You dont have javascript enabled! Please enable it!
শয়তান চীনারাও চায় বাংলাদেশের স্বাধীনতা – ইয়াহিয়া
‘শয়তান চীনারাও স্বপ্ন দেখে পূর্ব পাকিস্তান স্বাধীন হােক। তাহলে আসাম, পশ্চিমবঙ্গ ও স্বাধীন বাংলাদেশ মিলে গােটা এলাকাই তার বলয়ে চলে যাবে। ভাসানীর দলের মনেও একই আশা। তাছাড়া বাংলাদেশ স্বাধীন হলে চীন বঙ্গোপসাগরে একটি বন্দর এবং ভারত মহাসাগরে প্রবেশের পথ পেয়ে যাবে।’ বিস্ময়করভাবে, ১৯৭১ সালের ২ জানুয়ারি জেনারেল ইয়াহিয়া ঠিক এই ভাষাতেই ভয় দেখিয়েছিলেন আমেরিকাকে। ইসলামাবাদে নিযুক্ত মার্কিন রাষ্ট্রদূত যােসেফ ফারল্যান্ড ২ জানুয়ারি ওয়াশিংটনে পররাষ্ট্রমন্ত্রীর কাছে যে টেলিগ্রামটি প্রেরণ করেন তার শিরােনাম ছিল- পূর্ব-পশ্চিম পাকিস্তানের সম্ভাব্য ভাঙন- চীনের ভূমিকা’। টেলিগ্রামটির তরজমা অবিকল তুলে ধরা হলাে। 
“১. প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়ার সঙ্গে আমার দীর্ঘ আলােচনায় তিনি পাকিস্তানের দুই অংশের সম্ভাব্য ভেঙে যাওয়া সম্পর্কে দারুণ উদ্বেগ প্রকাশ করেন। তিনি বলেন, বর্তমানে সংবিধান প্রণয়নের যে প্রক্রিয়া চলছে সেক্ষেত্রে তার জন্য এটাই হলাে সবচেয়ে ঝামেলার বিষয়। রাজনৈতিক প্রক্রিয়াকে এটা একটা বিরাট নেতিবাচক দিকে নিয়ে যেতে পারে। তার কথায় সংবিধান কিরূপ হবে সে ব্যাপারে তিনি তার মত চাপিয়ে দিতে চাননি। কারণ এটা এমনই এক প্রক্রিয়া যা পাকিস্তানকে প্রায় বিলুপ্তির দিকে নিয়ে যেতে পারে। অথচ একটি অখণ্ড পাকিস্তানই জাতীয় লক্ষ্য এবং তিনি তাই আশা করেন। আইয়ুব খানের উক্তির প্রতিধ্বনি তুলে তিনি বলেন, পাকিস্তান ভাঙনের যজ্ঞে তিনি পৌরােহিত্য করতে চান না।
২. তার সঙ্গে অনুষ্ঠিত আমার প্রথম বৈঠকের কথা আমি তাকে স্মরণ করিয়ে দেই। বললাম, পাকিস্তানের ঐক্য ও সংহতির প্রতি শ্রদ্ধাশীল থাকাই মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের নীতি এবং আমি প্রত্যেক সময়ে এ কথা প্রকাশ্যে পুনর্ব্যক্ত করেছি। তারপরেও এর বিপরীতে একটি বিরুদ্ধ অপপ্রচার রয়েছে। এর সঙ্গে তারাই জড়িত যাদের সঙ্গে যুক্তরাষ্ট্রের স্বার্থ সংশ্লিষ্ট বিরােধ রয়েছে। যুক্তরাষ্ট্র তলে তলে পাকিস্তানের দুই অংশের বিভক্তি নিশ্চিত করতে চেষ্টা চালাচ্ছে বলে রটনাকারীদের দাবি বানােয়াট ও ভিত্তিহীন। এটা এমনকি যারা রাজনীতি ও সামরিক বিষয়াদির প্রাথমিক পাঠও জানেন তারাও বুঝবেন যে এটা কতটা অসার। আসলে দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ায় যুক্তরাষ্ট্র। আরেকটি অনুন্নত দেশের উত্থান দেখতে চাওয়ার বিষয়টি কতই না উদ্ভট। কিন্তু তা সত্ত্বেও যুক্তরাষ্ট্রের এ ধরনের একটি কথিত অবস্থানের কথা প্রেসে এবং দুর্ভাগ্যবশত উচ্চ রাজনৈতিক গুরুত্ব রয়েছে এমন বহু স্থানেও তা পাত্তা পাচ্ছে।
৩. ইয়াহিয়া বলেন, পাকিস্তান সরকার এ ধরনের খবরাখবরে যে মুহূর্তে কিছুটা উদ্বেগ অনুভব করছে তখন এ বিষয়ে মার্কিন সরকারের পুনঃআশ্বস্ত করার বিষয়টি জানতে পেরে তিনি বড়ই স্বস্তিবােধ করছেন। তিনি বলেন, পাকিস্তানের দুই অংশকে ঐক্যবদ্ধ রাখতে তার পক্ষে সম্ভব সবকিছুই তিনি করে যেতে সংকল্পবদ্ধ। কারণ অন্যথায়, তার কথায় তখন বিভক্ত পশ্চিম পাকিস্তান, ভারত এবং সাধারণভাবে গােটা দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার ভয়ঙ্কর বিপদ আরাে বেশি প্রকট হয়ে উঠবে। 
৪. আমার অনুরােধের জবাবে তিনি কী ধরনের ভয়ঙ্কর বিপদ আশঙ্কা করছেন তা ব্যাখ্যা করেন। ইয়াহিয়া বলেন, উল্লেখযােগ্য বিপদ তাদের কাছেই মনে হবে, যারা মানচিত্র অথবা সামরিক কৌশল অথবা চীনা নেতৃবৃন্দের আকাক্সক্ষা সম্পর্কে যাদের সামান্যও ধারণা রয়েছে। তাদের অনুধাবন করা উচিত যে, সামরিকভাবে অনিরাপদ, স্বাধীন এবং ভৌগােলিকভাবে বিচ্ছিন্ন পূর্ব পাকিস্তান সর্বোচ্চ অগ্রাধিকারের সঙ্গে একটি টার্গেটে পরিণত হবে। স্বাধীন পূর্ব পাকিস্তান হবে একটি নিউক্লিয়াসের সূচনা। ইয়াহিয়া মত দেন, অনুমান করা চলে যে, সেক্ষেত্রে রাজনৈতিক অবস্থাটি হবে এমনই সহজতর যে, চীন পূর্ব পাকিস্তানের এবং তার সন্নিহিত বিশেষ করে পশ্চিমবঙ্গ ও আসাম পর্যন্ত তার প্রভাব বলয় বিস্তার করবে। এমনকি এখন ভাসানীর অনুসারীরা এ ধরনের সুযােগ সৃষ্টি দেখতেই উদগ্রীব।
৫, ইয়াহিয়া এ সময় তার মন্তব্য উচ্চকিত করতে বলেন, ‘শয়তান চীনারা বহু বছর ধরে চেয়ে আসছে যে, বঙ্গোপসাগরের বুকে একটি বন্দর এবং ভারত মহাসাগরে একটি প্রবেশদ্বার’। ইয়াহিয়া তখন আরাে বলেন, বাংলাদেশ স্বাধীনতা পেলে চীন দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার বিস্তৃত ভূখণ্ডে অবাধে ডানা মেলবে। সেক্ষেত্রে বার্মা (মিয়ানমার) ‘বেশি পেকে যাওয়া আমের মতােই টুপ করে তার ঝুড়িতে ঝরে পড়বে। থাইল্যান্ডেরও হবে একই দশা। ইয়াহিয়া তার বক্তব্যের উপসংহারে বলেন, ‘আপনারা যদি ভেবে থাকেন ভিয়েতনামে আপনাদের সত্যিই বিজয় নেমে এসেছে তাহলে ভেবে | দেখুন তাে এ সমস্ত এলাকা যদি চীনের কর্তৃত্বে চলে যায় তখন কী হবে?’
৬, আমি ইয়াহিয়াকে পাকিস্তানের সম্ভাব্য ভাঙন থেকে উদ্ভূত পরিস্থিতি সম্পর্কে খােলাখুলি মত প্রকাশের জন্য ধন্যবাদ জানাই। আমি নিজেও মত দিলাম একটি ‘স্বাধীন’ নতুন জাতি চীনের পক্ষেই যাবে। যদিও আমি এ কথা উল্লেখ করি যে, পিকিংয়ে কি ঘটতে চলেছে সে সম্পর্কে নির্দিষ্টভাবে আমার কোনাে ধারণা নেই।”
লক্ষণীয় যে, ১৯৭০ সালের নির্বাচনের আগে তৈরি সিআইএ’র ২৪ পৃষ্ঠার একটি দলিলে ভারত মহাসাগরে প্রবেশ নিয়ে চীনা আগ্রহের বিষয়টি নির্দিষ্টভাবে উল্লিখিত হয়। এতে বলা হয়েছে, ভারত চীনের প্রতি ভীত ও বৈরী থাকবে। চীনের পারমাণবিক সমার্থ, ভারতের দাবিকৃত ভূখণ্ড দখলে রাখা এবং সর্বোপরি পাকিস্তানের সঙ্গে তার সম্ভাব্য আঁতাত নয়াদিল্লিকে ভীষণভাবে উদ্বিগ্ন রাখবে। বর্তমান পাকিস্তানি শাসকরা মনে করছেন, চীন ভবিষ্যতে ভারতীয় হুমকির বিরুদ্ধে রাজনৈতিক সমর্থন ও অস্ত্রের মূল্যবান উৎস। ভারত ও পাকিস্তান ক্রমবর্ধমান হারে সােভিয়েত রাশিয়ার সঙ্গে ভালাে সম্পর্ক তৈরি করছে। সােভিয়েত ইউনিয়ন উপমহাদেশে যে স্বার্থ রক্ষা করতে চাইছে তা কিন্তু তেমন আদর্শিক নয়। সিআইএ’র কথায়, ‘আমরা বিশ্বাস করি দক্ষিণের প্রতিবেশীদের সঙ্গে সােভিয়েতের সম্পর্ক ভালাে রাখার ইচ্ছা, চীনকে। সামলানাের উদ্বেগ এবং ভারত মহাসাগরে নৌ-উপস্থিতির ক্রমপ্রসারের তাগিদ থেকেই তারা এটা চাইছে। পঞ্চাশের দশক থেকে সােভিয়েতরা ভারতকে বিরাট অর্থনৈতিক সহায়তা দিতে শুরু করে। ষাটের দশকের গােড়ায় তারা মনােযােগ দেয়। সামরিক সরবরাহে। গত দুই অথবা তিন বছর ধরে পাকিস্তানের ওপর চীনা প্রভাব। হ্রাস করতে এবং একই সঙ্গে সােভিয়েতের প্রভাব বৃদ্ধি করতে বেশ তােড়জোড় চালিয়েছে। অন্তত ১৯৬৫ সাল থেকে পাক-ভারতের উত্তেজনা প্রশমনে মস্কো সক্রিয় ছিল। তাদের মনে ছিল একটাই উদ্দেশ্য, পিকিং (বেইজিং) যাতে পরিস্থিতির সুযােগ না নিতে পারে। মস্কো এক্ষেত্রে কিছুটা সাফল্যের মুখ দেখেছে। ভারত চীনের বিরুদ্ধে প্রতিরক্ষা ব্যুহ তৈরি করেছে রাশিয়ার সঙ্গে। এ সম্পর্ক এক বিশেষ মাত্রা পেয়েছে। একই সঙ্গে নয়াদিল্লি সব সময় তার স্বাধীনতা ও বাধাহীন কার্যক্রমে স্বকীয়তা দেখিয়েছে। সে কারণেই ভারত মহাসাগরে সােভিয়েতসহ যে কোনাে ‘বিদেশী’ শক্তির উপস্থিতির বিরােধিতা করেছে। যাতে কেউ ঘাটি না করতে পারে সে ব্যাপারেও তার সংবেদনশীলতা সে স্পষ্ট করেছে।
১৯৬৯ সালে নিক্সনের পাকিস্তান সফরকালে প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়ার উপদেষ্টারা কিসিঞ্জারের নেতৃত্বাধীন মার্কিন প্রতিনিধিদলের সঙ্গে এক বৈঠকে মিলিত হন। ১ আগস্ট বেলা আড়াইটা থেকে সাড়ে চারটা পর্যন্ত অনুষ্ঠিত বৈঠকের শেষ পনের মিনিটে নিক্সন ও কিসিঞ্জার যােগ দেন। পাকিস্তানের পক্ষে ছিলেন পররাষ্ট্র সচিব এসএম ইউসুফ, প্রেসিডেন্টের পিএসও ছিলেন মেজর জেনারেল পীরজাদা, জি ডব্লিউ চৌধুরী ও যুক্তরাষ্ট্রে নিযুক্ত পাকিস্তানি রাষ্ট্রদূত আগা হিলারি কিসিঞ্জারের প্রশ্নের জবাবে পররাষ্ট্র সচিব ইউসুফ বলেন, একটি বৃহৎ শক্তি হিসেবে চীন সম্ভবত উত্তেজনা বৃদ্ধির কারণ হবে না। আমরা চীনকে খুব ভালাে প্রতিবেশী হিসেবে দেখছি। আমাদের অভিজ্ঞতা হতে পারে অনন্য দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার মতাে কোনাে চীনা সংখ্যালঘু নেই। পাকিস্তান ধ্বংসে চীনের কোনাে উদ্যোগ নেই। আমরা মনে করি আমাদের সহাবস্থান সম্ভব। চীন পাকিস্তানকে এই মর্মে আশ্বস্ত করেছে যে, তারা অখণ্ড পাকিস্তান দেখতে চায়। ভারতকে মােকাবেলার দিক থেকে পাকিস্তানে চীনের স্বার্থ শক্তিশালী। চীন অর্থনৈতিক ও সামরিক সাহায্যের দিক থেকে ভালাে বন্ধু। তারা কখনাে বলেনি পাকিস্তানের শুধু চীন থেকে সাহায্য নেয়া উচিত। পাকিস্তান বেশি প্রতিশ্রুতিতে বিশ্বাস করে না। কারণ, টিকে থাকার প্রশ্নটি নির্ভর করে ব্যাপকভিত্তিক সম্পর্কে। সােভিয়েত ইউনিয়নের দিকেও আমাদের কিছু নীতি রয়েছে। আমাদের আশঙ্কা সীমান্ত উত্তেজনা চীন ও রাশিয়ার মধ্যে যুদ্ধের কারণ হতে পারে। চীনের যুক্তি সােভিয়েতরা সিজারীয় বিজয়ের ফায়দা বজায় রাখতে চায়। আমরা বিশ্বাস করি শক্তিশালী চায়না উত্তেজনা বাড়ানাের কারণ হবে না।
নিক্সনঃ ১৯৫৩ সাল থেকে পরিস্থিতি বিশেষ করে সেন্টো ও সিয়াটোর কার্যকারিতা কতটা বদলে গেছে। আমাদের অঙ্গীকার অটুট, কিন্তু হুমকি আজ ভিন্ন চেহারায় রূপ নিয়েছে। 
ইয়াহিয়াঃ আমরা আমাদের আলােচনা নিয়ে বিশ্বময় ঘুরে বেড়িয়েছি। বিশ্বের এই অংশের অনেক জাতিকেই সম্পর্কের নতুন মাত্রা খুঁজতে হচ্ছে। আমি সবাইকে দুঃখের সঙ্গে একটি কথা বলেছি, দক্ষিণ এশিয়ার দুই প্রধান শক্তি একসঙ্গে কাজ করতে পারে না। আমরা ভুলে যাইনি যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে আমাদের ঘনিষ্ঠ সম্পর্কের কথা। আমরা বুঝতে পারি, কেন আজ আমরা সবচেয়ে ঘনিষ্ঠ মিত্রদের কাতারে নেই । কিন্তু আমরা আজো মিত্র।
নিক্সনঃ আমি এটা বেশ ভালােই বুঝতে পারছি যে, এই শতাব্দীর তৃতীয়ভাগে বিশ্বের এই অংশ প্রত্যক্ষ করতে পারে বিরাট প্রবৃদ্ধি অথবা ধ্বংস। এটা ধরে নিয়েই আমাদের কর্মপন্থা নির্ধারণ করতে হবে। আমি এই অঞ্চলকে এই শতাব্দীর যে কোনাে প্রেসিডেন্টের চেয়ে ভালাে জানি।

সূত্র:  ১৯৭১ আমেরিকার গোপন দলিল – মিজানুর রহমান খান – সময় প্রকাশন

error: Alert: Due to Copyright Issues the Content is protected !!