You dont have javascript enabled! Please enable it! ইন্দিরা যুদ্ধাপরাধীদের বিচার চাননি - সংগ্রামের নোটবুক
ইন্দিরা যুদ্ধাপরাধীদের বিচার চাননি
ইন্দিরা গান্ধী নিক্সনের অর্থমন্ত্রী জন বি কোনালিকে বলেন, তিনি (মুজিব) সত্যিই যুদ্ধাপরাধের বিচার প্রশ্নে আবেগপ্রবণ। প্রসঙ্গটি অবশ্য কোনালিই তুলেছিলেন। প্রভাবশালী মার্কিন রাজনীতিক কোনালি ১৯৭২ সালের ৬ জুন থেকে ১১ জুলাই বাংলাদেশ, ভারত ও পাকিস্তানসহ বিশ্বের বহু দেশ সফর করেন। তিনি ঢাকায় বঙ্গবন্ধু, সিমলায় ইন্দিরা ও রাওয়ালপিন্ডিতে ভুট্টোর সঙ্গে যথাক্রমে ৩, ৫ ও ৬ জুলাই মিলিত হন।| কোনালি এই তিন নেতার সঙ্গে সাক্ষাতের পর হােয়াইট হাউসে ১৪ জুলাই ১৯৭২ নিক্সন ও কিসিঞ্জারের কাছে তার অভিজ্ঞতা বর্ণনা করেন। তিনি বলেন, বাংলাদেশ অবশ্যই হবে বিশ্বের নিকৃষ্টতম স্থান। কিন্তু দেশটির প্রয়ােজন আমাদের সমর্থন। ভারতের সঙ্গে রচনা করতে পারে সেতু। প্রেসিডেন্ট নিক্সন এ সময় বলেন, জাপানিদের অবশ্যই উচিত এই এলাকার অধিকতর উন্নয়নে অর্থনৈতিক সহায়তা দেওয়া। কোনালি মুজিব সম্পর্কে বলেন, তিনি বাকপটু, চৌকস, দক্ষ অভিনেতা এবং বক্তৃতাবাগীশ। কোনালি বলেন, বাংলাদেশ টিকে থাকতে পারে কি না তা নিয়ে একটা প্রশ্ন ছিল। তার এখন দরকার পশ্চিম পাকিস্তানে আটকেপড়া দক্ষ বাঙালিদের। অন্যথায় তার বেসামরিক আমলার অভাব ঘুচবে না। কিন্তু মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র অব্যাহত সমর্থনের দায়িত্ব নিতে পারে না। ভারতে মিসেস গান্ধী তাকে আশ্বস্ত করেছেন যে, যুক্তরাষ্ট্রের বিরুদ্ধে ভারতের কোনাে বিদ্বেষ নেই।
উল্লেখ্য, কেনেথ কিটিং ইন্দিরার সঙ্গে আলােচনায় যে তিক্ত অভিজ্ঞতার বিবরণ দিয়েছেন কোনালির অভিজ্ঞতা ছিল। ঠিক বিপরীত। ইন্দিরার আচরণে তিনি ছিলেন মুগ্ধ। ভুট্টো সম্পর্কে তিনি বলেন, প্রেসিডেন্ট ভুট্টো যুক্তরাষ্ট্র সম্পর্কে তার দৃষ্টিভঙ্গির পরিবর্তন ঘটিয়েছেন। কোনালি বলেন, পাকিস্তানি নেতৃত্বের গুণগত মান অত্যন্ত উঁচু। বাঙালিদের ওপর পাকিস্তানিদের নিপীড়নের কথা ভুট্টো অস্বীকার করেন। যুদ্ধাপরাধের বিচার প্রশ্নে ভুট্টো বলেন- এটা পাকিস্তানকে যুদ্ধে জড়াতে বাধ্য করবে। পাকিস্তান ভারতীয়দের অনুকম্পার জন্য বসে থাকবে না। ভুট্টোও একজন চৌকস রাজনীতিক এবং একজন চৌকস নেতা। (সূত্র : প্রেসিডেন্টের জন্য প্রস্তুত কিসিঞ্জারের স্মারক) ইন্দিরার সঙ্গে মুজিবের ৫ জুলাইয়ের বৈঠকে মুজিব ও বাংলাদেশ প্রসঙ্গ এসেছে এভাবে- ‘আমি আপনাকে পূর্ণ আস্থার সঙ্গে মুজিবের সঙ্গে আমার কথােপকথনের বিবরণ দেব। আমি তাকে বললাম, মুজিব আমাকে স্পষ্ট করেই বলেছেন, বাংলাদেশকে পাকিস্তানের স্বীকৃতি না দেওয়া পর্যন্ত কোনাে ইস্যু নিয়েই কোনােরূপ সমঝােতা হতে পারে না এবং আমার বিচারে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ ইস্যু যা বাংলাদেশকে উদ্বিগ্ন রেখেছে তা হলাে পাকিস্তান থেকে বাঙালিদের প্রত্যাবর্তন। ইন্দিরা বললেন, তিনি মুজিবকে চাপ দেয়ার চেষ্টা করেননি। কারণ তিনি ভেবেছেন এতে সুফল মিলবে । বিভিন্ন দেশ থেকে প্রাপ্ত সহায়তার জন্য বাঙালিরা কৃতজ্ঞ। কিন্তু তিনি জানেন একটি নতুন জাতি হিসেবে তারা বহিঃস্থ কোনাে চাপ বা প্রভাব সম্পর্কে কতটা সংবেদনশীল হতে পারে। সহায়তাদান সত্ত্বেও ভারত কিন্তু বাংলাদেশকে প্রভাবিত করার অবস্থানে নেই। এই পর্যায়ে আমি তাকে শুধু পুনর্ব্যক্ত করলাম যে, আমি আপনার অনুভূতি ভালােভাবেই বুঝতে পেরেছি।
আমরা সাধারণত ধরে নিয়ে থাকি আমরা যেসব দেশকে সহায়তা দিই সেখানে আমরা প্রভাব খাটাতে পারি। কিন্তু বেশিরভাগ সময় তা হয় না। যখন আমরা অধিক সহায়তা দিই তখন আমাদের প্রভাব থাকে কম। বললাম, মুজিবের সঙ্গে আমার বৈঠকে আমি তার প্রচণ্ড আবেগ দেখে বিস্মিত হয়েছি। তিনি যুদ্ধাপরাধের বিবরণ দিচ্ছিলেন। তিনি (ইন্দিরা) একমত হলেন যে, এই বিষয়ে তিনি একজন ‘ইমােশনাল মানুষ’ (আমি কিন্তু বলিনি মুজিব একজন ইমােশনাল মানুষ শুধু বলেছি এই ইস্যুতে তিনি ইমােশনাল)। আমি তাকে প্রশ্ন করলাম, আপনি কি মনে করেন কথিত যুদ্ধাপরাধীদের বিচার প্রশ্নে মুজিব কি অঙ্গীকারবদ্ধ? তিনি জানালেন, গত কয়েক মাস ধরে বস্তুগতভাবে এ বিষয়ে তাদের অবস্থান কঠিনতর বলেই প্রতীয়মান হচ্ছে এবং বর্তমানে তাদের অবস্থান দাঁড়িয়েছে তারা বিষয়টি নিয়ে চাপ দেবে যাতে কিছু বিচার অনুষ্ঠিত হয়। ইন্দিরা গান্ধী অবশ্য এমন সুপারিশ দেয়া থেকে বিরত থাকেন যে, পাকিস্তানের প্রতি শুভেচ্ছার নিদর্শন হিসেবে তাদের অন্তত কিছু বেসামরিক বন্দিকে মুক্তি দেয়া উচিত। আমি বললাম, মুজিবের সঙ্গে আলােচনা করে আমারও একই ধারণা জন্মেছে। তিনি আমাকে ৩০০ থেকে ১ হাজার পাকিস্তানির বিচারের কথা বলেছিলেন (পাকিস্তান পরে যুক্তরাষ্ট্রকে বলেছে, যুদ্ধাপরাধের সংখ্যা প্রথমে বাংলাদেশ ১৫০০ দাবি করেছিল। এখন ১০০| তে নেমেছে। ভুট্টোও বলেছেন, তিনিও বিচার চান। ধর্ষকদের রক্ষা করতে চান না)।
কোনালি তার টেলিগ্রামে এ পর্যায়ে যে মন্তব্য করেন, তা থেকে ধারণা করা চলে যে, মুজিব পরিস্থিতির চাপে পাকিস্তানি যুদ্ধাপরাধীদের বিচারে ন্যূনতম হলেও একটা দৃঢ় অবস্থান নিয়েছিলেন, কিন্তু দৃশ্যত ইন্দিরা গান্ধী যে কোনাে বিচারেই হােক এই ইস্যুটিকে সামনের দিকে এগিয়ে নিতে চাননি। কোনালি বলেছেন, ‘আমি এখানে পুনশ্চ জোর দিয়ে বলছি যে, মিসেস গান্ধী আমাকে সর্বোত্তম বিশ্বাসের সঙ্গে বলেছেন যে, এসব বিষয়ে তিনি উদ্যোগ গ্রহণ করেছেন। কোনালি তার টেলিগ্রামে এ পর্যায়ে যে মন্তব্য করেন, তা থেকে ধারণা করা চলে যে, মুজিব পরিস্থিতির চাপে পাকিস্তানি যুদ্ধাপরাধীদের বিচারে ন্যূনতম হলেও একটা দৃঢ় অবস্থান নিয়েছিলেন; কিন্তু দৃশ্যত ইন্দিরা গান্ধী যে কোনাে বিচারেই হােক এই ইস্যুকে সামনের দিকে এগিয়ে নিতে চাননি। কোনালি বলেছেন, “আমি এখানে পুনশ্চ জোর দিয়ে বলছি যে, মিসেস গান্ধী আমাকে সর্বোত্তম বিশ্বাসের সঙ্গে বলেছেন, এসব বিষয়ে তিনি উদ্যোগ গ্রহণ করেছেন। আমার মনে হয়েছে, এসব তথ্যের গােপনীয়তার ব্যাপারে তিনি উদ্বিগ্ন। এ বিষয়ে বাংলাদেশের ভেটো থাকার কারণেই তিনি তা ভুট্টোর সঙ্গে আলেচনা উত্থাপন থেকে বিরত থাকেন। কোনালির কথায়, প্রেসিডেন্ট ভুট্টোর সঙ্গে সিমলা চুক্তির ফলাফলে আমি তাকে পুনরায় ধন্যবাদ জানালাম। বললাম, আমরা আসলে বন্ধুত্ব ও শুভেচ্ছা ছাড়া বাংলাদেশ, ভারত কিংবা পাকিস্তানের কাছে কিছুই চাই না। শেখ মুজিবুর চাইছেন যুক্তরাষ্ট্র যেন জাতিসংঘে সদস্যপদ লাভে উদ্যোগ গ্রহণ করে। পররাষ্ট্রমন্ত্রী সামাদ আজাদও তা-ই বললেন। বাংলাদেশের জাতিসংঘে প্রবেশে আমাদের সক্রিয় সমর্থন দেওয়ার কোনাে কারণ নেই।
কিন্তু বাংলাদেশের বিষয় নিয়ে কোনাে উদ্যোগ নিতে আমরা প্রতিশ্রুতি দেইনি। আমরা শিথিল মনােভাব নিয়েছি এই বিবেচনায় যে আমরা এখন কোনাে উদ্যোগ নিতে গেলে তা ভুল বােঝাবুঝি সৃষ্টি করবে। | ৬ জুলাই রাওয়ালপিন্ডিতে সিমলা সম্মেলন সম্পর্কে ভুট্টো কোনালিকে বলেন, ‘পাকিস্তান ও বাংলাদেশের মধ্যে যে সমস্যা তা নিরসনে ভারতের মধ্যস্থতা করার কোনাে অভিপ্রায় প্রকাশ পায়নি। পাকিস্তান ভারতীয়দের জানে। পাকিস্তান তাদের সঙ্গে বাস করেছে। যুদ্ধবন্দিদের ফেরত অথবা যুদ্ধাপরাধের বিচার প্রসঙ্গে ভারতের তরফে কোনাে আগ্রহ দেখলাম না। বরং বাংলাদেশ ও বন্দিদের ইস্যু তারা কাশ্মীর সমস্যা সমাধানে ব্যবহার করতে সচেষ্ট হয়েছে। ভারত বলেছে, তারা যদি সীমান্ত বিরােধে নিস্পত্তি ঘটাতে সক্ষম হয়, তাহলে যুদ্ধবন্দিদের ফেরত প্রশ্নে মুজিবরের ওপর তারা তাদের প্রভাব খাটাতে পারে। ভুট্টো আরাে বলেন, তিনি এক মিনিটের জন্যও নিজেকে মিথ্যা আশ্বাসে ভােলাতে চাননি। ভারতীয়রা প্রতিটি অজুহাতকে তারা তাদের স্বার্থসিদ্ধির জন্য চেষ্টা করেছে। তারা তাদের সমাধান চেয়েছে। পাকিস্তানকে বিকিয়ে। ভারতীয়রা নিজেদের উপরে উপরে মহান নেতার ভাব দেখায়। কিন্তু তারা নিজেদের জাতিসহ কোনাে কিছুতেই নেতৃত্ব দিতে অপারগ। তাদের সামর্থ্য কিংবা নেতৃত্বের গুণাবলির ঘাটতি রয়েছে। ভুট্টো বলেন, আমি ভারতীয়দের এ কথা বলেছি। পররাষ্ট্রমন্ত্রী সিং আমার কাছে জানতে চাইলেন, তিনি এ দ্বারা কী বুঝিয়েছেন। জবাবে আমি বললাম, নেতৃত্ব মানে ভূগােল ও মানুষের সংখ্যার চেয়ে অনেক বেশি কিছু। এর সঙ্গে সম্পৃক্ত চরিত্র, পটভূমি, কাজ, জলবায়ু এবং সম্পদ। এরকম অনেক কিছুর মিশেলেই গড়ে ওঠে নেতৃত্ব।
তিনি বলেন, ‘ভারত কিন্তু কখনােই পাকিস্তানের জন্য নেতৃত্ব সরবরাহ করেনি। বিপরীতক্রমে ভারতের জন্য নেতৃত্ব কিন্তু সবসময়ই এসেছে আজকের পাকিস্তান কিংবা কাশ্মীর থেকে। আজকের ভারত থেকে কিন্তু কখনােই নয়। আমি বললাম, আপনি নাকি যুদ্ধ শেষের পরে দুটো সডিভিশন প্রতিষ্ঠা করেছেন। তিনি স্বীকার করলেন। বললেন, ভারত এক জাতির বিরুদ্ধে অন্যকে খেলার চেষ্টা করেছে। তারা ভেবেছে, চীনের সঙ্গে তারা মৈত্রীর বন্ধন গড়ে তুলতে পারবে। কিন্তু আমি আজ বলছি, এতে দীর্ঘ সময় লাগবে। এমনটা ঘটার আগে বহু বছর কেটে যাবে। কারণ পাকিস্তানিদের মতােই ভারতীয়দের চেনা আছে চীনাদের। ভারতীয়রা রাশিয়ার সঙ্গে বন্ধুত্ব কিংবা জোটবদ্ধ ততদিন থাকবে যতদিন তাদের প্রয়ােজন পড়ে। তারা বাংলাদেশে রুশ প্রভাব ঢােকাতে চাইছে। ভুট্টো বলেন, আমেরিকানরা দরকারি সময়ের মুহূর্তে খুবই বিচক্ষণ। চীনারা প্রায়শ সময়ের ও প্রজ্ঞার ওপর নির্ভরশীল এবং যখন তারা দেখে শিগগিরই কোনাে সমস্যা মিটে যাবে না, তখন তারা এমন অবস্থান নেয় যে, এখন না হােক ১০০ বছর পরে তাে তাদের স্বার্থেই হবে। আর রাশানরা এক্ষুণি চায় শেষ রক্তের ফোটা। বাংলাদেশ ও ভারত উভয়ে একদিন এই বাস্তবতার মুখােমুখি হবে যে, ভালুকের নখর থেকে মুক্তি পাওয়া কতই না কঠিন। ভুট্টো বলেন, প্রেসিডেন্ট কেনেডির মৃত্যুর এক মাস আগে তিনি তাকে বলেছিলেন, তিনি যদি তার চীনা-ভীতি। কাটিয়ে উঠতে পারেন তাহলে চীনাদের সঙ্গে তার একটি বৈঠক ফলপ্রসূ হতে পারে। ভুট্টোর কথায়- চীনারা সবসময়ই দারুণ বুদ্ধিদীপ্ত এবং কথা ও আচরণে বিনয়ী । সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ হচ্ছে তারা সর্বদা তাদের অঙ্গীকার তা মৌখিক ও লিখিত যা-ই হােক না কেন তারা মর্যাদা রক্ষা করে। তারা যদি প্রতিশ্রুতি না দিতে চায় তাহলে তারা পুরাে বিষয়টি এড়িয়ে যায়। কিন্তু একবার যদি তারা প্রতিশ্রুতি দেয় তাহলে সন্দেহাতীতভাবে তারা তা রক্ষা করবেই। ভুট্টো বলেন, ‘দক্ষিণ-পূর্ব, দক্ষিণ এশিয়ায় এবং ভারত মহাসাগরে যুক্তরাষ্ট্রের জোরালাে উপস্থিতি অপরিহার্য। আমি অবশ্যই শক্তিশালী সামরিক অর্থে অথবা পেশিশক্তি প্রদর্শনের জন্য নয়, আমি মনে করি, এখানে যেসব শক্তি সক্রিয় রয়েছে সেক্ষেত্রে একটি ভারসাম্য রক্ষার জন্য যুক্তরাষ্ট্রের বিকল্প নেই।

সূত্র:  ১৯৭১ আমেরিকার গোপন দলিল – মিজানুর রহমান খান – সময় প্রকাশন