You dont have javascript enabled! Please enable it! সামরিক চুক্তি ও একটি ঝগড়ার কাহিনী - সংগ্রামের নোটবুক
সামরিক চুক্তি ও একটি ঝগড়ার কাহিনী
১৯৭১ সালের ১৫ ডিসেম্বর বিজয়ের লগ্নে ভারত সরকার রাশিয়ার কাছে এ প্রস্তাব দিয়েছিল যে, বাংলাদেশকে স্বীকৃতি প্রদান করে মস্কো যেন ঢাকার সঙ্গে একটি সামরিক চুক্তি স্বাক্ষর করে। ভারত সােভিয়েত ইউনিয়নের সঙ্গে নিরাপত্তা ও প্রতিরক্ষা সহযােগিতা-সংক্রান্ত মৈত্রী চুক্তি সই করেছিল ১৯৭১ সালের আগস্টে। বিভিন্ন মার্কিন গােপন দলিল থেকে একটি বিষয় প্রতীয়মান হয় যে, সােভিয়েত ইউনিয়নের সঙ্গে ভারতের ঐ চুক্তির নেপথ্যে নিক্সন-কিসিঞ্জারের গােপন চুক্তির দোহাই হয়তাে অনুঘটক হিসেবে কাজ করেছে। কারণ সােভিয়েত নেতা ব্রেজনেভের কাছে নিক্সন ও কিসিঞ্জার ক্রমাগতভাবে এই বার্তা পৌছে দিচ্ছিলেন যে, কেনেডির সঙ্গে পাকিস্তানের একটি গােপন চুক্তি থাকার কারণেই তাদের পাকিস্তানের পাশে দাঁড়াতে হচ্ছে। মজার ব্যাপার হলাে, কথিত ঐ চুক্তি যে যুক্তরাষ্ট্রের জন্য কোনাে বাধ্যবাধকতা সৃষ্টি করে না, তা নিক্সন ও কিসিঞ্জার ভালাে করেই জানতেন। কিন্তু তারা তাদের স্বীকৃত ‘সাজানাে যুদ্ধের মহড়া সম্পন্ন করতে ঐ চুক্তিকেই ঢাল হিসেবে ব্যবহার করেন। এই প্রশ্নে কিসিঞ্জারের সঙ্গে মার্কিন পররাষ্ট্রমন্ত্রী রজার্সের মধ্যে মৃদু ঝগড়ার ঘটনাও ঘটে। ১৫ ডিসেম্বর, ১৯৭১ সিআইএর একটি ৪ পৃষ্ঠার নথি। এর কয়েকটি অংশ মােটা কালিতে লেপটে দেওয়া হয়েছে। এই অংশ হয়তাে আর কখনাে আলাের মুখ দেখবে না। এতে বলা হয়েছে, ১২ ডিসেম্বর দিল্লি সফরে এসেছেন সােভিয়েত ইউনিয়নের ফাস্ট ডেপুটি ফরেন। মিনিস্টার ভজিলি কুজনেৎসােভ। তার সফরের লক্ষ্য বাংলাদেশের রাজনৈতিক স্বীকৃতি নিয়ে আলােচনা করা। ভারতীয় সরকারি কর্মকর্তারা বলেছেন, ভারত সােভিয়েতের কাছ থেকে বাংলাদেশের রাজনৈতিক স্বীকৃতি আশা করে এবং তার অব্যবহিত পরই নতুন সরকারের সঙ্গে মস্কোর একটি ডিফেন্স ট্রিটি দেখতে চায়। সােভিয়েত মন্ত্রী ভারতীয় কর্মকর্তাদের বলেছেন, পাকিস্তানি সেনাবাহিনীর কাছ থেকে সাফল্যের সঙ্গে ভারতীয় সেনাবাহিনীর স্বাধীনতা নিশ্চিত করা অর্থাৎ ঢাকার পতন না ঘটা পর্যন্ত তারা স্বীকৃতি দিতে প্রস্তুত নন। সােভিয়েত মন্ত্রীর কথায়, পাকিস্তানের প্রতি তাদের যতটুকু প্রভাব এখনাে অবশিষ্ট রয়েছে তা তারা ধরে রাখতে চাইলে তারা এই শর্ত পূরণ না। হলে বাংলাদেশকে স্বীকৃতি দিতে অপারগ।
এই দলিলটি সিআইএর, কিন্তু এর উৎস মুছে ফেলা হয়েছে। শুধু এটুকু রাখা। হয়েছে তার তথ্য বিশ্বাসযােগ্য ও যথার্থ’ । দলিলটির ভাষ্য থেকে এটা স্পষ্ট যে, সােভিয়েত ইউনিয়ন বাংলাদেশকে স্বাধীন হিসেবে দেখতে ভারতীয় সশস্ত্র বাহিনীকে ১০ দিনের সময় বেঁধে দিয়েছিল। দলিলে বলা হয়, ভারতীয় কর্মকর্তাদের মতে ভারতীয় সশস্ত্র বাহিনীর অক্ষমতায় সােভিয়েত ইউনিয়ন অধৈর্য হয়ে পড়েছে। কারণ। তারা আক্রমণ শুরু হওয়ার আগেই বাংলাদেশকে স্বাধীন করতে ১০ দিনের সময় ঠিক করে দিয়েছিল। কুজনেটসভ ভারতীয়দের বলেছেন, পূর্ব পাকিস্তানে যুদ্ধ প্রলম্বিত হওয়ার কারণে জাতিসংঘ নিরাপত্তা পরিষদে যুদ্ধবিরতি প্রস্তাবের বিরােধিতা করা সােভিয়েত ইউনিয়নের জন্য অধিকতর অসম্ভব ব্যাপারে পরিণত হয়েছে। তিনি বলেন যে, যুদ্ধবিরতির প্রস্তাবের বিপক্ষে তারা তাদের ভেটো ক্ষমতা প্রয়ােগ করেই যাবে, কিন্তু সম্ভাব্য স্বল্প সময়ের মধ্যে ভারতীয় সেনাবাহিনীকে বাংলাদেশের স্বাধীনতা প্রশ্নে কার্যকর ভূমিকা রাখতে হবে। দলিলের তৃতীয় অনুচ্ছেদে বলা হয়, কুজনেটসভ তার নির্ধারিত মস্কো প্রত্যাবর্তনের তারিখ পিছিয়ে দিয়েছেন। কারণ তিনি সােভিয়েত কমিউনিস্ট পার্টির জেনারেল সেক্রেটারি লিওনাদ ব্রেজনেভের বিশেষ নির্দেশের অপেক্ষায় রয়েছেন। এই বিশেষ নির্দেশনা ভারতের অনুরােধ-সংক্রান্ত। ভারত অনুরােধ করেছে যে, সােভিয়েত স্বীকৃতির পর সােভিয়েত ইউনিয়ন স্বাধীন। বাংলাদেশের সঙ্গে একটি সামরিক চুক্তি করবে।
কুজনেটসভ জানিয়েছেন, এ ব্যাপারে দিকনির্দেশনা চেয়ে তিনি যখন বার্তা পাঠান ব্রেজনেভ তখন মস্কোতে ছিলেন না। কুজনেটসভ ভারতীয় নেতৃবৃন্দের সঙ্গে চীনা হস্তক্ষেপের হুমকি নিয়েও আলােচনা করেন। ভারতীয় সরকারি কর্মকর্তারা বলেন, ভারতীয় কর্মকর্তা ও কুজনেটসভ উভয়ে। একমত যে, চীনারা সিকিম দিয়ে আক্রমণ রচনার সিদ্ধান্ত নিতে পারে। তাদের অনুমান, শিলিগুড়ি এলাকায় ভারতের ব্যাপক আক্রমণাত্মক অবস্থান লক্ষ্য করে তারা। তাদের অভিযান চালিয়ে সীমিত লক্ষ্য অর্জন শেষে আবার নিজেদের প্রত্যাহার করে। নেবে। ভারত সরকারকে ব্ৰিত করতে যেমনটা তারা ১৯৬২ সালে করেছিল।’
উল্লেখ্য, সােভিয়েত ইউনিয়নের সঙ্গে বাংলাদেশের সামরিক চুক্তি সম্পাদনের ভারতীয় প্রস্তাবের কথা জানা গেল এই প্রথম। বাংলাদেশের সঙ্গে ভারতের সামরিক সহযােগিতা রক্ষাকবচ সংবলিত বহুল আলােচিত মৈত্রী চুক্তি সম্পন্ন হয় ১৯৭২ সালের ১৯ মার্চ প্রধানমন্ত্রী ইন্দিরা গান্ধীর ঢাকা সফরের সময়। এই চুক্তি সই হয় প্রায় অবিকল সােভিয়েত ও ভারতের মধ্যে সম্পাদিত মৈত্রী চুক্তির মতােই।
২৩ ডিসেম্বর, ১৯৭১
রাত ৮টা, টেলিফোনে কথােপকথন প্রেসিডেন্ট নিক্সনের সহকারী কিসিঞ্জার এবং পররাষ্ট্রমন্ত্রী রজার্স কিসিঞ্জার আমি এইমাত্র আপনার সংবাদ সম্মেলনের বৃত্তান্ত পড়লাম। আপনার জানা উচিত যে, প্রেসিডেন্ট মাটসকেভিচকে বলেছিলেন পাকিস্তানের প্রতি আমাদের একটি অঙ্গীকার রয়েছে। সুতরাং পশ্চিম পাকিস্তানের ওপর যদি কোনাে হামলা হয়, তাহলে সংঘাত বাধবে। আমি ভরনস্তবকে পরদিনই তা দেখিয়েছি। আমি এলেক্স জনসনকেও বলেছিলাম।… | রজার্স প্রেসিডেন্ট কি বলেছেন- একটা অঙ্গীকার ছিল।
কিসিঞ্জার উদ্ধৃতিটি ছিল এরকম, পশ্চিম পাকিস্তানের ওপর যদি কোনাে হামলা হয়, তাহলে একটি সংঘাত সৃষ্টি হবে। তিনি কেনেডির এইড মেমােয়ার (কূটনৈতিক স্মারক) দেখিয়েছেন, পাকিস্তানের বিরুদ্ধে ভারতের আগ্রাসনের ক্ষেত্রে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র পাকিস্তানের পাশে দাঁড়াবে।  রজার্স এটা সামরিক দিক নিশ্চিত করে না। আমি মনে করি না, এখানে কোনাে সমস্যা আছে। কেনেডির এইড মেমােয়ার ভারত কর্তৃক পাকিস্তান আক্রান্ত হলে যুক্তরাষ্ট্রকে যুদ্ধে যাওয়ার কোনাে বাধ্যবাধকতা আরােপ করেনি। সুতরাং আমাদের সে রকমভাবে কিছু বলা উচিত নয়, অন্যদিকে পাকিস্তানের সঙ্গে আমাদের আলােচনায়। এই ইঙ্গিতই মিলেছে- আমরা যেভাবেই চাই, সেভাবে তাদের সহায়তা দেব। আপনি নিশ্চয়ই এটা বলতে পারেন না, কেনেডির এইড মেমােয়ার যুক্তরাষ্ট্রকে যুদ্ধে যাওয়ার অঙ্গীকার করেছে। আপনি সংবিধানকে পাশ কাটাতে পারেন না… কিসিঞ্জার আমি সংবিধান পাশ কাটাতে চাইছি না। আমি একটা ন্যূনতম গ্রহণযােগ্যতা রক্ষা করার চেষ্টা করছি। কিন্তু এমন খুঁতখুঁতে অবস্থার আলােকে সেটা। তাে প্রায় অসম্ভব।
রজার্স ওহ কাম অন । এখানে কোনাে তুচ্ছ-তাচ্ছিল্যের বিষয় নেই। আমি শুধু বলতে চেয়েছি, যুদ্ধে যাওয়ার প্রশ্নে আমাদের কোনাে চুক্তিগত অঙ্গীকার (ট্রিটি কমিটমেন্ট) নেই। এমনকি পাকিস্তানের ওপর যদি কোনাে আক্রমণ আসে, তাহলেও নয়। আমাদের কোনাে আইনগত বাধ্যবাধকতা নেই। এরকম আমরা যদি কিছু সুপারিশ করি তাহলে তা বিপর্যয় ডেকে আনবে। আমাদের এমন কোনাে চুক্তি নেই। যাতে সামরিক ব্যবস্থা নিতে আমাদের প্রতিশ্রুতি সৃষ্টি হয়।
কিসিঞ্জার সেটা কোনাে বিষয় নয়। ঐ ডকুমেন্ট ব্যবহার করা হয়েছে আমাদের কিছু পদক্ষেপের যৌক্তিকতা দিতে।
রজার্স কোন ডকুমেন্ট? কিসিঞ্জার এইড মেমােয়ার। রজার্স কেউ কিন্তু এটা বলেনি কোনাে ডকুমেন্ট নেই। কিসিঞ্জার কিন্তু এটা বলা হয়েছে, ১৯৬৫ সালে ওসব ধুয়ে-মুছে গেছে।…
রজার্স (কিছুটা অংশ কালি দিয়ে লেপটে দেওয়া হয়েছে) আমি আসলে ওসব মূল্যহীন জিনিসের কোনাে খবরই জানি না। আমি এ মর্মে সন্তুষ্ট যে, যুদ্ধে যেতে যুক্তরাষ্ট্রের কোনাে আইনি বাধ্যবাধকতা নেই। যদি প্রেসিডেন্ট জনসাধারণের উদ্দেশ্যে
বলে থাকেন এটা আমাদের সংঘাতে জড়াতে পারে তাহলে ভালাে কথা। আমি মনে করি না, আমি এমন কিছু বলেছি যা স্ববিরােধী।
কিসিঞ্জার আমরা বলেছিলাম… রজার্স শুনুন, আমরা যদি চাই তাহলে সব সময়ই যুদ্ধে যেতে পারি। কিসিঞ্জার এটা তাে কোনাে কথা হলাে না।
রজার্স আমি এমন কিছুই বলিনি যা প্রেসিডেন্টকে কোনােভাবে ক্ষুন্ন বা খাটো করে। কিসিঞ্জার কিন্তু এই ডকুমেন্ট প্রেসিডেন্টের কিছু পদক্ষেপের যথার্থতা দিতে ভিত্তি হিসেবে ব্যবহার করা হয়েছে। তিনি তা ব্যবহার করেছেন এবং তিনি অনেককে এটা দেখাতে বলেছেন, যাতে এটা পরিষ্কার হয় যে, তিনি একটা গুরুত্ব দিয়েছেন।
রজার্স সেটা ঠিক। তবে আমি এমন কিছু বলিনি যা প্রেসিডেন্টের অবস্থানকে বিচ্যুত করে। আমি বলতে চেয়েছিলাম কোনাে সামরিক আক্রমণের সময় পাকিস্তানের প্রতিরক্ষার জন্য আমাদের কোনাে অঙ্গীকার সৃষ্টি হয় কি না। এর জবাব হলাে না। এটা আমরা করতে পারি, আমাদের “ডিসক্রিশান’ বা মর্জিমাফিক হিসেবে। আমরা নিশ্চয়ই আমেরিকান জনগণকে বলতে চাই না, আমরা যুদ্ধে যেতে অঙ্গীকারবদ্ধ। দেখুন সকালের সংবাদপত্রে কী লেখা হয়। তখন না হয় এ নিয়ে আবার কথা বলা যাবে। কিসিঞ্জার : আমি সংবাদপত্র নিয়ে উদ্বিগ্ন নই।

সূত্র:  ১৯৭১ আমেরিকার গোপন দলিল – মিজানুর রহমান খান – সময় প্রকাশন