You dont have javascript enabled! Please enable it! 1971.12.16 | নিক্সনের জন্য কাশ্মীর পেল পাকিস্তান - সংগ্রামের নোটবুক
নিক্সনের জন্য কাশ্মীর পেল পাকিস্তান
কাশ্মীর প্রশ্নে নিক্সন এতটাই আবেগপ্রবণ ছিলেন যে, তিনি যে কোনাে মূল্যে ঢাকার পতন মুহূর্তে সােভিয়েত ইউলিয়ন ও ভারতের কাছে নিশ্চয়তা চেয়েছেন। ১৯৭১ এর ১৫ ডিসেম্বর বিকেল ৫টা ৫৫ মিনিটে কিসিঞ্জার নিক্সনকে বলছেন, ভারতীয়দের বিশ্বাস করা যায় না। তারা চাইছে বাংলাদেশের কর্তৃপক্ষের বৈধতা জাতিসংঘের কাছ থেকে নিয়ে নিতে। এর ফলে জাতিসংঘকে আগ্রাসনের এক সক্রিয় অংশগ্রহণকারী হিসেবে গণ্য করা সহজ হবে। সে কারণেই আমরা এটা মানতে পারি না। সােভিয়েতরা আমাদের নিশ্চয়তা দিচ্ছে, পশ্চিম পাকিস্তানে হামলা হবে না। কিন্তু এমন কায়দা করে বলছে, তাতে কাশ্মীর প্রশ্নে নিশ্চয়তা মিলছে না। আমি আজই দক্ষিণ এশিয়ায় এইডের দায়িত্বপ্রাপ্ত মারি উইলিয়ামসের সঙ্গে কথা বলেছি। ব্যাটা ভারতের পক্ষে। কিন্তু তিনিও বলছেন, পাকিস্তান যদি তার অংশের কাশ্মীর হারায় তাহলে তার আর কিছুই থাকবে না। নিক্সন এ পর্যায়ে বলেন, ভালাে কথা। ভারতীয়দের এখন অত্যন্ত গুরুত্বের সঙ্গে বিবেচনায় নিতে হবে। তারা নিতে পারে, কিন্তু যদি তা তারা করে তবে তাদের । ঠিক আছে আমরা অপেক্ষা করব। আমাদের কোনাে বিকল্প নেই, শুধুই অপেক্ষা। এটা এখন ভারতীয়দের হাতে।
১৬ ডিসেম্বর, ১৯৭১, সকাল সাড়ে ৯টা নিক্সন ঢাকা আত্মসমর্পণ করেছে। এখন ইস্যু হলাে কিসিঞ্জার আগামী ২৪ ঘণ্টার মধ্যে ভারত যদি পশ্চিম পাকিস্তানে যুদ্ধবিরতির প্রস্তাবে রাজি না হয়, তাহলে আমরা পক্ষ নেব। এ পর্যন্ত না হয়, সােভিয়েতদের অপেক্ষার যুক্তি ছিল। এখন তাে টাকা আত্মসমর্পণ করেছে। নিক্সন প্রস্তাবটা কি তােলা হয়েছে। কিসিঞ্জার না। এটা টেবিলে আছে, আজ সম্ভবত ভােট হবে। আর সেটাই হবে পরীক্ষা। নিক্সন সােভিয়েতরা এতে ভেটো দেবে। কিসিঞ্জার তিনটি সম্ভাবনা আছে। প্রথমত, ব্রিটিশ প্রস্তাব গ্রহণ। দ্বিতীয়ত, পাক-ভারতের যুদ্ধবিরতি। তৃতীয়ত, ভারত কাশ্মীরে পাকিস্তানিদের নাস্তানাবুদ করা পর্যন্ত যুদ্ধ অব্যাহত রাখা। আমরা কিন্তু এদিকে গত রাতে পাকিস্তানিদের কাছ থেকে আরেকটি আবেদন পেয়েছি। তারা আমাদের কাছে বিমান চাইছে। কিন্তু আমরা তাে এখন এটা বিবেচনা করতে পারি না। এটা যদি কাল রাতের মধ্যে নিষ্পত্তি না ঘটে তাহলে আমরা জানিয়ে দেব রাশানরা এটা আমাদের ওপর চাপিয়ে দিল।
নিক্সন আমি কিন্তু একটা বিষয়ে অসন্তুষ্ট। ভারতের মন্ত্রিসভায় কী ঘটছে, তা আপনিও আমাকে জানাতে পারছেন না। আমি জানি স্টেট ডিপার্টমেন্টে ভারতপন্থি অনেক লােক আছে, তারা বিলম্ব ঘটাচ্ছে। কিন্তু আমি এটা চাই। আমি প্রতিদিন ভারতকে এ নিয়ে চাপের মধ্যে রাখতে চাই। ঢাকার তাে পতন ঘটেছে। এখন আমরা সেই রাষ্ট্রদূতকে (ভারতীয় রাষ্ট্রদূত ঝা) এখানে দেখতে চাই। তাকে জানিয়ে দিন তিনি আমাদের টেলিভিশন ও রেডিওর সুবিধা নিয়ে যে কাণ্ড করে চলেছেন, তাতে প্রেসিডেন্ট খুবই ক্ষুব্ধ। দ্বিতীয়ত, ভারতীয় কী পরিমাণ সাহায্য পায় সে সম্পর্কে আমি সাচ্চা খবর জানতে চাই। তারা যে পরিসংখ্যান ব্যবহার করছে তা সঠিক নয়। আমি একটি রিপাের্ট চাই। পিএল ৪৮০ একক ও বহুপক্ষীয়- সব হিসাবই আমি একসঙ্গে পেতে চাই। কারণ ওদের একটা চাপ দিতেই হবে। ভারতীয়রা যতদূর যেতে চায় রাশানরা কিন্তু তত দূরই যাবে। ভারতীয়দের সিদ্ধান্ত নিতে হবে, তারা একটি রাশান তাঁবেদার রাষ্ট্র হিসেবে থাকতে চায় কী চায় না।  কিসিঞ্জার মি. প্রেসিডেন্ট আমাদের পরবর্তী করণীয় হলাে- যুক্তরাষ্ট্র থেকে ভারতে পণ্য সরবরাহ বন্ধ করা। ১২৩ মিলিয়ন ডলারের পণ্য যাচ্ছে ভারতে। অবশ্য এ জন্য ভারত ইতােমধ্যেই পরিশােধ করেছে। এটা বন্ধ করতে গেলে অনেক মামলায় জড়াতে হবে।  নিক্সন ভারতীয়রা যদি তাদের বর্তমান পথচলা অব্যাহত রাখে তাহলে তাে আমাদের কোনাে উপায় থাকবে না। এমনকি তাদের সঙ্গে কূটনৈতিক সম্পর্ক ছিন্ন করে দেব। হেনরি কথাটা কি ঠিক বললাম? কিসিঞ্জার বিলকুল ঠিক। ইতােমধ্যেই তারা এক শক্তিশালী বিজয় লাভের বিবৃতি দিয়েছে। চীনের জন্য তা বয়ে এনেছে এক অবিশ্বাস্য অভিঘাত। এটা আমাদের গায়ে লাগেনি বটে, কিন্তু কথা হলাে- ভারতীয়রা অবশ্যই চীনাদের অপদস্ত করেছে।
নিক্সন ও, ভালাে কথা। জর্ডান কি প্লেন পাঠিয়েছে? কিসিঞ্জার ১৭ টি। নিক্সন এখন আমার কথা হলাে- এসব ছােটখাটো বিষয়ের প্রতি আমরা কিন্তু একটা নিয়ন্ত্রণ বজায় রেখেছি। এখন আমরা রাশানদের এটা বলতে চাই, তােমরা এতই অবিশ্বস্ত যে, তােমাদের সঙ্গে ডিল করা চলে না কোনাে ইস্যুতে। এখন তাহলে। সেই কার্ড খেলতে পারি। কিসিঞ্জার হ্যা, আমরা কথাটা এখন সুন্দরভাবে বলতে পারি। নিক্সন আমরা ঘরােয়াভাবে বলতে পারি, কিন্তু তারা তা বিশ্বাস নাও করতে পারে। কিসিঞ্জার : আচ্ছা। তারা যদি শেষ পর্যন্ত পশ্চিম পাকিস্তানে যুদ্ধবিরতিতে রাজি না হয়, তখন আমরা কী করব? | নিক্সন মধ্যপ্রাচ্যে আলােচনা বন্ধ করে দিতে হবে। ইসরাইলকে দিতে হবে অস্ত্র। সল্ট নিয়ে আলােচনা স্থগিত করতে হবে। অর্থনৈতিক নিরাপত্তা পরিষদ প্রকাশ্য অবস্থান নিতে পারে। তারা বলতে পারে বিপদে স্বরূপটা কী হবে? এটা ঝুঁকিপূর্ণ, কিন্তু উপায় কী? আমি আরাে অনেক দূর যাব। আমরা তাদের সঙ্গে বাণিজ্য আলােচনা বন্ধ করে দিতে পারি। মধ্যপ্রাচ্য নিয়ে স্মিথকে আর অগ্রসর হতে দেব না এবং যে কোনাে পরিস্থিতি হােক না কেন, উবরিনিনের সঙ্গে কথা বলা বন্ধ করে দেয়া হবে। | কিসিঞ্জার : সবই ঠিক। হােয়াইট হাউস চ্যানেল ভেঙে দিন।
নিক্সন আর রাশানদের প্রতি যে কোনাে প্রকাশ্য বিবৃতিতে শীতল মনােভাব দেখাতে হবে। আর প্রতিরক্ষা বাজেট পরিকল্পনাও আমি বাড়িয়ে দেব।  কিসিঞ্জার : প্রতিরক্ষা বাজেট প্রণয়নের কাজ চলছে। নিক্সন : শুক্রবার (১৭ ডিসেম্বর) রাতের মধ্যে কাজটা শেষ করতে পারবেন না? কিসিঞ্জার : পারব। নিক্সন কিন্তু হেনরি, আমি তাে কিছুতেই স্বস্তি পাচ্ছি না। এই যে সহায়তার রিপোের্ট যে এখানে আসছে না তা সত্যই আমাকে পাগল করে তুলেছে। ভারতকে আমরা কত সাহায্য দিচ্ছি, আগামী বছরে কী দেব? এসবই আমি জানতে চাই। আমি জানি, বড় খেলা হচ্ছে রাশিয়ার খেলা। কিন্তু ভারতীয়রা খেলেও আজ আমাদের এখানে এনেছে। এটাও জানি। তারা তাদের খেলা শেষ হলে এসে বলবে, আচ্ছা, সব ভুলে যান। আমরা দুঃখিত। কিন্তু আমরা কিছুতেই তা মানব না। তারা যদি রাশিয়ার প্রতি নির্ভরশীল থাকতে চায় তাহলে তাই থাক। ভারতের পরিচয় হবে রাশিয়ার একটি তাবেদার রাষ্ট্র। ভারত যদি একান্তই কথা না শুনে তাহলে সাহায্য বন্ধ করে দেব।  কিসিঞ্জার : কিন্তু আমাদের স্মরণ রাখতে হবে এই বাস্তবতা। আমাদের একটি আমলাতান্ত্রিক পদ্ধতি রয়েছে এবং আমি মনে করি, ভারতকে যদি কথাটা স্টেট ডিপার্টমেন্ট বলে তাহলেই ভালাে। নিক্সন সিসকোকে ডাকুন। তিনি ভারতীয় রাষ্ট্রদূতকে ডাকবেন। তাকে সাফ জানিয়ে দিতে হবে, যদি যুদ্ধ বিরতির প্রস্তাব কার্যকর না হয়, তাহলে আমাদের সামনে কোনাে বিকল্প থাকবে না। আমরা ভারতকে সব ধরনের সহায়তা বন্ধ করে দেব। এক ঘণ্টার মধ্যে আমাকে জানাবেন। কিসিঞ্জার : ইয়েস মি. প্রেসিডেন্ট। এর পরে ফুট নােটে লেখা হয়েছে কিসিঞ্জার নিক্সনকে ১০টা ৪০ মিনিটে ফোন করেন এবং জানান ভারত পশ্চিম পাকিস্তানে একতরফা যুদ্ধবিরতি ঘােষণা করেছে। তার কথায় এটা আমরাই করেছি।’ কিসিঞ্জার অবশ্য এজন্য ভারতের ওপর পর্যাপ্ত চাপ সৃষ্টির জন্য সােভিয়েত ইউনিয়নের ভূমিকার প্রশংসা করেন। লক্ষণীয় হচ্ছে নিক্সন ও কিসিঞ্জারের সংলাপে পূর্ব পাকিস্তান পাকিস্তানের হাতছাড়া হওয়ায় কোনাে আক্ষেপ করেননি। বরং ঢাকায় যখন আত্মসমর্পণের দলিলে স্বাক্ষরদান চলছে তখন কিসিঞ্জার নিক্সনকে বলছেন, মি. প্রেসিডেন্ট, কনগ্রাচুলেশন্স। আপনার জন্যই রক্ষা পেল পশ্চিম পাকিস্তান।

সূত্র:  ১৯৭১ আমেরিকার গোপন দলিল – মিজানুর রহমান খান – সময় প্রকাশন