You dont have javascript enabled! Please enable it!

ইয়াহিয়ার মুজিব বরণে ভুট্টোর বাগড়া

১২ নভেম্বর, ১৯৭১ ওয়াশিংটন স্পেশাল অ্যাকশন গ্রুপের বৈঠকে অংশগ্রহণকারীরা দৃশ্যত দ্বিধান্বিত ছিলেন ইন্দিরা গান্ধী তার যুক্তরাষ্ট্র সফরের পরে তার অবস্থানে কোনাে মৌলিক পরিবর্তন আনেন কি না। সহকারী পররাষ্ট্রমন্ত্রী সিসকো উল্লেখ করেন, এই পরিস্থিতিকে দুটো দিক থেকে বিশ্লেষণ করা চলে। উদ্দেশ্যের দিক থেকে আমাদের এটা ধরে নিতে হবে যে, মিসেস গান্ধী পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে আনতে চান। প্রেসিডেন্ট তার ওপর সত্যিই প্রকৃত প্রভাব বিস্তার করতে সক্ষম হয়েছেন। তিনি তাকে এমন কিছু ভরসা দিয়েছেন যা তিনি চাইলে কাজে লাগাতে পারেন। কিন্তু আমার এই নিয়ে কোনাে দ্বিধা নেই যে অগ্রগতির যে কোনাে ইঙ্গিত অথবা রাজনৈতিক সমঝােতার দিক থেকে কোনাে ঘাটতি বজায় থাকলে তা কিন্তু যুদ্ধ প্রতিহত করার ক্ষেত্রে নীতি-নির্ধারণী সূচক হিসেবেই কাজ করবে।  কিসিঞ্জার তিনি যদি চান ভারত কিন্তু এ ধরনের দুর্বল অবস্থায় পাকিস্তানকে ভবিষ্যতে আর কখনাে বাগে পাবে না। আমরা তাদের সাহায্য বন্ধ করে দিয়েছি, অন্যান্য দেশও নিয়েছে একই সিদ্ধান্ত। এমনকি ভারতীয়দের সবচেয়ে মডারেট লােকটিও এই সিদ্ধান্তে পৌঁছাবেন যে, তারা এই পরিস্থিতিকে কাজে লাগিয়ে পাকিস্তান সমস্যা চিরতরে সমাধান করে নিতে পারেন; এবং তারা যদি পূর্ব পাকিস্ত নিকে ভেঙে দিতেই সক্ষম হয়, তাহলে পশ্চিম পাকিস্তান সম্ভবত ভেঙে পড়বে। মিসেস গান্ধীকে যদি আমাদের পথে চলতে গিয়ে রাজনৈতিকভাবে মাশুল দিতে হয়, তাহলে কিন্তু আমাদের তা অবশ্যই বিবেচনায় নিতে হবে। কিন্তু আমি নিশ্চিত প্রেসিডেন্ট সেভাবে ঝুঁকবেন না। আমাদের নীতি এটা নয় যে, ভারতকে উৎসাহিত অথবা ভারতের কাজ সম্পন্ন করে দেয়া। এই বিষয়ে আগামী সপ্তাহে প্রেসিডেন্ট ন্যাশনাল সিকিউরিটি কাউন্সিলের বৈঠক ডাকবেন।

আমরা ওয়াশিংটন স্পেশাল অ্যাকশন গ্রুপের এই বৈঠক ডেকেছি এজন্য যে, আপনাদের এ কথা বলার জন্য, যা ইতােমধ্যেই তিনি আপনাদের বলেছে। আমরা রাজনৈতিক মূল্যায়নকে উৎসাহিত করব। তবে আমরা ভারতের এমন স্ট্রাটেজি সমর্থন করব না, যাতে পশ্চিম পাকিস্তানের টিকে থাকা অসম্ভব হয়ে পড়ে। (সিসকোর দিকে তাকিয়ে) আপনি যখন বাংলাদেশের প্রতি আপনার মুভমেন্ট শুরু করেছেন, ভারত অনতিবিলম্বে তাদের চাহিদা বাড়িয়ে দিল। উদ্দেশ্য পরিষ্কার, পাকিস্তানিরা যাতে নির্দিষ্ট সময়সীমার মধ্যে তা পূরণে অক্ষম থাকে। ঝুকে পড়ার এই নীতি শুধুই প্রেসিডেন্টের মনে কী ছিল তা বিবেচনাপ্রসূত নয়। প্রেসিডেন্ট ভেবেছেন, ভারতকে যাতে আমরা নিরুৎসাহিত করি। ভারত যেন খুব বেশি দূরে না যায়। সোমবার অর্থাৎ৫ নভের ভারতীয় পার্লামেন্টের অধিবেশন শুরুর আগে প্রেসিডেন্ট এ ব্যাপারে কোনাে কিছুই করতে নারাজ যদি না এই কক্ষের মধ্যে প্রবলভাবে অনুভূত হয় যে, আমাদের কিছু একটা করা অবশ্যই উচিত।

সিসকো : আমি মনে করি, প্রত্যেকেই প্রত্যেকের কাছে জিজ্ঞেস করা উচিত, বেলুনটি যাতে ওপরের দিকে না উড়তে পারে সে জন্য আমাদের কী করা উচিত।

কিসিঞ্জার : ভারতীয়দের চাহিদা পূরণের চেয়ে আর কি কোনাে পথ খােলা নেই।  সিসকো : ভারত একটি দাবির ব্যাপারে স্থির। আর তা হলাে মুজিবের মুক্তি। তিনিই একমাত্র ব্যক্তি যিনি ইয়াহিয়ার সঙ্গে সমঝোতা কতে পারেন। কিসিঞ্জার : না, তারা বলতে শুরু করেছিল, ইয়াহিয়ার অবশ্যই উচিত আওয়ামী লীগ নেতৃবৃন্দের সঙ্গে কথা বলা এবং ইয়াহিয়া যেন কোনাে অবস্থাতেই মুজিবকে হত্যা করে। এরপর যখন তারা দেখল, পাকিস্তান এতে রাজি হয়েছে তখন তারা তাদের সুর পাল্টে ফেলল। আওয়াজ তুলল, ইয়াহিয়াকে অবশ্যই মুজিবের সঙ্গে কথা বলতে হবে।  সিসকো আমার ধারণা মিসেস গান্ধীকে দেয়া প্রেসিডেন্টের প্রস্তাব খুবই অর্থপূর্ণ। গান্ধী যদি বেছে নিতে চান, তাহলে এটা হবে এক মধুর আপােস।

কিসিঞ্জার : আপনার ধারণায় সে প্রস্তাবটি কী হতে পারে।

সিসকো : তিনটি বিকল্পের মধ্যে ইন্দিরাকে মনে হলাে, ইয়াহিয়া মুজিব কর্তৃক নির্দিষ্ট করে দেয়া প্রতিনিধির সঙ্গে ইয়াহিয়ার বৈঠকে বসার আগ্রহের বিষয়টি নিয়ে তিনি বেশি উৎসাহ বােধ করছে।

কিসিঞ্জার আপনার কী ধারণা, সেটাই প্রকৃত অবস্থা? সেটাই কি ভারতকে অবদমিত রাখতে যথেষ্ট? আমার অনুমান সােমবারেই আমরা এটা জেনে যাব।

ভ্যান হেলেন : এটা কিন্তু আমাদের তরফে ভারতীয় দাবি মেনে নেয়ার ক্ষেত্রে নতুন করে কোনাে চাপ সৃষ্টি নয়। কিন্তু ইয়াহিয়াকে এমন একটি ফর্মূলা দেয়া যা ভারতের আসল দাবি পূরণের পরিবর্তে কম কিছু।

সিসকো : প্রেসিডেন্ট তাে তেমন সুপারিশই রেখেছেন।

কিসিঞ্জার আমার ভুল হতে পারে, কিন্তু আমার মন বলছে, ইয়াহিয়া এই বিষয়টিকে গুরুত্বপূর্ণ প্রস্তাব হিসেবে বিবেচনা করবেন না। বরং তিনি এটাকে শেষ অস্ত্র হিসেবে দেখতে অধিকতর আগ্রহী হতে পারেন।

সিসকো : আমি একমত, অন্য দুটি বিকল্পের সঙ্গে এই বিষয়টির স্পষ্ট তফাৎ রয়েছে। তিনি শুধু ইঙ্গিত দিয়েছেন যে, তিনি এটা বিবেচনা করতে রাজি হতে পারেন। কিন্তু এটা শুধু পশ্চিম পাকিস্তানের ওপর চাপ বাড়ছে বলেই নয়, পূর্ব পাকিস্তানে বিদ্রোহ চরম রূপ নেয়ার পরিপ্রেক্ষিতেও তিনি এক্ষেত্রে তাগিদ অনুভব করছেন।

কিসিঞ্জার : আমরা এখন ও আগামী সােমবারের মধ্যে আর কী করতে পারি বলে আপনি সুপারিশ রাখতে পারেন।

সিসকো আমরা কিছুই করতে পারি না। অথবা আমরা ভারতীয় রাষ্ট্রদূত এল কে ঝাকে ডাকতে পারি এবং আবার তাদের বলতে পারি, কেন তাদের সংযম প্রদর্শন করা উচিত। আমরা উল্লেখ করতে পারি যে, ভারত সরকারের বিবেচনার জন্য আমরা। কিছু নির্দিষ্ট প্রস্তাব পেশ করেছি। এসব প্রস্তাব বিবেচনায় নিতে তারা ব্যর্থ হলে ভারতের অবস্থান স্পষ্ট হয়ে যাবে। আর সে কারণেই তাদের বক্তব্য জানতে আমরা অপেক্ষা করছি।

কিসিঞ্জার আপনার কী ধারণা, আপনি তাে এসব তাদের আগেই বলেছেন। এখন আবার বলে কী ফায়দা।  সিসকো তা ঠিকই বলেছেন, তেমন কিছু হয়তাে হবে না। কিসিঞ্জার পাকিস্তানিদের আমরা কী বলব।

সিসকো আমার মনে হয়, প্রেসিডেন্টের সঙ্গে ইন্দিরার বৈঠকের ফলাফল ইয়াহিয়াকে সরাসরি জানিয়ে দেয়া উচিত। তাকে আমাদের বলা উচিত, ভারত দৃশ্যত তৃতীয় বিকল্পের ব্যাপারে আগ্রহী। এটা জানিয়ে আমরা তাকে প্রশ্ন করতে পারি, এবার বলুন আপনি কি ভাবছেন?

কিসিঞ্জার মিসেস গান্ধী কিন্তু প্রেসিডেন্টের সঙ্গে আলােচনায় কোনাে কিছুতেই তেমন আগ্রহ দেখাননি। তিনি প্রেসিডেন্টের সঙ্গে আলােচনায় বেশিরভাগ সময় কাটিয়েছেন এটা বলতে যে, বেলুচিস্তানের কখনােই পাকিস্তানের অংশে পরিণত হওয়া উচিত হয়নি। প্রেসিডেন্ট যখন তার কাছে সেনা প্রত্যাহারের কথা জানতে চেয়েছেন তখন তিনি বলেছেন, তিনি তাকে তা পরদিন জানাবেন। অথচ শিষ্টাচারের মাথা খেয়ে তিনি এ প্রসঙ্গে আর কিছু উল্লেখই করেননি।

সিসকো : অন্যদিকে ভারতীয় রাষ্ট্রদূতকে আমরা যদি এখন আবার ডাকি তাহলে আমাদের দিক থেকে তাতে এক ধরনের হতাশার প্রতিফলন ঘটতে পারে। আমি মনে করি না যে, আমরা যদি আমাদের অবস্থান আবার পুনর্ব্যক্ত করি তাহলে আগামী ৪৮ ঘন্টায় তা এতমন কোনাে তাৎপর্য বয়ে আনবে না। তবে আমি বিশ্বাস করি যে, আলােচনার বিষয়ে ইয়াহিয়াকে অবহিত করা উচিত। আমি এটা পুনর্ব্যক্ত করতে চাই যে, রাজনৈতিক সমঝােতার দিকে যদি কোনাে অগ্রগতির সূচনা ঘটে তাহলে এটাই ভবিষ্যৎ তৈরিতে সবচেয়ে সহায়ক হবে।

কিসিঞ্জার আপনি কিন্তু এভাবে যুক্তি পেশ করতে পারেন যে, যুদ্ধ প্রতিহত করার সবচেয়ে ভালাে উপায় হচ্ছে পাকিস্তানকে অব্যাহতভাবে সামরিক সরবরাহ | দেয়া। আমরা কিন্তু গত কয়েকবছর ধরে এক্ষেত্রে ভারতকেই শ্রেষ্ঠ অবস্থানে রেখেছি।

সিসকো : কিন্তু আপনি যে বিকল্পের কথা বললেন, তার সঙ্গে আমি একমত নই। কারণ পাকিস্তানকে অস্ত্র সরবরাহ দেয়া হলে তা সােভিয়েত ইউনিয়নের সঙ্গে অস্ত্র প্রতিযােগিতায় জড়িয়ে পড়ার পরিস্থিতির সৃষ্টি করতে পারে। এমনটা হলে? | কিসিঞ্জার বড্ড দেরি হয়ে গেছে। আমরা তাে পাকিস্তানের ওপর বাড়তি চাপ সৃষ্টি করতে চাইনি। তৃতীয় বিকল্প বেছে নিয়ে ইয়াহিয়া যদি এটা করতে রাজি হন, তাহলে শুভস্য শীঘ্রম। আমরা এক্ষেত্রে সবচেয়ে ভালাে পন্থা বেছে নিতে পারি, পাক পররাষ্ট্র সচিব সুলতান খানের সঙ্গে আলােচনার মাধ্যমে। আগামী সপ্তাহে তিনি। আসছেন।

ভ্যান হােলেন সুলতান খান শুধুই একজন সিনিয়র বেসামরিক আমলা। এ ধরনের আলােচনার চ্যানেল হচ্ছে ইয়াহিয়া ও ফারল্যান্ড। আমরা যদি এখন সুলতান খানকে ব্যবহার করতে চাই তাহলে তা শুধু জটিলতাই বাড়াবে। কিসিঞ্জার। সােভিয়েতরা কি সহায়ক হতে পারে?

সিসকো : সােভিয়েতদের সঙ্গে কথা বলতে পারলে তাে খুবই ভালাে হয়। আমরা এক্ষেত্রে প্রেসিডেন্টের সঙ্গে গ্রোমিকোর আলাপ-আলােচনা স্মরণে আনতে পারি। পররাষ্ট্রমন্ত্রী এবং আপনার (কিসিঞ্জারের প্রতি) সঙ্গেও তাে আলােচনা হয়েছে। রাশানরা এই ইঙ্গিতই দিয়েছিল যে, দক্ষিণ এশিয়ায় তারা একটি বিস্ফোরণ দেখতে নারাজ। যদিও এটা নিয়ে কোনাে প্রশ্ন নেই যে, ভারতে তাদের অস্ত্র সরবরাহ বাড়ছে। আমরা এখন বলতে পারি দেখুন, পরিস্থিতির কিন্তু অবনতিই ঘটছে। আমরা তাদের জানাতে পারি, বিরাজমান সমস্যা থেকে বেরিয়ে আসতে ভারতকে আমরা যে পথ দেখিয়েছি।

কিসিঞ্জার : কিন্তু আমরা তৃতীয় বিকল্পের জন্য তাদের চাপ দেব না।  সিসকো কেউ কিন্তু আমাদের বলছে না, আমরা তৃতীয় বিকল্প এগিয়ে নেই। অথবা ইয়াহিয়ার প্রতি চাপ সৃষ্টি করি।

ভ্যান হােলেন রাজনৈতিক সমঝােতার পন্থাই একমাত্র উপায়। আমরা শুধুই তৃতীয় বিকল্পের প্রসঙ্গ তুলতে এবং তা খতিয়ে দেখতে বলতে পারি।

কিসিঞ্জার (সিসকোর প্রতি) আমি কিন্তু আপনার বার্তা অনুমােদন করেছি। (ফুটনােট : কিসিঞ্জার ১২ নভেম্বরে ইসলামাবাদে প্রেরিত টেলিগ্রামের (নং ২০৬৬৬১) উল্লেখ করেন। এতে ফারল্যান্ডকে ইয়াহিয়ার সঙ্গে বৈঠকে মিলিত হওয়ার নির্দেশ দেয়া হয়। বার্তা পৌছে দিতে বলা হয় যে, গান্ধী ওয়াশিংটন সফরকালে প্রেসিডেন্টের কাছে এ মর্মে সতর্ক সমর্থন ব্যক্ত করেন যে, সম্ভাব্য রাজনৈতিক সমাধানে ইয়াহিয়া মুজিব মনােনীত প্রতিনিধির সঙ্গে সংলাপের সূচনা ঘটাতে পারেন।)

সিসকো এ সংক্রান্ত মূল বার্তাটি ছিল খুবই জটিল। তাই আমি সংক্ষেপ করে এটুকুই উল্লেখ করেছি যে, আমরা এই মুহূর্তে ইয়াহিয়ার কাছে গিয়ে শুধু এটুকু বলতে পারি যে, ভারত তৃতীয় বিকল্পের প্রতি আগ্রহ দেখিয়েছে। সুতরাং এখন আপনার মতামত দিন। এর চেয়ে বেশি কিছু বলা ঠিক হবে বলে মনে হয় না। | কিসিঞ্জার : (সেলডেনের প্রতি) প্রতিরক্ষা দপ্তরের কী মত?

নয়েস : আমি মনস্তাত্ত্বিক প্রভাব খাটো করে দেখতে চাই না। কিন্তু পাকিস্তানে আমাদের সমরাস্ত্র সরবরাহনীতির বাস্তব প্রভাব নির্দিষ্টকরণ-যােগ্য বলে মনে হয় না। | কিসিঞ্জার : কি ভারত অস্ত্র সরবরাহ পাচ্ছে, পাকিস্তান পাচ্ছে না।

নয়েস : আমাদের দিক থেকে নিশ্চয়ই নয়। ভারত সম্ভবত চীনের কাছ থেকে অস্ত্র পাচ্ছে। সিসকো : (নয়েসের প্রতি) আপনি কি বলতে চাচ্ছেন যে, আমাদের সমরাস্ত্র সরবরাহনীতি পাকিস্তান সেনাবাহিনীকে নিষ্ক্রিয় করেনি?

নয়েস : ভারা নিয়ি নয়। কিসিঞ্জার : জেনারেল রায়ান, আপনি কী মনে করেন?

রায়ান : আমার এক্ষেত্রে কিছুই বলার নেই। তবে এটা মনে হচ্ছে যে, ভারত এই মুহূর্তে চালকের আসনে বসে আছে।

কিসিঞ্জার : যদি যুদ্ধ বাধে তাহলে আমাদের কী করা উচিত হবে? সিসকো : আগামী দুই-তিন দিনের মধ্যে অন্যান্য কিছু প্রস্তুতিমূলক পদক্ষেপ আমরা নিতে পারি। আমরা এখনাে ইয়াহিয়া ও মিসেস গান্ধীর ব্যক্তিগত বৃত্তে বিচরণ করছি। এখন আমাদের দেখতে হবে ইন্দিরা গান্ধীর ওয়াশিংটন সফর-পরবর্তী বিবৃতিতে যুদ্ধের দামামা বেজে ওঠার দিন-ক্ষণ আপ্ল হিসেবে অনুমিত হয় কি না। আমি মনে করি, আমাদের উচিত হবে জাতিসংঘের নিরাপত্তা পরিষদকে সঙ্গে নিয়ে অগ্রসর হওয়া। পরিষদের কাছ থেকে সংযমের একটা বার্তা নিশ্চিত করা যেতে পারে। আমার অবশ্য কোনাে ধারণা নেই যে, নিরাপত্তা পরিষদের এ ধরনের প্রস্তাব বাস্তবে কতটা প্রভাব ফেলতে পারে। অথবা প্রস্তাবকে বাস্তযােগ্য করা আদৌ সম্ভব কি না? আমার মনে হয়, বেলুন উপরে উঠার আগেই এই ইস্যুতে জনসমক্ষে যাওয়া আমাদের জন্য গুরুত্বপূর্ণ। যুদ্ধ শুরু হয়ে গেলে একটা যুদ্ধবিরতির প্রস্তাব নিয়ে যে কোনাে উপায়ে হোক আমাদের নিরাপত্তা পরিষদে যেতে হবে। এ কথা মনে রেখে কিছু বিষয় সম্পর্কে আগাম ধারণা নিতে চাই। আমরা একটি প্রস্তাবের খসড়া তৈরি করার কাজ শুরু করেছি। এবং নিরাপত্তা পরিষদে বিষয়টি উত্থাপনের প্রস্তুতিও নিয়ে রাখছি। এটা অবশ্যই চীনা কমিউনিস্টদের জন্য হবে প্রথম পরীক্ষা। আমি আশা করব, তারা উপকারে আসবেন। এই উদ্যোগ অবশ্যই সােভিয়েতদের জন্য উল্লেখযােগ্য অবস্থান তৈরি করবে। তারা নিরাপত্তা পরিষদে আমাদের মতাে একই বাস্তবতার মুখােমুৰি হবেন। আমার বিবেচনায় এটা একটা আগাম নিবারণমূলক ব্যবস্থা।

কিসিঞ্জার : আপনার সেই প্রস্তাবে কী বলা হবে?

সিসকো : এটা হবে খুবই সহজ। এতে পরিস্থিতির বর্ণনা থাকবে। উভয়পক্ষের প্রতি পরিস্থিতির অবনতি না ঘটাতে থাকবে সংযম প্রদর্শনের আহ্বান। আমরা

সতর্কতার সঙ্গে গুলিবর্ষণ বন্ধ করতে উভয়পক্ষের প্রতি আহ্বান জানাতে পারি। একটি যুদ্ধবিরতি অবশ্য খুবই জটিল হবে। ভারত ও পাকিস্তানের মধ্যে ইস্যু নির্ধারণ সহজ হবে। আমাদের যুক্তি থাকবে পূর্ব পাকিস্তানে যা ঘটছে তা আসলে একটি স্বাধীনতার আন্দোলন। সুতরাং আমাদের খুবই সতর্ক থাকতে হবে। কিন্তু আমার বিবেচনায় এই ইস্যু প্রকাশ্যে আনার প্রক্রিয়াটি হবে গুরুত্বপূর্ণ। এ ব্যাপারে সংশ্লিষ্টদের অবহিত রাখতে হবে। 

জেনারেল রায়ান : আমরা পাকিস্তানের কাছ থেকে এমন কী নিশ্চয়তা পেয়েছি। যে, তারা ভারতের বিরুদ্ধে সর্বাগ্রে কোনােই ব্যবস্থা নেবে না।

সিসকো : এটাই কিন্তু মস্তবড় বিপদের কথা।

কিসিঞ্জার যে কোনােভাবেই হােক, তারা যদি পূর্ব পাকিস্তানকে রাজনৈতিকভাবেই হারাবে, তাহলে তারা সেই পরাজয় কেন যুদ্ধের মাধ্যমে নিশ্চিত করবে না?

ভ্যান হেলেন : আসলে পূর্ব পাকিস্তানকে যুদ্ধের মাধ্যমেই বিসর্জন দেয়া পাকিস্ত েিনর জন্য সহজতর।

কুশম্যান পাকিস্তানিরা জানে মুক্তিযােদ্ধাদের তারা মুছে ফেলতে পারবে না। এটা করতে হলে তাদের মুক্তিযােদ্ধাদের ঘাঁটি ও সরবরাহের উৎস উচ্ছেদ করতে হবে। | কিসিঞ্জার ভারত যদি বিষয়টি নিষ্পত্তি না চায় তাহলে রাজনৈতিক ক্ষেত্রে আমরা আমাদের ইচ্ছা অনুযায়ী সিদ্ধান্ত নিতে পারি। ভারতীয়রা সেক্ষেত্রে নতুন নতুন দাবি নিয়ে আসবে। আর সেক্ষেত্রে আমরা ভারতীয়দের জন্য মধ্যস্ততাকারী হিসেবে গণ্য হব।

ভ্যান হােলেন কিন্তু এটাও সম্ভব যে, যুদ্ধের চেয়ে কম কিছুর ক্ষেত্রে আমরা ইয়াহিয়াকে সাহায্য করতে পারি।

সিসকো : ইয়াহিয়া ভাবতেই পারেন না, আমরা তাকে চাপ দিয়ে চলেছি। তিনি একজন গোঁয়ার। ফারল্যান্ডের সঙ্গে তার আলাপ-আলােচনার বৃত্তান্ত জেনে আমি বরং একটু বিস্মিত হয়েছি।

ভ্যান হােলেন : ইয়াহিয়া ফারল্যান্ডের কাছ থেকে সমস্যা সমাধানে রাজনৈতিক পরামর্শ চেয়েছিলেন। | সিসকো : আমি অবশ্য বলছি না যে, ইয়াহিয়াকে আমাদের চাপ দেয়া উচিত। আমি চেয়েছি মিসেস গান্ধীর সঙ্গে আলােচনার বিবরণ ইয়াহিয়াকে জানিয়ে দিক ফারল্যান্ড। কিসিঞ্জার আমি বুঝতে পেরেছি। আর সে কারণেই আমি আপনার বার্তা অনুমোদন করেছি।

সিসকো : আমাদের ভালাে বন্ধু ভুট্টো এখন কমিউনিস্ট চীন সফরে। গােড়াতেই গণ্ডগােল পাকানাের জন্য যারা প্রধানত দায়ী তিনি তাদের অন্যতম। মুজিবকে বরন করতে তিনিই ইয়াহিয়াকে মন্ত্রণা দেন। আর এখন কিনা তিনি বলছেন, ইয়াহিয়ার উচিত মুজিবের সঙ্গে আপােস করা। তিনি আসলে ইয়াহিয়ার অবস্থানকে জটিল করে দিয়েছেন। ভ্যান হেলেন অথবা বলতে পারেন, সম্ভবত ইয়াহিয়ার অবস্থান মসৃণ করেছেন।

সূত্র:  ১৯৭১ আমেরিকার গোপন দলিল – মিজানুর রহমান খান – সময় প্রকাশন

error: Alert: Due to Copyright Issues the Content is protected !!