পিকিং যুদ্ধে জড়ালে ওয়াশিংটনকে কাছে পেত দিল্লি
একাত্তরের বাংলাদেশের স্বাধীনতা সংগ্রামে যুক্তরাষ্ট্র ও চীনের ভূমিকা সমান্তরাল রেখায় দাড়িয়েছিল। প্রচলিত মত এমনই যে, চীন ভারতের শুধু বিরােধিতা নয়, এমনকি পাকিস্তানের পক্ষে সামরিক হস্তক্ষেপেও তার প্রস্তুতি ছিল। কিন্তু সদ্য প্রকাশিত মার্কিন দলিল এমন ধারণাও হাজির করেছে যে, যুক্তরাষ্ট্র পাকিস্তান রক্ষায় চীনের অনুকূল ভূমিকা আশা করলেও একই সঙ্গে তার সামনে এই বিকল্পও ছিল যে, চীন ভারত আক্রমণ করলে সে সমর্থন দিত দিল্লিকেই। শুধু সামরিক ও বেসামরিক আমলা পর্যায়ে নয়, খােদ নিক্সন-কিসিঞ্জারের একান্ত সংলাপেও এ দৃষ্টিভঙ্গির সমর্থন মেলে। এই দুজন যেমন নিশ্চিত ছিলেন যে, যুক্তরাষ্ট্রকে যুদ্ধে জড়াবেন না, শুধু সাজানাে যুদ্ধের মহড়া দেখিয়ে সম্ভব হলে অখণ্ড পাকিস্তান রক্ষা করবেন; তেমনই তারা চীনের কাছ থেকে বড়জোর ভয় দেখানােটুকু আশা করেছেন। এর বেশি নয়। বােঝাই যাচ্ছে, ওয়াশিংটনের এই মনােভাব চীনেরও অজানা ছিল না।
১০ জুলাই, ১৯৭১
ঊনচল্লিশ পৃষ্ঠার এই দলিল তৈরি করা হয় সিনিয়র রিভিউ গ্রুপের জন্য। রিপাের্টটি সিআইএ, স্টেট ডিপার্টমেন্ট ও প্রতিরক্ষা মন্ত্রণালয় কর্তৃক অনুমােদিত। এতে বলা হয়েছে, একটি সীমিত পাক-ভারত সংঘাতের পটভূমিতে ভারতকে সামরিক সমর্থন প্রদান একটি কম সম্ভাবনাময় কৌশল হিসেবে গণ্য হতে পারে। তবে চীন যদি পাকিস্তানের পক্ষে ব্যাপকভাবে হস্তক্ষেপ করে অর্থাৎ সে যদি ভারতকে মারাত্মক উপায়ে হুমকি প্রদর্শন করে তাহলে ভিন্ন কথা। চীন যদি ব্রহ্মপুত্র উপত্যকায় দখল করে নেয়ার উদ্যোগ নেয় তখন আমরা ভারতকে সামরিক সহায়তা দেয়ার বিষয়টি বিবেচনায় নেব। ভারতকে এই ধরনের সহায়তা দেয়া রাজনৈতিকভাবে অধিকতর সহজ হবে যদি ভারত পাকিস্তান আক্রমণের উদ্যোক্তা না হয়। মনে রাখতে হবে, এশিয়ায় আমরা তুলনামূলকভাবে ভারতকেই বেশি গুরুত্ব দেব। আর সে কারণে চীনের সম্ভাব্য আক্রমণের পটভূমিতে ভারতকে সামরিক সহায়তা দেয়া হবে ঐ ধারণার প্রতি স্বীকৃতি। সেক্ষেত্রে পাকিস্তানের সঙ্গে আমাদের সম্পর্ক হোঁচট খাবে। আমরা অবশ্য আর যা-ই হোেক পাকিস্তানের বিরুদ্ধে ব্যবহারের জন্য ভারতকে অস্ত্র দেব না। আমরা এটা বিবেচনায় রাখব যে, পাকিস্তানের সঙ্গে যাতে আমাদের একটা যুদ্ধোত্তর সম্পর্ক বজায় রাখা সম্ভব হয়। বিশেষ করে যুক্তরাষ্ট্র যদি একই সঙ্গে একটি সমঝােতামূলক রাজনৈতিক নিষ্পত্তিতে সাফল্য অর্জন করতে পারে, সে লক্ষ্যে সুনির্দিষ্ট যেসব পদক্ষেপ নেয়া হতে পারে তার মধ্যে গুরুত্বপূর্ণ কয়েকটি হলাে ।
১৯৬৪ সালের এয়ার ডিফেন্স এগ্রিমেন্ট নিয়ে ভারতের সঙ্গে আলােচনা, ভারত যদি চায় তাহলে একটি জরুরি সামরিক সহায়তা কর্মসূচি গ্রহণ, চীনা সামরিক তৎপরতা সম্পর্কে ভারতের সঙ্গে গােয়েন্দা তথ্য বিনিময়, অতিরিক্ত সহায়ক ব্যবস্থাদি নিয়ে ব্রিটিশ ও সােভিয়েতদের সঙ্গে সমন্বয়। এর সুবিধা হচ্ছে এটা হবে আমাদের সামগ্রিক এশীয় নীতির সঙ্গে সঙ্গতিপূর্ণ। আমাদের নীতি হচ্ছে, এশিয়ায় যেসব দেশ চীন কর্তৃক হুমকিগ্রস্ত কিংবা চীনা আগ্রাসনের শিকার হবে তাদের সহায়তা দেয়া। সুতরাং সেক্ষেত্রে ভারতের সঙ্গে ঘনিষ্ঠ সম্পর্কের একটি দারুণ ভিত্তি তৈরি হবে। ভারতের ওপর সােভিয়েতের প্রভাব হ্রাস পাবে। আর অসুবিধার মধ্যে রয়েছে এ পদক্ষেপ নিলে চীন ও পাকিস্তান উভয়ের সঙ্গে আমাদের সম্পর্কের টানাপােড়েন তৈরি হবে।
২৫ মে, ১৯৭১
হেনরি কিসিঞ্জারের জন্য প্রস্তুত এক কনটিনজেন্সি স্টাডিতে বলা হয়- গত ১০ দিন ধরে আমরা ভারতীয় বাহিনী পূর্ব ও পশ্চিম পাকিস্তানের সীমান্তের কাছাকাছি মুভমেন্ট জোরালাে করেছে মর্মে অশুভ রিপাের্ট পাচ্ছিলাম। ভারত সরকার সীমান্তে বিএসএফের শক্তি বৃদ্ধি করেছে এবং নিয়মিত সেনাবাহিনীকে সীমান্ত থেকে তিন কিলােমিটারের ভেতরে মােতায়েন করেছে। পাঞ্জাবে ট্যাকের চলাচল লক্ষ্য করা গেছে। অন্যদিকে পূর্ব পাকিস্তান থেকে হিন্দু উদ্বাস্তুরা স্রোতের মতােই ভারতে প্রবেশ করছে। এদের সংখ্যা দৈনিক এক লাখের বেশি হবে। এই পটভূমিতে ভারতের ক্রমবর্ধমান উদ্বেগ স্বাভাবিক। ইতােমধ্যেই ৩৪ লাখের বেশি উদ্বাস্তু ভারত সীমান্ত অতিক্রম করেছে। ভারত সরকার প্রবল জনমত ও সংসদের চাপের মুখে। তারা উদ্বাস্তু স্রোত বন্ধ দেখতে চাইছে। চাইছে বাঙালিদের সমর্থন দিতে । ভারত সরকার আশংকা করছে উদ্বাস্তু আগমন যদি তারা ঠেকাতে না পারে তাহলে পূর্ব ভারতের রাজ্যগুলােতে উদ্বাস্তু সংখ্যা ৮০ লাখে পৌছাবে। ভারতীয়দের মতে এ ধরনের একটা অবস্থা সংশ্লিষ্ট এলাকার সামাজিক ও অর্থনৈতিক কাঠামাের ওপরে এক অসহনীয় বােঝা সৃষ্টি করবে। পাকিস্তানি সেনাবাহিনীর সামরিক সাফল্যের মুখে ভারত একই সঙ্গে বাঙালিদের স্বাধীনতা সংগ্রাম সমর্থনে পদক্ষেপ নিচ্ছে। বিএসএফ প্রতিষ্ঠিত শিবিরে কথিত মতে ১০ হাজার বাঙালি গেরিলা ও অন্তর্ঘাত কৌশল সম্পর্কে প্রশিক্ষণ নিচ্ছে। বাঙালি বিচ্ছিন্নতাবাদীদের সীমিত পরিমাণ অস্ত্র ও গােলাবারুদও সরবরাহ করা হচ্ছে এবং কিছু ভারতীয় বাহিনী বিচ্ছিন্নতাবাদীদের প্রশিক্ষণ ও সহায়তা দিতে পূর্ব বাংলায় ঢুকে পড়েছে। ভারতীয় ও পাকিস্তানি সীমান্তরক্ষীদের মধ্যে বেশ কিছু সংঘাতের ঘটনা
ঘটেছে। অন্তত একবার পাকিস্তানি বিমান ভারতীয় আকাশসীমা লংঘন করেছে।
আট পৃষ্ঠার এই সমীক্ষায় বলা হয়, ভারত সম্ভবত পাকিস্তানের সঙ্গে এখনাে যুদ্ধে জড়িয়ে পড়তে চায় না। ভারত হয়তাে বিশ্বাস করতে পারে যে, তার জাতীয় স্বার্থের জন্য দরকার হলাে পাকিস্তানের বিরুদ্ধে একটি প্রিএপটিভ’ আক্রমণ। পাকিস্তানিরা তাদের দিকে সম্ভবত ভাবছে যে, বিদ্রোহ বেঁচে থাকতে পারে কেবলই ভারতীয় রাজনৈতিক ও সামরিক সমর্থনে। আর সে কারণেই তারা ভারতের মধ্যে অবস্থিত প্রশিক্ষণ শিবিরে সরাসরি হামলার সিদ্ধান্ত নিতে পারে। আর দীর্ঘমেয়াদি পরিকল্পনা থেকে এই বিপদও রয়েছে যে, পাকিস্তানিরা নিজেরাই ভারতের সঙ্গে একটি সংঘাত উস্কে দিতে পারে, যাতে পূর্ব পাকিস্তানের অভ্যন্তরীণ পরিস্থিতি থেকে আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের দৃষ্টি ভিন্নদিকে প্রবাহিত হয়। সেক্ষেত্রে পূর্ব পাকিস্তানের জনগণের মনে তারা এই ধারণা দিতে চাইতে পারে যে, আমাদের হুমকির চেয়ে বরং ভারতীয় হুমকি অনেক বেশি মারাত্মক। তাই হাঙ্গামার চেয়ে অখণ্ড পাকিস্তানই ভালাে। আর পূর্ব পাকিস্তানে পশ্চিম পাকিস্তানি সামরিক বাহিনীর উপস্থিতি তাদের জন্যই মঙ্গল। সমীক্ষায় এ পর্যায়ে উল্লেখ করা হয় যে, চীনের দিক থেকে ভারতের মনে ভীতি রয়েছে।
তাদের ধারণা একটি সম্ভাব্য পাক-ভারত সংঘাতের পরিণতিতে প্রত্যক্ষ চীনা হস্তক্ষেপ নিশ্চিত হতে পারে। আমরা গােয়েন্দা সূত্র থেকে জানতে পেরেছি- ভারতের সঙ্গে পাকিস্তানের সম্ভাব্য যুদ্ধে জড়িয়ে পড়ার ক্ষেত্রে চীন সম্ভবত ইতােমধ্যেই। পাকিস্তানকে একটা শর্তসাপেক্ষ প্রতিশ্রুতি দিয়ে থাকতে পারে। চীনারা হয়তাে আশ্বাস দিয়েছে যে, তারা তিব্বত সীমান্ত দিয়ে সামরিক তৎপরতা শুরু করবে। তবে শর্ত হচ্ছে- এটা তারা করবে তখনই যখন তারা দেখতে পাবে যে, ভারতীয় সেনাবাহিনী জোরপূর্বক এবং সুপরিকল্পিতভাবে পাকিস্তানি সীমান্ত অতিক্রম করেছে। চীনারা যদি সরাসরি জড়িয়ে পড়ে তাহলে সােভিয়েতরাও ভারতকে প্রকাশ্যে সমর্থন দেবে এবং প্রয়ােজনীয় সামরিক সহায়তা নিয়েও তাদের পাশে দাঁড়াবে। ভারত ও পাকিস্তান যদি সম্মুখযুদ্ধে লিপ্ত হয় তাহলে যুক্তরাষ্ট্র ১৯৬৫ সালের মতােই অনেক কঠিন সিদ্ধান্তের মখােমুখি হবে। কারণ ১৯৬৫ সালের পরিস্থিতির চেয়েও এবারের অবস্থা তাৎপর্যপূর্ণভাবে অধিকতর জটিল হবে এবং এই সম্ভাবনা প্রবল যে, যুদ্ধ একই সঙ্গে চলবে পূর্ব ও পশ্চিম সীমান্তে এবং সেক্ষেত্রে কোনাে না কোনাে মাত্রায় চীন ও সােভিয়েত জড়িয়ে পড়বে। তবে যদিও সম্ভাবনা কম কিন্তু তা সত্ত্বেও ভারতের বিরুদ্ধে। চীন যদি বড় ধরনের আক্রমণ পরিচালনা না করে তাহলে কোনাে মার্কিন সামরিক অঙ্গীকারে জড়ানাে চলবে না।
৩ মার্চ, ১৯৭১ বাঙালির জীবনে ২৫ মার্চ নেমে আসার অনেক আগেই বহু কনটিনজেন্সি স্টাডি প্রস্তুত করেছিল যুক্তরাষ্ট্র। এর অন্যতম হচ্ছে- ন্যাশনাল সিকিউরিটি কাউন্সিলের স্টাফ সেক্রেটারি জিয়ান ডব্লিউ ডেভিস স্বাক্ষরিত ১৬ পৃষ্ঠার একটি সমীক্ষা । এতে বলা হয়, ‘পশ্চিম পাকিস্তান যদি অনুরােধ করে তা হলেও চীনা সামরিক হস্তক্ষেপে সম্ভাবনা একেবারেই ক্ষীণ থাকবে। চীনারা এমনিতেই অতি ঝুঁকির মধ্যে নিজেদের জড়াতে বড় বেশি বিমুখ। তাছাড়া এতে জড়ালে তেমন উপকারও নেই। তাই চীনারা ভাবতে পারে যে, এতে জড়াতে চাইলে তাদের সৈন্যদের অবিরােধীয় ভারতীয় ভূখণ্ড অতিক্রম করতে হবে। এর পরিণামে এক বড় ধরনের চীন-ভারত সংঘাতের জন্ম দিতে পারে। (ভারতীয় ভূখণ্ড এড়াতে হলে চীনকে সমুদ্র পথে অথবা বার্মার মধ্য দিয়ে তার সৈন্যদের ৪০০ মাইল পথ অতিক্রম করতে হবে। যা-ই হােক, এ ধরনের উদ্যোগ নিতে চীনের যে ধরনের সামর্থ্য থাকা দরকার তা আসলেই সীমিত। আর সে কারণে এ ধরনের অ্যাডভেঞ্চারে নিজেকে জড়ানাে থেকে সে দূরেই থাকবে। তারপরেও চরম অসম্ভব সত্ত্বেও আমরা যদি ধরে নেই যে, ভারতীয় এবং অথবা বার্মার ভূখণ্ড অতিক্রম করে এসে সে সামরিক হস্তক্ষেপ করবেই, তাহলে আমরা ভারতীয়দের (এবং অথবা বার্মাকে প্রতি রাজনৈতিক সমর্থন দেব। শুধু তা-ই নয়, সম্ভবত আগ্রাসন ব্যর্থ করে দিতে আমরা সেক্ষেত্রে বস্তুগত সমর্থনও নিশ্চিত করব। কিন্তু মনে রাখতে হবে যে, যুক্তরাষ্ট্রের জন্য এই এলাকায় কোনাে গুরুত্বপূর্ণ নিরাপত্তাগত স্বার্থ নেই। তাই, আমাদের প্রত্যক্ষ সামরিক সংশ্লিষ্টতা এড়িয়ে যেতে হবে।
সূত্র: ১৯৭১ আমেরিকার গোপন দলিল – মিজানুর রহমান খান – সময় প্রকাশন