বাংলাদেশের বিজয়লগ্নে কাশ্মীর নিয়ে দরকষাকষি
প্রেসিডেন্ট নিক্সনের জাতীয় নিরাপত্তা বিষয়ক উপসহকারী ব্রিগেডিয়ার জেনারেল আলেকজান্ডার হেগ রুশ কূটনীতিক ভরনস্তবকে ডেকে পাঠান ১৪ ডিসেম্বর রাত ১২টা ২২ মিনিটে। তিনি এসে হােয়াইট হাউসে পৌছান ১২টা ৪০ মিনিটে। এদিন সকালেই সােভিয়েত ইউনিয়নের কাছ থেকে খসড়া যুদ্ধবিরতি প্রস্তাব পান নিক্সন। জেনারেল হেগ রুশ কূটনীতিককে বলেন, সােভিয়েত প্রস্তাবে কয়েকটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয়ের কোনাে উল্লেখ নেই। এতে বেশ ফাঁকফোকর থেকে গেছে। এর মধ্যে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ হলাে- ভারত যে পশ্চিম পাকিস্তানের ভূখণ্ড দখল করে নেবে না, তার কোনাে অঙ্গীকার নেই। হেগের কথায়, মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র সরকারের কাছে এটাই হলাে অন্যতম মুখ্য বিষয়। তবে হেগ এ কথাও বলেন যে, সােভিয়েত বার্তার সংক্ষিপ্ত সার তিনি এভাবে বুঝতে চান যে, ভারত ও পাকিস্তানের মধ্যে বর্তমানে যে সীমান্ত রেখা রয়েছে, তার কোনােই পরিবর্তন হবে না। রুশ কূটনীতিক বলেন, এমনটা সােভিয়েতেরও দৃষ্টিভঙ্গি বলে তিনি ব্যক্তিগতভাবে বিশ্বাস করেন। ১৪ ডিসেম্বরেই ভারত মহাসাগরে সপ্তম নৌবহর প্রেরণ প্রশ্নে মার্কিন স্টেট ডিপার্টমেন্ট একটি টেলিগ্রাম পাঠায় দিল্লিতে তাদের দূতাবাসে। এতে বলা হয়- ভারতীয় রাষ্ট্রদূত ঝা সহকারী পররাষ্ট্রমন্ত্রী সিসকোর সঙ্গে দেখা করে বলেছেন, ভারত মহাসাগরে পারমাণবিক অস্ত্র সজ্জিত মার্কিন নৌবহর মােতায়েনে ভারত সরকার উদ্বিগ্ন। ভারতীয় রাষ্ট্রদূত বলেন, এর আগে মার্কিন আন্ডার সেক্রেটারি আরউইন তাকে অবহিত করেন। যে, আসলে লােকজন সরিয়ে আনার লক্ষ্যেই হেলিকপ্টারগুলাে অবস্থান নিয়েছে থাইল্যান্ডে। তিনি অনুমান করেছেন যে, হেলিকপ্টারগুলাে সম্ভবত ব্যাংককে রয়েছে।
কিন্তু পরবর্তীকালে তারা এমন ইঙ্গিত পেয়েছেন যে, ঐ হেলিকপ্টারগুলাে পারমাণবিক জ্বালানিচালিত এয়ারক্রাফট কেরিয়ারের ওপরে সজ্জিত রয়েছে। ঝা বলেন, তিনি যুক্তরাষ্ট্রকে এর আগে এটা স্পষ্ট করে বলেছেন, বিদেশী নাগরিকদের নিরাপদে সরিয়ে নিতে সবরকম পদক্ষেপ গ্রহণে ভারত সংকল্পবদ্ধ এবং সে লক্ষ্যে তার সরকারের রয়েছে সর্বাত্মক প্রস্তুতি । যদি দরকার পড়ে ঢাকা থেকে সব বিদেশী নাগরিককে তারা সরিয়ে নেবে। ভারত সরকার এখন যুক্তরাষ্ট্রের কাছে এই নিশ্চয়তা চায় যে, দিল্লির সঙ্গে আগাম চুক্তি ছাড়া যুক্তরাষ্ট্র যেন লােকজন সরানাের কাজ শুরু না করে। ১৩ ডিসেম্বর পেন্টাগনের এক সংবাদ সম্মেলনে সপ্তম নৌবহর মােতায়েন সংক্রান্ত এক প্রশ্নের জবাবে সেক্রেটারি লেয়ার্ড ইঙ্গিত দেন- যুক্তরাষ্ট্র সরকারের কনটিনজেন্সি। পরিকল্পনা রয়েছে এবং ইকুয়েশন কাজে এর ব্যবহার প্রয়ােজন হতে পারে। ঝা বলেন, নয়াদিল্লি থেকে তিনি এমন রিপাের্ট পেয়েছেন, মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের নাগরিক। অথবা পাকিস্তানি সৈন্যদের পশ্চিম পাকিস্তানে সরিয়ে নিতে যুক্তরাষ্ট্র সরকার বাংলাদেশের কোনাে এলাকায় তার নৌবহরের নােঙর নিশ্চিত করতে পারে। ঝা। বলেন, এ ধরনের কোনাে পদক্ষেপ নেয়া হলে তা হবে খুবই মারাত্মক বিষয় এবং দীর্ঘমেয়াদে ভারত-যুক্তরাষ্ট্র সম্পর্কে ক্ষতিকর প্রভাব ফেলবে। এর আরাে নানাবিধ মাত্রা সৃষ্টি হতে পারে। তবে সংঘাতের আশু অবসানের প্রক্রিয়ায় তা কোনাে প্রভাব। ফেলবে না। ১৪ ডিসেম্বর মঙ্গলবার সন্ধ্যা ৬টায় হেনরি কিসিঞ্জার, সােভিয়েত চার্জ দ্য। এফেয়ার্স/মিনিস্টার ভরনস্তব ও ব্রিগেডিয়ার জেনারেল হেগ এক বৈঠকে মিলিত হন। ড. কিসিঞ্জার এ সময় বলেন, সােভিয়েত সরকারের কাছ থেকে নিশ্চয়তা পেয়ে আমরা। আশ্বস্ত হচ্ছি যে, পশ্চিম পাকিস্তানের ভূখণ্ড দখল নিয়ে ভারতের সত্যি কোনাে উদ্দেশ্য নেই । তিনি স্পষ্টতই বুঝতে চান যে, বর্তমান সংকট শুরুর আগে দুদেশের সীমান্ত রেখা যেমনটা ছিল, ঠিক তেমনটাই রাখতে ভারতের মনে কোনাে দ্বিধা নেই । জবাবে। রুশ দূত তার সঙ্গে একমত হন। তবে কিসিঞ্জারের এদিনের বক্তব্যের বিবরণ থেকে।
স্পষ্টই প্রতীয়মান হয় যে, ১৬ ডিসেম্বরে ঢাকায় পাকিস্তানিদের আত্মসমর্পণের সিদ্ধান্ত নিরঙ্কুশ অর্থেই পশ্চিম পাকিস্তান এবং পাক অধিকৃত কাশ্মীরের ভবিষ্যতের সঙ্গে ওতপ্রােতভাবে জড়িয়ে পড়েছিল। যুক্তরাষ্ট্রের ব্যাকুলতার কারণ ছিল একটাই। যে করেই হােক, পশ্চিম পাকিস্তানকে রক্ষা করতে হবে। সে কারণেই রুশ মিনিস্টারের সঙ্গে আলােচনায় কিসিঞ্জার বলেন, যুদ্ধবিরতি প্রশ্নে নিরাপত্তা পরিষদে যে প্রস্তাব উঠেছে, সে ব্যাপারে চীনের মনােভাব আমাদের জানা নেই। কিন্তু সব পক্ষ যদি এ | ধরনের একটি রেজুলেশন বাস্তবায়িত হতে দেখে, তাহলে উপমহাদেশের বিরােধ নিস্পত্তি হতে পারে আগামীকালই। রুশ মিনিস্টার এ সময়ে বলেন- মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র একটি সাধারণ যুদ্ধবিরতি প্রস্তাবের ঊর্ধ্বে যেতে রাজি হচ্ছে না। আবার এটাও সত্য। যে, এ ধরনের প্রস্তাব মেনে নেয়া সােভিয়েত ও ভারতীয় নেতৃবৃন্দের পক্ষে সম্ভব হচ্ছে। । ড. কিসিঞ্জার বলেন, এ ধরনের একটি রেজুলেশন সৈন্য প্রত্যাহারের (সম্ভবত পূর্ব পাকিস্তান থেকে) শর্ত পূরণে বাধ্যবাধকতা সৃষ্টি করতে পারে। কিন্তু বাস্তবতা হচ্ছে, ভারতীয় সৈন্যরা ইতােমধ্যেই পাকিস্তানি ভূখণ্ডে ঢুকে পড়েছে। রুশ মিনিস্টার বলেন, যুক্তরাষ্ট্র এই জটিলতার জন্য দায়ী। কারণ, সােভিয়েতের কাছে এক সপ্তাহ আগে দেওয়া প্রস্তাব তারা গত সােমবার পুনরায় পরিবর্তন করেছে। এজন্য সােভিয়েত নেতৃবৃন্দ গভীরভাবে উদ্বিগ্ন। উদ্বেগের সুনির্দিষ্ট কারণ হলাে, মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র সরকার এর আগে ড. কিসিঞ্জারের হাত দিয়ে যে প্রস্তাব দিয়েছিল সেখান থেকে সরে এসেছে। বিশেষ করে ঐ প্রস্তাবে রাজনৈতিক সমাধানের কথা লেখা থাকলেও পরে তা বাদ দেওয়া হয়। ড. কিসিঞ্জার বলেন, এ কথা সত্য।
কিন্তু মার্কিন প্রস্তাবে দ্রুত সাড়া দিতে সােভিয়েতের ব্যর্থতার কারণেই এই অবস্থার উদ্ভব ঘটেছে। রুশ মিনিস্টার বলেন, আমাদের বুঝতে হবে সমস্যাটাই জটিল। এটা আসলে সােভিয়েত অথবা যুক্তরাষ্ট্রের। কোনাে অসৎ চিন্তার ফসল নয় । কিসিঞ্জার বলেন, ভারতকে বিপুল পরিমাণ আধুনিক অস্ত্রশস্ত্র সরবরাহের তােড়জোড় এবং ভারতকে রক্ষাকবচ দিতে চীনকে হুমকি। দেওয়ার বিষয়টি পরিস্থিতিকে আরাে জটিল করেছে। রুশ মিনিস্টার জবাবে বলেন, পাকিস্তানেরও কিছু মার্কিনি, কিছু সােভিয়েত ও কিছু চীনা অস্ত্র রয়েছে। প্রকৃত সমস্যা কিন্তু পূর্ব পাকিস্তানে পাকিস্তানিদের মারাত্মক ভুল পদক্ষেপ থেকেই উদ্ভূত হয়েছে। কিসিঞ্জার বলেন, অতীতচারিতা নয়, আমরা কিন্তু এখন বাস্তব সমস্যা মেটাতে চাইছি এটাই জরুরি। যুক্তরাষ্ট্র এই মুহূর্তে তার দিক থেকে সৈন্য প্রত্যাহার সংক্রান্ত দাবি পরিত্যাগে প্রস্তুত। এখন যুক্তরাষ্ট্র আশা করছে, সােভিয়েতও তাদের দিক থেকে। রাজনৈতিক নিপত্তির দাবি বর্জন করুক। তাহলেই একটা আপােসের রাস্তা তৈরি হবে। রুশ মিনিস্টার এ সময় উল্লেখ করেন, যুক্তরাষ্ট্র কিন্তু তার আগের ‘ল্যাঙ্গুয়েজ থেকে সরে এসেছে। আর তার ফলেই সমস্যার সৃষ্টি হয়েছে। মি, ব্রেজনেভের কাছে লেখা চিঠিতে প্রেসিডেন্ট নিক্সন ঢাকায় মার্কিন উদ্যোগ সম্পর্কে যে কথা উল্লেখ করেছিলেন, সেজন্য মস্কো খুবই সন্তুষ্ট হয়েছিল। কিন্তু রাজনৈতিক উদ্যোগ থেকে ওয়াশিংটনের আকস্মিক বিচ্যুতি প্রত্যক্ষ করে মস্কো খুবই বিরক্ত বােধ করেছে। আসলে এখন পূর্ব পাকিস্তানে রক্তস্নাত প্রতিরােধের সময়। সব পক্ষকে একযােগে কাজ করতে হবে। এই মুহূর্তে একটি ভায়াবেল রেজুলেশনের একমাত্র অর্থ হচ্ছে, বাংলাদেশের কাছে ক্ষমতা হস্তান্তর । ড. কিসিঞ্জার বলেন, মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র সরকার এ ধরনের কোনাে প্রস্তাব মেনে নিতে পারে না।
রুশ মিনিস্টার জবাব দেন, সত্যি বলতে কী, এই প্রশ্নটি এখন নিতান্তই একাডেমিক। কারণ তিনি এ সংবাদ জানতে পেরেছেন যে, পূর্ব পাকিস্তান সরকার ইতােমধ্যেই পদত্যাগ করেছে। ড, কিসিঞ্জার এ পর্যায়ে উল্লেখ করেন, তিনি এখন তিনটি বিষয়ের ওপর জোর দিতে এবং সমঝােতায় পেীছাতে চান। এক, ভারতীয়রা পশ্চিম পাকিস্তানে হামলা চালাবে না। দুই, ভারতীয়রা পাকিস্তানি ভূখণ্ড (পষ্টতই কাশ্মীরকে বােঝানাে হয়েছে) দখলে রাখার ইচ্ছা ব্যক্ত করবে না। তিন, সংকট শুরুর আগের সীমান্ত রেখা মেনে চলবে। রুশ মিনিস্টার বলেন, এতে আমাদের আপত্তি নেই। এটা সােভিয়েতেরও মনের কথা। কিসিঞ্জার এ পর্যায়ে আরাে কিছুক্ষণ তার মতামত ব্যক্ত করেন। এ থেকেও স্পষ্ট। হয়, বাংলাদেশের বিজয়লগ্নে নিক্সন ও কিসিঞ্জার স্বাধীন বাংলাদেশের অভ্যুদয় নিয়ে নয়, বরং কাশ্মীরসহ পশ্চিম পাকিস্তান রক্ষার প্রশ্নেই ছিলেন যেমন উদ্বিগ্ন, তেমনি সংবেদনশীল। কিসিঞ্জার মন্তব্য করেছেন যুক্তরাষ্ট্র সরকার জানে, পূর্ব পাকিস্তান আর পশ্চিম পাকিস্তানে ফিরে যাবে না। কিন্তু যুক্তরাষ্ট্র আইনগতভাবে এই পরিবর্তনকে এই মুহূর্তে মেনে নিতে অপারগ। সুতরাং জাতিসংঘের মাধ্যমে যদি তেমনটা করতে যুক্তরাষ্ট্রকে বাধ্য করার চেষ্টা করা হয়, তাহলে সে অবশ্যই ভেটো দেবে। ভারত এখন শুধু পশ্চিম পাকিস্তান থেকে পূর্ব পাকিস্তানকে আলাদা করেই ক্ষান্ত হতে চাইছে না। একইসঙ্গে সে এই নতুন ব্যবস্থাকে একটা বৈধতা দিতে চাইছে। মাত্র দুসপ্তাহ আগে ম্যাডাম গান্ধী বলেছেন, পূর্ব পাকিস্তানের পরিস্থিতি পাকিস্তানের অভ্যন্তরীণ সমস্যা। সুতরাং এই দৃষ্টিকোণ থেকেই যুদ্ধ বন্ধ হওয়া উচিত।
কিসিঞ্জার বলেন, বাংলাদেশের মতাে একটা ইস্যু নিয়ে কেন মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র মিছিমিছি সােভিয়েত ইউনিয়নের সঙ্গে সম্পর্ক খারাপ করতে চাইবে? উপরন্তু অনেকে যেমনটা ভাবে, সেভাবে কিন্তু মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র ভারতবিরােধী নয়। সােভিয়েত ইউনিয়ন ঠিকই জানে প্রকৃত সমস্যা কোথায়। ১৫ ডিসেম্বর, ১৯৭১ সকাল হােয়াইট হাউসের ওভাল অফিসে কিসিঞ্জার নিক্সনকে বলেন, ‘রাশানরা গতকাল এসে এই মর্মে গ্যারান্টি দিয়েছে যে, পশ্চিম পাকিস্তানে হামলার ঘটনা ঘটবে না। এখন তা হলে প্রশ্ন হলাে, কোন আইনানুগ পথ আমরা বেছে নেব। কিসিঞ্জারের এ সময়ের উপলব্ধি হচ্ছে, সংকটের একটা সমাধান আনুষ্ঠানিক রূপ পেতে পারে, যদি নিক্সন ও ব্রেজনেভের মধ্যে পত্র চালাচালি হয় এবং তা জনসমক্ষে প্রকাশের ব্যবস্থা করা যায় । কিসিঞ্জারের কাছে নিক্সন জানতে চান, আচ্ছা বলুন তাে, যুক্তরাষ্ট্র ও সােভিয়েত ইউনিয়নের মধ্যে একটা প্রকাশ্য বােঝাপড়ার বিষয়টিকে চীন কিভাবে দেখবে। কিসিঞ্জার ত্বরিত জবাব দেন, ওহ, যদি পশ্চিম পাকিস্তান রক্ষা করা যায়, তাহলে চীনারা আনন্দে লাফিয়ে উঠবে। লক্ষণীয় যে, নিক্সন এ সময় কিসিঞ্জারের কাছে এ কথাও খােলাসা করে নেন যে, পশ্চিম পাকিস্তানে। আগ্রাসন না চালানাের অর্থ কি বিরােধপূর্ণ কাশ্মীরেও হামলা অথবা দখল করে নেয়ার চেষ্টা থেকে বিরত থাকা? কিসিঞ্জার সােভিয়েত মিনিস্টার ভরনস্তবের বরাত দিয়ে নিশ্চিত করেন যে- হ্যা, ঠিক তাই। তিনি আমাকে বলেছেন, এখনাে পর্যন্ত পশ্চিম পাকিস্তানের ভূখণ্ড দখল করে নেয়ার কোনাে ঘটনা ঘটেনি। আমি তাকে এও বলেছি, আমার সঙ্গে আবার কোনাে আইনি খেলা খেলতে যেও না। আমরা মনে করি, বিদ্যমান সীমান্ত রেখার অর্থ হচ্ছে- বিরােধপূর্ণ কোনাে ভূখণ্ডও দখল করে নেয়া যাবে ।’ কিসিঞ্জার এ পর্যায়ে আরাে বলেন, আমার এই মন্তব্য শুনে ভরনস্তব স্পষ্ট করেছেন যে- হ্যা, আমরা সেই গ্যারান্টিই দিচ্ছি। সুতরাং এখন দেখার বিষয় হলাে, বিষয়টি কিভাবে আনুষ্ঠানিক রূপ নিচ্ছে।
কিসিঞ্জার আবেগের সঙ্গে এ সময় নিক্সনকে। এমন কথাও বলেন যে, তিনি যে ফলাফল আশা করছেন, তা যদি বাস্তবে রূপ লাভ করে তাহলে সেটা হবে একটি নিরঙ্কুশ অলৌকিক ঘটনা। তার বক্তব্যের সমর্থনে কিসিঞ্জার এ সময় নিক্সনকে তথ্য দেন- ‘আমার কাছে অসংখ্য গােয়েন্দা ফাইল রয়েছে যাতে সন্দেহাতীতভাবে এটা স্পষ্ট যে, ভারতীয় স্ট্রাটেজি ছিল পশ্চিম পাকিস্তানকে তারা একটা বিরাট বিস্ময় উপহার দেবেই।’ ১৫ ডিসেম্বর সকাল সাড়ে ১১টায় কিসিঞ্জার ও সােভিয়েত চার্জ দ্য এফেয়ার্স ভরনৎসােভের সঙ্গে বৈঠক হয়। কিসিঞ্জার এ সময় বৈরিতার অবসানে সােভিয়েত প্রধানমন্ত্রী কসিগিনকে লেখা একটি চিঠি হস্তান্তর করেন। এই বৈঠকের সার সংক্ষেপে লেখা আছে, সােভিয়েত ইউনিয়ন যুক্তরাষ্ট্রকে নিঃশর্তে এই গ্যারান্টি দিচ্ছে যে, পশ্চিম পাকিস্তান অথবা কাশ্মীরে কোনাে হামলা হবে না। তারা যখন পশ্চিম পাকিস্তানের কথা উল্লেখ করে, তখন পাক অংশের কাশ্মীরসহ বিদ্যমান বিভাজন রেখাকেই বুঝিয়ে থাকে। এ পর্যায়ে কিসিঞ্জার মন্তব্য করেন যে, ‘সােভিয়েতরা এ নিয়ে প্রকাশ্যে বলতে পারে না। কারণ তখন তা হয়তাে একটি বন্ধু-রাষ্ট্রকে আহত করার পর্যায়ে পড়বে। এটা তাে সত্য যে, ভারত সােভিয়েত ইউনিয়নের একটি ক্লায়েন্ট রাষ্ট্র ছিল না। আমি ভরনস্তবকে বললাম, দুটি পথ খােলা। পশ্চিম পাকিস্তানে শিগগিরই যুদ্ধবিরতি কার্যকর দেখতে চাই। তা যেভাবেই হােক, জাতিসংঘ কিংবা আমাদের সঙ্গে সরাসরি যােগাযােগের মাধ্যমে। অন্যথায় উপযুক্ত সিদ্ধান্ত গ্রহণ ছাড়া আমাদের সামনে কোনাে বিকল্প পথ থাকবে না।’
সূত্র: ১৯৭১ আমেরিকার গোপন দলিল – মিজানুর রহমান খান – সময় প্রকাশন