নিক্সন ও কিসিঞ্জারের ‘সাজানাে যুদ্ধের মহড়া
গােপন দলিল স্পষ্ট করছে যে মার্কিন কংগ্রেস ও স্টেট ডিপার্টমেন্টের ইচ্ছার বিপরীতে নিক্সন ও কিসিঞ্জার বাংলাদেশের বিরুদ্ধে দৃশ্যত যুদ্ধের যে প্রস্তুতি নিয়েছিলেন তা ছিল সাজাননা। শােনা যাক তাদের জবানীতেই
৮ ডিসেম্বর, ১৯৭১
বিকেল ৪টা ২০ মিনিট থেকে ৫টা ১ মিনিট। প্রেসিডেন্ট নিক্সন তার জাতীয় নিরাপত্তা বিষয়ক সহকারী কিসিঞ্জার ও এটর্নি জেনারেল মিশেলের কথােপকথন। কিসিঞ্জার : মি, প্রেসিডেন্ট। আপনি টেড কেনেডির (প্রেসিডেন্ট কেনেডির ছেলে, যিনি ‘৭১ এ বাংলাদেশের পক্ষ নিয়েছিলেন) বিরুদ্ধে একটা জিনিস ব্যবহার করতে পারেন। আমি জানি পাকিস্তানের সঙ্গে কেনেডি একটি গােপন চুক্তি করেছিলেন। স্টেট ডিপার্টমেন্ট তা অবশ্য নাকচ করেছে।
নিক্সন : আইয়ুব আমাকে বলেছিলেন এমন একটি চুক্তি আছে। কিসিঞ্জার আমিও তা জানতাম ।
নিক্সন : অবশ্য রাষ্ট্রদূত (সম্ভবত পাকিস্তানে নিযুক্ত মার্কিন রাষ্ট্রদূত) আমার কাছে তা অস্বীকার করেন। আমি বললাম, কথাটা আমাকে আইয়ুব বলেছে। রাষ্ট্রদূত | বললেন, না এমন কিছু নেই। আসলে সে এ বিষয়ে কিছুই জানত না।
কিসিঞ্জার (এখানে কথােপকথনের ৩ সেকেন্ড ডিক্লাসিফাই করা হয়নি) আমি বললাম, এটা অবশ্যই ব্যাক চ্যানেলে চলে গেছে। মি, প্রেসিডেন্ট শাহের কাছ থেকে আপনার জন্য একটি বার্তা পেয়েছি। তিনি সেখানে বলেছেন, তিনি গােলাবারুদ পাঠাতে পারেন এবং এখনই তা করতে রাজি আছেন। কিন্তু তিনি বিমান পাঠাতে অপারগ। এর প্রথম কারণ পাকিস্তানিরা এখন আর কোনােভাবেই প্লেন চালাতে পারে না। কারণনিক্সন তারা পড়তে পারে না।
কিসিঞ্জার সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ হচ্ছে সােভিয়েত ইউনিয়ন ও ভারত যে চুক্তি করেছে তা ইরানের অবস্থানকে নাজুক করেছে। তাই তিনি প্রস্তাব করেছেন, জর্ডান তাদের বিমান পাঠাবে পাকিস্তানে। কারণ পাকিস্তানিরা জর্ডানের বিমান চালাতে পারে। আর তখন তিনি তার বিমান পাঠাবেন জর্ডানে। সঙ্গে থাকবে ইরানীয়
পাইলটরা। এর ফলে পাকিস্তানে তারা (জর্ডান) ব্যস্ত থাকার সময় জর্ডানকে কাভার করা সম্ভব হবে। নিক্সন আমার অবশ্যই ভাবা উচিত। আমি ভাবতে পারি আমরা জর্ডানীয়দের বিষয়ে ইসরাইলের কাছ থেকে প্রতিশ্রুতি পেতে পারি। কিসিঞ্জার ওহ! কোনাে সমস্যা নেই। নিক্সন এই ইস্যুতে নিশ্চয়ই ইসরাইল আমাদের পক্ষে থাকবে। তারা কি থাকবে না? কিসিঞ্জার আগামীকাল শুক্রবার গােল্ডামায়ারের (ইসরাইলের প্রধানমন্ত্রী) সঙ্গে দেখা হবে। নিক্সন ভালাে কথা। যখন তার সঙ্গে কথা হবে, তুমি তাকে বলবে- দেখুন এটা একটা রাশান কূটকৌশল। তাহলেই তিনি বুঝবেন। কিসিঞ্জার তা তাে বুঝলাম মি, প্রেসিডেন্ট। এখন আমাদের বাজিটা কি হবে? ভারতীয় পরিকল্পনা তাে পরিষ্কার। তদের সৈন্যবাহিনী পূর্ব পাকিস্তান থেকে সরিয়ে নিচ্ছে পশ্চিমে। এরপর তারা পাকিস্তানের স্থল ও বিমানবাহিনী ধ্বংস করে দেবে। দখল করে নেবে কাশ্মীরের পাকিস্তানি অংশ। আর তখন শাহের কাছ থেকে আপনি আরেকটি বার্তা পাবেন। তাতে তিনি বলবেন, পশ্চিম পাকিস্তানের এই অংশটি ইরানের নিরাপত্তার জন্য ভয়ঙ্কর হুমকি। এটা যখন ঘটবে পশ্চিম পাকিস্তানের বিকেন্দ্রীভূত শক্তিগুলাে স্বাধীনতা পেতে চাইবে। বেলুচিস্তান ও উত্তর-পশ্চিম সীমান্ত প্রদেশ স্বাধীন হবে। পশ্চিম পাকিস্তান হবে আফগানিস্তানের মতােই বহু খণ্ডে বিভক্ত। (অস্পষ্ট ৫টি দেশ?] নিক্সন ইয়াহ, ইয়াহ, ইয়াহ।
কিসিঞ্জার পূর্ব পাকিস্তান হবে একটি ভুটান। এসবই অর্জিত হবে ভারতীয় সেনাবাহিনী এবং সােভিয়েত অস্ত্র ও সমর্থনে। সােভিয়েত ইউনিয়ন ও তার তাঁবেদার দেশের কারণে এভাবে বহু দেশ হুমকিগ্রস্ত হবে। আমি হেলমসের সঙ্গে আজ সকালে কথা বলেছি। আমি আমার এসব ধারণা তার সঙ্গে ঝালাই করে নিলাম, আমি কিন্তু একজন উপদেষ্টাও পেলাম না। তিনি মনে করেন, এসব ঘটনার ধ্বংসাত্মক প্রভাব পড়বে মধ্যপ্রাচ্যে। আরবরা ভাবতে বসবেন, ভারতীয়দের মতাে তারাও যদি সােভিয়েতের কাছ থেকে একই ধরনের (মৈত্রী চুক্তি) রক্ষাকবচ লাভ করে তাহলে তারাও অনুরূপ এক দফা কিংবা তার চেয়ে বেশিসংখ্যকবার চেষ্টায় অবতীর্ণ হবেন। চীনাদের ক্ষেত্রে আমার বর্তমান মূল্যায়ন হচ্ছে, তারা হয়তাে একটা পর্যায় পর্যন্ত বেপরােয়া থাকতে পারে। কিন্তু তারা যদি বুঝতে পারে যে, আমরা পাকিস্তানের বিভক্তি মেনে নিয়েছি তখন তারা বলবে, “আচ্ছা ঠিক আছে, আমরা যথাসাধ্য সুন্দরভাবেই খেলেছি। কিন্তু এখন আমরা বড় দুর্বল এবং তখন তারা আমাদের সঙ্গে কথা না বলেই ঘুরপথে তাদের তৈরি বৃত্ত ভেঙে বেরিয়ে আসবে। অথবা পুরাে পরিকল্পনাই। পরিত্যাগ করবে। সুতরাং আমি মনে করি এখন এক মস্ত ওয়াটার শেড তৈরি হয়েছে। মিসেস গান্ধী সফরে আসছেন। তার কোনাে বন্ধু নেই (অস্পষ্ট)। নিক্সন হ্যা, সেটা একটা ভুল। কিসিঞ্জার ভুলটা হলাে আমাদের বােঝা উচিত ছিল। তিনি (গান্ধী) কোনাে অজুহাত খুঁজছেন না। কারণ তিনি এগিয়ে যেতেই প্রস্তুত ছিলেন। দ্বিতীয়ত, রাশানদের সঙ্গে আমাদের আরাে কঠোর হওয়া উচিত ছিল। নিক্সন এখন আমরা কি করতে পারি? কিভাবে? কিসিঞ্জার আমাদের বলা উচিত গত রােববারে যেভাবে চূড়ান্তভাবে বলেছি। এটা ঘটতে দেওয়া হলে তা আমাদের সম্পর্কের একটা পরিবর্তন সূচিত করবে। সেক্ষেত্রে মধ্যপ্রাচ্যে কোনাে সমঝােতা হতে পারে না। আমরা খেলাটা কঠিন করে তুলব। তৃতীয়ত, ২২ নভেম্বরে তারা যখন তৎপরতা শুরু করল, তখন আপনি যেভাবে চেয়েছিলেন সেভাবে ছিন্ন করা উচিত ছিল। কিন্তু আমলাতন্ত্রকে আমরা রাজি করাতে পারিনি। আমরা প্রথম বা দ্বিতীয় দিনে অর্থনৈতিক সাহায্য এবং দশ দিন দেরি না করে সব ধরনের অস্ত্র সরবরাহ বন্ধ করে দিতে পারতাম।
মিশেল অস্পষ্ট। কিসিঞ্জার না আমরা রাশানদের স্পষ্ট করতে পারতাম না। নিক্সন আমি বিস্মিত! আমি বিস্মিত!
কিসিঞ্জার আমি শুধু এটুকুই বলব, আমলাতন্ত্র আমাদের কোথায় নিয়ে গেছে। আপনি আপনার প্রথম সফরকালে ইয়াহিয়াকে প্রতিশ্রুতি দিয়েছিলেন সেখানে কিছু অস্ত্র পাঠাতে।
নিক্সন হ্যা, দিয়েছি।
কিসিঞ্জার আমলাতন্ত্রের সেই প্রতিশ্রুতি পূরণে এক বছর লেগে গেছে। বাঙালিরা যখন আক্রমণ করল, তখন সেই অস্ত্র গন্তব্যে পৌছাতে শুরু করল।
নিক্সন আমি জানি।
কিসিঞ্জার আমরা দোষারােপ করছি না। আমরা তাে জানতাম না ‘৭১-এ যুদ্ধ। হতে যাচ্ছে। কিন্তু এটা ঠিক যে আপনার প্রতিশ্রুতি রক্ষা করতেই এক বছর কেটে গেল।
নিক্সন এখন ওসব কথা থাক। প্লেন কিভাবে পাঠানাে যায় তাই বলুন।
কিসিঞ্জার কিন্তু এই প্লেনের উদ্দেশ্য কি হবে? আমরা যেখানে নিজেরাই ঝামেলায়।
নিক্সন অস্পষ্ট। কিসিঞ্জার আমরা খেলাটা কঠিন করে তুলতে পারি। নিক্সন আমি একমত। কিসিঞ্জার যদি আমরা তা চাই । তাহলে চীনাদের কাছে একটা বার্তা পাঠাতে
পারি, তােমরা যদি সত্যই অগ্রসর হতে চাও তাহলে এখনই সময়।’ | নিক্সন ঠিক আছে। আমরা তা করব। মিশেল সীমান্তে সৈন্য সমাবেশ ঘটাতে তাদেরকে সবকিছু করতে হবে।
কিসিঞ্জার : কিন্তু রাশানদের ব্যাপারে আমি ভীত । কিন্তু আমি অবশ্য সতর্ক করে দিতে চাই যে, মি. প্রেসিডেন্ট, আমাদের ফাকি যদি ধরা পড়ে তাহলে কিন্তু আমরা বিপদে পড়ব।
নিক্সন কিভাবে? কিসিঞ্জার আমরা হারব। মিশেল আপনার কি ধারণা রাশানদের সঙ্গে আমরা হেরে যাব?
নিক্সন কি আমাদের করা উচিত হেনরি? একটা উপায় বের করাে, ঠাণ্ডা মাথায় ভেবেচিন্তে সিদ্ধান্ত নিতে হবে।
কিসিঞ্জার কিন্তু সিদ্ধান্ত নেয়ার জন্য আমাদের হাতে ৩৬ ঘণ্টা সময় আছে। নিক্সন আমি তা জানি কিন্তু আমি আর এ নিয়ে কোনাে বৈঠক করতে চাই না। কিসিঞ্জার তারা (স্টেট ডিপার্টমেন্ট) মনে করে এটা আমাদের যুদ্ধ নয়। নিক্সন এটা আমাদের যুদ্ধ নয়, এটা আসলে রাষ্ট্রের অবস্থান। কিসিঞ্জার ইয়াহ। মিশেল শাহ কি বলছেন?
নিক্সন না, ইয়াহিয়া আমাদের সাহায্য চেয়েছেন। ইয়াহিয়া চীনকে বিভ্রান্ত করতে চান না। হেনরি আমাদেরকে এখানে বিকল্প খুঁজে বের করতে হবে। আমরা যদি এখন কিছু না করি তাহলে তােমার আশঙ্কা এটা দক্ষিণ এশিয়ায় প্রভাব ফেলবে। আমরা যদি কিছু করি তাহলে চীন কিছু করার কথা ভাববে। তারা ভারত অথবা রাশিয়া বা উভয়ের বিরুদ্ধে অগ্রসর হবে এবং তখন একই রূপ পদক্ষেপ নিতে রাশানদের উৎসাহিত করবে। এটা হলাে বিপদের একদিক।
কিসিঞ্জার আর মধ্যপ্রাচ্যে? ইরান ও ইন্দোনেশিয়ার মতাে দেশগুলাের মধ্যে প্রভাব ফেলবে। তারা হয় সােভিয়েত অথবা তার কোনাে তাবেদার রাষ্ট্রের কাছ থেকে। হুমকির সম্মুখীন হবে। ইরান যদি এমন অবস্থার মুখে পড়ে তখন তারা ভাবতে পারে আমরা ঠিক সহজে নড়ার পাত্র নই।
সম্ভাব্য দৃশ্যটা আমি এভাবে দেখি। চীন যদি এই মুহূর্তে সিদ্ধান্ত নেয়, তাহলে চীনাদের সঙ্গে মিলে আমরা পরিস্থিতির উন্নতি ঘটাতে পারি ।
নিক্সন : কিভাবে? কিসিঞ্জার আমরা জাতির সঙ্গে কঠিনভাবে খেলব। নিক্সন তুমি কি ভাবে জাতিসংঘ উপযুক্ত স্থান? | কিসিঞ্জার না, না। কিন্তু রাশান ও ভারতীয়রা ভাবতে পারে যে, আমরা যুদ্ধে জড়িয়ে পড়তে পারি।
নিক্সন তারা এটা ভাবতে পারে? কিসিঞ্জার আমার তাই মনে হয়। নিক্সন আমি ভাবছিলাম কি? চীনকে সাজ্ঞ কথাটা বলে দিতে । কথাটা হলােএটা হবে একটা ড্রেস রিহার্সাল এবং তারা যদি সীমান্তের দিকে কিছুটা অগ্রসর হয়, তাহলে তা ভারতকে সংযত করবে। আর সে ক্ষেত্রে চীনারা নিরাপদেই থাকবে । রাশানরা নিশ্চয় চীনাদের ডাম্প করতে যাচ্ছে না। অন্তত এখন নয়।
| কিসিঞ্জার মি, প্রেসিডেন্ট। আমার তাে মনে হয় রাশানরা বাণিজ্য সুবিধা, মধ্যপ্রাচ্যের সমঝােতা ও সঙ্কট নেগােশিয়েশন পরিত্যাগ করবেন। …আমি এ অনুমান করতে পারি যে, চীনারা তেমন কিছু করবে না। তবে তারা যদি একটুও অগ্রসর হয়, তাহলে পশ্চিম সীমান্তে বেশি সৈন্য সমাবেশ ঘটানাে থেকে ভারতকে তা বিরত রাখবে।
সূত্র: ১৯৭১ আমেরিকার গোপন দলিল – মিজানুর রহমান খান – সময় প্রকাশন