You dont have javascript enabled! Please enable it!

ইন্দিরাকে নিক্সন পাকিস্তান ভাঙায় লাভ নেই

১৯৭১ সালের ৪ নভেম্বরে ইন্দিরা গান্ধী নিক্সনকে আরাে বলেন, সাম্প্রতিক ঘূর্ণিঝড়ের কারণে আমাদের আরাে বাড়তি জটিল পরিস্থিতির মােকবেলা করতে হয়েছে। উদ্বাস্তুদের ধর্মীয় স্বাতন্ত্রের সঙ্গে স্থানীয় ভারতীয়দের ধর্মীয় তফাৎ পরিস্থিতিকে নাজুক করতেই সহায়তা করেছে। ভারতীয় জনগণের ওপর উদ্বাস্তুদের বােঝা চাপিয়ে দেয়া হয়েছে। এ কারণে ভারত সরকার সম্ভাব্য সাম্প্রদায়িক দাঙ্গা ও রক্তপাত এড়াতে মরিয়া। হয়ে উঠেছে। প্রেসিডেন্ট নিক্সন এ সময় উল্লেখ করেন, উদ্বাস্তুরা যাতে দেশে ফিরে যায় সেটা যুক্তরাষ্ট্র সরকারেরও নীতি। ইন্দিরা এ সময় জাতিসংঘের পর্যবেক্ষক নিয়ােগ প্রসঙ্গে বলেন, এতে তার সরকারের আপত্তি নেই। কিন্তু মুশকিল হলাে, তারা কী ভূমিকা রাখবে সে সম্পর্কে তাদের ধারণা স্পষ্ট নয়। তিনি বলেন, বর্তমানে যে কোনাে বিদেশী পর্যবেক্ষক যে কোনাে স্থান পরিদর্শন করতে পারছেন। নিক্সন উল্লেখ করেন, যুক্তরাষ্ট্র ভারতের এই উভয় সংকট অবস্থার প্রতি সহানুভূতিশীল। শুধু যুক্তরাষ্ট্র নয়, অন্যান্য দেশও পূর্ব পাকিস্তান থেকে উদ্বাস্তু প্রবাহে সংখ্যাধিক্যে উদ্বেগ প্রকাশ করছে। নিক্সন উল্লেখ করেন, সম্ভবত বাংলাদেশের পক্ষ থেকে এমন কৌশল অবলম্বন করা হচ্ছে, যার ফলে সার্বিক পরিস্থিতির নাটকীয়তা আরাে বৃদ্ধি পাচ্ছে। উদাহরণস্বরূপ চট্টগ্রাম বন্দরে মানবিক ত্রাণ বােঝাই জাহাজ চলাচলে বাধা দানের মাধ্যমে তারা কী অর্জন করতে চায় তা উপলব্ধি করা কঠিন। এটাও ঠিক যে, এ ধরনের গেরিলা তৎপরতার জন্য যে ধরনের প্রশিক্ষণ ও আধুনিক মারণাস্ত্রের যােগান দরকার তা তাদের রয়েছে। প্রধানমন্ত্রী গান্ধী এ পর্যায়ে পুর্ব পাকিস্তানে পাক সেনাদের বর্বরতার বিবরণ দেন।

তিনি বলেন, নিষ্ঠুর নিপীড়নমূলক ব্যবস্থা সত্ত্বেও পাক সেনারা এলাকায় কোনাে নিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠা করতে পারছে না। এই অভিযােগ অব্যাহত রয়েছে যে, ভারত গেরিলা আন্দোলন উস্কে দিয়েছে এবং ধারাবাহিকভাবে সমর্থন দিয়ে চলেছে। কিন্তু আমাদের সত্য উপলব্ধি করতে হবে। আর তা হলাে পূর্ব পাকিস্তান পশ্চিমের সঙ্গে। একত্রিত থাকবে, এটা আর আশা করা বৃথা। স্বায়ত্তশাসনের জন্য চাপ সর্বব্যাপী। নিক্সন বলেন, এটা ঠিক যে, পাল্টাপাল্টি দোষারােপের ঘটনা পরিস্থিতিকে কোনাে অগ্রগতির দিকে নিয়ে যেতে বাধাগ্রস্ত করেছে। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের কোনাে উদ্যোগকে কার্যকর করার ক্ষেত্রেও এমন পরিবেশ প্রতিকূল অবস্থাই সৃষ্টি করছে। এতে কোনাে সন্দেহ নেই যে, পরিস্থিতি থেকে উত্তরণ ঘটাতে চাইলে পাকিস্তানকে শেষ পর্যন্ত অনেক কিছুই কবুল করতে হবে। প্রধানমন্ত্রী বলেন, প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়া অব্যাহতভাবে একটি পবিত্র যুদ্ধের কথা বলছেন। এটা উল্লেখ করতে হবে যে, পাকিস্তানের সীমান্তবর্তী। এলাকায় ভারতীয় সৈন্যের উপস্থিতিতে পাক-সেনাদের হামলা প্রতিরােধে ভারসাম্যমূলক ভূমিকা রাখছে। আর এ ধরনের উত্তেজনাকর পরিস্থিতির কারণেই ভারত অতিরিক্ত রক্ষাকবচ হিসেবে সােভিয়েত ইউনিয়নের সঙ্গে একটি চুক্তি সম্পাদনে প্রভাবিত হয়েছে। সােভিয়েত ইউনিয়নের কাছে ভারতের স্থিতিশীলতা একটি গুরুত্বপূর্ণ। বিষয়। আর সে কারণেই সােভিয়েত ইউনিয়ন একটি রাজনৈতিক সমাধানের জন্য চাপ দিচ্ছিল। ভারতে কিন্তু অনেকেই সােভিয়েতের সঙ্গে চুক্তির বিরােধিতা করেছিলেন।

পার্লামেন্টেও সংখ্যাগরিষ্ঠ অংশ এ নিয়ে উদ্বেগে ছিলেন। নিক্সন এ সময় প্রধানমন্ত্রীর কাছে সমাধানের সম্ভাব্য উপায় সম্পর্কে তার দৃষ্টিভঙ্গি কামনা করেন। জবাবে ইন্দিরা গান্ধী বলেন, ভারতের সবচেয়ে উদ্বেগের বিষয় হচ্ছে, পাকিস্তানের পরিস্থিতি ভারতের ওপর কতটা কী প্রভাব বিস্তার করে। নিক্সন বলেন, যুক্তরাষ্ট্রের লক্ষ্য হচ্ছে, পরিস্থিতি মােকাবেলায় পাকিস্তানকে গঠনমূলক লাইনে নিয়ে আসা। যুক্তরাষ্ট্র সরকার সর্বদায়ই ভারতীয় জনগণের প্রশংসা করে থাকে এবং তাদের উদ্বেগ অনুধাবন করতে চায়। পূর্ব পাকিস্তানে সামরিক সহায়তা দান প্রশ্নে আমরা যে, বিধিনিষেধ আরােপ করে চলেছি তা কিন্তু নিশ্চিতভাবেই ভারতের সঙ্গে আমাদের সম্পর্ক মনে রেখেই। ইন্দিরা বলেন, গুরুত্বপূর্ণ ইস্যু কিন্তু এখনাে মুজিবের ভবিষ্যৎ। কারণ তিনি স্বায়ত্তশাসনের প্রতীক। প্রেসিডেন্ট ইন্দিরা গান্ধীকে আশ্বস্ত করেন যে, যুক্তরাষ্ট্র সরকার সে কারণেই পাকিস্তানের ওপর বিরাট চাপ সৃষ্টি করে চলেছে। প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়াকে আমরা অনুরােধ করেছি তিনি যেন একতরফাভাবে ভারত সীমান্ত থেকে সৈন্য ফিরিয়ে নিয়ে আসে। তবে যুক্তরাষ্ট্র এটা যদিও মনে করে যে, ভারত তার জাতীয় স্বার্থের জন্য যা ভালাে মনে করে তা-ই করবে। তবে উত্তেজনা প্রশমনের জন্য তার পক্ষে হয়তাে কিছু পদক্ষেপ নেয়ার সুযােগ রয়েছে। পিএন হাকসার এ সময় উল্লেখ করেন যে, ভারতীয় সৈন্যদের ছড়িয়ে-ছিটিয়ে রাখা ভারতের জন্য জটিলতার সৃষ্টি করেছে। নিক্সন এ সময় বলেন, সৈন্যদের স্থানান্তরের ফলে সৃষ্ট অসুবিধা তিনি বুঝতে পারেন।

প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়া কিছু সৈন্য প্রত্যাহারে ইঙ্গিত দিয়েছেন এবং তিনি তা একতরফাভাবে করতে রাজি হয়েছেন। বাস্তবে তিনি যদি এটা করে দেখান তাহলে ভারতের পক্ষ থেকেও একইরূপ পদক্ষেপ গ্রহণ যুক্তরাষ্ট্র আশা করবে। তবে ভারতই এ ব্যাপারে তার সিদ্ধান্ত নেবে। নিক্সন ইন্দিরাকে আশ্বাস দেন যে, পরিস্থিতির উন্নয়নে যুক্তরাষ্ট সম্ভব সব। ধরনের পদক্ষেপ নেবে। যুক্তরাষ্ট্রও মানবিক ত্রাণ সহায়তা অব্যাহত রাখবে। পাকিস্তান। সরকারকে সংযম প্রদর্শনে উৎসাহিত করবে এবং সর্বোপরি একটি রাজনৈতিক সমঝােতায় পৌছতে সব পক্ষকে সংশ্লিষ্ট করতে তৎপরতা অব্যাহত রাখবে। নিক্সন এ সময়ে উল্লেখ করেন, একটি কথা আপনাকে বলে রাখি, পাকিস্তানকে দিখণ্ডিত করার মধ্য দিয়ে কিন্তু কিছুই অর্জিত হবে না। ভারত যদি যুদ্ধ শুরু করে তাহলে তার কারণ কিন্তু কিছুতেই বােধগম্য হওয়ার নয়। এক্ষেত্রে পরিস্থিতির সঙ্গে কিছুটা মিল খুঁজে। পাওয়া যায় মধ্যপ্রাচ্যের সঙ্গে। কারণ যুক্তরাষ্ট্র সরকার ইসরায়েল সরকারকে বলছে, তার সরকার যদি বৈরিতা শুরু করে তাহলে তারা তা সমর্থন করতে পারবেন না। যদিও ইসরায়েলের সঙ্গে তাদের রয়েছে দীর্ঘমেয়াদি বন্ধুত্বপূর্ণ সম্পর্ক। ভারত যদি বৈরিতা শুরুই করে তাহলে অন্যান্য পরাশক্তি কার্যত ঠিক কী ধরনের প্রতিক্রিয়া দেখায় তা এখনই আন্দাজ করা কঠিন। বৈঠক শেষে প্রেসিডেন্ট নিক্সন ভারত সরকারের বর্তমান ক্রান্তিকালে যুক্তরাষ্ট্রের সহানুভূতি ব্যক্ত করেন। এই বৈঠকের পরদিন ৫ নভেম্বর, ১৯৭১ নিক্সন ও কিসিঞ্জার হােয়াইট হাউসের ওভাল অফিসে বৈঠকে মিলিত হন।

ইন্দিরার সঙ্গে নিক্সনের আলাপ-আলােচনা সম্পর্কে কিসিঞ্জার তার মূল্যায়ন দিতে গিয়ে বলেন, আমার সংক্ষিপ্ত মূল্যায়ন হচ্ছে, যে কোনাে বিচারেই হােক ভারতীয়রা বেজন্মা। তারা সেখানে একটি যুদ্ধ শুরু করেছে… তাদের কাছে পূর্ব পাকিস্তান আর কোনাে ইস্যু নয়, আমি গতকাল শুধু দেখছিলাম, ইন্দিরা কিভাবে আপনাকে পশ্চিম পাকিস্তান প্রশ্নে নিয়ে যায়? কিসিঞ্জার অবশ্য মত দেন যে, তবে এটাও ঠিক যে, ইন্দিরার সঙ্গে আলােচনায় নিক্সন অন্তত কিছু অর্জন করতে সক্ষম হয়েছে। যেহেতু তিনি একজন বেজন্মা, তাই আমরা যা চেয়েছিলাম সেটুকু তাে পেয়েছি। এখন তিনি আর দেশে ফিরে গিয়ে বলতে সক্ষম হবেন না যে, মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র তাকে উষ্ণ সংবর্ধনা দেয়নি। আর সে কারণেই তিনি অসন্তুষ্ট হয়ে যুদ্ধযাত্রার প্রস্তুতি নেবেন। কিসিঞ্জার আরাে উল্লেখ করেন, ইন্দিরা নিজের জালে নিজে বন্দি হয়ে পড়েছেন। তিনি আশা করেছিলেন, আপনি তাকে একটা শীতল সংবর্ধনা দেবেন। আর সেটাকে তিনি অজুহাত হিসেবে কাজে লাগাতে পারবেন। বলতে পারতেন, যুক্তরাষ্ট্র তাে আমাকে পাত্তাই দিল না।

কিসিঞ্জারের এই পর্যবেক্ষণ কবুল করেন নিক্সন। বলেন, ‘আমরা ডাইনি বুড়িটাকে সত্যি পরাস্ত করতে পেরেছি।’ এ কথার পিঠে কিসিঞ্জার উল্লেখ করেন, সত্যি বলতে কী, ইন্দিরার সঙ্গে আলােচনা ফলপ্রসূ হয়েছে বটে, কিন্তু আমরা কিছুই ছাড় দেইনি। আপনি যেসব ক্ষেত্রে নরম হয়েছেন, তাতে কিছুই আসে যায় না। আপনি তাকে এক ইঞ্চিও ছেড়ে দেননি।  এই আলােচনার ২ ঘন্টা পরে নিক্সন ও ইন্দিরা সকাল ১১টা ২০ মিনিটে ওভাল অফিসে পুনরায় মুখােমুখি হন। এ সময় কিসিঞ্জার ও হাকসার উপস্থিত ছিলেন। নিক্সন। আলােচনার শুরুতেই তার আসন্ন চীন সফরের লক্ষ্য ও উদ্দেশ্য ব্যাখ্যা করেন। আলােচনা এক ঘণ্টা চলে। এ সময় বিশ্বের বহু গােলযােগপূর্ণ অঞ্চলের রাজনীতি ও কূটনীতি নিয়ে মতবিনিময় চলে। কিন্তু দক্ষিণ এশিয়ার প্রসঙ্গ এসেছিল সামান্যই। পাক-ভারত সীমান্ত থেকে ভারতীয় সৈন্য প্রত্যাহারে ইন্দিরার মনােভাব জানতে আরেক দফা চেষ্টা চলে। কিন্তু নিক্সনের সে প্রস্তাব সম্পর্কে ইন্দিরা কোনাে কথাই বলেননি।

সূত্র:  ১৯৭১ আমেরিকার গোপন দলিল – মিজানুর রহমান খান – সময় প্রকাশন

error: Alert: Due to Copyright Issues the Content is protected !!