বাংলাদেশের জন্ম আমেরিকাই দেখেছে সর্বাগ্রে
বিস্ময়করভাবে আমেরিকার গােপন দলিল আরেক নতুন ধারণা হাজির করেছে। যুক্তরাষ্ট্রের ন্যাশনাল সিকিউরিটি কাউন্সিল বঙ্গবন্ধুর ৭ মার্চের ভাষণের আগে বাংলাদেশের জন্মই শুধু দেখেনি, নতুন রাষ্ট্রের সম্ভাব্য অভ্যুদয়ে সর্বাগ্রে স্বীকৃতি দান। ও শেখ মুজিবকে কি ভাষায় অভিনন্দন জানানাে হবে তারও খসড়া তারা চূড়ান্ত করেছিল। সতের পৃষ্ঠার এই ঐতিহাসিক স্মারকটি যুক্তরাষ্ট্রের তৎকালীন প্রতিরক্ষা উপমন্ত্রী ডেভিড প্যাকার্ড, পররাষ্ট্র দফতরের আন্ডার সেক্রেটারি জন এন, ইরােইন, জয়েন্ট চিফ অব স্টাফের চেয়ারম্যান এডমিরাল থমাস এইচ, মুরার, সিআইএ’র পরিচালক। রিচার্ড হেলমসের জন্য প্রস্তুত করা হয়। (হেলমস ১৯৬৬-৭৩ পর্বে সিআইএ-এর পরিচালক ছিলেন। ক্যান্সারে আক্রান্ত হয়ে ২০০২ সালে তিনি মারা যান। এডমিরাল মুরার ‘৭০-৭৪ পর্বে ঐ পদে ছিলেন। তিনি মারা যান ২০০৪ সালে।) ন্যাশনাল সিকিউরিটি কাউন্সিলের স্টাফ সেক্রেটারি জিয়ান ডেভিস স্বাক্ষরিত আলােচ্য দলিলটিতে বলা হয়েছে, এতে বর্ণিত কনটিনজেন্সি স্টাডি এনএসএসএম ১১৮ এর জন্য প্রস্তুত করা হয়েছে। ৩ মার্চ বিকেল তিনটায় অনুষ্ঠেয় সিনিয়র রিভিউ গ্রুপের জন্য তৈরি করা হয়েছে। এই দলিলটি ১৯৬৯ সালে সিআইএ প্রণীত মার্কিন অবস্থানকেই নিশ্চিত করে যে, যুক্তরাষ্ট্রের নীতি নির্ধারকরা ভেবেছিলেন দুটি রাষ্ট্র নয়, অবিভক্ত পাকিস্তানই দক্ষিণ এশিয়ায় যুক্তরাষ্ট্রের স্বার্থের রক্ষাকবচ। আর ভারতও তার জাতীয় স্বার্থেই পাকিস্তানকে অবিভক্তই দেখতে চাইবে। ৩ মার্চ, ১৯৭১। অর্থাৎ বঙ্গবন্ধুর ৭ মার্চের ভাষণের ৪ দিন আগে তৈরি এই রিপাের্টের শিরােনাম ছিল, ‘কনটিনজেন্সি স্টাডি অন পাকিস্তান পূর্ব পাকিস্তানের বিচ্ছিন্নতা’।
এর সূচনাতে বলা হয়, ‘৭০ এর নির্বাচনের মধ্য দিয়ে দুটি মেরুকরণ স্পষ্ট হয়ে উঠেছে। আওয়ামী লীগ ভারতের সঙ্গে রিকন্সিলিয়েশনের নীতি গ্রহণ করেছে। আর বামপন্থী পিপলস পার্টি ভারতের সঙ্গে অব্যাহতভাবে বিরােধিতা চালিয়ে যাবে বলেই সংকল্পবদ্ধ। এই অবস্থায়। মুজিব যেহেতু নিরঙ্কুশ বিজয় অর্জন করেছেন, তাই তার পক্ষে নমনীয় হওয়ার সম্ভাবনা কম। যদিও এখনও পর্যন্ত আওয়ামী লীগ নেতৃবৃন্দ বলছেন, বিচ্ছিন্নতার চেয়ে সর্বোচ্চ প্রাদেশিক স্বায়ত্তশাসন অর্জনের মধ্য দিয়েই ঐক্যবদ্ধ পাকিস্তানে থাকা সম্ভব। কিন্তু ভুট্টো ও তার অনুসারীরা সম্ভবত কৌশলগত কারণেই এই সিদ্ধান্তে পৌছতে পারেন যে, আওয়ামী লীগের কর্মসূচির ভিত্তিতে একটি দুর্বল ফেডারেল পদ্ধতি গ্রহণের চেয়ে পূর্ব পাকিস্তানকে বিচ্ছিন্ন হতে দেয়াই উত্তম। এটা মনে করার কারণ আছে যে, ইয়াহিয়া দুই বিবদমান পক্ষের মধ্যে একটি সমঝােতায় আন্তরিক এবং তিনি | আপােসের জন্যই এসেম্বলি স্থগিত করেছেন। পরিবর্তিত অবস্থায় মার্কিন স্বার্থ ও মার্কিন নীতির সীমাবদ্ধতা উল্লেখ করে বলা হয়, আমাদের অব্যাহত অবস্থান হচ্ছে দুই স্বাধীন রাষ্ট্রের অভ্যুদয়ের চেয়ে ঐক্যবদ্ধ পাকিস্তানই মার্কিন স্বার্থের জন্য সবচেয়ে অনুকূল। একটি স্বাধীন পূর্ব পাকিস্তান হবে অধিকতর নাজুক। তার অভ্যন্তরীণ অস্থিতিশীলতা, অর্থনৈতিক স্থবিরতা ও বহিঃস্থ নাশকতা পশ্চিম পাকিস্তানের চেয়ে তারই প্রকট হবে। চূড়ান্তভাবে আমরা অবশ্য এটা স্বীকার করছি যে, আমাদের সামনে বাস্তবসম্মত কোনাে বিকল্প নেই। ঘটনা প্রবাহের প্রতি আমাদের প্রভাবও খুবই সীমিত। হতে বাধ্য। পাকিস্তানের সঙ্গে আমরা যে বিশেষ সম্পর্ক রক্ষা করে আসছিলাম তা ষাটের দশকের শেষ পর্যায়ে একটা পরিণতি লাভ করেছে। বর্তমান পেক্ষাপটে আমরা সম্ভবত মুজিব ও তার অনুসারীদের সঙ্গে আমাদের যেটুকু সম্পর্ক রয়েছে তা দিয়ে পূর্ব পাকিস্তানের বিচ্ছিন্নতার একটা সম্ভাব্য সময়সীমা ও রূপরেখাকে প্রভাবিত করতে পারি।
অথবা তার প্রতি পশ্চিম পাকিস্তানিদের আগ্রহের বিষয়টিকেও আমরা যাচাই করতে পারি। কিন্তু এটা ঠিক যে পূর্ব পাকিস্তানিরা যদি সত্যই তাদের দেশ স্বাধীনের চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত গ্রহণ করে তাহলে আমরা তা প্রতিহত করতে পারি না। একইভাবে পশ্চিম পাকিস্তানের রাজনীতি বিশেষ করে ভুট্টো ও তার অনুসারীরা যদি বিচ্ছিন্নতার পথই কবুল করে নেয় তাহলেও আমরা তাদের ফেরাতে অক্ষম। দলিলে বলা হয়, আমাদের এই যােগ্যতা থাকতে হবে যে, আমাদের স্বার্থ যাতে গুরুতরভাবে বিপন্ন না হয় তা বিবেচনায় রেখে দুই স্বাধীন দেশের সঙ্গেই সন্তোষজনক সম্পর্ক বজায় রাখা। পূর্ব ও পশ্চিম পাকিস্তানে বর্তমানে যে পররাষ্ট্রনীতির প্রতি দৃষ্টিভঙ্গি তা নিকট ভবিষ্যতে বদলে যাবে বলে মনে হয় না। উভয় দেশই যুক্তরাষ্ট্রসহ ভারত, রাশিয়া ও চীনের সঙ্গে একটা ভায়াবেল সম্পর্ক বজায় রাখতে চাইবে। তারা কার্যত যুক্তরাষ্ট্রের বন্ধুত্ব চাইবে।
এ পর্যায়ে দলিলটিতে মুজিবের নেতৃত্বাধীন স্বাধীন বাংলাদেশ সম্পর্কে বলা হয়, এই দেশ গণতান্ত্রিক সরকার প্রতিষ্ঠা করতে সক্ষম হবে এবং জনগণের নিরঙ্কুশ আস্থাও ভােগ করতে পারবে। তার বড় প্রতিবেশী ভারতের সঙ্গে সহযােগিতামূলক সম্পর্ক রাখবে। একই সময় দেশটি কোনাে একটি শক্তির ওপর নির্ভরশীল না থেকে অন্যান্য দেশের সঙ্গে ভালাে সম্পর্ক বজায় রাখতে সচেষ্ট হবে। তবে এটা ঠিক যে, ভবিষ্যতে বাংলাদেশ নামে নতুন রাষ্ট্র ক্রমবর্ধমানহারে রাজনীতির ক্ষেত্রে রেডিকালাইজেশন ও অস্থিতিশীলতা প্রত্যক্ষ করবে। দলিলটির দ্বিতীয় পরিচ্ছেদে পূর্ব পাকিস্তানের পৃথক হওয়া অনিশ্চয়তার ক্ষেত্রে সম্ভাব্য নীতির বর্ণনা করা হয়। এটাই হলাে বর্তমান বাস্তবতা। আমরা এক্ষেত্রে তিনটি বিকল্প বিবেচনায় রাখতে পারি। প্রথমত, আমরা পাকিস্তানকে বলতে পারি আমাদের নীতি হলাে পাকিস্তানের স্বাধীনতা, ঐক্য ও অখণ্ডতাকে সমর্থন করা। আর বলা এটা, তােমার দেশ, তুমি। কিভাবে তােমার সমস্যা মােকাবেলা করবে তা তােমার বিষয়। দ্বিতীয়ত, আমরা বাঙালিদের ঘনিষ্ঠ হতে পারি। তাদের এই ইঙ্গিত দিতে পারি, আমরা যখন পাকিস্তানি ঐক্যের কথা বলব তখন তােমরা মনে রাখবে আমরা স্বীকার করি যে, পূর্ব পাকিস্তানে জাতীয়তাবাদীর ধারা বেগবান হচ্ছে এবং পরিবর্তিত পরিস্থিতিতে আমরা আমাদের নীতি ঠিক করে নিতে পারব। নতুন সরকার এলে তাকে আমরা স্বাগত জানাব। তৃতীয়ত, আমরা যখন আমাদের বর্তমান প্রকাশ্য অবস্থান রক্ষা করব তখন ঘরােয়াভাবে প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়াকে বলব, এক পাকিস্তান রক্ষায় মুজিবুর রহমানের। সঙ্গে যথাসাধ্য আলাপ-আলােচনা চালিয়ে যাও। দলিলটিতে বলা হয়, সিআইএ এই তৃতীয় বিকল্প অনুসরণে নির্দিষ্টভাবে আপত্তি তুলেছে। তাই সম্ভাব্য মার্কিন অবস্থান। হতে পারে প্রথম বিকল্পের ভিত্তিতে। এটা করা হলে পশ্চিম পাকিস্তান বুঝবে আমরা তাদের সঙ্গে আছি। আর বাঙালিরাও ভাববে আমরা হয়তাে তাদের সঙ্গেও আছি। যদিও আমরা দৃশ্যত মুজিবের এই অবস্থানের অর্থাৎ ঐক্যবদ্ধ পাকিস্তানের দিকেই আমাদের ঝোক থাকবে।
এ পর্যায়ে সিআইএ কেন তৃতীয় বিকল্পের বিরােধিতা করছে তার একটি ব্যাখ্যা দেয়া হয়। এতে বলা হয়, নির্বাচনের ফলাফল এটা নিশ্চিত করে যে, (ক) পাকিস্তান। অবশ্যই দ্রুততার সঙ্গে যেদিকে যেতে পারে। ১. দমনমূলক সামরিক শাসন ২. দুই। জাতির মধ্যে ভাঙন, যার মধ্যে কট্টর পশ্চিমাবিরােধী ক্ষুদ্র গােষ্ঠী থাকবে। ৩. আওয়ামী লীগের শিথিল কনফেডারেশনের প্লাটফরম থেকে একটি সাংবিধানিক সরকার প্রতিষ্ঠা। দলিলে বলা হয়, এই তৃতীয় বিকল্পও দক্ষিণ এশিয়ায় আমাদের স্বার্থের জন্য অধিকতর স্পষ্টভাবে সামঞ্জস্যপূর্ণ এবং আমাদের তা সমর্থন করা উচিত। (খ) কনফেডারেশনে বিদেশনীতি ও প্রতিরক্ষা নীতি থাকবে কেন্দ্রীয় সরকারের কাছে। ভুট্টোর কট্টোর চীনাপন্থি ও ভারতবিরােধী নীতি নিয়ন্ত্রিত হবে এবং তিনি পাকিস্তান সেনাবাহিনী ও বিমানবাহিনীকে নিয়ন্ত্রণ করতে পারবেন না। অথচ যদি দেশ দুটুকরাে হয় তাহলে তার জন্য এসব সুযােগ চমৎকারভাবেই ধরা দেবে। (গ) এমন সাক্ষ্য-প্রমাণ রয়েছে যে, পাকিস্তান সেনাবাহিনীর কতিপয় নেতৃবৃন্দ ক্রমেই এই আশংকা করছেন যে, একটি পৃথক পশ্চিম পাকিস্তানের বামপন্থী শাসনের পরিণতি কি হবে এবং তারা একটি ঐক্যবদ্ধ দেশেই তাদের স্বার্থ নতুন করে খুঁজে পাচ্ছেন। এমনকি তারা সর্বোচ্চ আঞ্চলিক স্বায়ত্তশাসনও দিতে প্রস্তুত, বাঙালি নেতৃবৃন্দ প্রকাশ্যেই যেজন্য যুক্তরাষ্ট্রের কাছ থেকে পুনর্নিশ্চয়তা চাইছেন।
এই পরিস্থিতিতে আমাদের সহযােগিতা ও আশ্বাস উল্লেখযােগ্য মাত্রায় প্রভাব বিস্তার করতে পারে। সেক্ষেত্রে উদার বিদেশনীতি সংবলিত একটি সাংবিধানিক সরকারই আমরা কামনা করতে পারি। দলিলটিতে বলা হয়, যদি পূর্ব পাকিস্তানের পৃথক হওয়া আসন্ন হয়, সেক্ষেত্রে যুক্তরাষ্ট্র এই তিনটি বিকল্প ভাবতে পারে। ১. আমরা ক. ১ এ বর্ণিত ধারণার ভিত্তিতে অগ্রসর হতে পারি। ২. আমরা পূর্ব পাকিস্তানের নেতৃবৃন্দকে জানিয়ে দিতে পারি যে, একটি স্বাধীন রাষ্ট্রের অভ্যুদয়কে স্বাগত জানাতে আমরা প্রস্তুত। সেক্ষেত্রে আমরা তার সরকারের সঙ্গে স্বাভাবিক কূটনৈতিক সম্পর্ক বজায় রাখব। একই সাথে পশ্চিম পাকিস্তানি নেতৃবৃন্দের সঙ্গেও আমাদের যােগাযােগ থাকবে ঘনিষ্ঠ এবং যখন যেমন দরকার পড়ে তাদেরকে জানিয়ে দেয়া হবে যে, আমরা পরিস্থিতির পর্যবেক্ষণ করছি এবং যথাযথ ব্যবস্থা গ্রহণ করা হবে। ৩. পরিস্থিতির পরিপ্রেক্ষিতে আমরা এটা স্বীকার করতে পারি যে, পূর্ব পাকিস্তানে নতুন সরকারের কাছ থেকে অর্থনৈতিক সহযােগিতার অনুরােধ আমরা সহানুভূতির সঙ্গে বিবেচনা করব। দলিলে এ পর্যায়ে প্রস্তাবিত যুক্তরাষ্ট্রের ভূমিকা সম্পর্কে বলা হয় যদি পৃথক হওয়া আসন্ন হয় তাহলে তা ঘােষণার আগে আমরা উক্ত ২ নং বিকল্প অনুসরণ করতে পারি । ঘরােয়াভাবে পূর্ব। পাকিস্তানি নেতাদের জানিয়ে দিতে পারি যে, আপনারা যদি স্বাধীনতা ঘােষণা করেন। তাহলে আমরা আপনাদের নতুন রাষ্ট্রকে স্বীকৃতি দেব এবং সেই সরকারের সঙ্গে স্বাভাবিক সম্পর্ক বজায় রাখতে এখন থেকেই প্রস্তুতি নেব। তবে আমরা যদি ঐ ১ নং বিকল্প অর্থাৎ পশ্চিম পাকিস্তানিদের সঙ্গে সম্পর্ক রাখি তাহলে বর্তমান অবস্থায়। নিতান্ত অপ্রয়ােজনীয়ভাবে বাঙালি নেতৃবৃন্দকে আমরা ক্ষুব্ধ করে তুলব। অথচ ভবিষ্যতে আমরা তাদের সঙ্গে সুসম্পর্ক রাখতে চাই। তার চেয়ে বরং তাদের সঙ্গে সম্পর্ক ভালাে রাখাই উত্তম। তবে পূর্ব পাকিস্তানি নেতৃবৃন্দ আনুষ্ঠানিকভাবে। স্বাধীনতার ঘােষণার আগেই যদি মার্কিন হস্তক্ষেপ আশা করে তাহলে আমরা তাতে সাড়া দেব না।
তখন তাদের বলব, পশ্চিম পাকিস্তানিরা আপনাদের ওপর মিলিটারি ক্র্যাকডাউন চালাতে পারে তা আমরা মনে করছি না। (ধরে নিতে হবে তাদের এই আশংকাই সত্যে পরিণত হবে।) আমরা অবশ্যই দৃঢ়তার সঙ্গে মার্কিন সামরিক সম্পৃক্ততা সুপারিশ নাকচ করে দেব। পূর্ব পাকিস্তান যদি প্রকাশ্যে তার স্বাধীনতা ঘােষণা করে এবং আমাদের স্বীকৃতি চায় সেক্ষেত্রে তৃতীয় পরিচ্ছদে বর্ণিত উপায়ে। পরিস্থিতি মােকাবেলা করতে হবে। এই পরিচ্ছেদে বলা হয়েছে, বিভক্তির ক্ষেত্রে পশ্চিম পাকিস্তান ‘সাকসেসর স্টেট’-এর মর্যাদা পাবে বলে মনে হচ্ছে। প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়াই সেক্ষেত্রে সরকার বা রাষ্ট্রপ্রধান হিসেবে বহাল থাকবেন। নামটাও তারা ধরে রাখতে পারবে পূর্ব পাকিস্তান হবে বাংলাদেশ। দলিলে এ পর্যায়ে নতুন রাষ্ট্র বাংলাদেশকে স্বীকৃতিদানের বিষয়টি এমন সাবলীলভাবে উপস্থাপন করা হয়েছে যার সঙ্গে পরবর্তীকালে নিক্সন কিসিঞ্জারের ভয়ানক বৈরিতা ও বিরােধিতার কোনােই মিল খুঁজে পাওয়া যায় না। দলিলটিতে প্রস্তাবিত মার্কিন পদক্ষেপ সম্পর্কে চারটি সম্ভাব্য প্রতিক্রিয়া গ্রন্থিত করা হয়। বলা হয়, পূর্ব ও পশ্চিম পাকিস্তান কিভাবে পৃথক হয় তার ওপর আমাদের করণীয় নির্ভর করছে। বিকল্প এক বাংলাদেশ একতরফাভাবে স্বাধীনতার ঘােষণা দেবে এবং পাকিস্তান তা মেনে নেবে। পাকিস্তান নিজেই বাংলাদেশকে স্বীকৃতি দিয়ে তার নতুন সরকারের সঙ্গে কূটনৈতিক সম্পর্ক স্থাপনের ঘােষণা দেবে। প্রস্তাবিত মার্কিন পদক্ষেপ হবে আমরা দ্রুততার সঙ্গে বাংলাদেশকে স্বীকৃতি দেব। পাকিস্তানের নতুন করে স্বীকৃতির প্রয়ােজন হবে না। কূটনৈতিক সম্পর্ক আগের মতাে বজায় থাকবে। বিকল্প দুই পাকিস্তান বাংলাদেশের স্বাধীনতা ঘােষণায় প্রত্যাখ্যান করবে, কিন্তু শক্তি দ্বারা তা প্রতিহত করতে উদ্যোগী হবে না।
সেক্ষেত্রে আমরা পাকিস্তানের সঙ্গে সম্পর্ক বজায় রাখার ক্ষেত্রে কিছুটা শ্রদ্ধাশীল মনােভাব দেখাব। তবে যেসব দেশ সর্বাগ্রে বাংলাদেশকে স্বীকৃতি দেবে যুক্তরাষ্ট্র হবে তার অন্যতম। আমরা এটা করতে গিয়ে দিনক্ষণ ও প্রকৃতি নির্ধারণে ব্রিটেনের সঙ্গে সলাপরামর্শ করে নেব। বাংলাদেশকে স্বীকৃতি দিতে ভারত ঝাপিয়ে পড়তে পারে। আমরা সেক্ষেত্রে ভারতের সঙ্গে একযােগে কিছু না করে বরং স্বীকৃতিদানের আগে তাদের একটু জানিয়ে দিতে পারি । বিকল্প তিন পাকিস্তান স্বাধীনতার ঘােষণা প্রত্যাখ্যান করে শক্তি দ্বারা তাকে পর্যুদস্ত। করবে। যুক্তরাষ্ট্রের ক্ষমতাধর ন্যাশনাল সিকিউরিটি কাউন্সিলের সমীক্ষায় দেখা যাচ্ছে এই নির্দিষ্ট বিকল্প ভাবনার সন্নিবেশ করতে গিয়ে তারা বাঙালিদের জীবনে মাত্র ২২ দিন। পরেই ভয়াল কালাে রাত নেমে আসার সম্ভাবনা অনুমান করতে পারেনি। তারা বলেছে, আমরা মনে করি না যে এমনটা ঘটতে পারে। আর যদি ঘটেও আমরা মনে করি না যে, পাকিস্তান দীর্ঘদিন ধরে সামরিক হস্তক্ষেপ বজায় রাখতে পারবে। সেক্ষেত্রে আমরা যখনই বুঝতে পারব যে স্বাধীন বাংলাদেশের সরকার কার্যকরভাবে প্রতিষ্ঠিত হয়েছে তখনই আমরা তাদের স্বীকৃতি দেব। বিকল্প চার পাকিস্তান ও বাংলাদেশ পারস্পরিক সম্মতির ভিত্তিতে পৃথক হবে। এক্ষেত্রে আমরা ত্বরিত বাংলাদেশকে স্বীকৃতি দেব। দুপক্ষের সমঝােতায় বাংলাদেশ জন্ম নিলে প্রেসিডেন্ট দুই রাষ্ট্রপ্রধানের কাছে শুভেচ্ছা জানিয়ে বার্তা প্রেরণ করবেন।
সূত্র: ১৯৭১ আমেরিকার গোপন দলিল – মিজানুর রহমান খান – সময় প্রকাশন