ঢাকায় ভারতপন্থি সরকারই পশ্চিমা স্বার্থের রক্ষাকবচ
বারমুডা ২১ ডিসেম্বর, ১৯৭১
যুক্তরাষ্ট্র ও ব্রিটেনের নীতি নির্ধারকরা এদিন ভবিষ্যদ্বাণী করেন যে, ভবিষ্যতের বাংলাদেশে ভারতঘেঁষা সরকারই হবে পশ্চিমা স্বার্থের রক্ষাকবচ। বারমুডায় অনুষ্ঠিত ঐ আলােচনায় যুক্তরাষ্ট্রের পক্ষে উপস্থিত ছিলেন প্রেসিডেন্ট নিক্সন, পররাষ্ট্রমন্ত্রী রজার্স, ড. হেনরি কিসিঞ্জারসহ ৯ জন। ব্রিটেনের পক্ষে ছিলেন প্রধানমন্ত্রী এডওয়ার্ড হিথ, পররাষ্ট্রমন্ত্রী স্যার এলেক ডগলাস-হােম, যুক্তরাষ্ট্রে নিযুক্ত ব্রিটিশ রাষ্ট্রদূত লর্ড ক্রোমারসহ আট জন। আলােচনার শুরুতেই স্যার এলেক মন্তব্য করেন, পাক-ভারত পরিস্থিতির মূল্যায়নে তাদের দুই দেশের মধ্যে তেমন মতপার্থক্য নেই। ব্রিটেনের মত হচ্ছে দুদেশের সংকটের সূত্রপাত ঐতিহাসিকভাবে তখনই, যখন পাকিস্তান সরকার সিয়েটো পরিত্যাগ এবং সেন্টোর সঙ্গে বাঁধনটা আলগা করে দিয়ে চীনের দিকে ঝুঁকে পড়ার সিদ্ধান্ত নেয়। ভারত ধরে নেয় উপমহাদেশের নিরাপত্তার জন্য এটা এক প্রকৃত হুমকি। আর এই পটভূমিতে ভারত ও সােভিয়েত রাশিয়ার মধ্যে স্বাক্ষরিত হয়, ‘ট্রিটি অব কনভিনিয়েন্স’। ব্রিটিশদের সন্দেহ হয়, ভারত এবার বুঝি একেবারেই সােভিয়েতের পকেটে চলে গেল। ভারত তাদের আনুষ্ঠানিকভাবে ঘাঁটি স্থাপনের অধিকার দিয়ে বসে কিনা। সুতরাং আজ সময় এসেছে, যুক্তরাজ্য ও যুক্তরাষ্ট্রকে উপমহাদেশের ভবিষ্যত সমস্যা মােকাবেলায় সিদ্ধান্ত নিতে হবে। পরিস্থিতির তিনটি দিক রয়েছে। প্রথমত, পশ্চিম পাকিস্তানের জন্য করণীয় নির্ধারণ। দ্বিতীয়ত, বাংলাদেশে অনতিক্রম্য দুর্ভিক্ষ ঠেকাতে মানবিক সহায়তা প্রদান। তৃতীয়ত, উপমহাদেশের সবচেয়ে ক্ষমতাবান রাষ্ট্র হিসেবে ভারতের সঙ্গে বােঝাপড়ার একটা পথ খুঁজে বের করা।
স্যার এলেক অভিমত দেন, অখণ্ড পাকিস্তানের জন্য আর কোনাে চিন্তাভাবনা করা অবাস্তব। আমাদের বুঝতে হবে উপমহাদেশের তিনটি দেশ রয়েছে। মার্কিন পররাষ্ট্রমন্ত্রী রজার্স এ সময়ে বলেন, ভুট্টো আসলে কী করেন তা বােঝা কঠিন। তবে একটা বিষয়ে যে কেউ নিশ্চিত হতে পারেন যে, তিনি তার নিজস্ব রাজনৈতিক ফায়দা হাসিলে পরিস্থিতিকে কাজে লাগাবেন। তিনি সম্ভবত উপযুক্ত সময়ে মুজিবকে মুক্তি দেবেন এবং সেনাবাহিনীকেই দায়ী করবেন যে, তারা কেন আগে বেসামরিক নিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠায় উদ্যোগী হয়নি। প্রেসিডেন্ট নিক্সন এ পর্যায়ে বর্তমান পরিস্থিতে সােভিয়েত স্বার্থের ব্যাপারে ব্রিটিশ দৃষ্টিভঙ্গি জানতে চান। রাশিয়া কি ভারতের জন্য একাই দায়দায়িত্ব নেবে না কি এটা দেখতে চাইবে যে, পশ্চিমা দেশগুলােও তাতে অংশ নিক। উত্তরে স্যার এলেক বলেন, তিনি মনে করেন, জোটনিরপেক্ষ থাকার ঐতিহ্য ভারত বজায় রাখবে। অন্তত কিছু করার জন্য তাে বটেই। ভারতীয়রা অবশ্যই বাংলাদেশে সম্ভাব্য চীনা প্রভাব বৃদ্ধি নিয়ে উদ্বিগ্ন ছিলেন। আর সে কারণেই তারা বাংলাদেশের নিয়ন্ত্রণে উদারপন্থি নেতাদের দেখতে চাইবে। নিক্সন প্রশ্ন করেন, যদি এমন চীনা বিপদের উত্থান কখনাে ঘটে। তাহলে ভারতীয়রা কি আমাদের, না সােভিয়েতের, নাকি উভয়ের কাছ থেকে সাহায্য লাভের চেষ্টা করবে। নিক্সন আরাে বলেন, কংগ্রেস এবং অন্যত্র ভারত সম্পর্কে একটা ভিন্নতর মূল্যায়ন বর্তমানে ক্রিয়াশীল। আর তা হলাে গত ২৫ বছর ধরে আমরা ভারতকে সাহায্য দিয়েছি। এটা ১০ বিলিয়ন ডলারের কম হবে না।
কিন্তু যুক্তরাষ্ট্রের ভাগ্যে জুটেছে দাঁতের ওপর লাথি । প্রশ্ন উঠেছে, আমরা যদি কোনাে প্রভাব খাটানাে ছাড়াই এটা অব্যাহত রাখি তাহলে কি এই সাহায্য মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের স্বার্থ রক্ষা করবে? যুক্তি দেয়া হচ্ছে, ঐ অর্থ বরং অভ্যন্তরীণভাবে খরচ করা ঢের উত্তম। নিক্সন এ ব্যাপারে ব্রিটিশ রায় জানতে চাইলে স্যার এলেক বলেন, আমরা অনুমান করতে পারি যে, ভারতীয় রাজনীতিকদের তরফে কোনাে কৃতজ্ঞতা বােধ থাকবে না। তবে তা সত্ত্বেও ভারত কিন্তু সােভিয়েত ইউনিয়নের ওপর সম্পূর্ণরূপে নির্ভরশীল হতে চাইবে না। সুতরাং ভারতের সঙ্গে আমাদের ভালাে সম্পর্কের সূত্রগুলাের সঙ্গে যােগাযােগ রক্ষা করে যেতে হবে। এলেক বলেন, আমার ধারণা। ভারতও এটা চাইবে। গত মাসে যুক্তরাষ্ট্রকে ভারত প্রশ্নে বেশ উদ্বিগ্ন হতে দেখেছে ব্রিটেন। এলেক মনে করেন, ভারতের সঙ্গে সম্পর্ক পুনরুদ্ধারে যতটা শুভেচ্ছা থাকা। দরকার যুক্তরাষ্ট্রের জন্য ভারতে তা এখনাে রয়েছে বলে তিনি মনে করেন। মার্কিন পররাষ্ট্রমন্ত্রী বলেন, মিসেস গান্ধী যদিও আমাদের সম্পর্কের ক্ষেত্রে সাহায্য যে একটি ফ্যাক্টর তা উল্লেখ করতেই অসন্তোষ প্রকাশ করেছেন। সুতরাং এই পরিস্থিতিতে কংগ্রেস অন্য কোনাে কর্মসূচি অনুমােদন করবে বলে মনে হয় না। স্যার এলেক প্রশ্ন করেন, ভারতের তরফে কেউ কি কখনাে সাহায্য প্রাপ্তির জন্য মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রকে ধন্যবাদ জানিয়েছে? রজার্স বলেন, ভারতীয়রা যে মনােভাব দেখিয়েছে তা অন্য কোনাে দেশের কাছ থেকে আমরা পাইনি।
তবে অবশ্য আমরা আশা করি যে ভারতে অন্তত নতুন করে প্রভাব বিস্তারের একটা সুযােগ যুক্তরাষ্ট্র পাবে। প্রেসিডেন্ট বলেন, মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র ভারতীয়দের কাছ থেকে কেবল “থ্যাঙ্ক ইউ ভেরি মাচ’ শুনতে রাজি নয়। আমরা যা করি, তা আমাদের নিজস্ব স্বার্থে এবং আমাদের গৃহীত পদক্ষেপের যথার্থতাও দিতে আমাদের সক্ষম হতে হবে সেই শর্তেই। যদি ব্যাপারটা এরকমই দাঁড়ায় যে, মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র ভারতের আশীর্বাদ লাভে ধন্য হতে চায় তাহলে তা অর্জনে আমরা কিছু করব। নিক্সন এ মন্তব্যের পরে উল্লেখ করেন, আসলে সমস্যার দিকে নজর দেয়ার ক্ষেত্রে এই দৃষ্টিভঙ্গি মনে হয় ঠিক নয়। তিনি নিজেই বলেন, আমাদের ধৈর্য ধারণ করতে হবে। ভারতকে একটি গুরুত্বপূর্ণ সিদ্ধান্ত নিতে হবে, সে নিজেকে আনােয়ার সাদতের ভূমিকায় অবতীর্ণ হতে দেবে কী দেবে না । নিক্সন বিস্ময় প্রকাশ করে বলেন, আমরা কি এমন একটা অবস্থান মেনে নেব যে, ভারত যা কিছু করবে তা স্বয়ংক্রিয়ভাবে সঠিক বলে গণ্য হবে। আর আমাদেরটা প্রমাণিত হবে ভ্রান্তিপূর্ণ। ব্রিটিশ পররাষ্ট্রমন্ত্রী ডগলাস হােম এ সময় পুনর্ব্যক্ত করেন যে, আসলে এটাই গুরুত্বপূর্ণ, চীনের সঙ্গে সম্পর্ক গড়ার প্রশ্নে পাকিস্তান কত দূর যায়। মিসেস গান্ধী জুয়া খেলেছেন, বাংলাদেশে চীনা প্রভাব কোনাে অবস্থাতেই নিয়ন্ত্রণের বাইরে যেতে দেয়া হবে না। আর পশ্চিমা স্বার্থ হলাে নতুন বাংলাদেশকে হতে হবে চীনাকেন্দ্রিক হওয়ার পরিবর্তে মূলত ভারতকেন্দ্রিক। নিক্সন এ কথার পিঠে মন্তব্য করেন, এটা নিয়ে কোনাে প্রশ্নই চলে না যে, আমাদের অভিন্ন লক্ষ্য থাকবে ভারত যেন সােভিয়েত। থলের ভেতরে আটকে না যায়। প্রায় ৫০০ মিলিয়ন ভারতীয় সেটাই তৈরির চেষ্টা করছে। সেক্ষেত্রে আমরা কিভাবে আমাদের প্রভাবকে উৎকৃষ্ট পন্থায় ব্যবহার করতে পারি? এক্ষেত্রে ব্রিটিশ পরামর্শকে আমি স্বাগত জানাই। নিক্সন বলেন, আমাদের অবশ্যই এটা স্বীকার করতে হবে যে, ভারতের সঙ্গে আমাদের বােঝাপড়াটা এক ঐতিহাসিক ব্যর্থতা। একটি দৃষ্টান্ত হলাে, যেসব ইস্যু গুরুত্বপূর্ণ, মার্কিন স্বার্থ সংশ্লিষ্ট এমন ইস্যুতে জাতিসংঘের ভােটাভুটিতে ভারতের ৯৩ শতাংশ সিদ্ধান্তই আমাদের প্রতিকূলে।
বাস্তবতার নিরিখে আমরা ভারতের পন্থা স্বীকার করে নিতে পারি এবং ভারতের সঙ্গে আমাদের সম্পর্ক উন্নয়নে একটা অধিকতর হিসাব-নিকাশের ভিত্তিতে অগ্রসর হওয়ার কথাও ভাবতে পারি। রজার্স বলেন, ভারত জাতিসংঘে আমাদের বিরুদ্ধে ভােট দিয়েই শুধু ক্ষান্ত থাকে না। আমাদের বিরােধিতা করার যে কোনাে সুযােগ তারা কাজে লাগায়। স্যার এলেক বলেন, আপনাকে তাহলে এই ধারণার ভিত্তিতে অগ্রসর হতে হবে যে, আপনি ভারতীয়দের কাছ থেকে কিছুই পাবেন না। কিন্তু ভারতে যে মৌলিক পশ্চিমা স্বার্থ রয়েছে তা আপনাকে অবশ্যই বিবেচনায় নিতে হবে। তিনি একমত হন যে, নতুন পরিস্থিতির পরিপ্রেক্ষিতে পশ্চিমা বিশ্বকে বাস্তবসম্ভত পদক্ষেপ। গ্রহণ করতে হবে। নিক্সন বলেন, বর্তমান পরিস্থিতিতে ভারতকে চীনা প্রভাবের বাইরে নিয়ে আসার চেয়ে সােভিয়েত মুক্ত রাখাই অনেক বেশি গুরুত্বপূর্ণ। অদূর ভবিষ্যতে হয়তাে এই ধারণা বদলে যেতে পারে। আমরা একমত হতে পারি যে, আমরা। ভারতকে স্বাধীন দেখতে চাই। আমাদের দীর্ঘমেয়াদি লক্ষ্য ব্রিটিশদের মতাে অভিন্ন। যদিও কৌশলগত দিক থেকে আমাদের মধ্যে ভিন্নতা রয়েছে। মার্কিন পররাষ্ট্রমন্ত্রী উল্লেখ করেন, ভারত যদি সােভিয়েতকে সুবিধা দেয়ার সিদ্ধান্ত নেয় তাহলে তা মার্কিন জনমতকে বিগড়ে দেয়ার জন্য যথেষ্ট। নিক্সন উপসংহার টানেন এই বলে, এই ক্ষেত্রে যুক্তরাষ্ট্র ও যুক্তরাজ্যের মধ্যে ঘনিষ্ঠ সহযােগিতার সম্পর্ক দরকার। বাংলাদেশ প্রশ্নে সুনির্দিষ্ট সিদ্ধান্ত গ্রহণের আগে আমাদের উচিত হবে ভুট্টোকে তার অবস্থান সংহত করার জন্য আরাে কিছুটা সময় দেওয়া।
২২ ডিসেম্বর, ১৯৭১
কিসিঞ্জার নিক্সনকে দেয়া এক স্মারকে বলেন- ভুট্টো বলেছেন, মুজিবকে শিগগিরই কারাগার থেকে মুক্তি দেয়া হবে এবং তাকে এক ধরনের গৃহবন্দি করে রাখা হবে। এটা অবশ্যই এক ধরনের শুভেচ্ছামাত্র। তবে তা মুজিবের মুক্তি, যুদ্ধবন্দি ও ভারতীয় নিরাপত্তা হেফাজতে থাকা অন্যান্য পশ্চিম পাকিস্তানির প্রশ্নে ভারতীয় ও বাংলাদেশী নেতৃবৃন্দের সঙ্গে সংলাপ শুরুর সুর নির্ধারণে একটি ভালাে পদক্ষেপ হতে পারে। এ পর্যায়ে কিসিঞ্জার উল্লেখ করেন, ভারত ও বাংলাদেশের সম্পর্কের গতি-প্রকৃতি কী। হবে তা নিয়ে নয়া দিল্লিতে বিরাট জল্পনাকল্পনা রয়েছে। আমাদের দূতাবাস নিশ্চিত হয়েছে যে, অর্থনৈতিক সহায়তা বিশেষ করে উদ্বাস্তুদের প্রত্যার্বতন এবং বাণিজ্য সম্পর্ক নির্ধারণে একটি ট্রিটি ইতােমধ্যেই স্বাক্ষরিত হয়েছে। সেখানে এমনকি নিরাপত্তা সংক্রান্ত কিছু বিধানাবলিও সংযােজিত হতে পারে। এটা হবে ভারত ও সােভিয়েত ইউনিয়নের সম্পাদিত মৈত্রী চুক্তির আলােকে।
সূত্র: ১৯৭১ আমেরিকার গোপন দলিল – মিজানুর রহমান খান – সময় প্রকাশন