You dont have javascript enabled! Please enable it! ইয়াহিয়ার আত্মসমর্পণ নিয়ে চৌ-কিসিঞ্জার সংলাপ - সংগ্রামের নোটবুক
ইয়াহিয়ার আত্মসমর্পণ নিয়ে চৌ-কিসিঞ্জার সংলাপ
১৯৭২ সালের জুনে চীন সফরে গিয়েছিলেন কিসিঞ্জার। ২০ জুন সন্ধ্যা ২টা ৫ থেকে ৬টা ৫ মিনিট পর্যন্ত চীনা প্রধানমন্ত্রী চৌ এনলাই কিসিঞ্জারের সঙ্গে কথা বলেন। ৪ ঘণ্টার আলােচনার বাংলাদেশ অংশের বিবরণ থেকে দেখা যায়, তারা বাংলাদেশ শব্দটির পরিবর্তে পূর্ব পাকিস্তানই ব্যবহার করেন। আর দুজনই একমত হন, জেনারেল ইয়াহিয়া যুদ্ধ সম্পর্কে ছিলেন অজ্ঞ। পূর্ব পাকিস্তানে ব্যাপক সৈন্যের সমাবেশ ঘটিয়ে তিনি ভুল করেছেন। দক্ষিণ এশিয়া নিয়ে এদিন আলােচনার সূচনা ঘটান কিসিঞ্জার। কিসিঞ্জার আপনি জানেন, দক্ষিণ এশিয়ার পরিস্থিতিতে আমরা ভয়ানক কঠিন প্রতিক্রিয়া দেখিয়েছিলাম। একদিন সকালে আমরা যখন একটি বার্তা পেলাম, আপনারা একটি বার্তা পাঠিয়েছেন আমাদের কাছে। আমি কিন্তু ধরেই নিয়েছিলাম, আপনারা সৈন্য পাঠিয়েছেন। আর তক্ষুণি সিদ্ধান্ত নিলাম, এই সৈন্য প্রেরণের কারণে সােভিয়েত ইউনিয়ন যদি আপনাদের বিরুদ্ধে আক্রমণ পরিচালনা করে তাহলে আমরা আপনাদের সমর্থন দেব। সেই হামলা নস্যাৎ করতে প্রয়ােজনে সামরিক ব্যবস্থা নেব। সম্ভবত আমরা আপনাদের বার্তা পেয়েছিলাম ১১ ডিসেম্বর, ১৯৭১। আমাদের সময় তখন সকাল। দুপুরে যখন বার্তাটি পড়ার সুযােগ পেলাম, দেখলাম বিষয়বস্তু ভিন্ন। আপনার স্মরণে আছে আমরাও কিন্তু হুমকি।
চৌ আসলে সেই সময় কিন্তু পূর্ব পাকিস্তানকে আর রক্ষা করা সম্ভব ছিল না।
কিসিঞ্জার না না, আপনারা সঠিক সিদ্ধান্তটিই নিয়েছিলেন। সৈন্য প্রেরণের জন্য সত্যি বড় দেরি হয়ে গিয়েছিল। কিন্তু আপনাদের রাষ্ট্রদূতের সঙ্গে আমার কথা হয়েছিল।
চৌ তারা তাে ছিলেন জাতিসংঘে। পরিস্থিতি সম্পর্কে স্পষ্ট ধারণা ছিল না। ভুট্টো নিজেই সামরিক বিষয় ভালাে বুঝতেন না। ইয়াহিয়া খান সামরিক পরিস্থিতি সম্পর্কে দম্ভোক্তি করেছিলেন। সুতরাং আমার বিশ্বাস, ভুট্টো ১১ ডিসেম্বরে পৌছেছিলেন, আর তার ধারণা ছিল ওই সময়ে পাকিস্তানের সামরিক পরিস্থিতি খুবই ভালাে যাচ্ছিল। অথচ তিনি জানতেন না, তার নিজ দেশেই কু ঘটে গেছে।
কিসিঞ্জার : আমার ধারণা তারিখটি ছিল ১১ ডিসেম্বর। ভুট্টো নিউইয়র্কে এলেনশুক্রবার, ডিসেম্বরের ১০ তারিখ হবে। আপনাদের সময় ১১ তারিখ। ১০ তারিখে আমি হুয়াং হুয়ার সঙ্গে বৈঠক করলাম। আমি হুয়াং হুয়ার সঙ্গে প্রথম মিলিত হই ১০ তারিখে। মানে শুক্রবারের সন্ধ্যায়। তার পরে ১১ তারিখ সকালে। না আমি মনে হয় ভুল বললাম। আমি হুয়াং হুয়ার সঙ্গে ১০ তারিখ সন্ধ্যায় কথা বলি। এবং তারপর আবার তার সঙ্গে কথা হয় আপনাদের বার্তাটি পাওয়ার পর। আমার মনে আছে, হুয়াং হুয়া খুবই কঠোর লাইন নিলেন। অথচ তিনি পরিস্থিতি জানতেন না। আর আমি কিনা ভাবলাম- আপনারা সামরিক ব্যবস্থা নিতে যাচ্ছেন। আমরা কিন্তু এমন নির্দেশও দিয়েছিলাম, সােভিয়েত ইউনিয়ন আপনাদের বিরুদ্ধে গেলে আমরাও তাদের বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়াব।
চৌ আচ্ছা বলুন ওয়াশিংটন স্পেশাল অ্যাকশন গ্রুপের বৈঠকের আংশিক অথবা পূর্ণ বৃত্তান্ত সংবাদপত্রে কী করে ছাপা হলাে?  কিসিঞ্জার এ সংক্রান্ত আমাদের আলােচনা কিন্তু কখনাে ওয়াশিংটন স্পেশাল গ্রুপের বৈঠকে হয়নি। কারণ এটা ছিল খুব বেশি রকম সংবেদনশীল। আমরা খুব ছােট গ্রুপে এ নিয়ে আলােচনা করেছিলাম। চৌ: আমি তা জানি। কিন্তু ওয়াশিংটন স্পেশাল অ্যাকশন গ্রুপ পূর্ব পাকিস্তানের পরিস্থিতি নিয়ে যা কিছু আলােচনা করেছে তার প্রতিটি ধাপ কেন সংবাদপত্রে ছাপা হলাে? কিসিঞ্জার মি. প্রধানমন্ত্রী আপনাকে বুঝতে হবে, ওয়াশিংটন স্পেশাল গ্রুপ এমন একটি গ্রুপ যার কাজ সিদ্ধান্তের বাস্তবায়ন, সিদ্ধান্ত গ্রহণ করা তার কাজ নয়। আসলে এই গ্রুপে আমাকে অত্যন্ত কঠোর অবস্থান নিতে হয়েছে। তার কারণ হচ্ছে, আমাদের আমলাতন্ত্রের এক বিরাট অংশ ভারতপন্থি এবং সােভিয়েতপন্থি।
চৌ বলেন কি, তাই বলে সােভিয়েতপন্থি?
কিসিঞ্জার যে কোনাে বিষয়ে আমরা দেখি, তারা চীনপন্থি হওয়ার চেয়ে বেশি প্রবণতা দেখায় সােভিয়েতপন্থি হওয়ার । আমি মস্কো সামিট বাতিলের হুমকি দিলে, আমি তাে প্রায় সহিংস আক্রমণের কবলে পড়ে যাই! আসলে ঘটেছিল কী? আমাদের আমলাতন্ত্রের কোনাে আনুগত্যহীন সদস্য সংবাদপত্রের কাছে এই দলিল পাচার করেছিল। এবং তারা আমাদের ধ্বংস করে দেয়ার জন্য তা পত্রিকায় পরিবেশন করে। তারা দ্বিতীয় কোনাে সুযােগ নিতে দেবে না।  চৌ কিন্তু সংবাদপত্রে সেই দলিলের বিবরণ পড়ে আমার মনে হয়েছে, এই গ্রুপের আলােচনাকারীরা বিভিন্ন মহল থেকে এসেছে।
কিসিঞ্জার হ্যা। তারা আমাদের অনুসৃত নীতির বিরুদ্ধে প্রায় সর্বসম্মত অবস্থান গ্রহণ করেছিল।
চৌ বিশেষ করে ভারতের প্রতি।
কিসিঞ্জার তারা আমাদের সামগ্রিক স্ট্র্যাটেজি বুঝতে পারেনি। তারা যদি বুঝতে পারতেন, আমরা আসলে সােভিয়েত ইউনিয়নকেও সঙ্গে রাখতে চেয়েছি।
তখন তাদের প্রতিক্রিয়াটা তুলনামূলক কম হতাে। ভারত মহাসাগরে আমরা আমাদের। সপ্তম নৌবহর নিয়ে গিয়েছিলাম, কিন্তু প্রাথমিকভাবে ভারতকে উদ্দেশ্য করে নয় । এটা ছিল মূলত সােভিয়েত ইউনিয়নের ওপর চাপ সৃষ্টি করা, যাতে একটু আগে আমি যা বললাম সেদিকে সােভিয়েত ইউনিয়ন সরে আসে।
চৌ সােভিয়েতরা কিন্তু আপনাদের একেবারে ভারত মহাসাগরের নিচ পর্যন্ত ঘনিষ্ঠভাবে অনুসরণ করে।  কিসিঞ্জার হ্যা হ্যা, তারা এমনভাবে নিজেদের অবস্থান বজায় রাখে, যাতে আমরা আমাদের খেয়ালখুশিমতাে বিচরণ করতে পারি।
 চৌ সােভিয়েতরা আসলে চেষ্টা করেছিল পূর্ব বাংলায় অধিকতর ডামাঢােল সৃষ্টি। করা। তারা সে কারণে প্রকাশ্যে প্রথমে সুশীমা প্রণালী এবং পরে মালাক্কা প্রণালীর মধ্য দিয়ে তাদের বহর অতিক্রম করায়।
 কিসিঞ্জার হ্যা। কিন্তু এমন কোনাে শক্তি প্রদর্শন করেনি, যাতে কিনা আমাদের সঙ্গে যুদ্ধে জড়িয়ে পড়ার কারণ ঘটে।
চৌ আপনি জানেন এটা তাে ঠিক যে, ওই রকম মহড়ার মাধ্যমে পূর্ববাংলার প্রতি তাদের সমর্থনের বহিঃপ্রকাশ ঘটিয়েছে।  কিসিঞ্জার হঁ্যা, তা ঠিকই বলেছেন। ওই মহড়া তারা ওই লক্ষ্যেই দিয়েছে। প্রকৃতপক্ষে পূর্ব পাকিস্তানে পাকিস্তানি সেনাবাহিনী এর পাঁচ দিন পরই আত্মসমর্পণ করেছে। সুতরাং আপনাদের কিছু করা সত্যিই বড় বেশি বিলম্বিত পদক্ষেপ হতাে।
চৌ ইয়াহিয়া খানও ১১ অথবা ১২ ডিসেম্বরে আত্মসমর্পণের পদক্ষেপ নিতে তার নির্দেশ পাঠিয়েছেন।
আলােচনার এ পর্যায়ে চীনের উপ-পরাষ্ট্রমন্ত্রী চিয়াও মন্তব্য করেন, আমি এক্ষেত্রে একটি কথা যােগ করতে চাই। ১০ তারিখ শুক্রবার সকালে জাতিসংঘের মহাসচিব ইউ থান্ট আমাদের জানিয়েছিলেন, পূর্ব পাকিস্তান তাদের লােকজনের মাধ্যমে অবহিত করেছে, পূর্ব পাকিস্তান।  কিসিঞ্জার ঠিকই বলেছেন, ভাইস ফরেন মিনিস্টারের বক্তব্য নিরঙ্কুশভাবে নির্ভুল। অত্যন্ত গােপনীয়তার সঙ্গে বলছি, আমরা তাদের বিরত থাকতে অনুরােধ করছিলাম। বলেছিলাম, আরেকটু সবুর করুন। আমরা চীনের সঙ্গে কথা বলে নিই, পরিস্থিতির একটা মূল্যায়ন করে নিই। আমার বিশ্বাস আপনারাও তেমন পরামর্শই। দিয়েছিলেন।
চিয়াও এটা ঘটল ভুট্টো যেদিন নিউইয়র্কে এলাে। পৌছামাত্রই আমরা তাকে এই সংবাদ জানালাম, তিনি মূলত ইউ থান্টের সঙ্গে দেখা করার জন্যই প্রস্তুত ছিলেন। আমরা থান্টের সঙ্গে মধ্যাহ্নভােজের ব্যবস্থা করে দিই। ভুট্টো এরপর তাড়াতাড়ি হােটেলে ফিরে গেলেন। কথা বললেন ইয়াহিয়া খানের সঙ্গে এবং তাকে পরামর্শ দিলেন, তেমন কিছু করা থেকে বিরত থাকতে। আমার ঠিক মনে আছে, এটা
কিন্তু ঘটেছিল ভুট্টো নিউইয়র্কে পৌছার দিনটিতে।
চৌ কিন্তু আজ আমাদের এটা অবশ্যই বলতে হবে, ইয়াহিয়া খান পিকিংওয়াশিংটন সম্পর্ক উন্নয়নে যথেষ্ট ভূমিকা পালন করেছেন। তার সঙ্গে আমাদের যখনই দেখা হয়, তখনই এ কথা আমরা তাকে বলি। কিন্তু এটা ঠিক যে, তিনি এমন একজন জেনারেল ছিলেন, যিনি জানতেন না কিভাবে একটি যুদ্ধ পরিচালনা করতে হয়। যুদ্ধকালে তিনি ছিলেন একেবারেই অথর্ব। তিনি যেসব তৎপরতা চালিয়েছেন, তা পরিস্থিতিকে আরাে অবনতির দিকে ঠেলে দিয়েছে। এটা এমন কিছু যা কিন্তু আমরা আশা করিনি। আমরা এটা আশা করেছিলাম, তিনি পরিস্থিতির উন্নতি ঘটাতে পারবেন না ঠিক, কিন্তু তিনি যে এতটা খারাপভাবে পরিস্থিতির মােকাবেলা করবেন তা নিশ্চয় আমরা জানতাম না। তার চার ডিভিশন সৈন্য ছিল। অথচ তাদের তিনি যুদ্ধ ক্ষেত্রেই পাঠালেন না। অথচ যুদ্ধ শুরুর আগেই তারা ধূলায় লুটিয়ে পড়তে শুরু করে। প্রকৃতপক্ষে আমাদের জানামতে এই সশস্ত্র বাহিনী যুদ্ধে অংশ নিতে সক্ষম। ছিল।
কিসিঞ্জার : সত্যিই, ইয়াহিয়া তার সৈন্যদের সীমান্তজুড়ে ছড়িয়ে-ছিটিয়ে দিলেন। পূর্ব পাকিস্তানে তিনি অহেতুক ব্যাপক সৈন্য মােতায়েন করেছিলেন। ঐ সৈন্যদের যদি তিনি পশ্চিম পাকিস্তান সীমান্ত থেকে আক্রমণাত্মক ভূমিকা পালন করাতে সক্ষম হতেন তাহলে তা হতাে অধিকতর উত্তম। দ্বিতীয়ত, তার উচিত ছিল ভারতীয়দের উপেক্ষা করা। সৈন্যদের একটি স্থানে সন্নিবেশ ঘটিয়ে তাদের কোথাও না কোথাও পরাস্ত করা।  চৌ আসলে তেমন ব্যবস্থা নিতে ইয়াহিয়া খানের চেয়ে আইউব খানই ছিলেন। অধিকতর সক্ষম।
কিসিঞ্জার ইয়াহিয়া খান ছিলেন চমৎকার মানুষ। কিন্তু খুব বেশি বুদ্ধিদীপ্ত নন। এবং সেই হিসেবে খুব ভালাে জেনারেলও তিনি ছিলেন না। কিন্তু আমরা তার কাছে অত্যন্ত কৃতজ্ঞ। কারণ তিনিই আপনাদের সঙ্গে আমাদের যােগাযােগ ঘটিয়েছেন। আমার বিবেচনায় ইয়াহিয়ার রাজনৈতিক ক্যারিয়ারে পিকিং-ওয়াশিংটন মৈত্রীর দূতিয়ালি তার সর্বশেষ সাফল্যের কাহিনী। তিনি সত্যিই গােপন মিশন পছন্দ করতেন। তিনি পরম ধৈর্যের সঙ্গে এ মিশনের পক্ষে কাজ করেছেন। আপনাদের এখানে আসার আগে তার সঙ্গে আমার আলাপ-আলােচনা হলাে। আমি লক্ষ্য করলাম তার অভিব্যক্তিতে ষড়যন্ত্রমূলক কূটকৌশল এখনাে দারুণ ঝিলিক দিচ্ছে। তিনি আমাকে চীনা প্রধানমন্ত্রীর সঙ্গে কী করে আলাপ-আলােচনা করতে হবে, তার কলাকৌশল সম্পর্কে জ্ঞান দিলেন। তিনি যেসব শিখিয়ে-পড়িয়ে দিয়েছিলেন, তা দেখছি এখন সবই ভ্রান্ত!
(প্রধানমন্ত্রী চৌ মুচকি হাসলেন)।

সূত্র:  ১৯৭১ আমেরিকার গোপন দলিল – মিজানুর রহমান খান – সময় প্রকাশন