বাংলার বাণী
ঢাকা: ১১ই জুন, সোমবার, ২৭শে জ্যৈষ্ঠ, ১৩৮১
গুরুতর অভিযোগঃ তদন্ত হওয়া দরকার
অভাব এবার একাডেমিকেও ছুঁয়েছে। টাকার অভাবে একাডেমির এমন অবস্থা যে, সরকারের কাছে থেকে টাকা না পেলে আগামী মাসে কর্মচারীদের বেতন দেয়া দায় হবে। এবং বিভিন্ন খাতে একাডেমির ১০ লক্ষ টাকা দেনা রয়েছে। সে দেনাও টাকার অভাবে শোধ করা যাচ্ছে না। পত্রিকান্তরে বিশেষ প্রতিবেদন সূত্রে আরও জানা যাচ্ছে যে, ১৯৭৩-৭৪ আর্থিক বছরে উন্নয়ন খাতে বাংলা একাডেমির জন্য ৪০ লক্ষ টাকা বরাদ্দ করা হয়েছিল। এর মধ্যে তিন কিস্তিতে একাডেমিকে ৩০ লক্ষ টাকা দেয়া হয়েছে। বাকি ১০ লক্ষ টাকা এপ্রিল মাসে দেয়ার কথা থাকলেও কোনো অজ্ঞাত কারণে শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের পরিকল্পনা কমিশন সেই টাকার ‘ছাড়’ অনুমোদন দেননি।
প্রসঙ্গতঃ উল্লেখ্য যে, প্রথম পঞ্চবার্ষিক পরিকল্পনা ও উন্নয়ন খাতে বাংলা একাডেমির জন্য তিন কোটি ৫০ লক্ষ টাকা বরাদ্দ করা হয়েছে। এবং বাংলা একাডেমীর দায়িত্ব কিছু বাড়ানো হয়েছে। সরকার ইতিহাস পরিষদকেও বাংলা একাডেমির অন্তর্ভুক্ত করে দিয়েছেন। তার ফলে একাডেমি ‘ইতিহাস ও পুরাতত্ত্ব বিভাগ’ নামে একটি নতুন বিভাগ সৃষ্টি করেছে। এই নতুন বিভাগের জন্য চলতি আর্থিক বছরে দু’লক্ষ টাকা বরাদ্দ করা হয়েছিল-সে টাকাও নাকি একাডেমি পায়নি।
প্রয়োজনানুগ টাকা সময়মত না পাবার অভিযোগ দিয়ে একাডেমি সূত্র জানাচ্ছে যে, এ যাবত যেসব উন্নয়ন প্রকল্পের কাজে বাংলা একাডেমি হাত দিয়েছিল, টাকার অভাবে তার সব কাজই প্রায় বন্ধ হয়ে গেছে। বিভিন্ন মন্ত্রণালয়ের যেসব বই ছাপা হয়েছে-তার টাকাও শোধ করা হয়নি। পৌনঃপুনিক বা আবর্তক খাতে একাডেমী যে টাকা পায় তারা অধিকাংশই নাকি উন্নয়ন খাতে ব্যয় করা হয়েছে। ফলে বর্তমানে তহবিল প্রায় শূন্যের কোঠায়, কর্মচারীদের বেতন দেয়ার টাকা পর্যন্ত নেই।
প্রতিবেদনের সূত্রে একাডেমী প্রসঙ্গে রাজধানীর বিভিন্ন মহলের যে উদ্বেগ ও প্রশ্ন তুলে ধরা হয়েছে তা হলো-
(ক) উন্নয়ন ও অন্যান্য খাতে একাডেমি যে পরিমাণ টাকা পেয়েছে তার যথাযথ স্বদ্যবহার হয়েছে কিনা, (খ) স্বজন তোষণের নামে একাডেমির কর্তাব্যক্তি একাডেমিতে বহু সংখ্যক বাড়তি অপ্রয়োজনীয় কর্মচারী নিয়োগ করেছেন-এ খবর সত্য কিনা, (গ) একাডেমির সেই কর্তাব্যক্তি একাডেমির স্বাথানুকুল কাজের চেয়ে বিদেশ ভ্রমণ ও গোষ্ঠীর স্বার্থরক্ষার কার্যক্রমে অধিকতর ব্যাপৃত থাকেন-এ খবর সত্য কিনা, (ঘ) একাডেমির একশ্রেণীর স্নেহভাজন কর্মচারী দায়সারা গোছের দায়িত্ব পালন করছেন অন্যেরা প্রাণান্ত কাজ করে একাডেমিকে বাঁচিয়ে রাখার চেষ্টা করছেন-এ খবর সত্য কিনা?
সচেতন ও সজাগ মহলের প্রতিটি প্রশ্নই বিশ্লেষণ যোগ্য। বাংলা একাডেমীকে স্বজনপ্রীতি বন্ধুতোষণ, প্রিয় পালন ইত্যাকার কর্ম চলে বলে দীর্ঘকালের যে অভিযোগ আছে তারই বহিঃপ্রকাশ ঘটেছে খ ও ঘ এর দুটি প্রশ্নে। সংশ্লিষ্ট দপ্তরের কাজ দেখার চেয়ে বিদেশ ভ্রমণ গোষ্ঠী স্বার্থ রক্ষায় তৎপরতা আখের গোছানোর হিকমত প্রদর্শনী থাকার কথাই বা কতটা সত্যতাও বিশ্লেষণ যোগ্য। এবং শুধু বিশ্লেষণ যোগ্য নয় তদন্ত যোগ্য। উন্নয়ন ও অন্যান্য খাতে বাংলা একাডেমি যে পরিমাণ অর্থ পেয়েছে তার যথাযথ সদ্ব্যবহারের প্রশ্ন স্বভাবতই উঠেছে একাডেমির দরিদ্র প্রকাশনা দেখে। প্রকাশিত গ্রন্থের সংখ্যা এবং সেই অনুপাতে বরাদ্দকৃত অর্থকে দুটোর মধ্যে সামঞ্জস্য নেই। অতএব এখানে একটা যথাযথ তদন্ত হওয়া দরকার যে সত্যিকারে ব্যাপারটা কি!
স্বাধীনতার বহু আগে থেকেই বাংলা একাডেমি নানা উন্নয়নমূলক প্রকল্পের কাজ করে আসছে। এর কাজ করবার, উন্নতি অগ্রগতি, লাভ লোকসান নিয়ে এখনো সচেতন লোকেরা নানা প্রশ্ন রেখেছেন। পরিস্থিতি পর্যালোচনার পরিবেশ সৃষ্টি করেছেন। আমাদের দেশে তখন বিভাষী সরকারের রাজত্ব ছিল। তাদের শোষণ ও অন্যায় কর্ম আমরা সহ্য করতে পারতাম না। বিপদের ঝুঁকি নিয়েও সজাগ নাগরিকেরা কথা বলেছেন। প্রতিবাদের আন্দোলন গড়ে তুলেছেন। ফলে নাই নাই করেও যথেষ্ট কাজ হতো।
এখন দেশ স্বাধীন। বাংলা একাডেমি শুধুমাত্র বাংলাদেশেরই একটা সংস্থা। বাঙালি জাতি ও বাংলা ভাষার উন্নয়নকর্মী হলো একাডেমির একমাত্র উদ্দেশ্য। এখন স্বাধীন দেশের নাগরিক হিসেবে সচেতন ব্যক্তিরা আরও সচেতন হবেন একাডেমিক ব্যাপারে-এতো সুখের কথা। এদেশ এখন আমার আপনার সবার। একাডেমিক টাকা একাডেমির উন্নয়ন সবই যেমন আমাদের, এর ক্ষতি ও দুর্নামটাও তেমনই সমানভাবে আমাদের। অতএব বছরে ক’টা বই প্রকাশ করা হল, ইতিহাস পরিষদ কতটা নিষ্ঠার সঙ্গে কাজ করলো, উন্নয়ন খাতে বরাদ্দকৃত টাকা কোথায় গেল কেনো গেলো- এ সব প্রশ্ন তো সুস্থ বুদ্ধি, সততা ও দেশপ্রেমের লক্ষণ।
এই দৃষ্টিভঙ্গিতে বিচার করে আজ সত্যি বাংলা একাডেমী সম্বন্ধে একটা সার্বিক জরিপ কাজ চালানোর প্রয়োজন। এবং কেন বাজেট ফেল করেছে এরও অসুস্থ একটা তদন্ত হওয়া আবশ্যক। কে বা কারা এই অরাজকতা ও অবস্থার জন্য দায়ী-অতঃপর তারা চিহ্নিত হোক ও দন্ডিত হোক সচেতন মহল তাই চায়৷ সত্য তা সে যত কঠিনই হোক সত্যের বেশেই আসুক। আহাম্মকের স্বর্গের চেয়ে তার পরিণাম হবে অধিকতর কল্যাণকর।
সোভিয়েত উদ্ধারকারী দলের বিদায় সংবর্ধনা
কার্জ শেষ, এবার বিদায় নেবার পালা। চট্টগ্রাম বন্দরে কর্মরত সোভিয়েত উদ্ধারকারী দল তাদের দায়িত্ব সেরে এবার স্বদেশে পথে যাত্রা করবেন। গত ৮ই জানুয়ারি চট্টগ্রাম পোর্ট ট্রাস্ট কর্তৃক আয়োজিত তাদের বিদায় সংবর্ধনা অনুষ্ঠানে সোভিয়েত উদ্ধারকারী দলের কাজের ভূয়শী প্রশংসা করে বক্তৃতা করেছেন বাংলাদেশের যোগাযোগ পররাষ্ট্রমন্ত্রী জনাব এম মনসুর আলী। তিনি বলেছেন, সোভিয়েত উদ্ধারকারী দলের ওপর অর্পিত দায়িত্ব সুচারুভাবে সম্পন্ন করে তারা বাংলাদেশ ও সোভিয়েত ইউনিয়নের জনগণের মধ্যে বিরাজমান মৈত্রী ও সহযোগিতার সম্পর্ক আরো জোরদার করার ক্ষেত্রে মূল্যবান অবদান রেখেছেন।
স্বাধীনতার প্রায় তিন মাস পর ১৯৭২ সালের ২৭ শে মার্চ বাংলাদেশ এবং সোভিয়েত ইউনিয়নের মধ্যে প্রটোকল স্বাক্ষরের এক মাসের মধ্যেই সোভিয়েত উদ্ধারকারী দল চট্টগ্রাম বন্দরে কাজ শুরু করেন। চট্টগ্রাম বন্দর তখন জাহাজ নোঙরের একেবারে অযোগ্য ছিল। বন্দরের নিকটবর্তী প্রচুর মাইন ছড়িয়ে-ছিটিয়ে ছিল চারিদিকে। পাকিস্তানি দখলদার বাহিনী সম্ভাব্য আক্রমণের আশঙ্কায় জালের মত মাইন সরিয়ে রেখেছিল। এছাড়া ছিল যুদ্ধে ধ্বংসপ্রাপ্ত জাহাজ নৌযান। যে জাহাজ-নৌযানের ধ্বংসাবশেষ জলের গভীরে তলিয়ে ছিল।
স্বাধীনতা-উত্তরকালে পুর্নবাসনের সাথে সাথে ধ্বংসপ্রাপ্ত যোগাযোগ ব্যবস্থাকে সচল করে তোলা বিশেষ জরুরী বলে অভিহিত হয়। বন্ধু বন্ধুরাষ্ট্র সোভিয়েত ইউনিয়ন বিষয়টির গুরুত্ব অনুধাবন করে তাদের সাহায্য এবং সহযোগিতার হাত স্প্রসারিত করে। সেই থেকে শুরু, প্রথমে বন্দর এলাকাকে মাইন মুক্ত করা এবং পরবর্তীকালে ডুবে যাওয়া জাহাজ গুলো ধ্বংসাবশেষ উদ্ধার। ইতিমধ্যে চট্টগ্রাম বন্দর সম্পূর্ণরূপে মুক্ত হয়েছে এবং ডুবে যাওয়া জাহাজ গুলো সর্বশেষ ধ্বংসাবশেষ টুকুও উদ্ধার করা হয়েছে। উদ্ধারকৃত ধ্বংসাবশেষ গুলো অর্পণ করা হয়েছে বাংলাদেশ ইস্পাত শিল্প কর্পোরেশন এর হাতে।
যোগাযোগমন্ত্রী সোভিয়েত ইউনিয়নের সাহায্য এবং সহযোগিতার কথা উল্লেখ করতে গিয়ে বলেছেন, বাংলাদেশে যখন কোন বৈদেশিক সহযোগিতা পাচ্ছিল না সেই সংকটজনক মুহূর্তে উদ্ধারকারী দল চট্টগ্রাম বন্দর পরিষ্কার করার কাজে হাত দেন। তারা সে কাজ সম্পন্ন করেছেন। এখন তাদের স্বদেশ ফেরার পালা। কিন্তু বিপদের সময় যে তারা সাহায্য করেছেন তার স্বাক্ষর অবশ্যই বাংলাদেশের মানুষের মনে আঁকা থাকবে।
শুধু স্বাধীনতা-পরবর্তীকালেই নয় স্বাধীনতা সংগ্রামের সময় এই মহান দেশ প্রতিটি পদক্ষেপে আমাদের দিকে সাহায্যের হস্ত সম্প্রসারিত রেখেছেন। ব্যক্তিগতভাবে তারা খোঁজখবর নিয়েছেন আমাদের স্বাধীনতা সংগ্রামের অধিনায়ক বঙ্গবন্ধুর। বিশ্বে আমাদের স্বপক্ষে জনমত সৃষ্টিতে সোভিয়েত সরকার এবং জনগণযে ভূমিকা পালন করেছেন তা অবিস্মরণীয়। রাষ্ট্রদূত মিঃ ফোমিন বিদায়ী সোভিয়েত উদ্ধারকারী দলের সমর্থন সংবর্ধনা অনুষ্ঠানে বলেছেন, সোভিয়েত উদ্ধারকারী দলের কাজ এটাই প্রমাণ করে যে প্রয়োজনের সময় বাংলাদেশের জনগণের পাশে থাকার জন্য সোভিয়েত জনগণ দৃঢ় সংবদ্ধ। পূর্বেও যেমন আমরা মহামান্য রাষ্ট্রপতির এই বক্তব্যের সভ্যতার প্রমাণ পেয়েছি, আমাদের দৃঢ় বিশ্বাস ভবিষ্যতে তার অন্যথা হবে না।
একশ্রেণীর লোক রয়েছে যারা যেকোন বিষয় নিয়ে অপপ্রচারের তুফান ছুটাতে ওস্তাদ। এটা কেউ করেন অর্বাচীনের মত আবার এমন লোকের সংখ্যাও কম নেই যারা একটা অসৎ লক্ষ্যকে সামনে রেখে অত্যন্ত সুপরিকল্পিতভাবে অপপ্রচার চালান। সোভিয়েত উদ্ধারকারী দলের কাজ নিয়ে আমাদের দেশে কম সন্দেহ-সংশয় সৃষ্টির অপচেষ্টা চালানো হয়নি। বড় বড় নিবন্ধ রিপোর্ট ফেঁদে এমনকি আমাদের সার্বভৌমত্বের ওপর কটাক্ষ্য করা হয়েছে। কাজ শেষে সোভিয়েত উদ্ধারকারী দলের বিদায় নেবার সময় সেই অপপ্রচারকারীদের উদ্দেশ্যে আমরা শুধু একটি কথাই রাখব অযথা জল ঘোলা করে চূড়ান্ত কোনো সুফল প্রত্যাশা করা যায় না।
সোভিয়েত উদ্ধারকারী দল স্বদেশে ফিরেছেন। তাদের প্রতি রয়েছে বাংলাদেশের মানুষের অকৃত্রিম শুভেচ্ছা। তারা এই সহযোগিতার মাধ্যমে বন্ধুত্বের যে দৃষ্টান্ত রাখলেন স্মরণীয় হয়ে থাকবে। দু’দেশের বন্ধুত্ব হবে দীর্ঘতম।
কালেক্টেড অ্যান্ড ইউনিকোডেড বাই- সংগ্রামের নোটবুক