মােশতাকের গােপন মিশনের চাঞ্চল্যকর বৃত্তান্ত
৭১ এর আগস্টে কলকাতায় মার্কিন মিশনের সঙ্গে প্রথম যােগাযােগ স্থাপন করেন কাজী জহিরুল কাইউম। কনসাল জেনারেল গর্ডন ৭ আগস্ট স্টেট ডিপার্টমেন্টে প্রেরিত টেলিগ্রামের সার সংক্ষেপে উল্লেখ করেন, ‘আওয়ামী লীগ নেতাদের মধ্যে মতানৈক্য নেই। তারা সর্বসম্মতভাবে পাকিস্তান সরকারের সঙ্গে একটা আপােসমূলক নিষ্পত্তি চায়। কাইউম বলেন, বাংলাদেশ মন্ত্রীর কাছে এ ব্যাপারে নির্দিষ্ট দিকনির্দেশনা রয়েছে। মন্ত্রী আশা করেন, বর্তমানে যে অচলাবস্থা বিরাজমান তা নিরসনে সংশ্লিষ্ট পক্ষগুলাের সঙ্গে আলােচনা করে নিষ্পত্তি সম্ভব। তবে তার পূর্বশর্ত হচ্ছে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রকে উদ্যোগ নিতে হবে। কাইউম বলেন, বাংলাদেশে সামরিক শক্তি বর্তমানে দুটি কনভেনশনাল ডিভিশন গঠনের চেষ্টা করছে। এছাড়া গেরিলারা তাে রয়েছেই। ওই ডিভিশন যখন গঠন করা সম্ভব হবে তখনই পূর্ববাংলার ভূখণ্ড দখল করার পরিকল্পনা নেয়া হবে।’ এই টেলিগ্রামের ফুটনােটে লেখা হয়েছে ১ জুলাই কনসাল জেনারেলের অফিসের একজন রাজনৈতিক কর্মকর্তা এবং আওয়ামী লীগের প্রতিনিধি কাজী জহিরুল কাইউমের সঙ্গে বৈঠক হয়। কাইউম কর্মকর্তাকে বলেছেন, ভারত ও পাকিস্তানের মধ্যে যুদ্ধ বেধে গেলে উদ্ভূত সম্ভাব্য পরিস্থিতি সম্পর্কে আওয়ামী লীগের নেতৃবৃন্দ উদ্বিগ্ন। তারা আশঙ্কা করছেন, পূর্ব পাকিস্তানের গেরিলাযুদ্ধ যদি প্রলম্বিত হয় তাহলে বাংলাদেশ আন্দোলনের নেতৃত্ব চরমপন্থিরা কব্জা করতে পারে। আর সেই ভীতি থেকেই আওয়ামী লীগ এখনই একটি রাজনৈতিক আপােস চাইছে। এজন্য তারা পূর্ণ স্বাধীনতা থেকেও পিছিয়ে আসতে প্রস্তুত রয়েছে। কাইউম এ লক্ষ্যে আওয়ামী লীগের প্রতিনিধি, পাকিস্তান, মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র ও ভারতের সঙ্গে মিলেমিশে একটা সমঝােতায় আসতে চায়। কিন্তু কাইউম স্পষ্ট করেন যে, আলােচনার প্রক্রিয়া যা-ই হােক না কেন, তাতে শেখ মুজিবুর রহমানের অংশগ্রহণের কোনাে বিকল্প নেই।
গর্ডন তার বার্তায় উল্লেখ করেন-
১. পলিটিক্যাল অফিসার ৭ আগস্ট আবার কুমিল্লা থেকে নির্বাচিত আওয়ামী লীগের এমএনএ কাজী জহিরুল কাইউমের সঙ্গে সাক্ষাৎ করেন। তিনি নিশ্চিত করেন, বাংলাদেশের পররাষ্ট্রমন্ত্রী খন্দকার মােশতাক আহমেদের সুনির্দিষ্ট নির্দেশে তিনি কনসাল জেনারেলের সঙ্গে যােগাযােগ করেন। কাইউম দুটি বিষয়ের প্রতি গুরুত্ব দেন। প্রথমত, যুক্তরাষ্ট্রই একমাত্র দেশ যে সাফল্যের সঙ্গে একটা সমঝােতায় পৌছানাের চেষ্টা করতে সক্ষম। দ্বিতীয়ত, এধরনের নিপত্তির ক্ষেত্রে অবশ্যই শেখ মুজিবুর রহমানকে রাখতে হবে। কাইউম বলেন, যদি মুজিবের বিচার করা হয়, ফাঁসি কার্যকর করা হয়, তাহলে আপােসের সম্ভাবনা নেমে যাবে শূন্যের কোঠায়। বাংলাদেশের মন্ত্রিসভায় অন্য যেসব আওয়ামী লীগের নেতা রয়েছেন, তাদের কোনােই নিয়ন্ত্রণ নেই বাংলাদেশের জনগণের ওপর। আর সে কারণে কোনাে আপােসরফায় পৌছাতে তারা অপারগ। অন্য দিকে মুজিবকে নিয়ে যদি কোনাে আপােসরফা করা সম্ভব হয় তাহলে তা জনগণের কাছে গ্রহণযােগ্যতা পাবে। এমনকি একটা স্থিতাবস্থা প্রত্যাবর্তন সম্ভব হতে পারে। কাইউম বলেন, শেখ মুজিবের অনুমােদিত সমঝােতার আওতায় উদ্বাস্তুরা দেশে ফিরে যাবে। কাইউম মনে করেন, পাকিস্তানকে সীমিত অস্ত্রসরবরাহের সিদ্ধান্ত নিয়ে যুক্তরাষ্ট্র সঠিক নীতি অনুসরণ করেছে। সে কারণেই রাজনৈতিক সমঝােতার জন্য যুক্তরাষ্ট্র পাকিস্তান সরকারকে সহজেই রাজি করাতে পারবে।
২. কাইউমের মতে আওয়ামী লীগ নেতারা মনে করেন, ভারত ও পাকিস্তান যুদ্ধে জড়িয়ে পড়ার এক বিরাট সম্ভাবনা রয়েছে। হয়তাে আগামী ১৫/২০ দিনের মধ্যেও এটা ঘটতে পারে। আর তা নিশ্চিতভাবেই উপমহাদেশের প্রত্যেকের জন্য বড় বিপজ্জনক। কাইউম বলেন, গুজব রয়েছে, ভারত শিগগিরই বাংলাদেশ সরকারকে স্বীকৃতি দিতে পারে। আর এটা বাস্তবে রূপ পেলে পাক-ভারতের সংঘাত তীব্রতর হবে, রাজনৈতিক সমঝােতার সম্ভাবনা হ্রাস পাবে। যুদ্ধের সম্ভাবনাও অধিকতর বৃদ্ধি। পাবে। যদি যুদ্ধ আসে তাহলে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের চেয়ে সােভিয়েত ইউনিয়নের পক্ষেই শান্তিপূর্ণ আপােস-রফার প্রক্রিয়ায় নেতৃত্বদানের সুযােগ সৃষ্টি হবে। আর সে ধরনের পরিস্থিতি হবে আওয়ামী লীগের জন্য প্রতিকূল।
৩. কাইউম বলেন, হাতে সময় অল্পই আছে। তাই তিনি যুক্তরাষ্ট্রকে যথাসম্ভব তাড়াতাড়ি তৎপর হতে অনুরােধ জানান। তিনি বলেন, যুক্তরাষ্ট্রই ভালাে জানে বিদ্যমান পরিস্থিতিতে কী করে সমঝােতা শুরু করতে হয়। তিনি সুপারিশ রাখেন, এক্ষেত্রে প্রথম পদক্ষেপ হবে পাকিস্তান সরকারকে এটা জানানাে যে, আওয়ামী লীগ সমঝােতার জন্য প্রস্তুত। এটা ওয়াশিংটনে পাকিস্তানি রাষ্ট্রদূত অথবা ইসলামাবাদে মার্কিন দূতাবাসের মাধ্যমে পাকিস্তানকে জানানাে যেতে পারে। তিনি নির্দিষ্ট করে বলেন, আমার সঙ্গে আপনার যেসব কথাবার্তা হলাে প্রয়ােজনে তার খুঁটিনাটি পাকিস্তান সরকারের কাছে প্রকাশ করতে পারেন। কাইউম বলেন, তিনি ব্যক্তিগতভাবে পাকিস্তান সরকারের সঙ্গে আলােচনার জন্য পশ্চিম পাকিস্তানে যেতে আগ্রহী এবং পররাষ্ট্রমন্ত্রী মুশতাক আহমেদও এই সফরে সঙ্গী হবেন। কিন্তু কথা হলাে এজন্য সর্বাগ্রে ক্ষেত্র প্রস্তুত করতে হবে। নিশ্চয়তা পেতে হবে যে তাদের সঙ্গে ভালাে আচরণ করা হবে। মােশতাক আহমেদ যুক্তরাষ্ট্র সরকারের কর্মকর্তাদের সঙ্গে বৈঠকে বসতে চান। কিন্তু তিনি এটা জানেন না যে, কিভাবে অগ্রসর হলে ভালাে হয়।
৪. কাইউম বলেন, মুক্তিবাহিনী ক্রমেই শক্তিশালী সামরিক শক্তি হিসেবে আত্মপ্রকাশ করতে যাচ্ছে। তারা ইতােমধ্যেই দুই ধরনের কৌশল উদ্ভাবন করেছে। তারা মুক্তিবাহিনীকে দিয়ে দুটো ডিভিশন করবে তাদের বর্তমান এক ডিভিশনে ১০ ব্যাটেলিয়ন সৈন্য রয়েছে। প্রতিটি ব্যাটেলিয়ন ১২০০ সদস্য সমন্বয়ে গঠিত। তাদের দ্বিতীয় ডিভিশন যখন প্রশিক্ষিত ও সুসজ্জিত হবে তখন তারা পূর্ববাংলার অংশবিশেষ দখল করে নিতে উদ্যোগী হবে। অবশ্য মুক্তিবাহিনীর গেরিলা যােদ্ধারা প্রদেশজুড়ে গেরিলাযুদ্ধ অব্যাহত রাখবে। কাইউম বলেন, ভারত সরকারের হাতে দেরাদুন ও রাজস্থানে ৫০০ পূর্ব পাকিস্তানি (অজ্ঞতাপ্রসূত মন্তব্য?) অফিসার স্কুল রয়েছে। প্রশিক্ষণ শেষে তাদের মুক্তিবাহিনীর দায়িত্বে দেয়া হবে। ভারত সরকার ইতােমধ্যেই কনভেনশনাল ডিভিশনকে বিমান বিধ্বংসী কামানসহ অন্যান্য আধুনিক অস্ত্রশস্ত্রে সজ্জিত করছে। গেরিলা যােদ্ধাদের সীমান্ত সন্নিহিত শিবিরে সংক্ষিপ্ত প্রশিক্ষণ দেয়া হচ্ছে।
৫. দীর্ঘমেয়াদে আওয়ামী লীগ বিশ্বাস করে, সামরিক বিজয় তারা অর্জন করতে পারে। কিন্তু ততদিনে পূর্ববাংলা ধ্বংসস্তুপে পরিণত হবে। আর যদি পাকিস্তান ও ভারতের মধ্যে যুদ্ধ হয় তাহলে পরিস্থিতি হবে আরাে নিকৃষ্টতর। আর এসব কারণেই একে রাজনৈতিক আপােসরফায় পৌছানােকে আওয়ামী লীগ বিশেষ গুরুত্ব দিচ্ছে। তবে যা-ই ঘটুক না কেন, পূর্ববাংলায় এক ব্যাপকভিত্তিক পুনর্গঠনের কাজ কিন্তু প্রয়ােজন হবে। কাইউম মনে করেন, মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রই একমাত্র দেশ যে কিনা প্রয়ােজনীয় সহায়তা দিতে সক্ষম হবে।
গর্ডন এ পর্যায়ে মন্তব্য করেন, কাইউমের যথার্থতা নিয়ে সন্দেহ প্রকাশের কোনাে অবকাশ নেই। কাইউমের জানা মতে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র সরকারের সঙ্গে আওয়ামী লীগের যোগাযোগের একমাত্র মাধ্যম তিনিই। সামরিক দিক থেকে তাকে খুবই আস্থাবান মনে হয়েছে, মুক্তিবাহিনীর বিজয় অবশ্যম্ভাবী। কিন্তু একইভাবে তার দৃঢ় বিশ্বাস রাজনৈতিক, সমাধানের প্রয়ােজন রয়েছে। এই টেলিগ্রামের ফুটনােটে লেখা হয়েছে ঢাকার কনসুলেট জেনারেল আওয়ামী লীগে কাইউমের ভূমিকা সম্পর্কে খোঁজখবর নিয়েছেন। তাদের মূল্যায়ন হচ্ছে, তিনি আওয়ামী লীগের নেতৃত্বে উল্লেখযােগ্য কেউ নন। কিন্তু সম্ভবত তিনি খন্দকার মােশতাক আহমেদের বিশ্বস্ত এবং একজন সাচ্চা প্রতিনিধি। মুশতাক বাংলাদেশের স্বাধীনতা আন্দোলনে পররাষ্ট্রমন্ত্রী । ( ঢাকা থেকে পাঠানাে টেলিগ্রাম ৩০৫৭, ৮ আগস্ট, আরজি ৫৯, সেন্ট্রাল ফাইলস ১৯৭০-৭৩, পল ২৩-৯ পাক) ৯ আগস্ট পাকিস্তানের মার্কিন দূতাবাস কাইউমের প্রস্তাব সম্পর্কে তাদের মূল্যায়ন দেন। এতে তারা বলেছে, যদি ধরে নেয়া হয়, তার উদ্যোগ বৈধ এবং বাংলাদেশ নেতৃবৃন্দের মতামত প্রতিফলিত হয়েছে, কিন্তু তা সত্ত্বেও ইয়াহিয়া খানের সরকারের কাছে এটা গ্রহণযােগ্যতা পাবে বলে মনে হয় না। দূতাবাস মনে করে, এ ধরনের প্রস্তাব নিয়ে পাকিস্তান সরকারের সঙ্গে আলােচনায় জড়িয়ে পড়লে হিতে বিপরীত হতে পারে। তবে যুক্তরাষ্ট্র যদি ভবিষ্যতে বাংলাদেশ নেতৃবৃন্দের সঙ্গে সম্পর্কের কথা বিবেচনায় রাখে তাহলে ঝুঁকি নেয়াটার একটা গ্রহণযােগ্যতা আছে।
সূত্র: ১৯৭১ আমেরিকার গোপন দলিল – মিজানুর রহমান খান – সময় প্রকাশন