মুক্তিযােদ্ধাদের অস্ত্র দিতে কোসিগিনের আশ্বাস
২১ মে, ১৯৭১
ওয়াশিংটনে হেনরি কিসিঞ্জার বৈঠক করেন ভারতীয় রাষ্ট্রদূত এল কে ঝায়ের সঙ্গে। ঝা আলােচনার শুরুতেই ভারতের উদ্বাস্তু পরিস্থিতি ব্যাখ্যা করেন। তিনি বলেন, এটা শুধুই অর্থ ও ত্রাণের বিষয় নয়। বড় সমস্যা হলাে ভারত এত বিপুলসংখ্যক উদ্বাস্তুকে ধারণ করতে অপারগ। সুতরাং তারা যাতে পূর্ব পাকিস্তানে ফিরে যায় তেমন ব্যবস্থা তাকে বের করতেই হবে। ঝা উল্লেখ করেন, উদ্বাস্তুদের একটি বড় সংখ্যাই হিন্দু। তাছাড়া। উদ্বাস্তু ও স্থানীয় বাসিন্দাদের মধ্যে সাম্প্রদায়িক বিরােধ দানা বাঁধছে। পশ্চিমবঙ্গে এই সমস্যা মারাত্মক রূপ নিয়েছে। তার কথায় পরিস্থিতি ‘অত্যন্ত বিস্ফোরমুখ। ঝা উল্লেখ করেন, প্রেসিডেন্টের কাছে আমাদের প্রধানমন্ত্রীর লেখা চিঠিতে এসব বিষয়ে বিস্তারিত বর্ণনা করা হয়েছে। কিসিঞ্জার এ সময় মন্তব্য করেন, উদ্বাস্তুদের ওপরে আপনি যুদ্ধে যেতে পারেন না। রাষ্ট্রদূত ঝা বলেন, অনেকে চাইবে, উদ্বাস্তুদের সশস্ত্র করে ফেরৎ পাঠানাে হােক পূর্ব পাকিস্তনে। অন্যরা চাইছে, প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়ার ওপর চাপ সৃষ্টি করা হােক। কিসিঞ্জার প্রশ্ন রাখেন, আমরা কী করতে পারি? ইয়াহিয়া দাবি করছেন, তিনি একটি রাজনৈতিক সমঝােতা চান। ঝা বলেন, ভারতও কিন্তু এটা দেখতে চাইছে। আমরা নিশ্চিত হতে চাইছি, পরিস্থিতি একটি রাজনৈতিক সমঝােতার দিকে গড়াচ্ছে। কিসিঞ্জার বলেন, আমি তা বেশ বুঝতে পারছি।’ তবে খােলাখুলি আপনাকে অবশ্য একটা কথা বলতে হবে যে, প্রধানমন্ত্রীর চিঠিটি পাঠ করতে কিন্তু আমি সক্ষম হইনি। লেট’স নট প্লে গেমস’।
(এ সময় কিসিঞ্জার ইন্দিরা গান্ধীর চিঠিটি খুঁজে নিয়ে দ্রুত তা পাঠ করেন)। কিসিঞ্জার এরপর বলেন, আমরা এটি যত্নের সঙ্গে পাঠ করব। আপনি আবার যখন আসবেন তখন এ নিয়ে কথা হবে। আপনাকে আমি এখন এটুকু বলতে পারি যে, বিষয়টা যেভাবে একেবারে নিয়ন্ত্রণের বাইরে চলে গেছে তার আমরা নিন্দা জানাই। আমরা বিশ্বাস করি, পূর্ব পাকিস্তনের ঘটনাবলি পর্যায়ক্রমে এবং অতি সতর্কতার সঙ্গে নাড়াছড়া করা উচিত। ব্যক্তিগতভাবে আমি নিশ্চিত নই যে, স্বাধীন পূর্ব পাকিস্তান ভারতের স্বার্থ রক্ষা করবে। রাষ্ট্রদূত ঝা এ সময় ইঙ্গিত দেন, এই দৃষ্টিভঙ্গি তিনি উপলব্ধি করতে পারছেন। তিনি বলেন, ভারত পাকিস্তনের ভাঙন দেখতে চায়নি। কিন্তু বাস্তবতা এটা যে, পাকিস্তন যে টিকছে ভারত এটাও দেখতে পায়নি। এটাই হলাে ঘটনা। আমারা গেরিলা তৎপরতার আশঙ্কা করছি। একই সঙ্গে পূর্ব পাকিস্তানে চীনা সম্পৃক্ততার প্রশ্নটিও আমাদের বিবেচনায় রয়েছে। আমাদের মতে চীনা সম্পৃক্ততার জন্য এটাই প্রকৃষ্ট সময়।
২২ মে, ১৯৭১
করাচির কস্যুলেট জেনারেল স্টেট ডিপার্টমেন্টে একটি টেলিগ্রাম প্রেরণ করে। এতে উল্লেখ করা হয়, ‘আমি করাচিতে প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়া খানের সঙ্গে আজ দেড় ঘণ্টার এক বৈঠকে মিলিত হয়েছি। আমি এ সময় ভারতে উদ্বাস্তু পরিস্থিতি এবং সে সম্পর্কে যুক্তরাষ্ট্র সরকারের উদ্বেগের কথা তাকে অবহিত করছি। জবাবে ইয়াহিয়া বলেন, তিনি বিষয়টি বুঝতে পেরেছেন। কিন্তু তার যুক্তি হচ্ছে, ভারত আড়াই মিলিয়ন পূর্ব পাকিস্তনি উদ্বাস্তুর যে পরিসংখ্যান দিচ্ছে তা ঠিক নয়। পাকিস্তন সরকার অবশ্য এটা জানে যে, উল্লেখযােগ্যসংখ্যক মানুষ সীমান্ত অতিক্রম করেছে। ইয়াহিয়া বলেন, গত তিন অথবা চার বছরের ব্যবধানে আনুমানিক দেড় মিলিয়ন উদ্বাস্তু’ পূর্ব পাকিস্তনে। অনুপ্রবেশ করেছে। এদের এই যাতায়াত ভারত কখনাে স্বীকার করেনি। এবং এমনকি আন্তর্জাতিক গণমাধ্যম এ নিয়ে আক্ষেপ করেনি। বিচ্ছিন্নতাবাদী আন্দোলনে ভারতের মদদ দান এবং সশস্ত্র জঙ্গিদের পূর্ব পাকিস্তনের অব্যাহত অনুপ্রবেশ নিয়ে পাকিস্তনের অভিযােগ তিনি পুনর্ব্যক্ত করেন। আমি তাকে বললাম, আপনাদের অবস্থানের কথা আমরা জানি। কিন্তু উদ্বাস্তুদের স্রোত অবশ্য রােধ করতে হবে। তিনি ইঙ্গিত দেন যে, আমার বক্তব্যের গ্রহণযােগ্যতা রয়েছে; এবং উল্লেখ করেন, একটি শান্তিপূর্ণ রাজনৈতিক সমঝােতার জন্য তিনি আন্তরিক পদক্ষেপ নেবেন। ইয়াহিয়া। আশা প্রকাশ করেন যে, মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র ভারতকে সংযত থাকতে তার প্রচেষ্টা অব্যাহত রাখবে। কারণ তারা ভারতীয় ও বাঙালি অনুপ্রবেশকারীদের অস্ত্র ও গােলাবারুদ দিচ্ছে। ভারতের সীমান্তের কাছাকাছি এলাকায় তারা তাদের প্রশিক্ষণ দিচ্ছে। স্বাভাবিক অবস্থা ফিরিয়ে আনতে এসবই প্রতিবন্ধক।
২৫ মে, ১৯৭১
ওয়াশিংটন স্পেশাল অ্যাকশন গ্রুপের বৈঠকের জন্য প্রস্তুত স্মারকে উল্লেখ করা হয়, এমন খবর পাওয়া গেছে যে, ইন্দিরা গান্ধী তার সেনাবাহিনীকে পূর্ব পাকিস্তন দ্রুত দখল করে নিতে একটি পরিকল্পনা প্রণয়নের নির্দেশ দিয়েছে। এর সামরিক কৌশলটা হবে ইসরায়েলি টাইপ লাইটেনিং থ্রাস্ট’। ভারত বাঙালি গেরিলাদের প্রশিক্ষণ ও অস্ত্র সাহায্য দিচ্ছে। কিছু ভারতীয় ও আধা সামরিক সৈন্য পূর্ব পাকিস্তানে গিয়ে সম্ভবত সীমিত আকারের অপারেশনও পরিচালনা করছে।
২৬ মে, ১৯৭১
পররাষ্ট্রমন্ত্রী রজার্স নিক্সনের কাছে প্রদত্ত স্মারকলিপিতে উল্লেখ করেন, তিনটি বিষয় যুদ্ধের বিপদ সৃষ্টি করেছে- অব্যাহত সামরিক নিপীড়ন, পূর্ব পাকিস্তানে রাজনৈতিক সমঝােতার ঘাটতি ও অর্থনৈতিক দুর্যোগ, ভারতে উদ্বাস্তুদের বিরাট স্রোত (ভারতীয়দের হিসাব অনুযায়ী উদ্বাস্তুদের সংখ্যা এখন ৩০ লাখের বেশি) এবং ভারত কর্তৃক বাঙালি গেরিলাদের আন্তঃসীমান্ত সমর্থন।
৯ জুন, ১৯৭১
ভারপ্রাপ্ত পররাষ্ট্রমন্ত্রী আরউইন নিক্সনকে এক স্মারকে পাকিস্তানের অর্থনৈতিক সহায়তার পরিপ্রেক্ষিত অবহিত করেন। এতে তিনি উল্লেখ করেন, পূর্ব পাকিস্তানে গেরিলাদের প্রতিরােধ কার্যক্রম ক্রমেই কার্যকর ও সংগঠিত হয়ে উঠছে। গেরিলারা পরিবহন ব্যবস্থা বিপর্যস্ত করে দিয়েছে এবং সামরিক আইন প্রশাসনকে যারা সহায়তা দিচ্ছে তাদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নিতে শুরু করেছে।
২৬ জুন, ১৯৭১
ভারতের মার্কিন দূতাবাসে স্টেট ডিপার্টমেন্টের এক টেলিগ্রামে বলা হয়, ২৪ জুন ওয়াশিংটনে পররাষ্ট্রমন্ত্রীর সঙ্গে প্রিন্স সদরুদ্দিন আগাখানের আলােচনা হয়েছে। সদরুদ্দিন ছিলেন জাতিসংঘের উদ্বাস্তু-বিষয়ক হাইকমিশনার। তিনি ওই বৈঠকে জাতিসংঘের উদ্বাস্তু হাইকমিশন ইউএনএইচসিআর এর পূর্বপাকিস্তন ও ভারতে কার্যক্রম শুরু সম্পর্কে তার প্রচেষ্টার বিবরণ দেন। তিনি বলেন, পাকিস্তন সরকার ঢাকায় তার উপস্থিতির প্রস্তব মেনে নিয়েছে। এবং তিনি বিশ্বাস করেন যে, উদ্বাস্তুদের জন্য অভ্যর্থনা কেন্দ্র খুলতে তিনি পাকিস্তানকে রাজি করাতে পারবেন। কিন্তু ভারত সরকার নির্দিষ্টভাবে পূর্বপাকিস্তানে উদ্বাস্তু হাইকমিশনের উপস্থিতি প্রত্যাখ্যান করেছে। ভারত বলেছে, নয়াদিল্লির বাইরে উদ্বাস্তু হাইকমিশনের উপস্থিতি তারা মানতে নারাজ। সদরুদ্দিন ভারতীয় নীতির সমালােচনায় মুখর। তার যুক্তি, ভারত আন্ত সীমান্ত অনুপ্রবেশ যাতে আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের কাছে প্রকাশ না পায় সেজন্যই তারা রাখঢাক নীতি অনুসরণ করছে। তিনি একই সঙ্গে জাতিসংঘের সম্ভাব্য কার্যক্রমে সােভিয়েত আপত্তি সম্পর্কেও উদ্বেগ প্রকাশ করেন। স্টেট ডিপার্টমেন্ট অবশ্য সদরুদ্দিনকে বলে দিয়েছে তিনি যেন তার চেষ্টা অব্যাহত রাখেন। সদরুদ্দিন তার আলােচনাকালে মত প্রকাশ করেন যে, পূর্বপাকিস্তান সংকটের সমাধান না হলে দক্ষিণ এশিয়ায় এক নতুন ভিয়েতনামের জন্ম হতে পারে। বাঙালি ও পাঞ্জাবিদের মধ্যে মেরুকরণ চলছে। তাদের পরস্পরের প্রতি কোনাে সহানুভূতি নেই।
পূর্বপাকিস্তানের চরমপন্থি বিশেষ করে নকশালীরা তাদের নিজেদের অবস্থান শক্তিশালী করতে ‘বিদেশী সেনাবাহিনীর’ ভীতিকে কাজে লাগাচ্ছে। এর পরিণতিতে গেরিলাযুদ্ধ। প্রলম্বিত হতে পারে। সদরউদ্দিন ব্যাখ্যা করেন, ভারত এ বিষয়টি নিয়ে খুবই উদ্বিগ্ন। সে কারণেই ভারতের ‘ইনার কেবিনেট সিদ্ধান্ত নিয়েছে যে, তারা বাংলাদেশকে স্বীকৃতি দেবে না। পাকিস্তানের বিরুদ্ধেও যুদ্ধে যাবে না। কিন্তু মুক্তিফৌজের প্রতি সব রকম সমর্থন দিয়ে যাবে। আর সে কারণে ভারত পূর্বপাকিস্তান সীমান্তে জাতিসংঘের উপস্থিতি চায় না। তারা উদ্বাস্তুদের জন্য বিদেশী ত্রাণ ঠিকই চায়, কিন্তু বিদেশীরা সীমান্তে ঘুরে বেড়াক তা তারা দেখতে নারাজ। ৯ জুলাই, ১৯৭১ প্রেসিডেন্টের নিরাপত্তা-বিষয়ক উপসহকারী জেনারেল হেগ নিক্সনকে অবহিত করেন, আপনি জানেন যে, ভারতের পররাষ্ট্রমন্ত্রী শরণ সিং ওয়াশিংটন আসার পথে মস্কো সফর করেছেন। এ সময় সােভিয়েত প্রধানমন্ত্রী কোসিগিনের সঙ্গে অনুষ্ঠিত তার বৈঠকে বাঙালি গেরিলাদের অস্ত্র সহায়তা দেয়া নিয়ে কথা হয়। এ সময় কোসিগিন ভারত সমর্থিত গেরিলাদের ক্ষুদ্র অস্ত্র (স্মল আর্মস) সরবরাহের প্রস্তাবে রাজি হন। প্রশ্ন হলাে কোসিগিন-শরণ সিং গােপন আলােচনার বিষয় কোন সূত্রে যুক্তরাষ্ট্র জানতে পেরেছিল? সদ্য অবমুক্ত মার্কিন দলিল থেকে এ প্রশ্নের জবাব মেলেনি।
কারণ এই রিপাের্টের সাের্স বা উৎস ডিক্লাসিফাই বা অবমুক্ত করা হয়নি। তবে এই সারসংক্ষেপ থেকে ধারণা করা চলে যে, ১৯৭১ এ বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধে মুক্তিযােদ্ধাদের জন্য সােভিয়েত অস্ত্র সহায়তা ও সম্ভাব্য চীনা আক্রমণ থেকে রক্ষা পেতেই ১৯৭১ সালের ৯ আগস্টে সম্পাদিত হয়েছিল সােভিয়েত-ভারত মৈত্রী চুক্তি। এই দলিলে দেখা যাচ্ছে, শরণ সিং পূর্ব পাকিস্তানে ভারতীয় হস্তক্ষেপ সম্ভাবনা নস্যাৎ করতে সম্ভাব্য চীনা হুমকি মােকাবেলায় সােভিয়েতের কাছে সামরিক সুরক্ষা দেয়ার অনুরােধ জানায়। কোসিগিন এই প্রস্তাবে ইতিবাচক মনােভাব দেখান। কিন্তু কথিত মতে তিনি শর্ত আরােপ করেন যে, এজন্য মিসেস গান্ধীর কাছ থেকে আনুষ্ঠানিকভাবে অনুরােধপত্রের প্রয়ােজন হবে। নিক্সন মুক্তিযােদ্ধাদের সােভিয়েত অস্ত্র সরবরাহের স্থানে কলম দিয়ে দাগ কাটেন এবং মন্তব্য জুড়ে দেন যে, ‘কিসিঞ্জার, এটা যদি সত্য হয়, কিটিংকে (ভারতে নিযুক্ত মার্কিন রাষ্ট্রদূত) নির্দেশ দিন এ ব্যাপারে দিল্লির কাছে শক্ত প্রতিবাদ জানাতে। তবে প্রথমে এটা ঘরােয়াভাবে উল্লেখ করতে হবে।
সূত্র: ১৯৭১ আমেরিকার গোপন দলিল – মিজানুর রহমান খান – সময় প্রকাশন