মুজিববিহীন কনফেডারেশনের স্বপ্নও দেখেছিলেন ভুট্টো?
বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধ শুরুর পরেও পাকিস্তান যুক্তরাষ্ট্রের সমর্থনে একটি কনফেডারেশন গঠনের চেষ্টা চালিয়েছে। খন্দকার মুশতাক আহমেদ প্রমুখ এর সঙ্গে জড়িত ছিলেন। কিন্তু আমেরিকার সদ্যপ্রকাশিত দলিল এই সত্যকে সামনে এনেছে যে, কনফেডারেশনের চিন্তা ১৬ ডিসেম্বরের পরেও সক্রিয় ছিল। আর সবচেয়ে নাটকীয় হচ্ছে এই ইঙ্গিত যে, ভুট্টো ভেবেছিলেন মুজিব বাংলাদেশে ফিরে গিয়ে রাজনীতিতে দ্রুত ফুরিয়ে যাবেন। তাহলে কি তিনি স্বপ্ন দেখেছিলেন, মুজিবকে ছাড়াই এমন কিছু একটা করা সম্ভব হবে?
বাংলাদেশের অভ্যুদয়ের মুহূর্তে যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে আলােচনায় ভুট্টো কিন্তু একটুও আক্ষেপ করেননি। বরং ১৮ ডিসেম্বরে ওয়াশিংটনে যুক্তরাষ্ট্রের কাছে গভীর কৃতজ্ঞতা জানিয়েছেন। স্পষ্টতই এটা ছিল পশ্চিম পাকিস্তানকে রক্ষায় যুক্তরাষ্ট্রের ভূমিকার স্বীকৃতি। কিসিঞ্জারও এ সময় নিক্সনকে পূর্ব পাকিস্তানে যুদ্ধ বন্ধের খবর দিয়ে বলেন, মি. প্রেসিডেন্ট অভিনন্দন, আপনি পশ্চিম পাকিস্তানকে রক্ষা করতে পেরেছেন।
বাংলাদেশের বিজয় লাভের দুদিন পর অর্থাৎ ১৮ ডিসেম্বর ১৯৭১ ভুট্টো পাকিস্ত নের ডেসিগনেটেড উপ-প্রধানমন্ত্রী হিসেবে সাক্ষাৎ করেন মার্কিন পররাষ্ট্রমন্ত্রীর সঙ্গে। ভুট্টোর সঙ্গে ছিলেন পাকিস্তানি রাষ্ট্রদূত রাজা। ভুট্টো বললেন, ২৫ মার্চের ঘটনা যদিও অবশ্যম্ভাবী ছিল। কিন্তু এর পরে পাকিস্তান সেনাবাহিনী যা করেছে তা সমর্থনযােগ্য নয়। তবে ২৫ মার্চের পরেও একটা রাজনৈতিক সমঝােতা সম্ভব ছিল। এখনাে আমি মনে করি ঢিলেঢালা হলেও একটা কনফেডারেশন বাস্তবায়নের চেষ্টা তিনি করবেন। তিনি বলেন, যদিও তাকে মাঝে মধ্যে ইয়াংকি বিরােধী সাবেক পররাষ্ট্রমন্ত্রী হিসেবে চিহ্নিত করা হয়। কিন্তু তিনি পাকিস্তান ও যুক্তরাষ্ট্রের সম্পর্কের ইতিহাসে একটি নতুন অধ্যায়ের সূচনা ঘটাতে চান। তার কথায়পাকিস্তানের প্রতিরক্ষায় যুক্তরাষ্ট্র যেভাবে আন্তর্জাতিক আইন ও সভ্য সমাজের মৌলিক নীতি অনুসরণ করেছে পাকিস্তান তাতে মুগ্ধ। ভুট্টো এ মর্মে উদ্বেগ প্রকাশ করেন যে, সােভিয়েতরা চেয়েছিল পাকিস্তানের বিনিময়ে কিউবার বিপরীত রূপ দিতে। ভুট্টো অবশ্য এ সময় ভারতের সঙ্গে সম্পর্ক উন্নত করতে অঙ্গীকার ব্যক্ত করেন। বলেন, এখন যা দরকার তা হলাে দ্রুত পূর্ব পাকিস্তান থেকে ভারতীয় সৈন্যদের চলে যাওয়া নিশ্চিত করা। আর সে ক্ষেত্রে অত্যন্ত দুর্বল এক কনফেডারেশনের মাধ্যমে হলেও পাকিস্তানের ঐক্য ধরে রাখা সম্ভব। তিনি বলেন, আমি দুটো বিষয় স্পষ্ট করতে চাই। প্রথমত, দক্ষিণ এশীয় সংকটে আন্তর্জাতিক আইনে গােটা দৃশ্যপট সােভিয়েত আচরণ দ্বারা বিপর্যস্ত হয়েছে। দ্বিতীয়ত, ভুট্টো ভারতের সঙ্গে রিকন্সিলিয়েশনের জন্য প্রস্তুত। ভুট্টো উল্লেখ করেন যে, আমরা শুনেছি- ভারতীয় যুদ্ধ জাহাজে সােভিয়েতরা এমনকি তাদের সৈন্য দিয়েও সহায়তা দিয়েছে। ওই জাহাজগুলাে ছিল সর্বাধুনিক মিসাইল সজ্জিত। ভুট্টো বলেন, আমি জানি এটা কতটুকু ঠিক। তবে এটা সত্য যে, পাকিস্তান এর আগে ভারতের সঙ্গে যুদ্ধ করেছে। কিন্তু সােভিয়েতের সঙ্গে কখনাে নয়। এবারে সােভিয়েতরা আমাদের পরাজিত করেছে এবং কিউবায় তাদের পরাজয়ের মাসুল নিয়েছে পাকিস্তানের মূল্যে। তাদের উদ্দেশ্য ছিল চীনকে এটা দেখানাে যে, তারা নয়, তৃতীয় বিশ্বের নেতা হচ্ছে সােভিয়েত ইউনিয়ন। দ্বিতীয় মৌলিক দিক হচ্ছে, ভারতের সঙ্গে সম্পর্কের উন্নয়নে পাকিস্তানি জনগণের প্রস্তুতি। ভারতের সামনে এখন সুযােগ এসেছে পাকিস্তানের সঙ্গে সম্পর্কোন্নয়ন। অথবা সব সময়ের জন্য বিরােধিতা বজায় রাখা। ভারত যদি বর্তমানের সুযােগ হাতছাড়া করে তাহলে অনাগত ভবিষ্যতের জন্য ঘৃণা, বিশৃঙ্খলা ও ভয়ানক হত্যাযজ্ঞ বহাল থাকবে। এই ঘৃণা বাংলার মুসলমানদের যেমন তেমনি গােটা উপমহাদেশেই তরঙ্গায়িত হবে। ভারতের অবশ্য উচিত হবে দুদেশের মধ্যে একটা সম্মানজনক আপােসরফায় পৌছাতে বিচক্ষণতা প্রদর্শন করা। এটা বর্তমানের শূন্যতার মধ্যে হবে না। এজন্য সময় লাগবে। ভুট্টো বলেন, ইয়াহিয়া আমাকে দেশে যেতে বলেছেন আর সেজন্য আগামীকাল রােমে তার জন্য বিশেষ বিমান প্রস্তুত থাকবে। আমার দেশের মাটি কিভাবে তাকিয়ে আছে তা প্রত্যক্ষ করতে আমি উদগ্রীব।’ তিনি প্রেসিডেন্টকে বলবেন, হয় রাজনৈতিক ক্ষমতা হস্তান্তর এখনই হােক না হলে তাকে সমস্যা মােকাবেলায় কঠিন পরিস্থিতির মুখােমুখি হতে হবে। আর এটা সম্ভব না হলে তাকে ফিরে যেতে দেয়া হােক, সিন্ধে তার ছােট্ট র্যাঞ্চে। তিনি দেশে ফিরে নৌকার গতি ফেরাতে অথবা কারাে কর্তৃত্ব চ্যালেঞ্জ করতে চান না। (এদিনের আলােচনার বিবরণ জানিয়ে পররাষ্ট্রমন্ত্রী রজার্স বিভিন্ন দূতাবাসে যে টেলিগ্রাম পাঠিয়েছিলেন, তাতে এই পর্যায়ে একটি টীকা রয়েছে। এতে বলা হয়েছে, ভুট্টোর এই মন্তব্যে এক ধরনের স্ববিরােধিতা রয়েছে। কারণ অন্যত্র তিনি বলেছেন তিনি। আশা করেন যে, পাকিস্তানের জনগণ পশ্চিম পাকিস্তানের ক্ষমতা হস্তান্তরের জন্য নিশ্চয় আরেকটি যুদ্ধ প্রত্যক্ষ করবে না।) ভুট্টো বলেন, মার্চ থেকে ঘটে যাওয়া অনেক বিয়ােগান্তক অধ্যায় এড়ানাে যেত, যদি না ক্ষমতা হস্তান্তরে মাত্রাতিরিক্ত বিলম্ব না ঘটানাে হতাে। ২৫ মার্চের সামরিক অভিযান ছিল অনিবার্য। কিন্তু তার পরের ঘটনাবলি অমার্জনীয় এবং ক্ষমতা হস্তান্তরের মাধ্যমেই তা এড়ানাে যেত। সরকার যদি জনগণকে তার সঙ্গে না নিতে চায় তাহলে সরকারের সবাই পরিণত হবে পিগমিতে এবং পাকিস্তান এক কঠিন অবস্থা থেকে আরেক অবস্থার মুখােমুখি হবে।
ভুট্টো বলেন, ভারতীয় এবং অন্যদের এখন যা বুঝতে হবে তা হলাে, সব কিছু গুছিয়ে জনমত প্রস্তুত করতে তার এক মাস অথবা তার চেয়ে বেশি কিছু সময় দরকার হবে। তিনি বুঝতে পারছেন যুদ্ধ-বিরতি চুক্তি নিয়ে পশ্চিম পাকিস্তানে ইতােমধ্যেই বিক্ষোভ শুরু হয়েছে। পাকিস্তানের কাছে ভারতের যদি কিছু চাওয়ার থাকে তাহলে তাকে তা কূটনৈতিক চ্যানেলে বলতে হবে। তার কাছে মানবিকতাই কাম্য। কিন্তু দুঃখজনক হচ্ছে ভারতীয়দের ভীষণ সংকট রয়েছে এবং সে কারণেই ভারতের সাড়ায় তিনি আস্থাশীল থাকতে পারছেন না। ভুট্টো বলেন, যুক্তরাষ্ট্রকে তার অবশ্যই বলা উচিত, দয়া করে তথাকথিত বাংলাদেশকে দ্রুত সমর্থন দেবেন না। তিনি বেশ বুঝতে পারছেন যে, পাকিস্তানের দুই অংশেই এখনাে পাকিস্তানপন্থি ভাবাবেগ তীব্র। ভারত যেভাবে পূর্ব পাকিস্তানে সামরিক শক্তি প্রয়ােগের মাধ্যমে তার লক্ষ্য অর্জন করেছে তা থেকে বিষয়টি পরিষ্কার। স্বীকৃতির বিষয়টি নিয়ে অপেক্ষা করাই সঙ্গত। কারণ এ ধরনের পদক্ষেপ নিতে হলে আন্তর্জাতিক আইন অনুযায়ী কিছু পূর্বশর্ত পূরণ করতে হবে। পাকিস্তান আশা করে, যুক্তরাষ্ট্র সরকার এ ব্যাপারে সিদ্ধান্ত নিতে পাকিস্তানের সঙ্গে ঘনিষ্ঠ যােগাযােগ রাখবে। মার্কিন পররাষ্ট্রমন্ত্রী এ পর্যায়ে ভারতের বিচক্ষণতার কথাটির ওপর গুরুত্ব দেন এবং বলেন যে, ভারতীয়রা জনসম্মুখে বেশ একটা বিচক্ষণতার বহিঃপ্রকাশ ঘটিয়ে থাকেন। কিন্তু ঘরােয়াভাবে কার্যসাধন করেন একেবারেই ভিন্নভাবে। ভুট্টো এ কথার সঙ্গে একমত হন এবং বলেন যে, এ কারণেই এটা গুরুত্বপূর্ণ যে, যুক্তরাষ্ট্র বর্তমানে যে রাজনৈতিক উদ্যোগ নিয়েছে তার যেন হাল ছেড়ে দেয়।
ভারতের কাছে যুক্তরাষ্ট্রের এটা স্পষ্ট করা উচিত যে, পাকিস্তানের সঙ্গে তার চুক্তিগত সম্পর্ক রয়েছে এবং সে এখনই তার কার্পেট গুছিয়ে স্থান ত্যাগ করছে না। ভারতকে এটাও স্পষ্ট করে বলা উচিত যে, দক্ষিণ এশিয়ায় কৌশলগত ভারসাম্যের পুনর্জীবনে পাকিস্তানকে ব্যাপক অর্থনৈতিক ও সামরিক সহায়তা দিতে যাচ্ছে। যুক্তরাষ্ট্রের তরফে ভারতকে এটাও জানিয়ে দেয়া উচিত যে, যুক্তরাষ্ট্রের বিশ্ব জুড়েই উল্লেখযােগ্য স্বার্থ রয়েছে। আর তা দক্ষিণ এশিয়ায় সােভিয়েত ইউনিয়নের সাম্প্রতিক তৎপরতায় যথেষ্ট ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে এবং যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে দীর্ঘমেয়াদি স্থায়ী নিস্পত্তি চাইতে হলে ভারতকে এটা মনে রাখতে হবে। যুক্তরাষ্ট্রের কাছ থেকে তার এটাও শ্রবণ করা উচিত যে, তারা পূর্ব পাকিস্তানে এক রকম আর কাশ্মিরে অন্যরকম কিছু করতে পারে না। ভারতীয়রা পূর্ব পাকিস্তানি শক্তি প্রয়ােগ করেছে। এখন প্রশ্ন হলাে, কাশ্মিরে কী হবে? এসবই এই মুহূর্তের জরুরি বিষয়, যা যুক্তরাষ্ট্রের উচিত হবে ভারতকে সাফ জানিয়ে দেয়া। কিন্তু বাস্তবে পাকিস্তানকে কতটা সামরিক এবং অর্থনৈতিক সাহায্য দেয়া সম্ভব হবে তা এখন গুরুত্বপূর্ণ নয় (যুক্তরাষ্ট্রের জনমত সম্পর্কে তিনি সচেতন)। যুক্তরাষ্ট্র ও পাকিস্তান সরকার এসব বিষয় নিয়ে পরে। আলােচনা করতে পারবে। কিন্তু এ মুহূর্তের জরুরি করণীয় হলাে ভারতের মনে এই উপলব্ধি পষ্ট করা যে, যুক্তরাষ্ট্র এখন এরকমই ভাবছে। এ সময় মার্কিন পররাষ্ট্রমন্ত্রী মন্তব্য করেন যে, ভারতকে এটাও বুঝতে হবে যে, শক্তি প্রয়ােগ করে এভাবে এক প্রতিবেশীর বিচ্ছিন্নতা নিশ্চিত করার নীতি ভয়ঙ্কর এবং তা ব্যাপকভিত্তিক প্রভাব রয়েছে। ভুট্টো এতে সায় দিয়ে বলেন, সত্যি এটা এক ভয়ঙ্কর প্যান্ডােরার বাক্স।
মার্কিন পররাষ্ট্রমন্ত্রী বলেন, তিনি আশা করেন যে, ভুট্টো এটা বুঝতে পেরেছেন। যে, বাংলাদেশে মানবিক সাহায্য নিশ্চিত করতে যুক্তরাষ্ট্র সরকার জনমতের এক বিরাট চাপের মুখে থাকবে। ভুট্টো বলেন, তিনি তা বুঝতে পারেন কিন্তু তিনি এই আশাটুকু করেন যে, এটা এমনভাবে করা হবে যা কোনােভাবেই যেন স্বীকৃতির জন্য তাৎপর্যপূর্ণ বলে প্রতীয়মান না হয় এবং তা যেন পূর্ব পাকিস্তানের ভবিষ্যৎ নির্ধারণে পাকিস্তানের পরিকল্পনাকে জটিল না করে। এ পর্যায়ে মার্কিন পররাষ্ট্রমন্ত্রী পূর্ব-পশ্চিম সম্পর্কের ব্যাপারে প্রশ্ন করেন। ভুট্টো বলেন, পাকিস্তান নতুন একটা ব্যবস্থা গড়ে তুলতে আগ্রহী এবং সেজন্য তার প্রস্তুতি রয়েছে। এটা গুরুত্বপূর্ণ যে, এটা পাকিস্তানের জনগণকেই করতে হবে এবং সেজন্য ভারতীয় সৈন্যদের প্রত্যাহার নিশ্চিত করতে হবে। ভুট্টো বলেন, মুজিব গুরুত্বপূর্ণ ছিলেন, কিন্তু দৃশ্যপটে তার পুনর্সম্পৃক্ততার জন্য জনমত গঠনের প্রয়ােজন রয়েছে সর্বাগ্রে এবং তিনি মনে করেন যে, যে কোনাে পরিস্থিতি হােক না কেন, মুজিব রাজনৈতিক ব্যক্তিত্ব হিসেবে কোনােক্রমেই তিন মাসের বেশি প্রভাবশালী হিসেবে গণ্য হবেন না। তার কথায়, মুজিব ভালাে বক্তা ছিলেন, কিন্তু তার মাথায় কিছুই নেই। তিনি মার্চে যা চেয়েছিলেন সব কিছুই পেতে পারতেন। একমাত্র ইতিহাস একদিন বলতে পারবে যে, কে ছিল সত্যিকারের দোষী (রিয়াল কালপ্রিট) মুজিব, ইয়াহিয়া না আমি। ভুট্টোকে এ সময় প্রশ্ন করা হয়, আচ্ছা বলুন তাে, মুজিবের পরে আওয়ামী লীগের নেতৃত্বের শীর্ষে কে আসতে পারে? ভুট্টো তা এড়িয়ে যান। শুধু বলেন, আরাে অনেকে আছেন। কিন্তু তাদের কারাে ভিশন নেই। দুর্ভাগ্যবশত পূর্ব পাকিস্তান ১৩ বছর ধরে সামরিক শাসনের আওতায় রাজনৈতিক দুর্ভোগ সহ্য করেছে এবং কেবল সােহরাওয়ার্দী ছাড়া অন্য কেউ নাম ভূমিকায় আসতে পারেননি। ভুট্টো বলেন, সােভিয়েতরা এখন সন্দেহাতীতভাবে বাংলাদেশের নেতৃত্বের পুরােভাগে তাদের নিজেদের লােক আনতে চাইবে। মার্কিন পররাষ্ট্রমন্ত্রী বলেন, আচ্ছা তবে বলুন পূর্ব পাকিস্তানে যুক্তরাষ্ট্রের ভূমিকা এখন কী হওয়া উচিত। জবাবে ভুট্টো বলেন, মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র নিশ্চয় সাত কোটি মানুষের সঙ্গে অবন্ধুসুলভ আচরণ করতে পারে না।
ভারত তাদের সাহায্য কমিয়ে আনতে পারে। সে কারণে যুক্তরাষ্ট্র সরকারের ওপর তারা দারুণভাবে নির্ভরশীল থাকবে। তারাই শুধু দিতে পারে আশা। মার্কিন পররাষ্ট্রমন্ত্রী এ সময়। সুনির্দিষ্টভাবে জানতে চান কনফেডারেশনের রূপটি কী হবে? ভুট্টো বলেন, একটি দুর্বল ভিত্তির কনফেডারেশন অতীতেই দুই অংশের মধ্যে হওয়া সম্ভব ছিল। তবে এখন তিনি নিশ্চিত করে বলতে পারেন না, এটা এখন কতটা সম্ভব? কিন্তু এটাই গুরুত্বপূর্ণ যে, এ ধরনের একটা ব্যবস্থা ধরে রাখতে পাকিস্তানের জনগণ উদগ্রীব। ভুট্টো বলেন, মিসেস গান্ধী এখন ভয়ঙ্কর পরিস্থিতির মুখােমুখি। তিনি উপমহাদেশের উপরে বাংলাদেশকে স্থাপন করে দিয়েছেন (অন্যত্র তিনি বিচ্ছিন্নতাবাদের জীবাণু শব্দটি ব্যবহার করেন। তার কথায়, যদি পূর্ব ও পশ্চিম পাকিস্তানের মধ্যে আগের ভারসাম্য বজায় না থাকে তাহলে গােটা পাকিস্তানেই তা ছড়িয়ে পড়তে পারে)। তিনি বলেন, মিসেস গান্ধী ‘সােভিয়েত মদ নিয়ে শয্যাগ্রহণের জন্য একদিন অনুশােচনা করবেন। সােভিয়েতদের মধ্যে মানবিক গুণাবলির বিন্দুমাত্র নেই।
আলােচনা শেষ পর্যায়ে ভুট্টো বলেন, তারা আসলেই ভূগােলের ক্রীতদাস’ এবং সে কারণেই তিনি তার পররাষ্ট্রনীতিতে ভারসাম্য বজায় রাখবেন। সাম্প্রতিক অতীতের ঘটনাবলি প্রমাণ করে যে, এই ভারসাম্য বজায় রাখাটা কতটা গুরুত্বপূর্ণ। যদি কোনাে ভারসাম্য না থাকত, চীনকে পালন করতে হতাে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা। আর সে ক্ষেত্রে পাকিস্তানকে সামরিক সহায়তা দিতে যুক্তরাষ্ট্রকে ‘ভয়ানক দায় বহন করতে হতাে। মার্কিন পররাষ্ট্রমন্ত্রী তার বক্তব্যের উপসংহারে বলেন, আমরা বুঝতে পারি পাকিস্তানি নেতৃত্বের জন্য চ্যালেঞ্জপূর্ণ দিন অপেক্ষা করছে। তিনি আশ্বাস দেন যে, বাংলাদেশেকে যুক্তরাষ্ট্র মানবিক সহায়তা দিয়ে যাবে। কিন্তু পাকিস্তানকে না জানিয়ে, কিংবা তাদের কোনাে উদ্যোগে জটিলতা সৃষ্টি করে তারা কিছু করবেন না। মার্কিন রাজনীতিবিদ উইলিয়াম পিয়ার্স রজার্স ১৯৬৯ থেকে ১৯৭৩ পর্যন্ত নিক্সনের মন্ত্রিসভায় ছিলেন। ২০০১ সালের ২ জানুয়ারি তিনি মৃত্যুবরণ করেন।
সূত্র: ১৯৭১ আমেরিকার গোপন দলিল – মিজানুর রহমান খান – সময় প্রকাশন