You dont have javascript enabled! Please enable it!
ইয়াহিয়া-মোশতাক মধ্যস্থতায় দ্বিধা-দ্বন্দ্ব
পাকিস্তানে নিযুক্ত মার্কিন রাষ্ট্রদূত ফারল্যান্ড লিখেছেন, কলকাতায় বাংলাদেশ প্রতিনিধিদের সঙ্গে যােগাযােগ সংক্রান্ত তথ্য সরবরাহ করায় ইয়াহিয়ার প্রতিক্রিয়া ছিল অনুকূল ও ইতিবাচক।’ ২৪ আগস্ট ‘৭১ স্টেট ডিপার্টমেন্টে প্রেরিত টেলিগ্রামে ফারল্যান্ড আরাে উল্লেখ করেন, আমি যে তাকে এই ধরনের গােয়েন্দা তথ্য সরবরাহ করেছি ইয়াহিয়া তাতে খুবই খুশি হয়েছেন। তিনি অনুভব করছেন, মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র তাদের রাজনৈতিক ও কূটনৈতিক অবস্থানের ক্ষেত্রে সঠিক পন্থাই অনুসরণ করছে। তিনি আশা প্রকাশ করেন, মার্কিন কর্মকর্তারা তাদের প্রথাগত সাবধানতা ও ডিসক্রিশন বলে উপযুক্ত যােগাযােগ রক্ষা করে চলবে। ইয়াহিয়া উল্লেখ করেন, তার বিরাট আশাবাদ যে, পাকিস্তানের দুই অংশের মধ্যে স্বাভাবিক রাজনৈতিক অবস্থার পুনরুজ্জীবন ঘটাতে তিনি সক্ষম হবেন। এর মধ্যে পূর্বাংশে ব্যাপকভিত্তিক অর্থনৈতিক ও রাজনৈতিক সমন্বয় ঘটাতে তিনি উদগ্রীব। এ লক্ষ্যে তিনি যথেষ্ট প্রস্তুতি নিয়েছেন। ইয়াহিয়া অভিমত দেন, আমি বুঝতে পারছি না, যেসব এমপিএ এবং এমএনএ’র বিরুদ্ধে ইতােমধ্যেই সব অভিযোেগ প্রত্যাহার করে নেয়া হয়েছে তারা কেন এগিয়ে আসছে না। তারা এগিয়ে এলেই তাে তিনি অতি দ্রুত পূর্ব পাকিস্তানে ক্ষমতা হস্তান্তর করতে পারেন। এসব বিষয়ে সাধারণ আলােচনার পরে আমি ইয়াহিয়াকে জিজ্ঞাস করলাম, আচ্ছা বলুন তাে, আপনি কি মনে করেন, আওয়ামী লীগের প্রতিনিধিদের সঙ্গে তৃতীয় কোনাে দেশে সংলাপ অনুষ্ঠানে বড় কোনাে প্রতিবন্ধকতা আছে? কাইউম যাদের দিকে ইঙ্গিত করেছেন, সেসব গুরুত্বপূর্ণ প্রতিনিধিরা এ ধরনের সংলাপে যােগ দিতে পারেন। তবে এটা করতে হবে গােপনে। নিশ্চিত করতে হবে যাতে বিষয়টি কোনােভাবেই প্রচার না পায়। আমি বললাম, এ ধরনের হাইপােথিটিক্যাল বৈঠকের মাধ্যমে যৌথভাবে সম্ভাব্য রাজনৈতিক সমঝােতার নানা দিক চিহ্নিত করা যেতে পারে। এ ধরনের আলােচনার ফলে উদ্বাস্তু, খাদ্য বণ্টন ও পুনর্বাসনের মতাে সংশ্লিষ্ট নানা বিষয়ে অর্থবহ উপায়ও বেরিয়ে আসতে পারে। জবাবে ইয়াহিয়া বলেন, তিনি এ ধরনের একটি অগ্রগতি সর্বান্তকরণে রূপ দিতে আগ্রহী। সুতরাং এ ব্যাপারে যখনই কোনাে নতুন অগ্রগতি ঘটবে, তখনই তিনি এ ব্যাপারে তাকে অবহিত করতে অনুরােধ জানান। ফারল্যান্ড এ পর্যায়ে মন্তব্য করেন, প্রতীয়মান হচ্ছে বর্তমান পরিস্থিতিতে বহুমুখী শক্তি নানা খেলা খেলছে। প্রথমত, অন্তত কিছু বাংলাদেশী এমনটা উপলব্ধি করছেন, তাদের অর্জিত স্বাধীনতা ভারতের স্বার্থ দ্বারা বেদনাদায়কভাবে সীমিত থাকবে। আর সে কারণেই স্বাধীনতা হতে পারে তাদের কাছে এক অলীক কল্পনা। দ্বিতীয়ত, ইয়াহিয়া শেষ পর্যন্ত এই সিদ্ধান্তে আসতে পারেন, আক্রমণের যে কৌশল তিনি অবলম্বন করছেন, তাতে তার ক্ষুধার নিবৃত্তি ঘটছে না। আর সে কারণেই যেটুকু অগ্রগতি ঘটেছে তা হয়তাে নিকষ অন্ধকারে ক্ষীণ আলাের স্ফুরণ।’
৩১ আগস্ট, ১৯৭১
এই টেলিগ্রাম খসড়া তৈরি হয় ২৫ আগস্ট। হােয়াইট হাউসে এটি পরিমার্জিত হয় ৩০ আগস্ট এবং অনুমােদনের পরে তা ইসলামাবাদ, কলকাতা, নয়াদিল্লি, লন্ডন ও ঢাকার মার্কিন মিশনে প্রেরণ করা হয়। এতে পররাষ্ট্রমন্ত্রী রজার্স উল্লেখ করেন,
১, আমরা একমত, রাষ্ট্রদূত ফারল্যান্ডের কাছে প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়া যে প্রতিক্রিয়া ব্যক্ত করেছেন, তাতে আশার ক্ষীণ আলাে হয়তাে রয়েছে। কিন্তু আমরা তাই বলে বিশ্বাস করি না, এই ইস্যুতে মধ্যস্থতা করার ভূমিকা পালনের সুযােগ যুক্তরাষ্ট্রের সামনে এসেছে। অন্যদিকে আমরা অবশ্য বর্তমান পরিস্থিতিতে সততার সঙ্গে মধ্যস্থতাকারীর ভূমিকা পালনের পথে আরেকটি ধাপ এগিয়ে যাওয়ার মধ্যে যুক্তি খুঁজে পেতে পারি। এর অর্থ হলাে কোনাে একটা নিরপেক্ষ ভূখণ্ডে উভয় পক্ষকে আলােচনায় বসতে সহায়তা করতে পারি। যাতে তারা ভবিষ্যতে সিরিয়াস আলােচনায় নিজেদের সম্পৃক্তি করতে পারে।
২. প্রথম পদক্ষেপ নিতে হবে রাষ্ট্রদূত ফারল্যান্ডকেই অবশ্য তিনি যদি বড় কোনাে সমস্যার মুখে না পড়েন। আমাদের ধারণাগুলাে আমরা ইয়াহিয়াকে অবহিত করতে পারি। কোনাে প্রকার ওকালতি না করে শুধুই তার প্রতিক্রিয়া পর্যবেক্ষণ করতে পারি। আমাদের দৃষ্টিভঙ্গি থাকবে বিপদের দিনে বন্ধু যেভাবে পাশে দাড়ায়। এটা মনে রাখতে হবে, ইয়াহিয়া না চাইলে আমরা কিন্তু বাংলাদেশ প্রতিনিধিদের সঙ্গে আর কোনাে আলােচনায় জড়াব না।
৩. আমাদের মনে হচ্ছে কাইউম যে প্রস্তাব নিয়ে হাজির হয়েছেন, তা সত্যি কতটা যথার্থ তা আরেকবার যাচাই করে নেয়া বুদ্ধিমানের কাজ হবে। আমাদের বিবেচনায় এটা করতে হলে কলকাতায় বাংলাদেশ পররাষ্ট্রমন্ত্রী’ মােশতাক আহমেদের সঙ্গে সরাসরি যােগাযােগ করাই উচিত হবে। দ্রুততম সময়ে এর চেয়ে অধিকতর ভালাে ফল লাভের আর কোনাে উপায় নেই।
তার সঙ্গে কথা বলে যদি মনে হয়, কাইউম যা বলেছেন তা ঠিক, তাহলে মােশতাককে আমরা জানিয়ে দিতে পারি, আপনারা যে প্রস্তাব দিয়েছেন, তার সার কথা আমরা ইতােমধ্যেই প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়াকে অবহিত করেছি।
৪. আমরা মােশতাক আহমেদকে আরাে জানিয়ে দেব, বাংলাদেশ প্রতিনিধিদের সঙ্গে পাকিস্তান সরকারের বৈঠক অনুষ্ঠানের ইয়াহিয়া আগ্রহ দেখিয়েছেন। এটা শুনে মােশতাক যদি নতুন করে কোনাে তথ্য দেন, তাহলে আমরা ইয়াহিয়াকে পুনরায় জানিয়ে দিতে পারি। আমরা যদি লক্ষ্য করি, উভয় পক্ষ আলােচনায় বসতে আন্তরিক, তাহলে আমরা সেক্ষেত্রে কতদূর কী ভূমিকা পালন করব অথবা করব না, তা নির্ধারণ করব।
৫. সতর্কতা- আমরা বিশ্বাস করি যে, এ ব্যাপারে পদক্ষেপ নিতে যথেষ্ট সতর্কতা অবলম্বন করতে হবে। পাকিস্তান সরকার এবং বাংলাদেশ প্রতিনিধিদের মধ্যে প্রত্যক্ষ যােগাযােগের খবর ফাঁস হয়ে পড়লে বিপদ আছে। আমাদের ভূমিকা চিহ্নিত হবে অথবা মুশতাক আহমেদের সঙ্গে আমাদের যােগাযােগের কথা জানাজানি হলে এই প্রক্রিয়ার হঠাৎ মৃত্যুর কারণ হতে পারে। সবচেয়ে বড় কথা, প্রতিটি পা ফেলতে গিয়ে সবসময় আমাদের মনে রাখতে হবে শেষ পর্যন্ত এসব সমঝােতার প্রভাব মার্কিন নীতির ওপর কতটা বৃহত্তর প্রভাব ফেলবে। আমাদের এটাও মনে রাখতে হবে, কারা। এই সমঝােতার প্রক্রিয়াকে বানচাল করতে আগ্রহী? আমরা ধরে নিতে পারি, এ ধরনের লােক পাকিস্তান, ভারত ও বাংলাদেশ আন্দোলনের মধ্যেই রয়েছে।
৬. কলকাতার জন্য রাষ্ট্রদূত ফারল্যান্ড যদি ইয়াহিয়ার অনুমােদন পান, তাহলে আপনি (কলকাতার কনসাল জেনারেল) যত তাড়াতাড়ি সম্ভব বাংলাদেশ পররাষ্ট্রমন্ত্রী মােশতাক আহমেদের সঙ্গে যােগাযােগ করবেন। কিন্তু তাকে একথা জানিয়ে দিতে হবে যে, আমরা শুধু এ সংক্রান্ত বার্তাই পৌছে দেব। মধ্যস্থতাকারীর ভূমিকায় অবতীর্ণ হব না। মােশতাক আহমেদকে ভিসা প্রদানের প্রশ্ন যদি আসে, তাহলে আপনি স্টেট ডিপার্টমেন্টের ১৫৪০৭৮ নম্বরে প্রেরিত বার্তায় উল্লিখিত নির্দেশনা অনুসরণ করবেন। অর্থাৎ আপনি বলবেন, ভিসা চেয়ে আপনি যে অনুরােধ করেছেন, তা আমরা ওয়াশিংটনে পাঠিয়ে দিয়েছি। সাবধান। আপনি কিন্তু কোনাে অবস্থাতেই এ ব্যাপারে তাকে উৎসাহ জোগাবেন না। আপনি তাকে এ কথাও বলতে পারেন, মােশতাক সাহেব, এখন যেহেতু পাকিস্তান সরকারের সঙ্গে বাংলাদেশের একটা যােগাযােগ অব্যাহত রয়েছে, তখন আপনার যুক্তরাষ্ট্র সফর একটু বিলম্বিত করলে ভালাে হয় না। কি? মােশতাক আহমেদকে যদি কলকাতায় না পাওয়া যায়, তবে তার গন্তব্য সম্পর্কে দ্রুততম সময়ে অবহিত করতে হবে।
মার্কিন পররাষ্ট্রমন্ত্রী রজার্স এ পর্যায়ে সব মিশনের উদ্দেশ্যে নিম্নরূপ দিকনির্দেশনা দেন।
৭. আমরা নিম্নোক্ত বিষয়ে অব্যাহতভাবে বিশ্লেষণ ও মন্তব্য আশা করি। ক, পাকিস্তান সরকার ও বাংলাদেশ প্রতিনিধিদের মধ্যে সম্ভাব্য সমঝােতা। খ, মুক্তিবাহিনীসহ বাংলাদেশ আন্দোলনের সঙ্গে সংশ্লিষ্টরা ‘স্বাধীনতা বনাম সমঝােতা প্রশ্নে অভ্যন্তরীণ টানাপােড়েন ও বিভক্তি। গ. ইয়াহিয়া ঠিক কী ধরনের আপােসমূলক ফর্মুলা পশ্চিম পাকিস্তানি সামরিক বাহিনী ও রাজনীতিকদের গেলাতে পারবেন। ঘ, কোনাে সমঝােতার জন্য মুজিবের মুখ্য ভূমিকা দাবি করছেন বাংলাদেশ প্রতিনিধিরা, অন্যদিকে দৃশ্যত ইয়াহিয়ার দরকার বিচ্ছিন্নতাবাদী বলির পাঁঠা’- এ দুয়ের মধ্যে কি করে সমন্বয় আনা যায়। এছাড়াও এ সংক্রান্ত অন্য যে কোনাে পরামর্শ ও সুপারিশ স্টেট ডিপার্টমেন্ট স্বাগত জানাবে। বার্তাটি এখানেই শেষ  তবে ফুটনােটে লেখা আছে, রাষ্ট্রদূত ফারল্যান্ড স্টেট ডিপার্টমেন্ট প্রেরিত বার্তার সঙ্গে একমত হয়েছেন এবং ইঙ্গিত দিয়েছেন যে, ৪ সেপ্টেম্বরে ইয়াহিয়ার সঙ্গে অনুষ্ঠেয় বৈঠকে তিনি এই ইস্যুতে কথা বলবেন। তিনি মন্তব্য করেন, এই সমঝােতার প্রক্রিয়ায় ইয়াহিয়া যেমনটি চাইবেন, ঠিক তেমন পন্থাই তারা অনুসরণ করবেন। এরপরের বার্তায় উল্লেখ করা হয়, ইয়াহিয়া ৪ সেপ্টেম্বরে বাংলাদেশ প্রতিনিধিদের সঙ্গে গােপন যােগাযােগে অনুমােদন দেন। এই পরিপ্রেক্ষিতে কলকাতার কনসাল জেনারেলকে স্টেট ডিপার্টমেন্ট থেকে নির্দেশ দেয়া হয় যে, তিনি যেন এ ব্যাপারে অগ্রসর হন। ৩ সেপ্টেম্বর, ১৯৭১ ন্যাশনাল সিকিউরিটি কাউন্সিলের হেরাল্ড স্যান্ডার্স ও স্যামুয়েল হসকিনসন কিসিঞ্জারের কাছে এক সারসংক্ষেপ উপস্থাপন করেন এভাবে, ‘বাংলাদেশ-পশ্চিম পাকিস্তানি আলােচনা ৪ সেপ্টেম্বর রাষ্ট্রদূত ফারল্যান্ড যদি ইয়াহিয়ার কাছ থেকে সবুজ সংকেত পান এবং বাংলাদেশ প্রতিনিধিরা একমত হন, তাহলে আমরা শিগগিরই তাদের মধ্যকার গােপন আলােচনার ঘনিষ্ঠ পক্ষ হতে পারি ।
তখন প্রধান ইস্যু হবে, অবশ্য যদি তেমন মুহূর্ত আদৌ আসে, আমরা একটি নিস্পত্তির ক্ষেত্রে কি ধরনের প্রভাব খাটাতে পারি। সিসকো (সহকারী পররাষ্ট্রমন্ত্রী) কিন্তু মনে করেন, মধ্যপ্রাচ্যের মতােই, মধ্যস্থতা করার সুযােগ যদি এসেই যায়, তাহলে আমাদের কালবিলম্ব করা উচিত হবে না। একেবারে ঝাপিয়ে পড়তে হবে।’  এই ইস্যুটি ৮ সেপ্টেম্বর, ১৯৭১ কিসিঞ্জারের নেতৃত্বাধীন ওয়াশিংটন স্পেশাল অ্যাকশন গ্রুপের বৈঠকে আলােচিত হয় এভাবে। ‘কিসিঞ্জার আমরা কি এখন বাংলাদেশ প্রতিনিধিদের নিয়ে আলােচনা করতে পারি? সিসকো আমরা এখন অখণ্ড পাকিস্তানের মধ্যে কি করে একটা রাজনৈতিক আপােসরফা করা যায়, তা নিয়ে বাংলাদেশ প্রতিনিধিদের চিন্তাভাবনা জানার চেষ্টা করছি। আমরা মনে করি, ছয় দফা এখন স্টেডিয়ামের মধ্যে। আমরা ইয়াহিয়ার অনুরােধে বাংলাদেশ বিষয়ক বার্তা পাঠিয়ে দিয়েছি। ইয়াহিয়া আমাদের তৎপরতার প্রশংসা করেছেন এবং আমরা তাকে নিশ্চয়তা দিয়েছি, আমরা কোনাে উল্লেখযােগ্য অবস্থান গ্রহণ করিনি।
কিসিঞ্জার এটা খুবই সহায়ক হতে পারে। আরউইন তবে অনেকটাই নির্ভর করছে মুজিবের ট্রিটমেন্টের ওপর।

সূত্র:  ১৯৭১ আমেরিকার গোপন দলিল – মিজানুর রহমান খান – সময় প্রকাশন

error: Alert: Due to Copyright Issues the Content is protected !!