You dont have javascript enabled! Please enable it!
ভারতের কোনাে মাস্টার প্লান ছিল না কিসিঞ্জার
২৩ জুলাই, ১৯৭১
ওয়াশিংটনে সিনিয়র রিভিউ গ্রুপের বৈঠকে স্টেট ডিপার্টমেন্টে যােশেফ সিসকো বলেন, যুদ্ধ প্রতিরােধ করতে পারা আমাদের স্বার্থের অনুকূল। তবে আমরা যদি ধরে নিই যে, ভারতীয়দের অবস্থান বদলাতে একমাত্র উপায় হচ্ছে লাঠি নিয়ে দাবড়ানাে, তাহলে তাে মুশকিল। আমি ভারতীয়দের মনস্তত্ত্ব বুঝতে পারি না। ভারতীয়দের এই ধারণা দিতে হবে যে, আমরা তাদের সাহায্যে আসতে পারি এমন কিছু একটা করছি। কিসিঞ্জার বলেন, আমি আপনার সঙ্গে একমত। সেজন্য আমাদের প্রস্তুতিও রয়েছে। কিন্তু ভারতীয়দের অবশ্যই কোনাে ভ্রান্ত ভীতির মধ্যে থাকা উচিত নয়। উদ্বাস্তু সমস্যার নিরসনে আমাদের পক্ষে সম্ভব আমরা সবকিছুই করতে চাই। কিন্তু ভারতকেও বুঝতে হবে যে, তারা কোনাে হঠকারী পদক্ষেপ নিলে তার পরিণতি কি দাঁড়াতে পারে। আরউইন বলেন, পরিস্থিতির বিচারে এ কথাটাই মুখ্য। ভারত আমাদের সন্দেহ করছে। তাদের ধারণা আমরা পাকিস্তানপন্থি। তারা চাপের বিষয়টি নিশ্চয় বুঝবে। যদি তারা বিশ্বাস করে যে, আমরা সাহায্যের জন্য সত্যিই আন্তরিক। কিন্তু সে ধরনের চাপ কোনাে কাজে দেবে না। আমাদের এটা দেখাতে হবে যে, পাকিস্তান এমন ব্যবস্থা নিচ্ছে যার ফলে উদ্বাস্তুদের স্রোত মন্থর অথবা বন্ধ হয়। পূর্ব। পাকিস্তানে উদ্বাস্তুরা ফিরতে আগ্রহী এমন একটা পরিবেশ দরকার। অন্যথায় রাজনৈতিক সমঝােতার ক্ষেত্রে একটা অগ্রগতি বাঞ্ছনীয়। কিসিঞ্জার এ কথায় সায় দিয়ে বলেন, উদ্বাস্তুদের প্রবাহ বন্ধ করতে আমাদের সর্বাত্মক পদক্ষেপ নেয়া জরুরি।
ভারত তাে নিশ্চয়ই আর উদ্বাস্তু উৎপাদন করছে না। করছে কি? অথবা ফিরে যেতে নিরুৎসাহিত করছে? সিসকো বলেন, উভয় পক্ষ থেকেই একযােগে পদক্ষেপ নিতে হবে। পাকিস্তানের দিক থেকে রাজনৈতিক সমঝােতাই হলাে সমস্যার শেকড়। তবে ইয়াহিয়ার দিকটাও ভাবতে হবে। তারও কিন্তু সীমাবদ্ধতা রয়েছে। ২৮ জুনের বক্তৃতায় ইয়াহিয়া চার মাস সময়ের মধ্যে পূর্ব পাকিস্তানে ক্ষমতা হস্তান্তরের অঙ্গীকার করেছেন। আমার বিবেচনায় এত দূরেই কেবল তিনি যেতে পারেন। আমাদের স্বীকার করতে হবে যে, সত্যিকারের অগ্রগতি ততক্ষণ নিশ্চিত করা যাবে না, যদি না রাজনৈতিক ক্ষমতা নিষিদ্ধ ঘােষিত আওয়ামী লীগের কাছে ফিরিয়ে দেয়া সম্ভব না। হয়। ২৮ জুনের বক্তৃতা একধাপ অগ্রগতি বটে। কিন্তু রাজনৈতিক সমঝােতার জন্য তা যথেষ্ট নয়। আমাদের অবশ্যই আরাে পদক্ষেপ নিতে ইয়াহিয়াকে উৎসাহ দিতে হবে। জাতিসংঘের উপস্থিতি মেনে নিতে ইয়াহিয়া খুবই ভালাে মনােভাব দেখিয়েছেন। তিনি সাধারণ ক্ষমা ঘোষণা করেছেন এবং উদ্বাস্তুদের নিজ গ্রামে ফিরতে আহ্বান জানিয়েছেন। কিন্তু তিনি সেনাবাহিনীকে ব্যারাকে ফিরিয়ে নিতে পদক্ষেপ নেননি। তবে এর প্রাথমিক কারণ হচ্ছে পূর্ব পাকিস্তান জুড়ে যেসব ঘটনা ঘটছে তা সামলাতে সেনাদের দরকার।
ভারত এখনাে স্বাধীনতা সংগ্রামকে সমর্থন দিয়ে। চলেছে। তারা সীমান্ত অতিক্রম করতেও সহায়তা দিচ্ছে। এখন আমরা যদি ইয়াহিয়কে তার সেনাবাহিনী ব্যারাকে ফিরিয়ে নিতে বলি তবে তার কিন্তু কোনাে মানে থাকবে না। মুদ্রার অপর পিঠ হচ্ছে আমরা ভারতকে উদ্বাস্তুদের জন্য সহায়তা হিসেবে ৫০ মিলিয়ন ডলার দিয়েছি। কিন্তু সীমান্তে ভারতীয় দিকে জাতিসংঘের উপস্থিতি মেনে নিতে জাতিসংঘ মহাসচিব ইউ থান্টের অনুরােধ তারা প্রত্যাখ্যান করে চলেছে। এ পর্যায়ে কিসিঞ্জার মন্তব্য করেন, ভারতীয় রাষ্ট্রদূত আমাকে বলেছেন, জাতিসংঘ পর্যবেক্ষক নিয়ােগের যে প্রস্তাব দিয়েছে তাকে তারা অবন্ধুসুলভ হিসেবে গণ্য করছে। সিসকো বলেন, আমি এ ব্যাপারে একমত যে, উভয়ের পাশে যাতে পর্যবেক্ষক নিয়ােগ হয় তার প্রতি সমর্থন দিয়ে যাওয়া। ভারত উদ্বাস্তু প্রত্যাবর্তনের সঙ্গে কতিপয় রাজনৈতিক সমঝােতাকে যুক্ত করছে। আমাদের আসলে এখন উচিত হবে রাশানদের সঙ্গে এই ইস্যুতে যােগাযােগ স্থাপন করা। আমাদের এখানে একটা অভিন্ন স্বার্থ রয়েছে যে, পরিস্থিতির বিস্ফোরণ ঘটবে না। আরউইন পরামর্শ দেন যে, ভারতকে আমাদের পরিকল্পনা অনুযায়ী অগ্রসর করাতে হলে এই মুহুর্তে জাতিসংঘের উপস্থিতি পাকিস্তানের সীমান্তে নিশ্চিত করা সহায়ক হবে। কারণ, জাতিসংঘ যদি তার অবস্থান নেয়ার পরে দেখাতে পারে যে, উদ্বাস্তুদের প্রবাহের ক্ষেত্রে ইতিবাচক প্রভাব পড়েছে। তাহলে এই যুক্তি দাড় করানাে সম্ভব হবে, এখন তা হলে ভারতীয় পক্ষে জাতিসংঘের উপস্থিতি নিশ্চিত করা হােক। আমরা উদ্বাস্তুদের ফেরত পাঠাতে ভারতকে। অব্যাহতভাবে উৎসাহ যুগিয়ে যাব। কিন্তু ব্যাপকভিত্তিক চাপ সৃষ্টি করা সম্ভব না হলে আমরা তাতে সফল হবে না। সুতরাং আর দেরি না করে জাতিসংঘের উপস্থিতি পাকিস্তানের মাটিতে প্রতিষ্ঠিত করতে হবে। কিসিঞ্জার বলেন, ইয়াহিয়া কিন্তু জাতিসংঘের উপস্থিতি ভারতের মেনে নেয়ার শর্তে মেনে নেননি। তিনি মেনেছেন, নিঃশর্তে। তবে এটা ঠিক যে, এটা নিয়ে কোনাে প্রশ্ন নেই যে, এই ইস্যুতে ভারতের ব্যাপক আবেগ ও স্পর্শকাতরতা রয়েছে।
আমার নিজের ধারণা হচ্ছে, ভারতীয়দের একটি প্রবণতা হচ্ছে হিস্ট্রিরিয়া তৈরি করা। কিন্তু এ থেকে প্রয়ােজনে কিভাবে পালাতে হবে তা তাদের জানা নেই। তারা একটি বড় ধরনের সংঘাত বয়ে আনতে পারে এবং আমার এই বিশ্বাস নেই এই পটভূমিতে চীন আসবে না। সিসকো উল্লেখ করেন, ভারতের মনস্তত্ত্ব হচ্ছে তারা খুব নির্দিষ্টভাবে নিজেদের একটি অবস্থানে দাঁড় করাতে চায়। যেক্ষেত্রে একমাত্র বিকল্প দাঁড়ায় শক্তির প্রয়ােগ। ভারতের এই মনােভাব বিবেচনায় রেখে ভারত নিজের ফাঁদে আটকে না পড়া পর্যন্ত পাকিস্তানে অস্ত্র সরবরাহ অব্যাহত রাখতে পারি। কিসিঞ্জার বলেন, ভারতীয়রা ভালােই জানে আমরা যে অস্ত্র পাকিস্তানকে দিচ্ছি তা সংখ্যায় বড়ই অল্প। তারা জানে, অন্য যে কোনাে জাতির তুলনায় তারাই অধিকতর মার্কিন সাহায্য পেয়েছে। কিন্তু আমি যখন ভারত সফর করছিলাম তখন তাদের সংবাদপত্রের ভূমিকা ছিল মারমুখী। অথচ তারা প্রেসকে শান্ত করতে কোনাে উদ্যোগই নেয়নি। আমি এটা ভেবে অবাক হচ্ছি যে, এটা কি পরিস্থিতির ফল, না ইচ্ছা করে সৃষ্টি করা হয়েছে? আমরা যদি ধরে নিই যে, ভারতীয় সংক্ষুব্ধতার পেছনে বড় কারণ হচ্ছে মানবিক দুর্ভোগ (যদিও মানবিক দুর্ভোগের প্রতি ভারতীয় দৃষ্টিভঙ্গি সম্পর্কে আমার নিজস্ব মূল্যায়ন রয়েছে), তারা যদি পূর্ব পাকিস্তানকে ধরাশায়ী করতে চায়, তাহলে সেটা এক বিরাট বিপর্যয় ডেকে আনবে। পশ্চিম পাকিস্তানে যে মানবিক বিপর্যয় সৃষ্টি হবে তা অকল্পনীয়। আমি মনে করি না। যে, ভারতের কোনাে মাস্টার প্ল্যান রয়েছে। কিন্তু তারা একটি বড় সংকটে নিজেদের নিপতিত করতে পারে।
কিন্তু পরিস্থিতিকে তারা একটি বড় সংকটের দিকে নিয়ে যেতে পারে। আরউইন পাকিস্তানকে অস্ত্র সহায়তা দেয়ার ব্যাপারে আমরা কিন্তু ভারতের কাছে নিজেদের স্বচ্ছতা বজায় রাখতে পারি। তাকে আমরা সঠিক তথ্য দিতে পারি, তাহলে তিনি বুঝবেন সাহায্যের পরিমাণ সত্যি কত কম। | কিসিঞ্জার আমি কিন্তু তা তাকে বলেছি। আপনার পরামর্শের প্রতি আমার কোনাে নির্দিষ্ট মত নেই। তবে এটুকু বুঝি আমাদেরকে অবশ্যই অতিরিক্ত পুনঃনিশ্চয়তা এবং অতিরিক্ত ভয় পাইয়ে দেয়ার মধ্যে একটা সামঞ্জস্য বজায় রাখতে হবে। | আরউইন ঝা বলেছেন, আমরা তাদের অর্থনৈতিকভাবে সাহায্য করছি। কিন্তু কখনাে রাজনৈতিকভাবে নয়। তারা সত্যিই ভগ্নমনস্ক। আমরা তাদের জন্য যা করেছি তা তারা স্বীকার করে; কিন্তু একই সঙ্গে আমাদের প্রতি অবিশ্বস্ত। অবশ্যই তারা কখনােই রাজনৈতিকভাবে আমাদের সঙ্গে ছিল না।
সিসকো যখন অনেক আমেরিকান ভারত নিয়ে ভেবেছে তখন তারা ব্যস্ত থেকেছে কৃষ্ণ মেননকে নিয়ে এবং তা কিন্তু ভ্রান্ত ভাবমূর্তি নয়। কিসিঞ্জার পাকিস্তানের কথা বলতে গেলে আমি বলব যে, আইকিউ বিষয়ে যদি পুরস্কারের ব্যবস্থা করা হয় তবে ইয়াহিয়া এবং তার সহযােগীরা কখনােই পাবেন না । তারা অনুগত, ভােলা মনের সৈন্য কিন্তু একটা বিষয় বুঝতে প্রকৃতপক্ষেই তারা বুদ্ধিবৃত্তিক সমস্যায় ভুগছে। আর তা হলাে, কেন পূর্ব পাকিস্তান পশ্চিম পাকিস্তানের অংশ হওয়া উচিত নয়। বর্তমান কাঠামাের কাছ থেকে আওয়ামী লীগের প্রতি কখনােই গ্রহণযােগ্যতা মিলবে না। ভারত যদি আক্রমণ করে তাহলে তা আগামী ছয় মাসের মধ্যে ঘটবে। আর পাকিস্তানিরাও আগামী ছয় মাসের মধ্যে আওয়ামী লীগকে পূর্ব পাকিস্তানে ক্ষমতায় বসাবে না। এটা এখন অবশ্যম্ভাবী যে, যে কোনাে রাজনৈতিক প্রত্রিক্রয়ার নিষ্পত্তি ঘটবে পূর্ব বাংলার জন্য কিছু স্বায়ত্তশাসন অর্জনের মধ্য দিয়ে। আমরা কি এমন একটি কর্মসূচি পেতে পারি? যেখানে উদ্বাস্তু ইস্যুকে রাজনৈতিক সমঝােতার প্রক্রিয়া থেকে বিচ্ছিন্ন করে দেখা হবে? পাকিস্তানিরা এরকম একটা কিছু তাদের জন্য ভাবতে সক্ষম নয়। তাদের সেই রাজনৈতিক দূরদর্শিতা নেই।
হেলমস (সিআইএ’র পরিচালক) আমি একমত যে ইয়াহিয়া কোনাে রাজনৈতিক সমাধান দেখছেন না। সিসকো ভারতীয়রা যদি এই সিদ্ধান্তে পৌঁছায় যে, আর কোনাে সমঝােতার আশা নেই তা হলে তাদের মধ্যে হতাশা জন্ম নেবে। আর তা তাদেরকে কালক্রমে অযৌক্তিক পদক্ষেপ গ্রহণে উৎসাহিত করবে। কিসিঞ্জার ভারতীয়দের এই অধিকার রয়েছে যে, তারা তাদের ভূখণ্ড থেকে উদ্বাস্তুদের সরিয়ে দিতে পারে। কিন্তু তাদের এই অধিকার নেই যে, কোনাে নির্দিষ্ট রাজনৈতিক ফর্মুলায় সংকটের সমাধানে চাপ সৃষ্টি করা। আরউইন আমি জানি প্রধানমন্ত্রী ইন্দিরা আপনাকে বলেছেন, তারা কোনাে ফর্মুলা চাপিয়ে দেবে না। কিন্তু ঝা চাপ দিচ্ছেন যে, আওয়ামী লীগকে যাতে পুনর্জীবিত করা হয়।  কিসিঞ্জার সে কথা সত্য। আবার একই সঙ্গে তারা একটি স্বাধীনতার আন্দোলনকেও সমর্থন দিচ্ছে এবং বলছে আওয়ামী লীগকে ফিরে আসতেই হবে। এখন আমরা যদি এমন একটা কর্মপরিকল্পনা নিতে পারি যাতে উদ্বাস্তুরা ফিরে আসতে শুরু করে, তাহলে ইয়াহিয়ার ওপর চাপ সৃষ্টি করার একটা সুযােগ কিন্তু আমরা পেয়ে যাব। তিনি উদ্বাস্তুদের ব্যাপারে বেশ ভালােই অবস্থান নিয়েছেন। আরউইন তিনি যা মুখে বলছেন, তা উত্তম বটে, কিন্তু আমরা কিছু (এক লাইনের চেয়েও কম সাের্স টেক্সট অবমুক্ত করা হলাে না) ইঙ্গিত পেয়েছি যে, এটা শুধুই একটা ফ্রন্ট। (সিআইএ পরিচালকের দিকে তাকিয়ে) আচ্ছা আপনিই বলুন, ইয়াহিয়া কি সত্যিই চান, বিপুলসংখ্যক হিন্দু উদ্বাস্তু প্রত্যাবর্তন করুক?
হেলমস নির্দিষ্ট করে আমরা এটা বলতে পারি না।

সূত্র:  ১৯৭১ আমেরিকার গোপন দলিল – মিজানুর রহমান খান – সময় প্রকাশন

error: Alert: Due to Copyright Issues the Content is protected !!