You dont have javascript enabled! Please enable it!
ভাবতেই পারি না মুজিব মৃত কিসিঞ্জার
সিআইএ পরিচালক হেলমস
১৯৭১ সালের ২৬ মার্চ (বাংলাদেশ সময় ২৭ মার্চের প্রথম প্রহরে) ওয়াশিংটনে স্পেশাল অ্যাকশন গ্রুপের বৈঠকে তথ্য দেন যে, মুজিব স্বাধীনতার ঘােষণা দিয়েছেন এবং তাকে গ্রেফতার করা হয়েছে। ২৭ মার্চ দুপুরে ভারতের পররাষ্ট্র সচিব দিল্লিতে মার্কিন রাষ্ট্রদূত কিটিংকে তলব করেন; এবং বলেন, তিনি কিছুক্ষণ আগেই রেডিও পাকিস্তানে শুনলেন, মুজিবকে আটক করা হয়েছে। স্বাধীনবাংলা বেতার অবশ্য এই খবর অস্বীকার করে বলেছে, বর্ণিত সময়ে মুজিব বাড়িতেই ছিলেন না। ৩১ মার্চ ক্যালিফোর্নিয়ার স্যান্ট ক্লিমেন্টে সিনিয়র রিভিউ গ্রুপের বৈঠক বসে। এতে কিসিঞ্জার প্রশ্ন করেন- মুজিব কোথায়? জবাবে সিআইএর ডেভিড ব্লি বলেন, তাকে আটক করা হয়েছে। মনে করা হচ্ছে, তিনি পশ্চিম পাকিস্তানে। সম্ভবত কোয়েটায়। ৮ এপ্রিল, ১৯৭১ পাকিস্তানে নিযুক্ত মার্কিন রাষ্ট্রদূত ফারল্যান্ড স্টেট ডিপার্টমেন্টকে জানান, মুজিবকে হয়তাে পশ্চিম পাকিস্তানের আত্মক ফোটে অন্তরীণ রাখা হয়েছে।
১৩ মে, ১৯৭১
প্রধানমন্ত্রী ইন্দিরা গান্ধী প্রেসিডেন্ট নিক্সনকে লেখা চিঠিতে উল্লেখ করেন, সকল রাজনৈতিক দলসহ ভারতীয় জনগণ শেখ মুজিবুর রহমানের ব্যক্তিগত নিরাপত্তার ব্যাপারে গভীরভাবে উদ্বিগ্ন। এ ব্যাপারে পাকিস্তানি প্রেসিডেন্টের কাছে আপনার পাঠানাে যে কোনাে বার্তা আমাদের ভরসা দেবে। ২২ মে, ১৯৭১ করাচিতে মার্কিন রাষ্ট্রদূতকে ইয়াহিয়া বলেন, তিনি মনে করেন, শেখ মুজিব মহা অপরাধ করেছেন। সাংবিধানিক আদালতে তার বিচার হবে। তবে তার বিচার হবে সুষ্ঠু ও নিরপেক্ষ। রাষ্ট্রদূত উল্লেখ করেন, আমি এ পর্যায়ে বললাম, একজন আইনজীবী হিসেবে প্রেসিডেন্টের বেতার ভাষণ শুনে আমার মনে হয়েছে মুজিব ইতােমধ্যেই “প্রিজাজড’।
তাছাড়া শেখ মুজিবের প্রতি রয়েছে ব্যাপক মাত্রায় আন্তর্জাতিক সহানুভূতি। সুতরাং তাকে দণ্ড দেয়ার মতাে একটি বিষয় বিবেচনার ক্ষেত্রে পাকিস্তানের উচিত হবে, বিশ্ব জনমতকে গুরুত্ব দেয়া । আমার এ কথা শুনে ইয়াহিয়া হা-না কিছুই বললেন না। তবে তার অভিব্যক্তি যে নেতিবাচক ছিল তা-ও নয়। তিনি ইঙ্গিত দেন যে, বিষয়টি ভেবে দেখবেন। ১৪ জুন, ১৯৭১ ন্যাশনাল সিকিউরিটি কাউন্সিলের হেরাল্ড স্যান্ডার্স ও স্যামুয়েল হসকিনসন কিসিঞ্জারকে ধারণা। দেন যে, ভারতীয়রা আশা করে, পূর্ব পাকিস্তানে সরকার গঠনে ইয়াহিয়ার উচিত হবে মুজিবকে মুক্তি দেয়া। তাদের মতে, শুধু এক মুজিবকে ছেড়ে দিলে উদ্বাস্তু প্রত্যাগমনে বিদ্যুৎ গতির প্রভাব পড়বে।
২৮ জুন, ১৯৭১
পাকিস্তান সফররত মার্কিন পররাষ্ট্রমন্ত্রী। উদ্বাস্তু ও অভিবাসন-বিষয়ক বিশেষ সহকারী এল. কিলগকে ইয়াহিয়া বলেন, মিসেস গান্ধী মুজিবের সঙ্গে গােপন আঁতাতের মাধ্যমে বর্তমান সংকটের সৃষ্টি করেছেন। ৭ জুলাই, ১৯৭১ দিল্লিতে মুজিবকে বাদ দিয়ে সমাধান-সংক্রান্ত কিসিঞ্জার উত্থাপিত এক প্রশ্নের জবাব ইন্দিরা গান্ধী এড়িয়ে যান। এদিন পররাষ্ট্রমন্ত্রী শরণ সিং কিসিঞ্জারকে বলেন, ২৮ জুন মুজিবের ব্যাপারে ইয়াহিয়া যে মন্তব্য করেছেন তা পরিস্থিতির উন্নয়নে। সহায়ক নয়। মি. সিং অবশ্য পরে একান্ত বৈঠকে উল্লেখ করেন যে, মুজিবকে অন্ত ভুক্ত করেই সমঝােতায় পৌছাতে ভারতের কোনাে চাপ নেই। দিল্লি শুধু এটুকু দেখতে চায় যে, সমাধানটি বেসামরিক ও অসাম্প্রদায়িক।
এটা যেন হিন্দুবিরােধী না হয়। ১২ জুলাই, ১৯৭১ ন্যাশনাল সিকিউরিটি কাউন্সিল প্রণীত পর্যালােচনামূলক এক দলিলে উল্লেখ করা হয় যে, আমরা ইয়াহিয়াকে এটা স্পষ্ট করতে পারি যে, আওয়ামী লীগই পূর্ব পাকিস্তানের একমাত্র দল, যার জনপ্রিয় ভিত্তি রয়েছে এবং মুজিবই একটা গ্রহণযােগ্য রাজনৈতিক সমঝােতায় বাঙালিদের রাজি করাতে সক্ষম। ২৩ জুলাই, ১৯৭১ ওয়াশিংটনে সিনিয়র রিভিউ গ্রুপের বৈঠকে অ্যাসিসট্যান্ট সেক্রেটারি যােশেফ সিসকো উল্লেখ করেন যে, মুজিবের যাতে বিচার না হয়, সে ব্যাপারে আমরা কতটা কী করতে পারি তা খতিয়ে দেখা উচিত। আমি এ নিয়ে পাকিস্তানি রাষ্ট্রদূত হিলালির সঙ্গে কথা বলব। এর আগের দিন ইসলামাবাদের মার্কিন দূতাবাস এক টেলিগ্রাম। বার্তায় উল্লেখ করে যে, আমরা এ মর্মে গুজব শুনছি যে, সামরিক আইন প্রশাসন শেখ মুজিবের গােপন বিচারের তােড়জোড় চালাচ্ছে। উল্লেখ্য, এ সময়টাতে কলকাতায় মােশতাক-কাইউমের সঙ্গে মার্কিন মিশনের কথাবার্তা চলছিল। মার্কিন নথিপত্র অনুযায়ী এই আলােচনার সব পর্যায়ে উল্লেখ করা হয় যে, যে কোনাে সমঝােতায় মুজিবকে রাখতেই হবে। ১১ আগস্ট, ১৯৭১ ওয়াশিংটনে ভারতের রাষ্ট্রদূত এল কে ঝা নিক্সনকে লেখা প্রধানমন্ত্রী ইন্দিরা গান্ধীর একটি সংক্ষিপ্ত ব্যক্তিগত বার্তা পৌঁছে দেন। এতে উল্লেখ করা হয় ভারতের সরকার, জনসাধারণ, সংবাদপত্র ও পার্লামেন্ট কোনাে প্রকারের বিদেশী আইনি সহায়তা ছাড়াই শেখ মুজিবের গােপন বিচার প্রশ্নে ইয়াহিয়ার কথিত বিবৃতিতে দারুণভাবে বিচলিত বােধ করছে।
আমাদের আশঙ্কা। তথাকথিত এই বিচার শেখ মুজিবের ফাঁসির দণ্ডের প্রচারকার্যেই ব্যবহার করা হবে। এতে পূর্ববাংলার পরিস্থিতি আরাে নাজুক হবে। ভারতেও এর মারাত্মক প্রভাব পড়বে। কারণ মুজিবের প্রতি রয়েছে আমাদের জনগণ ও সকল রাজনৈতিক দলের তীব্র অনুভূতি। আমরা এই অঞ্চলের শান্তি ও স্থিতিশীলতা বৃহত্তর স্বার্থে বাস্তবসম্মত পদক্ষেপ নিতে প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়া খানের ওপর আপনার প্রভাব বিস্তারের জন্য আবেদন জানাই।’ ২২ জুলাই সৈয়দ নজরুল ইসলামও নিক্সনের কাছে এক টেলিগ্রাম বার্তায় মুজিবের বিচার প্রশ্নে হস্তক্ষেপ কামনা করা হয়। ১১ আগস্ট, ১৯৭১ নিক্সনের সভাপতিত্বে সিনিয়র রিভিউ গ্রুপের বৈঠকে সহকারী পররাষ্ট্রমন্ত্রী সিসকো অভিমত দেন যে, কোনাে নির্দিষ্ট রাজনৈতিক সমাধানে আমাদের যে কোনাে ব্লুপ্রিন্ট নেই তা জানিয়ে দিয়েও আমরা বন্ধুত্ব বজায় রাখতে পারি। তবে একটা সুপারিশ আমরা রাখতে পারি যে, পাকিস্তানিরা যেন রাষ্ট্রদ্রোহিতার দায়ে বিচারাধীন আওয়ামী লীগ নেতা মুজিবুর রহমানের মৃত্যুদণ্ড কার্যকর না করে। নিক্সন মন্তব্য করেন, আমরা সাহায্য বন্ধ করিনি। ইয়াহিয়ার সঙ্গেও রয়েছে ব্যক্তিগত সুসম্পর্ক। সুতরাং তিনি যদি পুরােপুরি ফাদে না পড়েন তাহলে এ কথাই তিনি হয়তাে সায় দেবেন। ইয়াহিয়া মনে। করেন, ফারল্যান্ড তার বন্ধু। মুজিবকে হত্যা করাে না’- এমন সুপারিশ ইয়াহিয়ার কাছে ফারল্যান্ড রাখতে পারেন। নিক্সন আরাে মন্তব্য করেন, আমাদের উচিত হবে, রাজনৈতিক সমঝোতা প্রশ্নে জনসমক্ষে নিরপেক্ষ অবস্থান বজায় রাখা। তবে ঘরােয়াভাবে আমরা প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়াকে বলতে পারি, মুজিবকে তার হত্যা করা উচিত হবে না। ১৭ আগস্ট ১৯৭১ ওয়াশিংটন স্পেশাল অ্যাকশন গ্রুপের বৈঠকে জন। এন আরউইন উল্লেখ করেন যে, মুজিবকে ফাসিতে ঝােলানাে হলে তা কিন্তু পরিস্থিতিতে বিরাট পরিবর্তন বয়ে আনতে পারে।
কিসিঞ্জার আমরা কি জানতে পারি, বিচার নিয়ে কী চলছে? অ্যাডমিরাল থমাস এইচ মুরার আশা করা হচ্ছে দুমাস লাগবে। হেলমস: অক্টোবর পর্যন্ত। আরউইন : ভারতকে আমরা সংযত থাকতে এবং ভয় দেখাতে পারি। ভারতীয়রা। যেসব কারণে অগ্রসর হতে পারে তার মধ্যে কিছু সামরিক ঘটনা, একটি দুর্ভিক্ষ অথবা মুজিবের মৃত্যুদণ্ড কার্যকর করা।
২০ আগস্ট, ১৯৭১
পাকিস্তান দূতাবাস থেকে স্টেট ডিপার্টমেন্টে প্রেরিতে টেলিগ্রামের বিষয়বস্তু ছিল শেখ মুজিবুর রহমানের বিচার। ফারল্যান্ড লিখেছেন, ‘আমার ধারণা প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়া আমার সঙ্গে একাকী কথা বলতে সাচ্ছন্দ্য বােধ। করেন। ১৯ আগস্ট, ১৯৭১ তার সঙ্গে কথা বলার এমন একটা সুযােগ এল। আমি তাকে যথেষ্ট সাবধানতার সঙ্গে বললাম- দেখুন, আমি আপনাকে এমন একটা কথা বলতে চাই যা একান্তভাবেই পাকিস্তানের অভ্যন্তরীণ বিষয়। কিন্তু আমি খুব স্পষ্টভাবেই বুঝতে পারছি যে, এই বিষয়টির সঙ্গে নিশ্চিতভাবে এবং নির্দিষ্টভাবে। কার্যত মানবিক ও অর্থনৈতিক সব ধরনের সহায়তা যার সঙ্গে আমার সরকার সম্পৃক্ত রয়েছে, তাকে প্রভাবিত করবে। এছাড়াও এর সঙ্গে উদ্বাস্তু সমস্যারও সম্পর্ক রয়েছে, যা কিনা ইতােমধ্যেই আন্তর্জাতিক চেহারা পেয়েছে। আমি ইয়াহিয়াকে বললাম, বিশ্বের সব না হলেও অধিকাংশ জাতি অধীর আগ্রহে এবং উদ্বেগের সঙ্গে শেখ মুজিবুর রহমানের গােপন বিচার প্রক্রিয়ার দিকে নজর রাখছে। আর সবাই না হলেও তাদের সংখ্যাগরিষ্ঠ অংশই কিন্তু সেই বিচারের ফলাফল সম্পর্কে একটা ধারণা পােষণ করছে। এবং তারা সে কারণে উদ্বিগ্ন।
(ফুটনােট ১১ আগস্ট পররাষ্ট্রমন্ত্রী রজার্স ওয়াশিংটনের নিযুক্ত পাক রাষ্ট্রদূত হিলালির সঙ্গে টেলিফোনে কথা বলেন। মুজিবের বিচার প্রশ্নে যুক্তরাষ্ট্রের জনগণের মধ্যে যে উদ্বেগ তা তিনি তাকে অবহিত করেন এবং আশা প্রকাশ করেন যে, এই বিচার প্রক্রিয়া বিলম্বিত হবে। হিলালি বলেছেন, তিনি পররাষ্ট্রমন্ত্রীর এই উদ্বেগ সম্পর্কে ইসলামাবাদের কাছে রিপাের্ট করবেন। এই বিষয়টি ২৪ আগস্ট নিক্সনকে দেয়া কিসিঞ্জারের এক স্মারকে উল্লেখিত হয়েছে।) ফারল্যান্ডের বর্ণনায়, আমি বিষয়টির ইতি টানলাম এই বলে যে, একজন বন্ধু হিসেবে আপনাকে এ কথাটা না জানিয়ে পারলাম না। আমার সুপারিশ হচ্ছে, শেখ মুজিবের মৃত্যুদণ্ড কার্যকর করবেন । এই ধরনের পদক্ষেপ নেয়া হলে, আমার বিশ্বাস, এটা তার সরকারের যেমন, তেমনি ব্যক্তিগতভাবে নিজের বৃহত্তর স্বার্থের পরিপন্থী হবে। প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়া বললেন, তিনি আমাকে এবং আমার সরকারের উচ্চ পর্যায়কে আশ্বস্ত করতে চান। তিনি ইঙ্গিত দেন, এ প্রসঙ্গে আমার উদ্বেগের ভিত্তি নেই। তার কথায়, মুজিবের বিচার যাতে সুষ্ঠু হয়, সেজন্য ভাবনার কারণ নেই। তিনি পাকিস্তানের যােগ্যতম আইনজীবী এ কে ব্রোহিকে মুজিবের আইনজীবী হিসেবে পেয়েছেন। মিলিটারি ট্রাইবুনালকে জানিয়ে দেয়া হয়েছে যে, মুজিবের বিচার অবশ্যই সর্বোচ্চ সতকর্তার সঙ্গে পরিচালনা করতে হবে।
কোনাে প্রকার পক্ষপাত অথবা আগাম মূল্যায়নের বশবর্তী হলে চলবে এবং রায় সম্পর্কে যে সিদ্ধান্ত পৌছানাে হােক না কেন, তার রেকর্ড অবশ্যই পূর্ণাঙ্গ ও যথাযথ হতে হবে। ইয়াহিয়া আরাে উল্লেখ করেন যে, যে অভিযােগে বিচারকার্য চলছে তাতে মৃত্যুদণ্ডের সম্ভাবনাই বেশি। তবে এ ব্যাপারে তার একটি পরিকল্পনা আছে। মুজিবের যদি মৃত্যুদণ্ড হয় তাহলে তার পক্ষে ক্ষমা প্রার্থনার একটি আবেদন জানানাে হবে। আর সেক্ষেত্রে তিনি আবেদন মঞ্জুর করবেন। ইয়াহিয়া বলেন, আমি যখন মুজিবের তরফে ক্ষমা প্রার্থনার আবেদনটি পাব তখন সিদ্ধান্ত নেব না। ভাবনাচিন্তার কথা বলে কাটিয়ে দেব কয়েক মাস। বেসামরিক সরকার ঘটনের আগ পর্যন্ত আমি এভাবেই কালক্ষেপণ করতে চাই। আর যখন মুজিবকে ক্ষমা করে দেয়ার প্রশ্নটি বেসামরিক সরকারের এজেন্ডা হবে তখন তার মৃত্যুদণ্ড লাভের তেমন কোনাে সম্ভাবনাই থাকবে না।

 আমি প্রেসিডেন্টের কথা শুনে এ প্রসঙ্গে যবনিকাপাত ঘটালাম এই বলে যে, আপনি যা বলেছেন, সেটা ভালােই। তবে এই সমস্যার সমাধানে আপনি অধিকতর বিবেচনা করবেন বলে আমি আশা করি। জবাবে ইয়াহিয়া বলেন, আমি আপনাকে আশ্বস্ত করছি যে, এ ব্যাপারে উদ্বিগ্ন হবেন না। আমি কারাে মৃত্যুদণ্ড নিশ্চিত করতে যাচ্ছি না, যদিও তিনি একজন বিশ্বাসঘাতক হয়েও থাকেন। (ফুটনােট ২১ সেপ্টেম্বর, ১৯৭১ ইয়াহিয়ার সঙ্গে মুজিবের বিচার প্রশ্নে ফারল্যান্ড আবারও কথা বললেন। ফারল্যান্ড সংবাদপত্রের রিপাের্টের বরাত দিয়ে জানতে চান যে, মুজিবের বিচার শেষ হয়েছে কি না? ট্রাইবুনাল কি ইয়াহিয়ার কাছে সুপারিশ পেশ করেছে? ইয়াহিয়া জবাব দিয়েছেন, বিচার চলছে। তবে তার ইচ্ছা রয়েছে, এই বিচারের পূর্ণ

বিবরণ তিনি জনসমক্ষে প্রকাশ করবেন, যাতে মানুষ বুঝতে পারে বিচার অবাধ ও সুষ্ঠু হয়েছে। ফারল্যান্ড জানতে চান, বিচারের পরেও পূর্ব পাকিস্তানে রাজনৈতিক সমঝােতার জন্য তিনি কি মুজিবকে তুরুপের তাস’ হিসেবে আগের মতােই গণ্য করার কথা কি বিবেচনায় রেখেছেন? ইয়াহিয়া ইঙ্গিত দেন, এই সম্ভাবনার বিষয়ে তিনি ভেবে দেখবেন। তবে তিনি এ কথা উল্লেখ করেন যে, মুজিবের বিরুদ্ধে দেশদ্রোহিতার সাক্ষ্যপ্রমাণ এতই অকাট্য যে, তাকে মুক্তি দেয়া হলে পশ্চিম পাকিস্তানে তার প্রতিক্রিয়া হতে পারে ভয়ানক।) ৩১ আগস্ট মুজিবের বিচার প্রশ্নে আরেকটি নির্দিষ্ট টেলিগ্রাম স্টেট ডিপার্টমেন্ট থেকে ভারতীয় মার্কিন দূতাবাসে প্রেরণ করা হয়।
এতে বলা হয়, ভারতীয়রা যেহেতু মুজিবের বিচার প্রশ্নে আমাদের কাছ থেকে লিখিত কোনাে উত্তর চাইতে পারে, সেক্ষেত্রে রাষ্ট্রদূত কিটিং প্রেসিডেন্টের পক্ষে পররাষ্ট্র সচিব কাউলকে একটা মৌখিক বক্তব্য জনিয়ে দিতে পারেন। রাষ্ট্রদূত এক্ষেত্রে নিম্মোক্ত নির্দেশনা অনুসরণ করবেন প্রেসিডেন্ট মিসেস গান্ধীর কাছ থেকে বার্তা গ্রহণ করেছেন এবং যত্নের সঙ্গে তা বিবেচনায় নিয়েছেন। মুজিবের বিচারপ্রশ্নে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের গভীর আগ্রহ রয়েছে। পররাষ্ট্রমন্ত্রী রজার্স মুজিবের সংক্ষিপ্ত বিচার প্রশ্নে আমাদের উদ্বেগ পাকিস্তানকে জানিয়ে দিয়েছেন। ভবিষ্যতের যে কোনাে উপযুক্ত উপলক্ষে আমরা আমাদের এই উদ্বেগ জানানাে অব্যাহত রাখতে চাই, এটা শুধু মানবিক কারণে নয়। কারণ আমরা বিশ্বাস করি যে, মুজিবের বিচার এবং তার সম্ভাব্য মৃত্যুদণ্ড দক্ষিণ এশিয়ার বৃহত্তর শান্তি ও স্থিতিশীলতার প্রশ্নে গুরুত্বপূর্ণ।’ ৮ সেপ্টেম্বর ১৯৭১ ওয়াশিংটন স্পেশাল অ্যাকশন গ্রুপের বৈঠকে কিসিঞ্জার হঠাৎ প্রসঙ্গ ঘুরিয়ে বললেন, সিনেটর কেনেডি আজ আমার সঙ্গে দেখা করেন। তার আশঙ্কা মুজিবরকে সম্ভবত ইতােমধ্যেই মেরে ফেলা হয়েছে। আপনাদের কী মনে হয় এটা। সম্ভব?
সিসকো ইয়াহিয়া রাষ্ট্রদূত ফারল্যান্ডকে নির্দিষ্টভাবে বলেছেন, মুজিবকে ফাসিতে ঝােলানাে হবে না।  হেলমস মুজিব মৃত এই গুজবের স্বপক্ষে আমাদের কাছে কোনাে তথ্য নেই।  কিসিঞ্জার আমি এটা কেনেডিকে বলেছি এবং তিনি জানতে চেয়েছেন, তার কোনাে ছবি কেন ছাপা হচ্ছে না। আমরা কি আসলেই নিশ্চিত যে মুজিব বেঁচে আছেন?
উইলিয়ামস : এটা বিশ্বাস করতে কষ্ট হয় যে, তিনি বেঁচে থাকবেন না, আর তারা একটা বিচারের কথা ঘােষণা করবে, আরাে বলবে মুজিবের জন্য খ্যাতিমান আইনজীবী নিয়োগ করা হয়েছে।
কিসিঞ্জার আমি কিন্তু কল্পনাও করতে পারি না যে, মুজিব মৃত।
উইলিয়ামস তারা আমাকে নিশ্চয়তা দিয়েছিল মুজিবের বিচার করা হবে। মৃত মুজিবের চেয়ে তাদের কাছে জীবিত মুজিবের অনেক মূল্য।
৭ অক্টোবর, ১৯৭১
স্পেশাল গ্রুপের বৈঠকে সিআইএ পরিচালক হেলমস বলেন, দেশদ্রোহিতার অভিযােগে মুজিবুর রহমানের গােপন বিচার পূর্ব পাকিস্তানকে বিক্ষুব্ধ করেছে। একটি বিশ্বস্ত সূত্র বলেছে, মুজিবকে যাবজ্জীবন কারাদণ্ড দেয়া হয়েছে। ইয়াহিয়া এই দণ্ড সমুন্নত, হ্রাস কিংবা ঝুলিয়ে রাখতে পারেন। তিনি পূর্ব পাকিস্তান প্রশ্নে আসলেই কী দৃষ্টিভঙ্গি পােষণ করেন তা এই সংক্রান্ত সিদ্ধান্তের মধ্যে দিয়ে বােঝা যাবে। জনসন মন্তব্য করেন, মুজিবুর এখনাে সমঝােতার চাবি। ইয়াহিয়া যদি তাকে মুক্তি দেন এবং তার সঙ্গেই যদি একটা আপােসে আসেন… কিসিঞ্জার তার কথা লুফে নিয়ে দ্রুত বললেন- আমি মনে করি এটা অসম্ভব। এমন কিছুর জন্য ইয়াহিয়াকে শতকরা একশ ভাগ বদলাতে হবে। গত জুলাইতে আমি তাকে যা দেখলাম!  জনসন আমি একমত, যে এটা সম্ভব নয়। কিন্তু আমরা কিছু ইঙ্গিত পেয়েছি। ভ্যান হেলেন : রাষ্ট্রদূত ফারল্যান্ড সপ্রতি ইয়াহিয়ার কাছে প্রস্তাব দিয়েছেন যে, তিনি মুজিবরের সঙ্গে একটি ডিল করবেন এবং মজার ব্যাপার হলাে এ কথা শুনে ইয়াহিয়া তার স্বাভাবিক নেতিবাচক মনােভাব দেখাননি। এটা হয়তাে ইঙ্গিতপূর্ণ যে, তারা মুজিবের সঙ্গে সমঝােতার পরিকল্পনা করছেন। তবে উপযুক্ত সাক্ষ্য প্রমাণ না পেলে এটা ভীষণভাবে অনুমাননির্ভরই থেকে যাবে। হেলমস মিসেস গান্ধী তার একটি দীর্ঘ তালিকা সােভিয়েতের কাছে হস্তান্তর করেছেন। তিনি তাদের বলেছেন, মুজিবের জন্য সহায়ক একটি উপযুক্ত উপায় খুঁজে বের করতে।

সূত্র:  ১৯৭১ আমেরিকার গোপন দলিল – মিজানুর রহমান খান – সময় প্রকাশন

error: Alert: Due to Copyright Issues the Content is protected !!