট ধারণা নেই। আমাদের এমন একটি চিত্র দরকার যেখানে একটি খসড়া প্রস্তাব থাকবে এবং এ ধরনের উদ্যোগের ক্ষেত্রে সম্ভাব্য কী কী পরিস্থিতির উদ্ভব হতে পারে সে ব্যপারে। ধারণা থাকবে। একটি প্রস্তাব যদি নেয়া সম্ভব হয় তা পাকিস্তানের বিরুদ্ধে যাবে কিনা।
সূত্র: ১৯৭১ আমেরিকার গোপন দলিল – মিজানুর রহমান খান – সময় প্রকাশন