You dont have javascript enabled! Please enable it!
মুজিবকে বাদ দিয়ে সংলাপে পীড়াপীড়ি
২ অক্টোবর, ১৯৭১ ‘বাংলাদেশ-পাকিস্তান সরকারের সমঝােতা’ নিয়ে মার্কিন পররাষ্ট্রমন্ত্রী রজার্স ও ভারতীয় পররাষ্ট্রমন্ত্রী শরণ সিংয়ের মধ্যে অনুষ্ঠিত বৈঠকের বিবরণ এক টেলিগ্রাম বার্তায় ইসলামাবাদ, নয়াদিল্লি ও কলকাতার মার্কিন মিশনে প্রেরণ করা হয়। এতে বলা হয়-
১. সংক্ষিপ্তসার : দুই পররাষ্ট্রমন্ত্রীর বৈঠককালে সহকারী পররাষ্ট্রমন্ত্রী সিসকো এই ইস্যুতে এর আগে ভারতীয় রাষ্ট্রদূত ঝায়ের সঙ্গে তার আলােচনার কথা অবহিত করেন। (২৭ সেপ্টেম্বর ঝায়ের সঙ্গে আলােচনাকালে সিসকো বাংলাদেশ প্রতিনিধিদের সঙ্গে পাকিস্তান সরকারের বৈঠক অনুষ্ঠানকে উৎসাহিত করতে ভারতের সহযােগিতা কামনা করেন।) পররাষ্ট্রমন্ত্রী শরণ সিং মন্তব্য করেন, দেখুন সত্যি বলতে কি, বাংলাদেশের ওপর ভারত সরকারের কোনাে প্রভাব নেই। তাদের রয়েছে তহবিল সংগ্রহের স্বাধীন উৎস। তারা বরং আমরা কেন বাংলাদেশকে স্বীকৃতি দিতে ব্যর্থ হচ্ছি, সে কারণে আমাদের ওপর নাখােশ। সিং অবশ্য একই সঙ্গে বলেন, এর অর্থ এই নয় যে, ভারত সংলাপ চায় না।
২. পররাষ্ট্রমন্ত্রী রজার্স ভারতকে সংলাপের উদ্যোগ নিতে এগিয়ে আসার আহ্বান জানান। তবে শর্ত দেন যে, ভারত যেন মুজিবের অংশগ্রহণ প্রশ্নে চাপ সৃষ্টি না করে। কারণ, যুক্তরাষ্ট্র কিভাবে একটা সমঝােতায় পৌছানাে যায়, সে নিয়ে আলােচনায় মুজিবকে জড়াতে চায় না। শরণ সিং বলেন, বাংলাদেশী। লােকজনের সঙ্গে যুক্তরাষ্ট্রের তাে যােগাযােগ রয়েছে। সুতরাং তাদের প্রভাবই বেশি। তাই সংলাপের ব্যাপারে তাদেরই উদ্যোগ নেয়া উচিত। মার্কিন পররাষ্ট্রমন্ত্রী উপসংহার টানেন এই বলে যে, বাংলাদেশ প্রতিনিধিদের সঙ্গে পাকিস্তান সরকারের সমঝােতার প্রশ্নে যুক্তরাষ্ট্র সম্ভব সব কিছুই করবে।
তিনি আশা প্রকাশ করেন যে, ভারত এ ব্যাপারে সাহায্যের হাত বাড়িয়ে দেবে। 
১ অক্টোবরে দুই পররাষ্ট্রমন্ত্রীর মধ্যে অনুষ্ঠিত বৈঠকে শরণ সিং রাজনৈতিক সমাধানে গুরুত্বারােপ করেন। (ফুটনােট এর আগের আলােচনায় শরণ সিং বলেন, প্রতিদিন পূর্ব পাকিস্তান থেকে ভারতে গড়ে প্রায় ৩৩ হাজার উদ্বাস্তু প্রবেশ করছে। এর ফলে ইতােমধ্যেই নাজুক হওয়া পরিস্থিতি আরাে গুরুতর রূপ নিয়েছে। তিনি বলেন যে, সমস্যার সমাধানে মানবিক কর্মসূচি খুবই গুরুত্বপূর্ণ এবং একটি রাজনৈতিক নিস্পত্তির বিকল্প নেই। ভারতের কাছে কোনাে নির্দিষ্ট সমাধানের ফর্মূলা নেই। কিন্তু ভারত এটা মনে করে যে, একটি সমাধানে পৌছাতে পাকিস্তানের ওপর প্রয়ােজনীয় প্রভাব খাটাতে যুক্তরাষ্ট্রের সামর্থ্য রয়েছে। যুক্তরাষ্ট্র সমস্যা সমাধানে যে উপায় উত্তম মনে করে, তা-ই অনুসরণ করতে পারে। ভারত আশা করে যুক্তরাষ্ট্র মানবিক ত্রাণ নিশ্চিত করবে। কিন্তু পররাষ্ট্রমন্ত্রী রজার্স। বলেন, এটা কিন্তু যুক্তরাষ্ট্রের সমস্যা নয়, সুতরাং সমাধানের আশায় যুক্তরাষ্ট্রের দিকে। তাকিয়ে থাকা ভারতের এক ভ্রান্তি।) সিসকো ভারতীয় পররাষ্ট্রমন্ত্রীকে যত তাড়াতাড়ি সম্ভব সংলাপ শুরুর তাগিদ দেন। তিনি বলেন, গেরিলাদের মধ্যে উগ্রপন্থিদের প্রভাবশালী হওয়ার ব্যাপারে ভারতের উদ্বেগ যথার্থ। আর সে কারণেই মুজিবকে বাদ দিয়ে হলেও সংলাপ শুরু করাটা গুরুত্বপূর্ণ। সিসকো প্রশ্ন রাখেন, মুজিবকে বাদ দিয়ে এ ধরনের একটি আলােচনা শুরু করা সম্ভব হলে, তা কি যৌথভাবে ভারত, পাকিস্তান ও যুক্তরাষ্ট্রের স্বার্থ রক্ষা করবে না? ৪. শরণ সিং উত্তর দেন- বাংলাদেশের ওপর ভারত সরকারের যথেষ্ট প্রভাব নেই।
বাংলাদেশ পূর্ব পাকিস্তান থেকে অর্থের যোগান। পাচ্ছে। বিদেশ থেকেও তাদের সগ্রহ ভালাে। উপরন্তু আমরা তাদের স্বীকৃতি দিতে ব্যর্থ হওয়ায় তারা সন্তুষ্ট নয়। তাছাড়া বাংলাদেশের প্রতিনিধিরা ভারতকে সন্দেহের চোখেও দেখছে। তাদের আশংকা আওয়ামী লীগের শীর্ষস্থানীয় নেতাদের বাদ দিয়ে আলােচনা শুরুর পরিবেশ সৃষ্টি করতে ভারত তাদের মধ্যে ভাঙন ধরানাের চেষ্টা করছে। কী না আসলে ভারত সরকার সংলাপের বিরুদ্ধে নয়। কিন্তু কথা হলাে, সেজন্য মুজিব গুরুত্বপূর্ণ। ৫. রজার্স বলেন, মুজিবের নিচের পর্যায়ে আলােচনা শুরুর অর্থ এই নয় যে, তাকে পরিত্যক্ত করা আলােচনা শুরু করার অর্থ হচ্ছে- কোন পথে সমঝােতায় পেীছা সম্ভব তা খতিয়ে দেখা শরণ সিং উত্তর দেন, বাংলাদেশের সঙ্গে যুক্তরাষ্ট্রের যােগাযােগ রয়েছে। যেহেতু তাদের বৃহত্তর প্রভাব রয়েছে, তাই তাদেরই উচিত। সংলাপ শুরুর উদ্যোগ নেয়া। এ কথার পিঠে মার্কিন পররাষ্ট্রমন্ত্রী অবশ্য পুনরুল্লেখ করেন যে, ভারতই ব্যাপকভাবে প্রভাব খাটাতে সক্ষম। ৬. ভারতীয় স্থায়ী প্রতিনিধি সেন এ সময় যুক্তরাষ্ট্রের অবস্থান পুনর্ব্যক্ত করে বলেন, আমরা বাংলাদেশ ও পাকিস্তান সরকারের মধ্যে নিম্নপর্যায়ে আলােচনা শুরুর প্রস্তাব করছি। সিসকো উত্তরে বলেন, আলােচনা শুরুর জন্য আওয়ামী লীগের সিনিয়র নেতাদের কিন্তু কোনাে অভাব নেই। এমনকি পররাষ্ট্রমন্ত্রীও রয়েছেন। সিসকো অবশ্য উভয় পক্ষের নিম্নপর্যায়ে আলােচনা শুরুর ব্যাপারে কোনাে প্রস্তাব দেননি। সিসকো বলেন, শরণ সিং যেভাবে বললেন যে, বাংলাদেশের ওপরে ভারতের তেমন কোনাে প্রভাব নেই, তা তিনি মানতে অপারগ।
উল্লেখ্য, ৭ অক্টোবরের পরে সম্পাদিত আর কোনাে নথিতে মােশতাকের গােপন মিশন নিয়ে আলােচনা দেখা যায় না। নথিপত্র থেকে ধারণা করা যায়, মােশতাক স্বশরীরে মার্কিন কর্মকর্তাদের সঙ্গে আলােচনা করেননি। একমাত্র ভগ্নদূত কাজী কাইউম। ১৬ সেপ্টেম্বর ১৯৭১ এর পরে কাইউমের সঙ্গে মার্কিন কর্মকর্তাদের আর । কোনাে বৈঠকের তথ্য জানা যায় না।
১৪ সেপ্টেম্বরের বৈঠকে কাইউম বলেছেন, মােশতাক এবং পলিটিক্যাল অফিসারের সঙ্গে প্রস্তাবিত বৈঠক নিয়ে খন্দকার মােশতাক বাংলাদেশ মন্ত্রিসভার সঙ্গে আলােচনা করেছেন। তখন মন্ত্রিসভা জানতে চেয়েছে, এ ধরনের বৈঠকের উদ্দেশ্য কি? মােশতাক কাইউমকে জিজ্ঞেস করেছেন, এটা খতিয়ে দেখতে যে, কেন মার্কিন পলিটিক্যাল অফিসার মােশতাকের সঙ্গে বৈঠক করতে চান। জবাবে পলিটিক্যাল। অফিসার বলেছেন, তার ওপর নির্দেশ এসেছে, তিনি যেন বাংলাদেশের সর্বশেষ অবস্থান জানতে মােশতাকের সঙ্গে সরাসরি কথা বলেন। এর একটা নিহিত অর্থ হচ্ছে এ ধরনের আলােচনাকালে পলিটিক্যাল অফিসার হয়তাে কিছু বিষয় পররাষ্ট্রমন্ত্রীকে অবহিত করবেন। ১৫ সেপ্টেম্বর কলকাতা থেকে প্রেরিত ২৫১০ নম্বর টেলিগ্রামে এই বিবরণ দিয়ে বলা হয়- কাইউম বলেছেন, তিনি নিজেও এ ধরনের একটি বৈঠক। অনুষ্ঠানে আগ্রহী। কিন্তু মােশতাক যদি একান্তই রাজি না হন, তাহলে তাকে বাদ দিয়ে তিনি প্রধানমন্ত্রী তাজউদ্দিন আহমেদ অথবা ভারপ্রাপ্ত প্রেসিডেন্ট নজরুল ইসলামের সঙ্গে কথা বলার সুপারিশ করবেন।
১৬ সেপ্টেম্বর পলিটিক্যাল অফিসার কাইউমের সঙ্গে আবার দেখা করেন। কাইউম এদিন বলেন, একটি ব্যক্তিগত বৈঠক অনুষ্ঠানের প্রয়ােজনীয়তা নিয়ে মােশতাকের মন থেকে সন্দেহ ঘােচেনি। তিনি শুধুই জানতে চাইছেন, এই ধরনের বৈঠক করে ফায়দা কী হবে? ১৬ সেপ্টেম্বর কলকাতা থেকে প্রেরিত ২৫১৩ নম্বর টেলিগ্রামে এ বিষয়ে আরাে তথ্য দেয়া হয় যে, পলিটিক্যাল অফিসার এ পর্যায়ে কাইউমকে বলেন, আসলে মােশতাক যা কিছুই বলুন না কেন, তাই তিনি শুনতে প্রস্তুত।  ৭ অক্টোবর ন্যাশনাল সিকিউরিটি কাউন্সিল স্টাফ একটি পর্যালােচনামূলক সারসংক্ষেপ তৈরি করে। কিসিঞ্জারের কাছে এটি পাঠানাে হয় ৭ অক্টোবরে  এই নথির প্রচ্ছদ থেকে ধারণা মেলে, এটি তৈরি করেছেন স্যামুয়েল হসকিনসন এবং রিচার্ড কেনেডি। এই নথির শুরুতেই যেসব জিনিস যুক্তরাষ্ট্রের জন্য করণীয় তার তিনটি দিকনির্দেশ করা হয়। ক. উভয় পক্ষে নিয়মিত বাহিনীর মধ্যে উত্তেজনা প্রশমন ও গেরিলা তৎপরতা হ্রাস। খ, বাংলাদেশ নেতৃবৃন্দ ও পাকিস্তান সরকারের মধ্যে সংলাপের সূচনা। গ, উদ্বাস্তু প্রবাহ হ্রাস এবং তাদের দেশে ফিরতে উৎসাহিত করা। এসব ইস্যু সম্পর্কে ইন্দিরা গান্ধী ও ইয়াহিয়া খানকে উদ্দেশ্য করে চিঠির খসড়াও প্রস্তুত করা হয়। এই নথিতে সমঝােতায় অগ্রগতি’ শীর্ষক পরিচ্ছেদে বলা হয়, স্টেট ডিপার্টমেন্ট মনে করে যে, আওয়ামী লীগকে বাদ দিয়ে সংকটের সুরাহা করতে প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়া এ পর্যন্ত যেসব রাজনৈতিক পদক্ষেপ নিয়েছেন তা ফলপ্রসূ হওয়ার লক্ষণ দেখা যাচ্ছে না। কলকাতায় বাংলাদেশ নেতৃবৃন্দের কাছে এটা। গ্রহণযােগ্য হবে না। একটি রাজনৈতিক সম্ভাবনা নিশ্চিত করতে এই নথিতে সে কারণে সুপারিশ করা হয় যে, আমাদের পরবর্তী পদক্ষেপ হবে বাংলাদেশ নেতৃবৃন্দ ও পাকিস্তান সরকারের মধ্যে কী করে একটি সংলাপ শুরু করা যায় সে লক্ষ্যে। পরিকল্পনা গ্রহণ করা। আমাদের সামনে সম্ভাব্য দুটো চ্যানেল রয়েছে।
একটি হলাে ভারত সরকার এবং অন্যটি হলাে কলকাতা ও অন্যত্র অবস্থানরত বাংলাদেশের প্রতিনিধিবৃন্দ ডিপার্টমেন্ট অব স্টেট বিশ্বাস করে, সংলাপ অনুষ্ঠানের ব্যাপারে প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়া ইতিবাচক মনােভাব দেখাতেই রাজি হবেন কিন্তু সমস্যা হলাে। আমরা যা জানি তা হলাে, বাংলাদেশ নেতৃবৃন্দ কেবল স্বাধীনতা এবং মুজিবের মুক্তির ভিত্তিতে সমঝােতায় আগ্রহী। ডিপার্টমেন্ট অব স্টেট মনে করে ভারত বাংলাদেশের। নেতৃবৃন্দকে একটি সংলাপের ব্যাপারে তাদের প্রভাব খাটাতে তখনই রাজি থাকবে যখন তারা বুঝতে পারবে ইয়াহিয়ার ওপর প্রভাব খাটাতে আমাদের প্রস্তুতি রয়েছে। সুতরাং আমাদেরকে সিদ্ধান্ত নিতে হবে, আমরা এ ধরনের একটি সংলাপের মাঝামাঝি অবস্থান নেব কি নেব না। আরব-ইসরায়েল সংঘাতের মতাে অবস্থার সৃষ্টি হলে আমরা কিন্তু একটা সমাধানে পৌছতে আশাবাদী হতে পারি।

সূত্র:  ১৯৭১ আমেরিকার গোপন দলিল – মিজানুর রহমান খান – সময় প্রকাশন

error: Alert: Due to Copyright Issues the Content is protected !!