You dont have javascript enabled! Please enable it!
ভারতের সম্মতিতে সংলাপে রাজি ছিলেন নজরুল
১৮ সেপ্টেম্বর, ১৯৭১ কলকাতায় কনসাল জেনারেলের কাছে স্টেট ডিপার্টমেন্টের আরউইন প্রেরিত টেলিগ্রামে বলা হয়, কলকাতা যেভাবে উল্লেখ করেছে বাংলাদেশ পররাষ্ট্রমন্ত্রী মােশতাক আহমেদের সঙ্গে বৈঠক অনুষ্ঠানে কাইউমের অপারগতা কিংবা শীতল মনােভাব কিন্তু ভালাে ঠেকছে না। মনে হচ্ছে মােশতাকের উদ্যোগে তেমন সাড়া মেলেনি। এর অনেক কারণ থাকতে পারে, কিন্তু আমাদের জন্য যা বিবেচ্য তা হলাে
১. অনিচ্ছুক বাংলাদেশী প্রতিনিধিদের সমঝােতায় আনার জন্য আমাদের কোনাে তৎপরতা চালানাে ঠিক হবে না।
২, এ সময়ে আমরা কাইউমের আরেকটি প্রস্তাবের কোনাে মেরিট দেখছি না। তার বিকল্প প্রস্তাব হচ্ছে, প্রধানমন্ত্রী তাজউদ্দীন আহমেদ অথবা ভারপ্রাপ্ত প্রেসিডেন্ট’ নজরুল ইসলামের সঙ্গে বৈঠকে বসতে কিন্তু আমরা অনুমান করতে পারি, এই দুজনের কেউই মােশতাকের উদ্যোগ উস্কে দেননি। সুতরাং আপনার উচিত হবে কাইউমকে কোনােভাবেই উৎসাহ না দিতে।  কাইউমকে কোনােভাবেই আপনি বলতে যাবেন না যেন আপনি এই বাংলাদেশ প্রতিনিধিদের সঙ্গে সাক্ষাতে আগ্রহী। আর যদি একান্তই দেখেন যে, কাইউম নিজেই এই দুজনের যে কারাে সঙ্গে বৈঠকের আয়ােজন করে দিচ্ছে তাহলে সে পথ খােলা রাখুন এবং এ ব্যাপারে কিছু জানামাত্র দ্রুততম সময়ে আমাদের অবহিত করবেন। ডিপার্টমেন্ট তখন ভাববে কী করা যায়।
৩. আমরা অবশ্য মােশতাকের সঙ্গে দেখা-সাক্ষাৎ অব্যাহত রাখতে চাই। এর অন্য কোনাে কারণ না হলেও এটা যাচাই করে দেখা দরকার যে, কাইউমের রিপাের্টিং মােশতাকের পূর্ববর্তী কি না বর্তমান অবস্থা কতটা যথার্থ। ডিপার্টমেন্টের সুপারিশ হচ্ছে, আপনি অব্যাহতভাবে মােশতাকের সঙ্গে যােগাযােগের চেষ্টা চালিয়ে যাবেন। এটা করতে গিয়ে যে চ্যানেলকে উপযুক্ত ভাববেন সেটাই বেছে নেবেন। কাইউমকে এড়ানাের চেষ্টা করাই ভালাে। কারণ তার সাম্প্রতিক মতিগতি ভালাে ঠেকছে না। ক্রমেই তিনি যেন আবেগাপ্লুত এবং অস্থিরতায় ভুগছেন। তবে মনে রাখবেন, আপনাকে কিন্তু বাড়তি সতর্কতা অবলম্বন করে চলতেই হবে। আমরা। মােশতাকের কাছে পৌছে দেয়ার জন্য যে গুরুত্বপূর্ণ’ বার্তা পেয়েছি তার সম্ভাব্য প্রতিক্রিয়া স্মরণে রাখতে হবে। কারণ, সেখানে বা অন্যত্র উচ্চ পর্যায়ের বৈঠকের প্রস্তাব পাওয়া গেছে। এটা হতে পারে নিউইয়র্কে জাতিসংঘের সাধারণ অধিবেশনে বৈঠকের অংশ। মােশতাকের সঙ্গে যদি বৈঠক হয়, তাহলে এটা কিন্তু জানাতে ভুলবেন
যে, সমঝােতার ব্যাপারে প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়ার আগ্রহ রয়েছে।
২১ সেপ্টেম্বর, ১৯৭১
ফুটনােট ২০ সেপ্টেম্বর কলকাতার কনসাল জেনারেল স্টেট ডিপার্টমেন্টকে জানান যে, কলকাতায় বাংলাদেশ নেতৃবৃন্দ মার্কিন সরকারের প্রতিনিধির সঙ্গে বৈঠকে বসার প্রশ্নে বিভক্ত হয়ে পড়েছেন। কাইউম একজন বার্তাবাহকের মাধ্যমে জানিয়েছেন, মােশতাক আহমেদ এবং তাজউদ্দীন আহমেদ এ ধরনের বৈঠকে যােগ দিতে রাজি নন। ভারপ্রাপ্ত প্রেসিডেন্ট নজরুল ইসলাম অবশ্য কনসাল জেনারেলের অফিসের একজন পলিটিক্যাল অফিসারের সঙ্গে বৈঠকে ‘আগ্রহী’ (Keen) (কলকাতা থেকে পাঠানাে টেলিগ্রাম ২৫২৭, ২০ সেপ্টেম্বর)। স্টেট ডিপার্টমেন্ট থেকে কলকাতার কনসাল জেনারেলের কাছে পাঠানাে টেলিগ্রামে (ভ্যানহােলেন, সিসকো ও আরউইন অনুমােদিত) বলা হয়, বাংলাদেশের কোনাে রাজনৈতিক নেতৃত্বের সদস্যের সঙ্গে এ পর্যন্ত কোনাে মার্কিন কর্মকর্তা যােগাযােগ স্থাপন হয়নি। পলিটিক্যাল অফিসারকে অবশ্য ভারপ্রাপ্ত প্রেসিডেন্ট নজরুল ইসলামের সঙ্গে বৈঠকের অনুমতি দেয়া হয়েছে। আমাদের কাছে এই বৈঠকের অর্থ হচ্ছে- ক, ‘বাংলাদেশ সরকারের তরফ থেকে এ পর্যায়ে কোনাে রাজনৈতিক আপােস প্রশ্নে সত্যিই কোনাে আগ্রহ রয়েছে কি না? খ. বর্তমানে বাংলাদেশের প্রতিনিধিদের চাহিদা কী? গ. নজরুল ইসলাম এবং তার মাধ্যমে বাংলাদেশ মন্ত্রিসভাকে এটা জানানাে যে, আমরা ইতােমধ্যেই সমঝােতার ব্যাপারে বাংলাদেশের সম্ভাব্য আগ্রহের কথা প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়াকে জানিয়ে দিয়েছি (ফুটনােট ২১ সেপ্টেম্বর ইয়াহিয়া তার আগ্রহ পুনব্যক্ত করেন)। টেলিগ্রামে উল্লেখ করা হয়,
১. আমরা বিশ্বাস করি, বর্তমান মুহূর্তে বাংলাদেশ সরকারের উচ্চ পর্যায়ের কর্মকর্তারা অন্তত এটা ভালােই বুঝতে পারেন যে, ইয়াহিয়া সরকারের পক্ষ থেকে সমঝােতামূলক সমাধানে আগ্রহ রয়েছে। আপনি কিন্তু এই অবস্থান অব্যাহত রাখবেন যে, আমরা কিন্তু এই প্রক্রিয়ার সাতেপাঁচে নেই। আমরা শুধুই বার্তাবাহক। না চাইছি সমঝােতা, না চাইছি আলােচনায় অংশ নিতে। আমাদের এই ভূমিকার কথা যদি তেমন পরিস্থিতি আসে তাহলে প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়াকেও জানিয়ে দিতে কুণ্ঠিত হবেন না।
২. আপনি কিন্তু পূর্ব পাকিস্তানে জাতিসংঘের ত্রাণ তৎপরতার প্রতি শ্রদ্ধাশীল হতে বাংলাদেশ সরকার ও মুক্তিবাহিনীর সঙ্গে বৈঠকের সুযােগ পেলে তাদের জানিয়ে দেবেন।
৩. ডিপার্টমেন্ট বিশ্বাস করে, কাইউমকে যােগাযােগের মাধ্যম হিসেবে বাদ দেয়াই সমীচীন। নজরুল ইসলামের সঙ্গে যদি বৈঠকের সুযােগ আসে তাহলে বিকল্প কাউকে খুঁজে বের করার চেষ্টা করতে হবে। তাহলে বিকল্প মাধ্যমে আমরা নজরুল ও বাংলাদেশ মন্ত্রিসভার সঙ্গে যােগাযােগ রক্ষা করব (ফুটনােট একটি স্বাক্ষরবিহীন নথি থেকে মুদ্রিত এই নির্দেশনাপ্রাপ্তির এক সপ্তাহ পরে কনসাল জেনারেল ইঙ্গিত দেন, নজরুল ইসলামের সঙ্গে বৈঠক অনুষ্ঠানে তার প্রচেষ্টাকে কেউ থামিয়ে দিয়েছে। সুতরাং ইসলামের সঙ্গে যােগাযােগের একমাত্র মাধ্যম কাইউমই থাকল। কাইউম বার্তা পাঠিয়েছে, নজরুল ইসলাম এখনাে পর্যন্ত একজন মার্কিন পলিটিক্যাল অফিসারের সঙ্গে আলােচনায় আগ্রহী, কিন্তু সেজন্য তাকে ভারত সরকারের কাছ থেকে অনুমতি লাভ করতে হবে (কলকাতা থেকে প্রেরিত টেলিগ্রাম ২৫৭০, ২৮ সেপ্টেম্বর)।
৩০ সেপ্টেম্ব, ১৯৭১
এক সম্পাদকীয় নােটে বলা হয়, প্রেসিডেন্ট নিক্সন ও হেনরি কিসিঞ্জার হােয়াইট হাউসে এদিন ব্রিটিশ পররাষ্ট্রমন্ত্রী স্যার এলেক্স ডগলাস হােম এবং রাষ্ট্রদূত ক্রমারের সঙ্গে বিস্তারিত আলােচনা করেন। দক্ষিণ এশিয়ার সংকট নিয়ে আলােচনা করতে গিয়ে ডগলাস হােম উল্লেখ করেন, একটি রাজনৈতিক সমঝােতার জন্য বাংলাদেশ নেতৃবৃন্দের সঙ্গে আলােচনার গুরুত্ব কতটা? কিসিঞ্জার জবাবে বলেন, কলকাতায় বাংলাদেশের লােকজনের সঙ্গে আমরা যােগাযােগ রক্ষা করে চলেছি। ভারতের বাইরে পশ্চিম পাকিস্তানি ও বাংলাদেশের প্রতিনিধিদের মধ্যে একটি বৈঠক অনুষ্ঠানের আমরা। একটা উদ্যোগ নিয়েছি এবং সে লক্ষ্যে ইয়াহিয়ার কাছ থেকে সম্মতিও আমরা পেয়েছি। কিন্তু ভারতীয়রা এখন এটা পুরােপুরি ব্যর্থ করে দিতে চাইছে। যেসব লােক এ সমঝােতা চাইছে তাদের জীবন কঠিন করে তুলছে তারা। তাদের সবকিছুই পরীক্ষা-নিরীক্ষা করাতে ভারত তাদের বাধ্য করছে। যেসব বিষয় বাস্তবায়ন করা সম্ভব নয়, তারা অনবরত সেসব দাবি তুলছে। নিক্সন মনে করেন যে, ভারতীয়রা সংকটের একটি নিপত্তি প্রতিরােধ করতে মরিয়া।
তার কথায় তারা একটি খেলা খেলছে। আমি মনে করি এই খেলাটা তাদের ভুল, আমার ধারণা কোনাে সমাধান যাতে না হয়, সে লক্ষ্যে তারা সুপরিকল্পিতভাবে বাধা দিচ্ছে। এদিনের আলােচনার শেষ দিকে কিসিঞ্জার বলেন, ‘সত্যি বলতে কী, বাংলাদেশের মানুষ আলােচনার জন্য সম্পূর্ণভাবে উদগ্রীব। প্রথমত, তারা স্বায়ত্তশাসনের ইস্যুর নিপত্তি চায়। আর আমরা তাে সবাই জানিই যে, এই স্বায়ত্তশাসনই তাদের জন্য স্বাধীনতা এনে দেবে। এটা ছাড়া অন্য কোনাে দিকে পানি গড়াতেই পারে না। কিন্তু মুশকিল হচ্ছে ভারতীয়দের নিয়ে। তারা অনতিবিলম্বে পূর্ণ স্বাধীনতা লাভে তাদের আকাঙ্ক্ষাকে উস্কে দিচ্ছে। কিসিঞ্জার বলেন, ইয়াহিয়া কখনােই এই দাবি মেনে নেবেন না। একটা তাে আসলে মুখ রক্ষার ফর্মুলা বের করতে হবে। একটা ক্রান্তিকাল তাে অতিক্রম করতে দিতে হবে। এ সময় নিক্সন আগামী নভেম্বরে প্রধানমন্ত্রী গান্ধীর যুক্তরাষ্ট্র সফর নিয়ে কথা বলেন। তিনি আশা প্রকাশ করেন যে, যুক্তরাষ্ট্র ও যুক্তরাজ্য গান্ধীর সঙ্গে আলােচনার বিষয়বস্তু নিয়ে যথাসময়ে মতবিনিময় করবে। নিক্সন বলেন, এটা কিন্তু গুরুত্বপূর্ণ।

সূত্র:  ১৯৭১ আমেরিকার গোপন দলিল – মিজানুর রহমান খান – সময় প্রকাশন

error: Alert: Due to Copyright Issues the Content is protected !!