“মুজিব নিয়েছিলেন গান্ধীর পথ” – কিসিঞ্জার
কিসিঞ্জার মনে করেন, মুজিব ৭ মার্চে স্বাধীনতার ঘােষণা দিতে একটু কৌশলী হন। তিনি মহাত্মা গান্ধীর মতােই শান্তিপূর্ণভাবে স্বাধীনতার দাবি আদায় করতে চেয়েছিলেন। ৭ মার্চে মুজিব পূর্ব-পশ্চিমের মধ্যে নিশ্চিতভাবেই একটি সংঘাত এড়িয়ে গেছেন। ১৩ মার্চে নিক্সনকে দেওয়া এক স্মারকে এ মন্তব্য করেন কিসিঞ্জার। কিন্তু তিনি বলেন যে, আপাতত শােডাউন এড়ানাে গেলেও পশ্চিম পাকিস্তানের সঙ্গে কোনাে ধরনের সমঝােতা ও নিস্পত্তির প্রশ্নটি আগের মতােই রয়ে গেছে নাজুক। পরিস্থিতির কোনাে মৌলিক পরিবর্তন ঘটেনি। ইয়াহিয়া ও পশ্চিম পাকিস্তানি সামরিক কর্তৃপক্ষ প্রয়ােজনে শক্তি প্রয়ােগ করে পাকিস্তানের অখণ্ডতা বজায় রাখতে চাইবেন। এমন সাক্ষ্য-প্রমাণ মিলছে যে, সিলনের মধ্য দিয়ে পূর্ব পাকিস্তানে সামরিক শক্তি বৃদ্ধি করা হচ্ছে। ইয়াহিয়া ব্যক্তিগতভাবে সমঝােতা চাইতে পারেন। কিন্তু সেজন্য তাকে তার সেনাবাহিনীর পরাক্রমশালী কট্টরপন্থিদের কাছে জবাবদিহি করতে হবে। পূর্ব পাকিস্তানি নেতা মুজিবুর রহমান স্বাধীনতার ঘােষণা দেওয়া থেকে সামান্য পিছু হটলেও তার ৭ মার্চের ভাষণের দৃঢ়তা প্রকাশ পেয়েছে। মনে হচ্ছে তার এই পেছনে সরে আসা মূলত কৌশলগত। তিনি তার ভাষণে ইমানসিপেসন বা ‘মুক্তি’ শব্দটি ব্যবহার করেছেন, যা আসলে স্বাধীনতা ঘােষণারই নামান্তর। তিনি জানিয়ে দিয়েছেন, এটা অর্জিত না হওয়া পর্যন্ত আন্দোলন থামবে না। এটা লক্ষণীয় যে, মুজিব তার দল আওয়ামী লীগকে দেশের একমাত্র বৈধ কর্তৃপক্ষ হিসেবে ঘােষণার মধ্য দিয়ে তিনি। ইয়াহিয়ার মুখােমুখি হলেন। কিসিঞ্জার লিখেছেন, ইসলামাবাদে আমাদের দূতাবাসের বিশ্বাস মুজিব তার লক্ষ্যে অটল থেকেছেন। তিনি পশ্চিম পাকিস্তানি কর্তৃত্ব থেকে পূর্ব পাকিস্তানের বন্ধনমুক্তি চেয়েছেন।
তবে এখনাে একটি অখণ্ড পাকিস্তানের মধ্যে তিনি ‘পূর্ণ প্রাদেশিক স্বায়ত্তশাসন’ মেনে নিতে পারেন বলে গণ্য করা যেতে পারে। এ কথাও ঠিক যে, মুজিবুর রহমান নিশ্চিতভাবেই এই বিশ্বাসে উপনীত হয়েছেন যে, যে স্বাধীনতা তিনি চেয়েছেন তা শুধুই সরাসরি স্বাধীনতার দাবি জানানাের পথেই অর্জিত হতে পারে। ৭ মার্চের ভাষণ বিশ্লেষণ করলে এমনটা প্রতীয়মান হয় যে, সেনাবাহিনীর সঙ্গে প্রত্যক্ষ সংঘাতে জড়িয়ে পড়ার ঝুঁকি তিনি এড়াতে চেয়েছেন। তার ধারণা তিনি ধীরে ধীরে ক্ষমতায়নের মাধ্যমে তার লক্ষ্য অর্জন করবেন। আর এই প্রক্রিয়াতেই একতরফা স্বাধীনতাদানের পরিস্থিতি সৃষ্টি হবে। বর্তমানের এই জটিল রাজনৈতিক সমীকরণের আরেক চরিত্র হচ্ছে পশ্চিম পাকিস্তানি রাজনৈতিক নেতা জেড এ ভুট্টো। এই মুহূর্তে তিনি নীরব রয়েছেন। মধ্য ফেব্রুয়ারিতে ডাকা গণপরিষদের অধিবেশনে যােগ দিতে অস্বীকার করে তিনি বর্তমান সংকটকে ঘনীভূত করেছেন। যদি গণপরিষদ আহ্বান করা সম্ভব হয় তাহলে ভুট্টো ও রহমানের মধ্যে কেন্দ্র এবং প্রদেশের ক্ষমতার বণ্টন প্রশ্নে অন্তত কাগজে-কলমে হলেও একটা সুরাহা হতে পারে। সবচেয়ে বড় প্রশ্ন হলাে, ভুট্টো ও রহমান এই মুহূর্তে সংকট অবসানে সত্যিই কতটা আন্তরিক হবেন। কিসিঞ্জার তার স্মারকে উক্তরূপ বর্ণনা দানের পর মন্তব্য করেন যে, ইয়াহিয়া ও পশ্চিম পাকিস্তানের সামরিক বাহিনী অখণ্ড পাকিস্তান রক্ষায় কোনাে রাজনৈতিক সমাধানের প্রশ্নে এগিয়ে আসে কি না তা সামনের দিনগুলােতে স্পষ্ট হবে। ইয়াহিয়া মুজিবের সঙ্গে সাক্ষাৎ করতে শিগগিরই ঢাকা যাচ্ছেন। যেসব পরিস্থিতির উদ্ভব ঘটতে পারে তা হলাে :
১. ইয়াহিয়া হয়তাে রহমানের চ্যালেঞ্জ গ্রহণ না করার সিদ্ধান্ত নেবেন। হয়তাে বড় জোর রহমান ও অন্য নেতাদের গ্রেফতার করবেন এবং পূর্ব পাকিস্তানে একটা সামরিক সমাধান থেকে নিজেকে সংযত রাখবেন। এক্ষেত্রে দুটো সমস্যা আছে। প্রথমত, রহমান-গান্ধী আদলে অহিংস অসহযােগ আন্দোলন শুরু করেছেন। সে কারণে ইয়াহিয়া যে সামরিক আক্রমণ চালাবেন তার যথার্থতা দেওয়া কঠিন হবে। দ্বিতীয়ত, পশ্চিম পাকিস্তানি সামরিক বাহিনীর রয়েছে সামর্থ্যের সীমাবদ্ধতা। তারা একটি প্রলম্বিত জনবিদ্রোহকে দীর্ঘমেয়াদে প্রতিহত করতে সক্ষম হবে না।
২, একটা নিশ্চল অপেক্ষার খেলার উদ্ভব ঘটতে পারে। সেনাবাহিনী অথবা বেসামরিক কোনাে তরফেই অচল অবস্থা নিরসনে কোনাে সাহসী পদক্ষেপ নেয়া হবে। উভয়পক্ষ আশা করবে অন্যপক্ষ এটা ভাঙতে আগে এগিয়ে আসবে। সম্ভবত মুজিব এবং আমরা বর্তমানে ঠিক এই ধরনের একটি বাস্তবতার মুখােমুখি। এই অবস্থা থেকে শক্তি প্রয়ােগের ঘটনা ছাড়াই পর্যায়ক্রমে পূর্ব পাকিস্তানের ওপর একটি কার্যকর নিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠা করতে মুজিব সক্ষম হবেন।
৩. ইয়াহিয়া, রহমান অথবা ভুট্টো অধিকতর কৌশলগত রাজনৈতিক চাল দিতে পারেন। তারা প্রত্যেকেই নিজ নিজ অবস্থান থেকে একটুও না ছাড় দিয়ে সময়ক্ষেপণ করতে পারেন। সংক্ষেপে পাকিস্তানের সংকট অবসানের কোনাে লক্ষণ নেই। বরং তা হঠাৎ জ্বলে উঠতে পারে। আপনি জানেন গত শনিবার ৬ মার্চ সিনিয়র রিভিউ গ্রুপ বৈঠকে বসেছিল। লক্ষ্য ছিল পাকিস্তানের পরিস্থিতিতে যুক্তরাষ্ট্রের সম্ভাব্য ভূমিকা নির্ধারণ। ঐ বৈঠকে সাধারণভাবে সবাই একমত হয়েছেন যে, বর্তমান পরিস্থিতিতে যুক্তরাষ্ট্রের কূটনৈতিক হস্তক্ষেপ তেমন কোনাে সুফল বয়ে আনতে পারবে না। তাই উৎকৃষ্ট পন্থা হলাে নিষ্ক্রিয় থেকে ঘটনার পর্যবেক্ষণ করা। আমি বলতে চাইছি, আমাদের একেবারে হাত-পা গুটিয়ে বসে থাকতে হবে যাতে ইয়াহিয়া আপত্তিকর কিছুই না দেখতে পায়। কিসিঞ্জার নিক্সনকে স্পষ্টই এ কথা উল্লেখ করেন যে, পূর্ব পাকিস্তান এখন একটি রক্তস্নাত গৃহযুদ্ধের দ্বারপ্রান্তে। এই অবস্থায় যুক্তরাষ্ট্র নিম্নোক্ত কারণে নীরবতা পালন করে যাবে। প্রথমত, ইয়াহিয়া জেনে এসেছেন, আমরা অখণ্ড পাকিস্তানের পক্ষে। সুতরাং এখন এই অবস্থান নাটকীয়ভাবে বিসর্জন দেওয়া যায় না। ইয়াহিয়া আরাে জানেন, একটি রাজনৈতিক সমঝােতার জন্য আমরা সম্ভব সব চেষ্টা করে যাচ্ছি। দ্বিতীয়ত, এ কথা সত্য যে, পূর্ব পাকিস্তানের পরিস্থিতির প্রতি আমাদের প্রভাব যত সামান্য। আর সে কারণে আমাদের হস্তক্ষেপ অবাঞ্ছিত। এখন আমরা কিছু করতে গেলেই তা পশ্চিম পাকিস্তানিদের অসন্তুষ্টি করবে। ভবিষ্যতে সম্পর্ক ক্ষতিগ্রস্ত হবে। তারা অভিযােগ করবে আমরা অনধিকার চর্চা করছি। তবে এটাও মনে রাখতে হবে যে, আমরা যদি এখন এই অবস্থান গ্রহণ করি তাহলে পূর্ব পাকিস্তান যদি কোনােদিন স্বাধীন হয় তাহলে আমাদের ভূমিকাকে তারা সুনজরে দেখবে না। যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে নতুন রাষ্ট্রের সম্পর্ক ক্ষতিগ্রস্ত হবে। আমি এ ব্যাপারে আপনার মতামত জানতে চাই।
এর পরের দলিলটি ১৫ মার্চ ‘৭১ এ লেখা। স্টেট ডিপার্টমেন্টের কাছে প্রাচ্য ও দক্ষিণ এশিয়া বিষয়ক সহকারী মন্ত্রী সিসকো লিখেছেন পররাষ্ট্র মন্ত্রী রজার্সকে। এই তথ্য স্মারকের শিরােনাম ‘মুজিব নিয়ে নিলেন-পূর্ব পাকিস্তান; ইয়াহিয়া উড়ে গেলেনঢাকায়। ‘শেখ মুজিবুর রহমান আজ ঢাকায় ঘােষণা করেছেন, তার দল আওয়ামী লীগ পূর্ব পাকিস্তানের দায়িত্বভার গ্রহণ করেছে। কারণ প্রাদেশিক পরিষদে তারাই সংখ্যাগরিষ্ঠ। ৩০০ আসনের ২৮৮ পেয়েছে আওয়ামী লীগ। মুজিব পদক্ষেপ নেন একতরফাভাবে এবং ইয়াহিয়া খানের সামরিক আইন প্রশাসনকে উপেক্ষা করেই। সত্যি কথা হলাে, মুজিব যে পঁয়ত্রিশ দফা দিকনির্দেশনা দিয়েছেন তা খুবই পরিকল্পিত ও সতর্কতার সঙ্গে। এই পদক্ষেপের তাৎপর্য হচ্ছে, মুজিব ইয়াহিয়া সরকারের সঙ্গে প্রত্যক্ষ বিরােধে জড়িয়ে পড়লেন ঠিকই কিন্তু একই সঙ্গে তিনি শর্তহীনভাবে একতরফা পূর্ব পাকিস্তানের স্বাধীনতা ঘােষণা থেকে দূরে সরে থাকলেন। এখন ইয়াহিয়ার সামনে বিকল্প হচ্ছে ইতােমধ্যেই বিপন্ন হওয়া অখণ্ড পাকিস্তানের অস্তিত্ব আরাে হুমকিগ্রস্ত করবেন কি করবেন না? সেক্ষেত্রে ইয়াহিয়া তার সামরিক আইনের ক্ষমতা প্রত্যাহার করে নিতে পারেন অন্তত পূর্ব পাকিস্তান থেকে। অবশ্য একই সঙ্গে তা আবার পশ্চিম পাকিস্তানে বহাল রাখা কঠিন হবে। ইয়াহিয়া এবং সামরিক বাহিনীর অন্যরা যদি সিদ্ধান্ত নেন যে, মুজিবকে তারা শক্তি দিয়ে প্রতিহত করবেন, তাহলে পূর্ব পাকিস্তানে বাঙালি জাতীয়তাবাদী ও সামরিক বাহিনীর মধ্যে সংঘর্ষ শুরু হবে। আর তার পরিণতিতে বাংলার স্বাধীনতা হবে অনিবার্য। পশ্চিম পাকিস্তানের সঙ্গে সব প্রকারের বন্ধন ছিন্ন হবে। ভরসা একটাই যদিও তা দীর্ঘমেয়াদে ধরে রাখা সম্ভব হবে।
তা হলাে সেনাবাহিনী সাফল্যের সঙ্গে অভ্যুত্থান দমাতে পারে। মুজিব তার ভাষণে। বাঙালিদের ওপর যদি শক্তি প্রয়ােগের কোনাে ঘটনা ঘটে, তাহলে যার যা কিছু আছে’ তা নিয়ে ঝাপিয়ে পড়ার আহ্বান জানিয়েছেন। ১৪ মার্চ করাচিতে ভুট্টো উভয় অংশের সংখ্যাগরিষ্ঠ দলের কাছে ক্ষমতা হস্তান্তরের দাবি জানিয়েছেন। যার অর্থ হলাে ভুট্টোকে পশ্চিমে আর মুজিবকে পূর্বে। সিসকো এ পর্যায়ে মন্তব্য করেন, ভুট্টোর ভাষণ প্রকারান্তরে মুজিবের গৃহীত পদক্ষেপকেই উস্কে দিতে পারে। এটা কিন্তু বেশ কিছু সময় ধরে সন্দেহ করা হয়েছে যে, ভুট্টো সিদ্ধান্ত নিয়েছেন যে, পাকিস্তান যদি দুটুকরাে বা তার কাছাকাছি কিছু হয়, তাহলেই ভুট্টো পশ্চিমাংশে নিরঙ্কুশ ক্ষমতার অধিকারী হতে পারেন। ভুট্টোর অবশ্য মুজিবের মতাে পন্থা অনুসরণ কঠিন। কারণ, পশ্চিমে সেনাবাহিনী খুবই শক্তিশালী এবং তারা সম্ভবত সেখানে কোনাে বিদ্রোহ হলে তা সাফল্যের সঙ্গে স্তব্ধ করতে পারবে। এই দলিলের শেষ মন্তব্য পাকিস্তানে যেসব ঘটনা ঘটছে তাতে অখণ্ড পাকিস্তানে ভবিষ্যৎ অন্ধকার । ইয়াহিয়া এখন কী পদক্ষেপ গ্রহণ করেন, তার ওপর নির্ভর করছে অনেক কিছু।
সূত্র: ১৯৭১ আমেরিকার গোপন দলিল – মিজানুর রহমান খান – সময় প্রকাশন