You dont have javascript enabled! Please enable it!

মুজিবের ভূমিকা নিয়ে বিবৃতি চান কিসিঞ্জার

১৫ নভেম্বর, ১৯৭১ পাকিস্তানের পররাষ্ট্র সচিব সুলতান হােসেন খান ওয়াশিংটনে হেনরি কিসিঞ্জারের সঙ্গে বৈঠকে বসেছেন। পাকিস্তানের পক্ষে পাক রাষ্ট্রদূত (ডেজিগনেটেড) আগা মােহাম্মদ রাজা ও যুক্তরাষ্ট্রের পক্ষে হেরাল্ড এইচ স্যান্ডার্স উপস্থিত। পাক পররাষ্ট্র সচিব বলেন, সােভিয়েত রাষ্ট্রদূতের কাছে জানতে চাওয়া যেতে পারে যে, সেনা প্রত্যাহারে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের প্রস্তাবে তারা কোথায় গলদ দেখতে পাচ্ছেন। উত্তরে ড. কিসিঞ্জার বলেন, তার জানা আছে যে, ভারত কী জবাব দিতে পারে। তারা বলবে, পাকিস্তান পূর্ব পাকিস্তান সীমান্ত থেকে সৈন্য প্রত্যাহার করে নিক। পররাষ্ট্র সচিব খান বলেন, সেটা কিন্তু উত্তম; ভারত যদি পূর্ব পাকিস্তান সীমান্ত থেকে তার সেনা সরিয়ে গেরিলাদের ওপর থেকে সমর্থন প্রত্যাহার করে নেয়। কিসিঞ্জার বলেন, ঠিক আছে আমি এই ইস্যুটি তুলব। তিনি এ পর্যায়ে মুজিব ইস্যুতে চলে আসেন। বলেন, পররাষ্ট্র সচিবকে। তিনি কোনােভাবে চাপ দিচ্ছেন না, কিন্তু মুজিবকে নিয়ে তাদের ভাবনাটা আসলে কী, তা তিনি যতদূর সম্ভব অনুধাবন করতে চান। কিসিঞ্জার বলেন, পররাষ্ট্র সচিবের মুখে আগের রাতে যা তিনি শুনেছেন, তা যদি ঠিকভাবে বুঝতে পারেন তাহলে ব্যাপারটি এই দাঁড়াচ্ছে যে, পাকিস্তান সরকার আগামী কয়েকমাস ধরে মুজিবের প্রতি অধিকতর নমনীয়তা প্রদর্শন করতে সক্ষম হবে। পররাষ্ট্র সচিব বলেন, প্রেসিডেন্টের কাছ থেকে দিকনির্দেশনা ব্যতিরেকে তিনি এখন শুধু এটুকু বলতে পারেন, যদি একটি বেসামরিক সরকার প্রতিষ্ঠিত হয় এবং তারা যদি লক্ষ্য করে যে তারা পূর্ব পাকিস্তানের জনগণের কাছ থেকে সহযােগিতা লাভ করতে পারছে না, তখন কিন্তু তাদের সেই সমর্থন আদায়ে উপযুক্ত পদক্ষেপ গ্রহণ করতেই হবে।

সুতরাং সেই সরকার এই ইস্যু মােকাবেলা করবেই। যদি প্রাদেশিক সরকার উল্লেখ করে, জনগণের কাছ থেকে উপযুক্ত সাড়া পাচ্ছে না তখন তারা এই প্রশ্ন কেন্দ্রীয় সরকারের কাছে পেশ করবে। তবে তিনি বলেন, এটা উল্লেখ করতে হবে যে, মুজিবের বিরুদ্ধে সশস্ত্র বাহিনীর অনুভূতি খুবই নেতিবাচক। সুতরাং মুজিব প্রশ্নে কেন্দ্রীয় সরকার সিদ্ধান্ত গ্রহণের ক্ষেত্রে যথেষ্ট সতর্কতা অবলম্বন করবে বলেই আশা করা যায় । কিসিঞ্জার বলেন, তিনি ব্যক্তিগতভাবে বিশ্বাস করেন যে, যে ধরনের দাবি পূরণ করা হউক না কেন, ভারতের। পক্ষ থেকে নতুন করে দাবি তােলা হবে। কিন্তু এটাও সত্য যে, একটা সম্পূর্ণ নেতিবাচক অবস্থার মধ্যে যাতে আমাদের না পড়তে হয় সেজন্য আমাদের একটি প্লাটফরম প্রয়ােজন। ভারতীয়রা মুজিবকে আলােচনার মুখ্য হিসেবে ধরে নিয়েছেন এই বিচেনায় যে, তিনি পরিস্থিতি অনুযায়ী কাজ করবেন। কিসিঞ্জার বলেন, আমি ব্যক্তিগতভাবে বিশ্বাস করি, মুজিবকে যদি মুক্তি দেয়া হয়, তাহলে তিনি কলকাতায় সমঝােতা প্রক্রিয়া গােগ্রাসে গিলবেন। কিন্তু এখনাে পর্যন্ত অনেকের কাছেই তিনি একটি সমাধানের জন্য সেন্ট্রাল হিসেবে গণ্য হচ্ছেন। ড. কিসিঞ্জার এ পর্যায়ে উল্লেখ করেন, তিনি প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়ার কাছ থেকে দারুণভাবে একটি বিবৃতি পেতে উদগ্রীব। এই বিবৃতিতে আগামী ছয় মাসে মুজিবের জন্য ভূমিকা নির্দিষ্ট করা থাকবে। তিনি বলেন, প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়ার অবস্থান নিয়ে তিনি মাঝে-মধ্যেই বিপাকে পড়েন। তার উদ্দেশ্যের নানা ব্যাখ্যা তাকে ব্ৰিত অবস্থায় ফেলে। সুতরাং ইয়াহিয়ার সুনির্দিষ্ট দৃষ্টিভঙ্গি সম্পর্কে তার পরিষ্কার ধারণা থাকা দরকার। পাক পররাষ্ট্র সচিবের এক প্রত্নের জবাবে কিসিঞ্জার বলেন, এটা তার জানা গুরুত্বপূর্ণ এই কারণেও যে, পরিস্থিতি যেদিকে যাচ্ছে তা কালক্রমে একটি নির্দিষ্ট প্রস্তাবে রূপ পেতে পারে। পররাষ্ট্র সচিব বলেন, পাকিস্তানের অবস্থানের বিষয়ে ভারতকে কোনাে কিছু না জানানাে কিন্তু অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। কারণ প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়াকে বিব্রত করতে তারা তা লিক করে দিতে পারে।

তিনি এ প্রসঙ্গে বাংলাদেশ নেতৃবৃন্দের সঙ্গে সাম্প্রতিক সমঝােতা নিয়ে ওয়াশিংটন পােস্টে প্রকাশিত নিবন্ধের কথা উল্লেখ করেন। আলােচনার এই পর্যায়ে প্রেসিডেন্ট নিক্সনের সঙ্গে সাক্ষাতের জন্য পাক পররাষ্ট্র সচিবকে নিয়ে যান কিসিঞ্জার। সাত-আট মিনিট পরে ফিরে আসেন। ন্যাশনাল সিকিউরিটি কাউন্সিলের স্টাফ হেরাল্ড এইচ, স্যান্ডার্স স্বাক্ষরিত এই দলিলে উল্লেখ করা হয়, তারা ফিরে এসে একমত হন যে, এই বিষয়টি প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়াকে অবহিত করা হবে। পররাষ্ট্র সচিব ইয়াহিয়ার সঙ্গে কথা বলবেন এবং মুজিবের বিষয়ে তার ব্যক্তিগত মূল্যায়ন ব্যাকচ্যানেলে কিসিঞ্জারের কাছে পাঠাবেন। কিসিঞ্জার উল্লেখ করেন, এক্ষেত্রে যদি মিলিটিরি অ্যাকশনের ঘটনা ঘটে তাহলে এই ইস্যু প্রাসঙ্গিকতা হারাতে পারে। পাক পররাষ্ট্র সচিব মুজিব সম্পর্কে কিসিঞ্জারের আগ্রহের আতিশয্য দেখে তার জানার বিষয় সম্পর্কে অত্যন্ত সতর্কতার সঙ্গে যাচাই করে নেন। বলেন, আপনি আমাদের কাছে জানতে চাইছেন, পরিস্থিতি স্থিতিশীল করতে মুজিবের ভূমিকা এবং তার ব্যক্তিত্বকে কতটা কিভাবে কাজে লাগানাে যায় এবং তা কতটা সময় পর্যন্ত? কিসিঞ্জার আলােচনার সমাপ্তি টানেন এই বলে যে, পররাষ্ট্র সচিবের জবাব পেতে দিনপাচেক অপেক্ষা করতে পারেন। কিসিঞ্জার এদিন জুলাই মাসে ইসলামাবাদে তাকে দেয়া অভ্যর্থনা এবং তার পিকিং সফরে ইয়াহিয়া দয়ালু ভূমিকার কথা স্মরণ করে কৃতজ্ঞতা জানান। ১৬ নভেম্বর, ১৯৭১ কিসিঞ্জার নিক্সনকে দেয়া এক স্মারকে উল্লেখ করেন, মারি উইলিয়ামস রিপাের্ট দিয়েছেন যে, প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়ার দুজন উল্লেখযােগ্য উপদেষ্টা নিশ্চিত করেছেন যে, ইয়াহিয়া ক্রমশ পূর্ব পাকিস্তানের ঘটনাবলি থেকে বিল্লি হয়ে পড়ছেন। বহু ক্ষেত্রেই পাক সেনাবাহিনী প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়ার কাছ থেকে নির্দেশনা ছাড়াই স্বাধীনভাবে সিদ্ধান্ত নিচ্ছে। সম্প্রতি যে নতুন বেসামরিক সরকার নিয়ােগ করা হয়েছে তা আসলে কোনাে কাজের নয়।

গভর্নরের সামরিক উপদেষ্টার দায়িত্ব পালনরত একজন মেজর জেনারেল এই সরকার পরিচালনা করছেন। ইসলামাবাদের হাতে এখন শুধুই পররাষ্ট্রনীতি রয়েছে, এর অর্থ হচ্ছে আমেরিকা সরকারিভাবে যেসব সুপারিশ ও পরামর্শ দিচ্ছে তা ইসলামাবাদ গুরুত্বের সঙ্গে গ্রহণ করে ঠিকই। তাই প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়াও তার নীতি নির্ধারণী বিবৃতিতে তার বহিঃপ্রকাশ ঘটান। কিন্তু এসবের বাস্তবায়নের ভার থাকে সেনা অধিনায়কদের হাতেই। যারা আবার বিদেশী প্রভাবের ঊর্ধ্বে। পূর্ব পাকিস্তানের বাস্তবতা হচ্ছে, বেসামরিক গর্ভনরের ছদ্মাবরণে যেসব তৎপরতা সেনাবাহিনী চালাচ্ছে, তাতে বাঙালিরা ক্রমেই বিল্লি হয়ে পড়ছে। ইসলামাবাদ সেনাবাহিনীকে নির্দেশ দিয়েছিল যে, বেসামরিক জনগােষ্ঠীর বিরুদ্ধে তারা যেন সন্ত্রাসী তৎপরতা চালানাে থেকে বিরত থাকে। এ ব্যাপারে মার্কিন কর্মকর্তাদের পুনঃপুন আস্তও করা হয়। কিন্তু পাকিস্তানি সেনা অধিনায়করা বেসামরিক লােকজন ও গ্রামে তাদের সন্ত্রাসী হামলা অব্যাহত রেখেছে। নিরীহ গ্রামবাসী একদিকে সেনাবাহিনী ও তাদের স্থানীয় মিত্র এবং অন্যদিকে গেরিলাদের চাপের মধ্যে পড়ে খাবি খাচ্ছে। পূর্ব পাকিস্তানের গ্রামাঞ্চলের আইন-শৃঙ্খলা পরিস্থিতি অব্যাহতভাবে অবনতিশীল। সামরিক বাহিনী এসেম্বলি মেম্বারদের শূন্যপদে উপনির্বাচনের জন্য পছন্দের প্রার্থী তালিকা তৈরি করছে। ৭০ ভাগের বেশি প্রার্থীকে ইতােমধ্যে বিনা প্রতিদ্বন্দ্বিতায় নির্বাচিত ঘােষণা করা হয়েছে। এছাড়া হিন্দুদের বিরুদ্ধে অভিযান আরাে জোরদার করা হয়েছে। এই পর্যবেক্ষণ ইঙ্গিত দিচ্ছে যে, পাকিস্তানের প্রতি মানি নীতি পরিবর্তনের সময় বুঝি এসে গেছে। আগস্টে নির্ধারিত আমাদের নীতিতে উল্লিখিত ছিল যে, আমরা উযন্ত প্রবাহ হ্রাসে উদ্যোগ নেব। মানবিক সহায়তা দেব, এতে আমরা সফলও হয়েছি।

উল্লেখযােগ্য দুর্ভিক্ষ ঠেকানাে সম্বব হয়েছে। নতুন করে উদ্বান্ত স্রোত তৈরি হয়নি। বর্তমান পরিস্থিতির আলােকে বলা যায়, বাঙালিদের দেশ ত্যাগের কারণ অনাহারজনিত নয়। আইন-শৃঙ্খলার পরিস্থিতি ভেঙেপড়ার কারণে তারা নিরাপত্তার অভাববােধ করছে। সে কারণে হয় তারা শহরে কিংবা ভারতে ছুটছে। প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়া বর্তমানে ভার নির্বাচনী প্রক্রিয়া নিয়ে এবং তার সেনারা আক্রমণ পরিচালনায় ব্যস্ত। এর ফলে যদি গেরিলা তৎপরতার লাগাম টানা সম্ভব না হয়, তাহলে প্রশ্ন উঠবে গেলিরাদের স্বাধীনতার দাবির পরিপ্রেক্ষিতে ইয়াহিয়ার পক্ষে আর অন্য কী রাজনৈতিক বিকল্প খােলা থাকবে? তিনি যদি তা এখনই নির্ধারণ করতে ব্যর্থ হন, তাহলে তিনি এমন এক যুদ্ধে পূর্ব পাকিস্তানকে হারাবেন যার প্রতিক্রিয়ায় পশ্চিম পাকিস্তানের অখণ্ডতাও হুমকির সম্মুখীন হবে। ১৬ নভেম্বর, ১৯৭১ প্রধানমন্ত্রী ইন্দিরা গান্ধী নিক্সনকে লেখা | চিঠিতে উল্লেখ করেন যে, গতকাল আমাদের পার্লামেন্টে শীতকালীন অধিবেশন শুরু হয়েছে। এবং আমি সেখানে একটি বিবৃতি দিয়েছি। আমি আশা করি, মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র এবং তার প্রজ্ঞা যা কিনা এখন আপনার ব্যক্তিত্বের মধ্য দিয়ে স্কুরিত হচ্ছে, তা একটি রাজনৈতিক সমাধান খুঁজে পেতে ব্যবহার করা হবে। তবে এই রাজনৈতিক সমাধান পূর্ববাংলার নির্বাচিত জনপ্রতিনিধি এবং তাদের নেতা শেখ মুজিবুর রহমানের কাছে গ্রহণযােগ্য হতে হবে।

আমার দিক থেকে আমাদের জনগণের ধৈর্য ও সংযম রক্ষায় সর্বাত্মক উদ্যোগ নেব। তবে আমি এই প্রক্রিয়ায় জাতিসংঘ নিরাপত্তা পরিষদকে সম্পৃক্ত করার উদ্যোগ জেনে কিছুটা উদ্বেগ অনুভব করছি। যতই সুবিবেচনাপ্রসূত হােক না কেন, আমি মনে করি, এই ইস্যুতে এখন জনসমক্ষে বিতর্ক শুরু হলে তা রিকন্সিলিয়েশনের প্রক্রিয়াকে চরমভাবে জটিল করবে। বহু দেশই কিন্তু এ রকমের অভিজ্ঞতা প্রত্যক্ষ করেছে। আমরা যৌথভাবে যে সমাধান চাচ্ছি তাতে এই পদক্ষেপ প্রতিবন্ধকতা তৈরি করবে। ভারতে এই ধারণাই সৃষ্টি হবে যে, এই প্রস্তাবের অংশগ্রহণকারীরা কার্যত একটি টেকসই সমাধান চান না। তারা পশ্চিম পাকিস্তানের সামরিক বাহিনীর নিপীড়নের বিরুদ্ধে পূর্ব বাংলার জনগণের বিদ্রোহকে পাশ কাটাতে চান। পশ্চিম পাকিস্তানি শাসকরা প্রথমত তাদের উন্নয়নের সুফল থেকে বঞ্চিত করেছে। এবং অতঃপর গণতান্ত্রিক অধিকারের প্রতি তাদের বৈধ আকাক্ষাকে স্তব্ধ করে দিতে চেয়েছে। আমি আশা করব, যুক্তরাষ্ট্র তার প্রভাব খাটিয়ে এ ধরনের একটি ধারণা তৈরির সুযােগ হতে দেবে না।

সূত্র:  ১৯৭১ আমেরিকার গোপন দলিল – মিজানুর রহমান খান – সময় প্রকাশন

error: Alert: Due to Copyright Issues the Content is protected !!