লিবারেশন ফ্রন্টে যেভাবে মস্কোপন্থি কমিউনিস্ট
৮ সেপ্টেম্বর, ১৯৭১
ওয়াশিংটনে স্পেশাল অ্যাকশন গ্রুপের বৈঠক। আরউইন এই ক্ষেত্রে আমরা ভারতীয়দের হিট করব এবং জাতিসংঘের দিকে নিয়ে যেতে চেষ্টা করব। কিসিঞ্জার ভারতীয়রা নিরঙ্কুশভাবে একটি নিষ্ঠুর খেলা খেলছে। আরউইন পূর্ব পাকিস্তানে ত্রাণ বিতরণ প্রশ্নে জাতিসংঘের নিরপেক্ষতা প্রশ্নে আমি কি একটা কথা বলতে পারি? উইলিয়ামস একটা বিষয় বুঝতে হবে, আমরা খাদ্য বােঝাই জাহাজের সঙ্গে অন্য কোনাে জাহাজের নিরাপত্তা গুলিয়ে ফেলতে পারি না। আমরা ঢাকায় এ নিয়ে আলােচনা করেছি। খাদ্যবাহী যেসব নৌকা বা কার্গো নৌপথ অতিক্রম করবে তাদের জন্য ঝুঁকি থাকবেই। হয় যে কোনাে পরিস্থিতি মােকাবিলা করে অগ্রসর হওয়ার ক্ষমতা থাকতে হবে অথবা জাতিসংঘের প্রতীক ব্যবহারে ভরসা করতে হবে। তবে জাতিসংঘের ক্ষেত্রে তারা কিন্তু সশস্ত্র প্রহরী নিয়ােগ করতে পারবে না। সে কারণেই গেরিলাদের সঙ্গে একটা চুক্তিতে পৌছা দরকার। আর সেজন্য প্রয়ােজন ভারতীয় সমর্থন। পাকিস্তানের সঙ্গেও একটা চুক্তি করতে হবে যে, এসব জাহাজে কিন্তু কোনাে অবস্থাতেই পাট বহন করা যাবে না। কিসিঞ্জার পাকিস্তান কি এতে রাজি হয়েছে? উইলিয়ামস হ্যা, ঢাকায় তারা তেমন মতই দিয়েছে। কিসিঞ্জার তাহলে এখন ভারতীয়দের সঙ্গে কথা বলা যাক।
আরউইন ১. আমরা ভারতীয় রাষ্ট্রদূতকে ডাকব, ২. ত্রাণ পরিস্থিতি নিয়ে অগ্রসর হব, ৩. (কিসিঞ্জারের প্রতি) আপনি নিশ্চিত জানবেন, এ ব্যাপারে আপনাকে অবহিত করা হবে।
কিসিঞ্জার সামরিক তৎপরতার বিরুদ্ধে আমাদের কিন্তু অবশ্যই উচিত হবে ভারতকে হুঁশিয়ার করে দেয়া। (ফুটনােট নয়েস কর্তৃক গৃহীত এই বৈঠকের বিবরণে কিসিঞ্জারের এই মন্তব্যের আগে হেলমস বলেছিলেন, অল্প কয়েক মাসের মধ্যেই। বর্ষাকাল যেহেতু শেষ হচ্ছে, তাই আমরা শুষ্ক ভূমিতে যুদ্ধ শুরুর সম্ভাবনা প্রত্যক্ষ করার দ্বারপ্রান্তে পৌঁছে যাব।)
হেলমস (সিআইএ পরিচালক) : হুঁশিয়ারি পুনর্ব্যক্ত করার এখনই ভালাে সময়।
আরউইন ডবরিনিনের (সােভিয়েত রাষ্ট্রদূত) সঙ্গে পররাষ্ট্রমন্ত্রী রজার্সের বৈঠককালে ডবরিনিন বলেছেন, তারা ভারতকে সংযত রাখার চেষ্টা করছে। কিন্তু আসলে তারা কোনাে ইতিবাচক ব্যবস্থা নিচ্ছে না। তারা জাতিসংঘে নেতিবাচক ভূমিকা রাখছে। তারা কিছুটা কাজে আসতে পারে, তবে তা হবে খুবই সীমিত।
কিসিঞ্জার : এটা নির্ভর করছে তারা সহযােগিতা না করলে ঠিক কী ধরনের মাসুল তাকে দিতে হবে এটা ধরে নেয়ার ওপর। চীনারা এমন কোনাে নীতি প্রতিষ্ঠা করতে চায় না, যাতে একটি দেশের কোনাে অংশে গণ্ডগােল সৃষ্টি হতে পারে। ভারতকে প্রতিহত করার ক্ষেত্রে চীনাভীতি কি অন্যতম ফ্যাক্টর?
হেলমস : ভারতকে প্রতিহত করার সেটাই সবকিছু।
কিসিঞ্জার তাহলে কি আমাদের তেমনভাবে তাদের উদ্বেগ প্রশমন করা ঠিক হবে? সিসকো না।
হেলমস : সেটা আমাদের গেম প্লানের অংশ হওয়া উচিত। চীন কিছু একটা করে ফেলতে পারে। এমন একটা বিস্ময়ে রাখতে হবে ভারতকে। সিসকো : আমাদের কেন এই বিষয়ে ভারতীয়দের পুনঃআশ্বাস দিতে হবে, আমি কিন্তু তার কারণ দেখি না।
আরউইন ডবরিনিন দুই সপ্তাহের মধ্যে ফিরে আসবে। তিনি না আসা পর্যন্ত আমাদের অপেক্ষা করা উচিত।
কিসিঞ্জার : সংবাদপত্র যা-ই বলুক, কিছু আসে যায় না। ভারত যদি পাকিস্তানের বিরুদ্ধে ঝাঁপিয়ে পড়ে, প্রেসিডেন্ট সেক্ষেত্রে সাহায্য বন্ধ করে দেয়ার সিদ্ধান্ত নেবেন।
সিসকো সেটা হবে তার পক্ষে একটা ন্যূনতম ব্যবস্থা। হান্না যদি একটি যুদ্ধ পরিস্থিতির উদ্রেক ঘটে, তাহলে আপত্তি উঠবে না।
সিসকো আমরা সাহায্যের কথা দিয়ে শুরু করেছিলাম। বর্তমানে ভারতের যে আচরণ তাতে আমরা এই সম্ভাবনা বাদ দিতে পারি না। ভারতীয়রা গেরিলাদের সমর্থন দিচ্ছে এবং পূর্ব পাকিস্তানের স্থিতিশীলতা ফিরিয়ে আনতে সাহায্য করছে না। ভারতে অবস্থানরত উদ্বাস্তুদের জন্য ৭০ লাখ ডলারের সাহায্য প্রদানে আমরা কি সঠিক সিদ্ধান্ত নিয়েছি? আমরা যদি অত তাড়াতাড়ি সিদ্ধান্ত না নিতাম তাহলে কি ভারতের আচরণ ভিন্ন হতাে? বর্তমান পরিস্থিতির পরিপ্রেক্ষিতে আমাদের এটা খতিয়ে দেখা উচিত।
উইলিয়ামস : ত্রাণ বণ্টন সংক্রান্ত আলােচনায় আমরা আমাদের তত্ত্ব ঝালাই করে নিতে পারি। আমরা যদি কিছুটা প্রভাব খাটাতে সক্ষম হই, তাহলে আমাদের তা-ই করা উচিত। হুমকি দিয়ে নয়, গঠনমূলক উপায়ে। সিসকো আমাদের বলা উচিত, দেখ, এখন এটাই করা প্রয়ােজন এবং তা করতে হবে একত্রে। আমরা এক্ষেত্রে শর্ত দিচ্ছি না। কিন্তু কিছু স্থিতিশীলতা সৃষ্টি করতে তুমি আমাদের সাহায্য করতে পার।
কিসিঞ্জার : ভারতীয়রা তেমন কোমল হৃদয়ের লােক নয়। ১৫ সেপ্টেম্বর, ১৯৭১ ভারত ও পূর্ব পাকিস্তানের ত্রাণ পরিস্থিতি নিয়ে আলােচনা করতে আন্ডার সেক্রেটারি আরউইন ভারতীয় রাষ্ট্রদূত ঝাকে ডেকে পাঠান। পূর্ব পাকিস্তানের সম্ভাব্য দুর্ভিক্ষ এড়াতে তারা মতবিনিময় করেন। আরউইন উল্লেখ করেন যে, উদ্বাস্তুদের ত্রাণ সরবরাহে ভারত চমকার ভূমিকা পালন করছে। যুক্তরাষ্ট্র মনে করে, এই মুহূর্তের বড় ইস্যু হচ্ছে দুর্ভিক্ষ প্রতিরােধ করা। এ ব্যাপারে যথেষ্ট কার্যকর পদক্ষেপ না নেয়া হলে এটা ঠেকানাে কঠিন হয়ে পড়বে। যদি ত্রাণ বণ্টন বিঘ্নিত হয়, দুর্ভিক্ষ দেখা দিতে পারে। সেক্ষেত্রে উদ্বাস্তু প্রবাহ আরাে তীব্র হবে। এই মুহূর্তের ভয়ঙ্করতম বিপদ হচ্ছে গেরিলা তৎপরতা। কারণ তারা ত্রাণ সহায়তায় বাধা দিচ্ছে। ভারতের পূর্ব সীমান্তের পুরাে এলাকায় গেরিলারা সবচেয়ে সক্রিয়। এই এলাকায় তারা সাফল্যের সঙ্গে রেল ব্যবস্থা বেহাল করে দিতে সক্ষম হয়েছে। নৌপথ এখনাে কিছুটা ভরসা। কিন্তু সেখানেও যদি তারা বাধা দেয় তাহলে যুক্তরাষ্ট্র যত পদক্ষেই নিক না কেন, তা সব। ভণ্ডুল হবে। আন্ডার সেক্রেটারি উল্লেখ করেন যে, পররাষ্ট্র সচিব কাউল রাষ্ট্রদূত কিটিং ও অধ্যাপক গ্যালব্রিথের সঙ্গে আলােচনায় স্বীকার করেছেন যে, পাক সেনাবাহিনী কর্তৃত্ব ব্যতিরেকে ত্রাণ সরবরাহ অব্যাহত থাকা উচিত। আমরাও বিশ্বাস করি যে, ত্রাণ থাকা উচিত যুদ্ধের বাইরে।
আমরা মনে করি, ত্রাণ তৎপরতা থেকে পাক সামরিক বাহিনীকে দূরে রাখা যাবে। একই সঙ্গে আমরা আশা করি, ত্রাণ বণ্টনে নিরপেক্ষতা বজায় রাখতে ভারত সরকারও সহায়তা দেবে। আমরা আশা করব, সত্যিকারের স্বাধীনভাবে পরিচালিত জাতিসংঘের ত্রাণ তৎপরতায় বাংলাদেশ নেতৃবৃন্দ সমর্থন দেবেন। ভারতের কাছ থেকে আমরা আশা করি, তারা যেন ত্রাণ সরবরাহে বাংলাদেশ নেতৃবৃন্দকে সম্পৃক্ত করতে চাপ প্রয়ােগ না করেন। আমরা বিশ্বাস করি যে, ভারত সরকারের কাছে বাংলাদেশ নেতৃবৃন্দের ওপর প্রভাব খাটাতে বলা সেভাবে কার্যকর নাও হতে পারে। কারণ, গেরিলা আন্দোলনের প্রতি ভারতের পূর্ণ নিয়ন্ত্রণ না-ও থাকতে পারে। আবার একইভাবে বাংলাদেশ নেতৃবৃন্দ হয়তাে তাদের নিজস্ব সামরিক বাহিনীর ওপর পূর্ণ নিয়ন্ত্রণ বজায় রাখতে পারছেন না। তার পরেও বাংলাদেশ। নেতৃবৃন্দ যদি জাতিসংঘের ত্রাণ কর্মসূচির প্রতি সমর্থন দিতে বাংলাদেশ রেডিওকে। ব্যবহার করে তাহলে তা গঠনমূলক হিসেবে বিবেচ্য হবে। এইড ডেপুটি অ্যাডমিনিস্ট্রেটর উইলিয়ামস তখন তার সাম্প্রতিক পাকিস্তান সফরের সাফল্যের বর্ণনা দেন। তিনি বলেন, পাকিস্তান সরকার জাতিসংঘের কার্যক্রম মেনে নিয়েছে। তারা এমন নিশ্চয়তা দিয়েছে যে, ত্রাণ সরবরাহ ব্যবস্থা জাতিসংঘ কর্তৃক তদারকির প্রয়ােজন আছে এবং বণ্টনের ক্ষেত্রে হিন্দু-মুসলিম বৈষম্য সৃষ্টি করা হবে না।
উইলিয়ামস উল্লেখ করেন যে, ত্রাণ বণ্টনে ৮০০ টন পর্যন্ত ধারণ ক্ষমতাসম্পন্ন ১৭টি কোস্টাল ভেসেল ও ৯টি মিনি-বাঙ্কার্স ব্যবহার করা হবে। এর নাবিকরা হবেন সবাই বিদেশী। এসব জাহাজ একান্তভাবেই ত্রাণ বিতরণে নিয়ােজিত থাকবে। কোনাে অবস্থাতেই সামরিক কিংবা শিল্পজাত পণ্য আনা-নেয়ার কাজে ব্যবহার করা হবে না। জাহাজগুলাে জাতিসংঘের প্রতীক ব্যবহার করবে। ভারতীয় রাষ্ট্রদূত ঝা উল্লেখ করেন যে, অনাহারে মৃত্যু নিয়ে ভারতের উদ্বেগ রয়েছে। তবে ত্রাণ বিতরণে যে সমীক্ষা চালানাে হয়েছে তার ফলাফল গ্রহণযােগ্য। তিনি প্রশ্ন রাখেন, ভারত সরকার এক্ষেত্রে কিভাবে সাহায্য করতে পারে। তিনি বিস্ময় প্রকাশ করেন যে, এই ইস্যুতে বাংলাদেশ নেতৃবৃন্দের সঙ্গে কথা বললে তা আদৌ কাজে আসবে কি না? তিনি উল্লেখ করেন যে, ত্রাণ কার্যক্রম অধিকতর ইতিবাচক উপায়ে প্রদর্শিত হওয়া উচিত। পূর্ব পাকিস্তানি জনগণ ধীর গতির ঘূর্ণিঝড় ত্রাণের সঙ্গে পরিচিত। ঝা বলেন, বরিশালের মতাে এলাকায় ত্রাণ বিরতণ শুরু হওয়া উচিত। কারণ, সেখানে লজিস্টিকস গুরুত্বপূর্ণ নয়। তিনি সুপারিশ রাখেন যে, সীমান্তের উভয় দিকের ত্রাণ কর্মকর্তাদের উচিত হবে বাংলাদেশ প্রতিনিধিদের সঙ্গে অনানুষ্ঠানিক যােগাযােগ রক্ষা করা। ঝা বলেন, যুক্তরাষ্ট্রের যেসব বিষয়ে উদ্বেগ তা ভারত সরকারের মাধ্যমে না গিয়ে সরাসরি বাংলাদেশ প্রতিনিধিদের কাছে পৌঁছে দেয়াই যুক্তিযুক্ত। উইলিয়ামস বলেন, পূর্ব পাকিস্তানের জাতিসংঘ মিশন বাংলাদেশ প্রতিনিধিদের সঙ্গে যােগাযােগ রক্ষা করতে পারে না।
কিন্তু জাতিসংঘ অন্য কোথাও তাদের সঙ্গে কথা বলার সুযােগ পেতে পারে। তবে যেখানেই হােক না কেন, বাংলাদেশ প্রতিনিধিদের সঙ্গে ভারত সরকারের ভালাে সম্পর্ক এবং জাতিসংঘের ত্রাণ তৎপরতায় জনগণের স্পষ্ট সমর্থন সহায়ক হতে পারে। যদিও জাতিসংঘের সরাসরি যােগাযােগের এটা বিকল্প নয়। তিনি মনে করেন, এটা নির্দিষ্টভাবে একটা সুফল বয়ে আনতে পারে। যদি বাংলাদেশ বেতার এ মর্মে ঘােষণা দেয় যে, ক্ষুধার্ত জনগণের বিরুদ্ধে যুদ্ধ নয়। ভেন হােলেন এ সময় বলেন, ভারত সরকার জনসমক্ষে যে নীতি গ্রহণ করেছে তার সঙ্গে এটি হবে সঙ্গতিপূর্ণ। ভারত এটা পুনর্ব্যক্ত করতে পারে যে, কেউ যাতে না খেয়ে মারা না যায়, তা ভারত দেখতে চায়। সে কারণেই আন্তর্জাতিক ত্রাণ তৎপরতায় ভারতের রয়েছে সমর্থন। বাংলাদেশ নেতৃবৃন্দের প্রতি ভারতের প্রভাব তুলনামূলকভাবে সবচেয়ে বেশি। সুতরাং ভারত সরকার যদি সন্তষ্ট হয় যে, জাতিসংঘের কর্মসূচি নিরপেক্ষ তাহলে তারা তাদের ওপর যেন কার্যকর প্রভাব খাটায়। ঝা এ সময় উল্লেখ করেন, মানবিক ত্রাণ তৎপরতায় অন্যান্য দেশও যদি অংশ নেয় তবে তা সহায়ক হবে। বাংলাদেশ প্রতিনিধিদের সঙ্গে তারাও যােগাযােগ স্থাপন করতে পারে। এক্ষেত্রে ভারত সরকারের জন্য রাজনৈতিকভাবে বিষয়টি সহজতর হবে। কারণ ভারত এই ক্ষেত্রে আন্তর্জাতিক কোরাশের সঙ্গে সুর মেলাতে চায়।
আন্ডার সেক্রেটারি বলেন, ভারত যা চাইবে ঠিক সেভাবে সােভিয়েত ইউনিয়ন সাড়া দেবে বলে তিনি মনে করেন। ঝা মন্তব্য করেন, জাতিসংঘ ভারত সরকারের সঙ্গে নিরাপত্তা ইস্যু নিয়ে নিউইয়র্কে কতদূর অগ্রসর হয়েছে তা তিনি জানেন না। আগামী কয়েক সপ্তাহের মধ্যে পররাষ্ট্রমন্ত্রী ও পররাষ্ট্র সচিব নিউইয়র্কে পৌঁছাবেন। তখন এ নিয়ে বিস্তারিত আলাপ হবে। ঝা উইলিয়ামসের কাছে প্রশ্ন রাখেন, বর্তমান উদ্বাস্তু প্রবাহের কারণ সম্পর্কে তার মূল্যায়ন কী? উইলিয়ামস উত্তর দেন, উদ্বাস্তু সংখ্যা নির্ধারণ নিয়ে তিনি বড়ই বিপাকে আছেন। ভারত ও পাকিস্তানের এক্ষেত্রে দাবি পরস্পর বিরােধী। দুর্ভিক্ষ উল্লেখযােগ্য ফ্যাক্টর হিসেবে আবির্ভূত হবে না বলেই প্রতীয়মান হচ্ছে। উদ্বাস্তুদের প্রথম স্রোত ছিল রাজনৈতিক। দ্বিতীয় পর্যায়ে সাম্প্রদায়িক ভীতি ও নিরাপত্তাহীনতা ফ্যাক্টর হিসেবে কাজ করেছে। মুক্তিযােদ্ধাদের তৎপরতা ও উত্তেজনার সঙ্গে উদ্বাস্তু স্রোত তৈরির সম্পর্ক রয়েছে। তিনি বলেন, ড, মালিকের নিয়ােগে আমরা উৎসাহিত বােধ করছি। কারণ, হিন্দু-মুসলমানের ব্যাপারে তার একটি মডারেট পরিচিতি রয়েছে। আন্ডার সেক্রেটারি বলেন, উইলিয়ামসের কাছে রাষ্ট্রদূতের একটি প্রশ্নের আলােকে তিনি আরেকটি ইস্যু আলােচনায় আনতে চান। আর তা হলাে গেরিলাদের প্রতি ভারতের সমর্থন। তিনি মন্তব্য করেন যে, অব্যাহত লড়াইয়ের কারণে সাম্প্রদায়িক সমস্যা বৃদ্ধি পেয়েছে এবং তার ফলে উদ্বাস্তুদের সংখ্যাও বেড়ে গেছে। বাংলাদেশ আন্দোলনের প্রতি ভারত সরকারের সমর্থন দানের বিষয়টি যুক্তরাষ্ট্র বুঝতে পারে। কিন্তু যুদ্ধই উদ্বাস্তু সমস্যার সৃষ্টি করেছে।
এর পরে গেরিলাদের যদি সমর্থন দান অব্যাহত রাখা হয়, অথবা স্বাধীন রাষ্ট্র হিসেবে বাংলাদেশকে স্বীকৃতি দেয়া হয়, তাহলে উদ্বাস্তু বিপদ আরাে ভয়ানক হবে এবং ভয়ানক রূপ নেবে রেডিকালাইজেশন বা চরমপন্থা। যুক্তরাষ্ট্র আশা করে, ভারত সরকার উত্তেজনা যাতে বৃদ্ধি না পায় সে লক্ষ্যে সম্ভব সব কিছুই করবে। ঝা বলেন, এটা যদি মনে করা হয় যে, উদ্বাস্তুদের সংখ্যা সীমিত করার লক্ষ্যে ভারত সরকার চাইলেই গেরিলা তৎপরতা নিয়ন্ত্রণ বা বন্ধ করে দিতে পারে তাহলে তা হবে ভুল। গত মার্চে বিপুলসংখ্যক পূর্ব পাকিস্তানি সৈন্য স্বপক্ষ ত্যাগ করেছে এবং তারা এখন পূর্ব পাকিস্তানে কেবল বেসামরিক প্রশাসন পেলেই সন্তুষ্ট থাকবেন না। একইভাবে, লড়াই থেমে গেলেও বিপুলসংখ্যক উদ্বাস্তু স্বদেশে ফিরতে অনিচ্ছুকই থেকে যাবে। তবে যদি প্রকৃতই কোনাে বাঙালি সরকার প্রতিষ্ঠিত হয়, সেক্ষেত্রের কথা আলাদা। ভারত সরকার এই মর্মে অঙ্গীকারবদ্ধ যে, সে যতদূর সম্ভব লড়াই এড়াতে চায় এবং পাকিস্তান সরকারের সঙ্গে কোনাে না কোনাে মাত্রায় বজায় রাখতে চায় সম্পর্ক। আলােচনা এ পর্যায়ে রূপ নেয় উদ্বাস্তুদের সংখ্যা নিরূপণে। আন্ডার সেক্রেটারি উল্লেখ করেন যে, পাকিস্তান সরকার উদ্বাস্তুর সংখ্যা ২০ লাখ দাবি করছে। কিন্তু যুক্তরাষ্ট্র সরকার ভারত সরকারের প্রদত্ত ৮০ লাখ উদ্বাস্তুর সংখ্যা ধরেই সব ধরনের পরিকল্পনা গ্রহণ করেছে। আমাদের জন্য বড়ই উপকার হবে, যদি আমরা সংখ্যা গণনায় স্বাধীন কোনাে সংস্থা বা জাতিসংঘকে সম্পৃক্ত করতে পারি।
কংগ্রেসকে সেক্ষেত্রে অধিকতর আস্থায় নেয়া সম্ভব হবে।’ ঝা জবাবে বলেন, ভারত সরকার উদ্বাস্তুদের সংখ্যা যথেষ্ট যত্নের সঙ্গে সম্পাদন করেছে। যদি এটা যাচাই করা কংগ্রেসের জন্য জরুরি হয়ে পড়ে, সেক্ষেত্রে উদ্বাস্তু সাব-কমিটির চেয়ারম্যান কার্যকর ভূমিকা রাখতে পারেন। কারণ তিনিই সম্প্রতি ভারত সফর করেছেন। ঝা বলেন, ভারত সরকার কিন্তু অর্থ সহায়তা পেতে কংগ্রেসের প্রতি আহ্বান জানাচ্ছে না। তিনি উদ্বিগ্ন যে, মার্কিন সরকার পাকিস্তানিদের প্রদত্ত পরিসংখ্যানকে অধিকতর গ্রহণযােগ্য মনে করছে। আন্ডার সেক্রেটারি এদিনের আলােচনার ইতি টানেন এই বলে যে, জাতিসংঘ কর্তৃক গণনার প্রস্তাবে ভারতের যে প্রবল আপত্তি তা তারা বিবেচনায় নিয়েছেন।
১৬ সেপ্টেম্বর, ১৯৭১
ন্যাশনাল সিকিউরিটি কাউন্সিল স্টাফ কিসিঞ্জারকে দেয়া এক স্মারকে উল্লেখ করেন, সম্প্রতি বহুদলীয় বাংলাদেশ ন্যাশনাল লিবারেশন ফ্রন্ট গঠন করা হয়েছে ভারতের তদারকিতে। এই ফ্রন্টের মধ্যে রয়েছে মস্কোপন্থি কমিউনিস্টরা। ওয়াকিবহাল সূত্রগুলাের বিশ্বাস, ভারতীয় ও সােভিয়েত চাপের কারণেই এই মস্কোপন্থি কমিউনিস্টদের লিবারেশন ফ্রন্টে অন্তর্ভুক্ত করা হয়েছে। এই উদ্যোগের ফলে অন্তত বাংলাদেশ আন্দোলনের ভিত্তি ব্যাপকতা পেয়েছে এবং অবশিষ্ট যেসব পশ্চিমাপন্থি মডারেটরা রয়েছেন, তাদের বিরুদ্ধে কট্টর বামপন্থিদের হাত শক্তিশালী হয়েছে। টি এন কাউল একইসঙ্গে প্রকাশ্যে বলেছেন, খুব শিগগিরই ভারত বাংলাদেশকে স্বীকৃতি দেবে ঘরােয়াভাবে কাউল এবং বিদেশনীতি-বিষয়ক অন্য উল্লেখযােগ্য উপদেষ্টারা ইন্দিরা গান্ধীকে বলেছেন, যুদ্ধ অনিবার্য।
সূত্র: ১৯৭১ আমেরিকার গোপন দলিল – মিজানুর রহমান খান – সময় প্রকাশন