রাজাকাররা ও আর বিশ্বাসী নয়
ঢাকা ২৮ শে অক্টোবর—এক জেলার রাজাকারদের অন্য জেলায় ব্যাপকভাবে বদলি করে মুক্তিবাহিনীর মােকাবিলা করবার কাছে নিয়ােগ করতে পাক হানাদাররা উঠে পড়ে লেগেছে। পাক বাহিনী শহর, গ্রাম, গঞ্জ থেকে সক্ষম লােকদের এক বিশেষ আদেশ বলে সামরিক ছাউনীতে নিয়ে গিয়ে মােটামুটি গােছের একটা প্রশিক্ষণ দিয়ে রাজাকার বাহিনীতে সামিল হতে বাধ্য করছে। জানা গেছে, ঢাকা, চট্টগ্রাম, ফরিদপুর ময়মনসিংহ প্রভৃতি জেলা থেকে প্রশিক্ষণপ্রাপ্ত রাজাকারদের রংপুর, দিনাজপুর প্রভৃতি এলাকায় প্রেরণ করা হচ্ছে। বাংলাদেশের জনৈক নেতৃস্থানীয় ব্যক্তির ধারণা। দলে দলে মুক্তিবাহিনীর হাতে রাজাকারদের আত্মসমর্পণের ব্যাপারে সাবধানতা অবলম্বনের জন্যই এক জেলার লােকদের অন্য জেলায় ঠেলে দেওয়া হয়েছে। মুক্তিবাহিনীর হাতে ধৃত বেশ কিছু সংখ্যক রাজাকারদের মধ্যে বিভিন্ন জেলার লােক দেখা গেছে। ধৃত রাজাকারদের কাছ থেকে জানা গেছে যে, পাক বাহিনী এক ফতােয়া জারী করে তাদের রাজাকার বাহিনীতে প্রবেশ করতে বাধ্য করছে। জনৈক রাজাকার বলেন যে, অনেকে মুক্তিবাহিনীর বিরুদ্ধাচারণের ভূমিকা প্রদর্শন করে রাজাকার বাহিনীতে যােগ দিচ্ছে কারণ এর ফলে অতি সহজে যদি প্রাণে বেঁচে থাকা যায় তা হলে অস্ত্র-শস্ত্র সহ মুক্তিবাহিনীর কাছে আত্মসমর্পণের নামে মুক্ত জীবনের অধিকারী হওয়া সম্ভব হচ্ছে। উল্লেখযােগ্য, এত সাবধানতা সত্ত্বেও খান সেনারা রাজাকারদের আত্মসমর্পণ আটকাতে পারছে । কারণ জেলাব্যাপী ব্যাপকভাবে বদলি করেও রাজাকারদের মানসিক গতিকে অর্থাৎ বাঙালীর বাংলাদেশ প্রীতিকে ঠেকিয়ে রাখতে পারছে না। যদিও ব্যতিক্রম কিছু বিশ্বাসঘাতক ক্ষমতালােভী ইয়াহিয়া তাবেদার।
বাংলাদেশ (১) ॥ ১: ১৯ ॥ ১ নভেম্বর ১৯৭১
দালালের খায়েশ
বাংলাদেশের জনগণের গত ডিসেম্বর মাসের নির্বাচনী রায় বানচালের ব্যাপারে ইসলামাবাদের সামরিক জান্তার চক্রান্তের সহিত জড়িত পেশাদার দালাল ৮৮ বৎসর বয়স্ক নূরুল আমিন পাকিস্তানের প্রধান মন্ত্রীর চাকুরী গ্রহণে রাজী আছেন বলিয়া জানাইয়াছেন। গত ২৭শে অক্টোবর এপি এর প্রতিনিধির সহিত ঢাকায় এক সাক্ষাৎকালে তিনি বলেন, ‘পাকিস্তানের সংহতি রক্ষার উদ্দেশ্যে যে কোন পদ গ্রহণে আমি রাজী আছি।’ | তিনি জানান যে, চলতি মাসের প্রথমভাগে প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়া খানের সহিত সাক্ষাৎ করার উদ্দেশ্যে তিনি ইসলামাবাদ সফরে যাইবেন।
বাংলার বাণী ॥ ১০ সংখ্যা ॥ ২ নভেম্বর ১৯৭১
দেখরে যাদুর কারখানা!
প্রাক্তন প্রেসিডেন্ট আইয়ুব খানের নৈশ শয্যাসঙ্গিনী সরবরাহের বিশ্বস্ত দালাল মসিউর রহমান ওরফে যাদুমিয়া প্রগতি ৰাদের মুখােশ আঁটিয়া বাংলাদেশের জনগণকে কত রাজনৈতিক যাদুই না দেখাইয়াছে। বৃদ্ধনেতা মওলানা ভাসানীর নাম ভাঙ্গাইয়া রাজনীতির নামে এই যাদুমিয়া কত পারমিট ব্যবসা বাগাইয়াছে তাহার ইতিহাস বাংলাদেশের মানুষের মনে গাঁথা হইয়া রহিয়াছে। রংপুরে স্বীয় জন্মভূমিতে জাতীয় পরিষদের নির্বাচনে তরুণ ছাত্র লীগ নেতার নিকট শােচনীয়ভাবে পরাজিত হওয়ার ভয়ে নির্বাচনী ময়দান হইতে পলাতক, ৬ দফার ভিত্তিতে স্বায়ত্ব শাসনেরও বিরােধী। এই যাদুমিয়া মওলানা ভাসানীর নাম ব্ল্যাক মেইল করিয়া একলাফে একেবারে বাংলাদেশের স্বাধীনতা ঘােষণার দাবীতে পল্টনে জন সভা ডাকিয়া বসিলেন।
ইহার পর ২৫শে মার্চ হইতে বাংলাদেশে যখন রক্তের বন্যা বহিয়া গেল তখন অতি বিপ্লবী নেতাটির গায়ে কোন আঁচড়টি ও লাগিল না। মসিউর রহমান ওরফে যাদুমিয়া পাড়ি জমাইলেন কলিকাতায়। শােনা যায়, কলিকাতা হইতে তিনি পরে বাংলাদেশের দখলীকৃত এলাকায় গিয়া হানাদার জল্লাদ বাহিনীর সহিত হাত মিলাইয়া গণহত্যা আর লুঠতরাজে আত্মনিয়ােগ করেন। দখলীকৃত এলাকায় তিনি ভুট্টোর পিপলস্ পার্টি গঠনের সােল এজেন্ট গ্রহণ করেন হানাদার সৈন্যদের নেকনজর লাভের আশায়। মওলানা ভাসানী এই খবর শুনিয়া তাহাকে দেশােদ্রোহী বলিয়া আখ্যায়িত করিয়া ন্যাপ হইতে বহিষ্কার করিলেন। দখলীকৃত এলাকায় মুক্তিযােদ্ধারা এই দালালের পিছনে লাগিবার পর তিনি বুঝিতে পারিলেন যে, পশ্চিম পাঞ্জাবী বাবারা তাহাকে আর রক্ষা করিতে পারিবে না। | ইহার পর নাকি তিনি তাঁহার বন্ধু স্থানীয় আওয়ামী লীগ দলীয় এম, এন, এ, এম, পি এদের নিকট দালালীর জন্য ক্ষমা প্রার্থনা করিয়া চিঠি লিখিয়াছেন এবং মুক্তাঞ্চলে আশ্রয় প্রার্থনা করিয়াছেন। ইদানীং শােনা যাইতেছে, যাদুমিয়া ইসলামাবাদ সাম্রাজ্য এবং বাংলাদেশের দখলীকৃত এলাকায় ন্যাশনাল আওয়ামী পার্টি সংগঠন করার মতলব আঁটিয়াছেন। ভূট্টোর টেন্ডেলগিরি’ ছাড়িয়া হঠাৎ ন্যাপ সংগঠনের মতলব তাহার ঘাড়ে চাপিবার কারণ-সম্পর্কে ওয়াকেবহাল মহল বলেন-যে, সরাসরি ভুট্টোর টেন্ডেলগিরি করিলে দালালীতে ধরা পড়িবার আশঙ্কা বেশী। তাই প্রগতিবাদীর মুখােশ লাগাইয়া ন্যাপের নামে দালালী করিলে ধরা পড়িবার ভয়ও নাই, তদুপরি মাওলানা ভাসানীকেও ব্লাক মেইল করা যাইবে। ইসলামাবাদের সামরিক জান্তাও তাহাই চায় । আর ভুট্টোর দলে ভিড়িলে দালালীতে খুব একটা সুবিধাও করা যাইবে না। কারণ ভুট্টোর প্রতি ইয়াহিয়ার মনােভাব খুব ভালাে নয়। যাদুমিয়ার কাজ কারবার দেখিয়া সেই মুসলিম লীগ আমলের গানটাই ঘুরাইয়া গাহিতে ইচ্ছা করে, দেখরে যাদুর কারখানা, দীনের ভাইরে।
বাংলার বাণী ॥ ১০ সংখ্যা ॥ ২ নভেম্বর ১৯৭১
অধিকৃত এলাকায় উপনির্বাচনের নামে দালালদের গণপ্রতিনিধি বানাইবার জল্লাদী কারসাজি
(রাজনৈতিক ভাষ্যকার)। বাংলাদেশের দখলীকৃত এলাকায় মুক্তিযােদ্ধাদের প্রচন্ড গেরিলা তৎপরতা এবং জঙ্গী শাহীর অবশ্যম্ভাবী। পতনের মুখে দখলীকৃত এলাকায় জঙ্গীশাহীর উপনির্বাচন অনুষ্ঠানের স্বপ্ন ধুলিস্যাৎ হইয়া গিয়াছে। অবস্থা বেগতিক দেখিয়া জঙ্গীশাহী উপনির্বাচন অনুষ্ঠানে সাহস পাইতেছে না। তদুপরি, পিন্ডির রাজনৈতিক চক্রান্তের জারজ সন্তানদের মধ্যে যাহারা জল্লাদ ইয়াহিয়ার পা চাটিয়া কামান-মর্টার আর ট্যাংকের গােলা বারুদের ধুম্রজালের ছত্রছায়ায় থাকিয়া উপনির্বাচনে দাঁড়াইবার স্বপ্ন দেখিতেছিল— বাংলাদেশের জনগণ কর্তৃক গত নির্বাচনে ঘৃণার সহিত প্রত্যাখ্যাত হইয়া ছিল ইহারাও আর প্রাণভয়ে প্রকাশ্যে নির্বাচনী মাঠে নামিতে সাহস পায় নাই। কারণ, জনগণের কাছে ভােট ভিক্ষায় বাহির হইলে কেহই ঘরে ফিরিয়া আসিতে পারিবে না। তাই ইসলামাবাদ জল্লাদশাহীর সেই পদলেহী ভূঁইফোড় রাজনীতিবিদরা প্রকাশ্য নির্বাচনে নামিতে তাহাদের অক্ষমতার কথা জঙ্গী শাহীকে জানাইয়া দেয় এবং তাহাদিগকে নির্বাচন ছাড়াই নির্বাচিত বলিয়া ঘােষণা করিতে আব্দার জানায়। ইসলামাবাদের সামরিক চক্রও দেখিল প্রস্তাব একেবারে মন্দ নয়। এত ঢাক-ঢােল পিটাইয়াও যদি উপনির্বিাচন না করা যায় তাহা হইলে মুখ থাকিবে না। কাজেই এই সহজ উপায় অবলম্বন করা যাইতে পারে।
জঙ্গীচক্র বাংলাদেশের দখলীকৃত এলাকায় সকল দালালকে মসনদে বসিবে। কিন্তু, অন্যান্য দালালদের মধ্যে আসন ভাগাভাগির পর ফরিদ আহমদ মিয়ার ভাগে কেবল নিজের আসনটিই পড়ে এবং কেবল একটি আসন লইয়া তাহার মন্ত্রী হইবার কোন আশা নাই। তাই সে গােস্বা করিয়া সরিয়া দাঁড়াইয়াছে। | পিন্ডি ইসলামাবাদের বাছাই করা জারজ সন্তান ফজলুল কাদের চৌধুরী, সবুর খান, ওয়াহিদুজ্জামান, মাহমুদ আলী, খাজা খায়ের উদ্দিন, মােসলেহউদ্দিন, শফিকুল ইসলাম প্রমুখ ৩৩ জনকে বিনা নির্বাচনেই নির্বাচিত বলিয়া ঘােষণা করা হইয়াছে বলিয়া জানা যায়। রাজনৈতিক পর্যবেক্ষকদের মতে অন্তত: জাতীয় পরিষদের সদস্য হিসাবে এইবার এই জানােয়ারের দল ইসলামাবাদ সাম্রাজ্য পাড়ি দিয়া আত্মরক্ষা করিতে সুযােগ পাইবে। কারণ, এতদিন ইহাদিগকে ইসলামাবাদ সাম্রাজ্যে আত্মগােপন করার জন্য অনুমতি দিতেও জঙ্গীচক্র রাজী হয় নাই। ইহারা জানে যে, বাংলাদেশের মাটিতে ইহাদের আর ঠাই হইবে না। এদিকে ক্ষমতালােভী ভুট্টোকে ইয়াহিয়া শেষ পর্যন্ত কাঁচকলাই দেখাইল। ভুট্টোর দল হইতে বাংলাদেশের দখলীকৃত এলাকায় দুই তিনটি বাদে আর প্রার্থী দাঁড় করাইবার সুযােগ দিল না। অথচ ভুট্টো তাহার দলের ভাইস-চেয়ারম্যান মাহমুদ আলী কাসুরীকে ঢাকায় পাঠাইয়াছিল প্রার্থী খুজিয়া বাহির করার জন্য। কিন্তু কাসুরী ঢাকা আসিয়া পা রাখিতেই সব আসন ভাগ বাটোয়ারা হইয়া নির্বাচন ছাড়াই শূন্যপদ পূরণ হইতে চলিয়াছে। কাসুরী ভূট্টোর মাথায় ইহা এক নিষ্ঠুর বজ্রপাত ছাড়া আর কি। তবে জাতীয় পরিষদের শূন্য আসনে বিনা নির্বাচনে নির্বাচিত বলিয়া যাহারা নাম লিখাইয়াছে তাহাদের নামের তালিকাটি মুক্তিযােদ্ধাদের জন্য জল্লাদ ইয়াহিয়াই প্রস্তুত করিয়া দিয়াছে। ইতিহাসের বিচারে একদিন ইহাই রায় হইবে এবং সেদিন খুব বেশী দূরে নয়।
বাংলার বাণী ॥ ১০ সংখ্যা ॥ ২ নভেম্বর ১৯৭১
চট্টগ্রামে চারজন দালাল খতম
(নিজস্ব প্রতিনিধি প্রেরিত) চট্টগ্রাম, ৩রা নভেম্বর মুক্তিবাহিনীর গেরিলারা চারদিকে কড়া প্রহরার ব্যুহ ভেদ করে পাক সামরিক গুন্ডার পদলেহী চারজন দালালকে গুলী করে হত্যা করে এক অসাধারণ বীরত্বের পরিচয় দিয়েছেন। এছাড়া তারা অপর এক দালালকে গুরুতররূপে আহত করেছেন। বর্তমানে তাকে হাসপাতালে ভর্তি করা হয়েছে। নিহত দালালেরা হােল, বাকলিয়া ইউনিয়ন কাউন্সিলের চেয়ারম্যান বাচ্চু মিয়া, উরকিরচর। ইউনিয়ন কাউন্সিলের চেয়ারম্যান মাইজ্যা মিয়া, সাতকানিয়া নিবাসী চট্টগ্রাম শহরের অন্যতম নামজাদা। মােক্তার মােজফর আহমদ এবং চৌধুরী হাটের ফয়েজ আহমদ। ফয়েজ আহমদকে চৌধুরী হাটের বুকে লােকজন সরিয়ে প্রকাশ্য দিবালােকে হত্যা করা হয়েছে। মুক্তিবাহিনীর হাতে যে দালালটি আহত হয়েছে, সে হােল পাকিস্তান মুসলিম লীগের (কনভেনশন) শহর শাখার সেক্রেটারী ক্যাপ্টেন বস্তৃতিয়ার। তাকে তার বাসভবনেই গুলী করা হয়, তার পেটে ও কাঁধে গুলীর আঘাত লেগেছে বলে জানা গেছে।
অমর বাংলা ॥ ১:১ ॥ ৪ নভেম্বর ১৯৭১
হানাদার ও রাজাকারদের দলে দলে আত্মসমর্পণ
মুক্তি বাহিনীর সর্বত্র বিজয়-অভিযান। কুমিল্লা রণাঙ্গনের ফেনী ও বিলােনিয়ার মধ্যে অবস্থিত ফুলগাজী রেল সেতুটি মুক্তিবাহিনী গত সপ্তাহে ধ্বংস করে দিয়েছেন। কুমিল্লা জেলার কসবার কাছে সম্প্রতি ৩নং পাঞ্জাব রেজিমেন্টের সৈন্যদের বহনকারী একটি লঞ্চ মুক্তি যােদ্ধারা ডুবিয়ে দেন। এর ফলে বহু খান সেনা খতম ও তাদের অস্ত্রশস্ত্র ধ্বংস হয়। | বাঞ্ছারামপুরে আরও একটি লঞ্চ মুক্তিবাহিনীর গেরিলা যােদ্ধারা ডুবিয়ে দেন। ফলে আরও বহু সৈন্য খতম হয়। একই অঞ্চলে গেরিলা যােদ্ধারা ব্যাপক আক্রমণ চালিয়ে খান সেনাদের ৩টি স্পীড বােট ও ১০টি। দেশী নৌকা ডুবিয়ে দেন। গত সপ্তাহে কুমিল্লা জেলার কসবার কাছে মুক্তিবাহিনী অতর্কিতে আক্রমণ করে দুই’শ তৃতীয়। পাঞ্জাব রেজিমেন্টের শত্রু সৈন্য খতম করেছেন। লঞ্চ থেকে মুক্তিযােদ্ধারা প্রচুর অস্ত্র শস্ত্র দখল করে। নিয়ে পরে ডুবিয়ে দেন।
অমরাতােলিতে এক টহলদার পাকিস্তানী বাহিনীকে অতর্কিতে আক্রমণ করে মুক্তিযােদ্ধারা ৪ জন শত্রু সৈন্যকে খতম করেন। ৩রা অক্টোবর নয়ানপুর রেল ষ্টেশনের কাছে ৩ জন হানাদার খতম করেন। | বিলম্বে প্রাপ্ত খবরে প্রকাশ, গত ২রা অক্টোবর কুমিল্লা জেলার হােমনা থানায় ১১ জন পাকিস্তানী পুলিশ ও ৫ জন রাজাকার মুক্তিবাহিনীর কাছে আত্মসমর্পণ করে। তাছাড়া অস্ত্রশস্ত্র সহ ১৫ জন। রাজাকার মুক্তিবাহিনীর কাছে আত্মসমর্পণ করে। ১লা অক্টোবর বল্লায় শত্রুবাহিনীর সমাবেশ ছাউনী। আক্রমণ করে মুক্তিবাহিনী আশ্রমপুরা থেকে বল্লা পর্যন্ত যাতায়াতকারী সৈন্যদের মধ্যে ২৫ জনকে নিহত। এবং ৮ জন আহত করেন।
হানাদার সৈন্য নিহত হলে তারা অবস্থা বেগতিক দেখে পশ্চাদপসরণে বাধ্য হয়। মুক্তিযােদ্ধারা এগিয়ে। হানাদারদের সঙ্গে সরাসরি মুখােমুখি সংঘর্ষে লিপ্ত হন। এই সংঘর্ষে ৪০ জন শত্রু সৈন্য প্রাণ হারায়।
রংপুর
রংপুর সেক্টরে সম্প্রতি চিলাহাটির প্রায় ১৭ মাইল দক্ষিণ-পশ্চিমে মুক্তিবাহিনীর অতর্কিত। আক্রমণের ফলে বহু সংখ্যক পাকিস্তানী সৈন্য ও রাজাকার নিহত হয়। গত ৪ঠা অক্টোবর মুক্তিবাহিনী বৈঠামারীর কাছে মাইন বিস্ফোরণে শত্রু পক্ষের একটি জীপ ধ্বংস করে দিয়েছেন। বিলম্বে প্রাপ্ত এক সংবাদে জানা যায় যে দিনাজপুর জেলার চিরিরবন্দরে দখলদার পাকিস্তানী সৈন্যদের সঙ্গে মুক্তিবাহিনীর প্রচন্ড সংঘর্ষ হয়। এই সংঘর্ষে মুক্তিবাহিনীর দুর্ধর্ষ যােদ্ধারা ৪ জন শত্রু সৈন্য হত্যা করেন এবং একটি রাইফেল দখল করেন। ৫ই অক্টোবর দিনাজপুর জেলার খানপুরে মুক্তিবাহিনী খান সেনাদের সংগে এক সংঘর্ষে লিপ্ত হন ও ৪ জন খান সেনাকে খতম করেন। এই সংঘর্ষে আরও ৯ জন শত্রু সেনা আহত হয়।রংপুর, সিলেট, চাটগাঁ, ঢাকা, ময়মনসিংহ ও যশাের জেলায় মুক্তিবাহিনীর গেরিলা যােদ্ধাদের তৎপরতায় দখলদার সৈন্য ও রাজাকার খতম হয়েছে।
ময়মনসিংহ-এর গফরগাঁও এলাকায় ও সিলেটের রাধানগর এলাকায় প্রচন্ড সংঘর্ষ হয়। মুক্তিবাহিনীর মােকাবেলার জন্য খান সেনারা সিলেট শহরে সান্ধ্য আইন জারী করেও নিষ্প্রদীপ মহড়া চলছে। চাটগাঁ বন্দরে দখলীকৃত বাংলাদেশের সামরিক কর্তৃপক্ষ বিশেষ সতর্কতামূলক ব্যবস্থা করার। মধ্যেই মুক্তিবাহিনীর গেরিলা যােদ্ধারা গত ১লা অক্টোবর এক ভয়াবহ আক্রমণে একটি তেলবাহী গ্রীক গাড়ী মারাত্মকভাবে বিধ্বস্ত করে।
কুষ্টিয়া-খুলনা-যশােরে ব্যাপক আক্রমণ
গত ৫ই অক্টোবর রেবিলবাড়ীর কাছে মুক্তিযােদ্ধারা একটি শত্রুঘাটির ওপর প্রচন্ড আক্রমণ চালান এবং ৩৫ জন খান সেনা খতম করেন। ৪ জন দস্যু সৈন্য মারাত্মকভাবে আহত হয়। একই দিনে মুক্তিবাহিনী একসাবাড়িয়াডাঙ্গার মধ্যে টেলিফোনে যােগাযােগ বিচ্ছিন্ন করে দেন এবং নবকাঠিতে শত্রুপক্ষের একটি জীপ ধ্বংস করেন। গত ৩রা অক্টোবর বরিশাল জেলার বাবুগঞ্জের কাছে দখলদার পাকিস্তানী সৈন্য ও কুখ্যাত রাজাকারদের ওপর গেরিলাযােদ্ধারা অতর্কিত আক্রমণ চালিয়ে ৪ জন হানাদার খতম করেন।
জয়বাংলা (১) ॥ ১: ২৬ ॥ ৫ নভেম্বর ১৯৭১
বিজয় বার্তা
অস্ত্রসহ রাজাকার বন্দী কুষ্টিয়া-যশােহর-খুনলা-রণাঙ্গণ মুক্তিবাহিনীর বীর যােদ্ধাগণ গােয়ালহাটের সন্নিকটে দুজন এবং কোস্তনিয়ার নিকটে পাঁচজন পাকসেনাকে হত্যা করে। এ ছাড়া যশােহর জেলার গদখালী ও নাবারুণ-এর মাঝামাঝি এক জায়গায় রেল লাইন উড়িয়ে দিয়ে যােগাযােগ ব্যবস্থা বিচ্ছিন্ন করে দেয়। মুক্তিযােদ্ধারা চুনামকাঠির কোন এক জায়গায় ১৪টি রাইফেলসহ ১৮ জন রাজাকারকে আটক করতে সমর্থ হয়। খুলনা জেলার খাজুরা, হামিদপুর, লেবুতলা, ওসমানপুর প্রভৃতি এলাকায় হানাদার পাক বাহিনী আক্রমণ চালারে বীর মুক্তিযােদ্ধারা এর পাল্টা আক্রমণ চালায় ফলে ১৮ জন পাক সেনা খতম হয়। খুলনার শ্যামনগরের কাছে এক আক্রমণ চালিয়ে মুক্তিবাহিনী ৪ জন খান সেনাকে হত্যা করে।
| বিপ্লবী বাংলাদেশ ॥ ১: ১২ ! ৭ নভেম্বর ১৯৭১
কুড়িগ্রাম থানার শান্তি কমিটির ৩ জন সদস্যের আত্মসমর্পন কুড়িগ্রাম ॥ ৮ই নভেম্বর আমাদের কুড়িগ্রাম প্রতিনিধি পরিবেশিত সংবাদে প্রকাশ গত ৪ঠা নভেম্বর কুড়িগ্রাম শান্তি কমিটির ৩ জন সদস্য কুড়িগ্রামে অবস্থানেরও আমাদের মুক্তিবাহিনীর নিকট আত্মসমর্পন। করেছে তারা তাদের ফটো লাগানে পরিচিত কার্ডও সমর্পন করেছে। তাদের উক্তিতে প্রকাশ কুড়িগ্রাম,
উলিপুর ও চিলমারী অঞ্চলের কৃষকদের ধান কাটার জন্য পাক সেনারা প্রস্তুতি গ্রহণ করছে। কারণ এই ধান দিয়েই তারা রাজাকারদের খাওয়া-খরচ চালাবে। এই তিনজন সদস্যের নাম হল— জয়নাল আবেদীন, জহুরুল হক ও মােহাম্মদ আলী সরকার।
অগ্রদূত ॥ ১: ১১ ॥ ১০ নভেম্বর ১৯৭১
সুলতান আহমেদ নিহত
স্বাধীন বাংলা বেতার পরিবেশিত রৌমারি ॥ ৮ই নভেম্বর-আমাদের দুর্বার সাহসী মুক্তিযােদ্ধারা অদ্য নারায়ণগঞ্জের রাস্তায় এক আক্রমণ চালিয়ে পাক সামরিক জান্তার অধিকৃত বাংলার প্রাদেশিক সাধারণসভার নব নির্বাচিত সদস্য দালাল সুলতান আহমেদকে গুলির আঘাতে নিহত করে। তার সঙ্গে আরও ৪ ব্যক্তি আহত হয় এবং তাদের মধ্যে একজনের হাসপাতালে মৃত্যু ঘটে। | সুলতান আহমেদের এই মৃত্যুর ফলে বর্বর ইয়াহিয়া উপনির্বাচনের নায়কগণ মৃত্যু ভয়ে সংকিত ও উদ্বিগ্ন হয়ে উঠেছে।
অগ্রদূত ॥ ১: ১১ ॥ ১০ নভেম্বর ১৯৭১
দালালদের নাভিশ্বাস
মুক্তি বাহিনীর দালাল নিধন যজ্ঞ সফলতার সহিত অগ্রসর হইতেছে। প্রাক্তন গভর্ণর মােনেম খা খতম হওয়ায় পুতুল মন্ত্রী সভার সদস্য ইসহাকের আহত হওয়ার, মুসলীম লীগ পান্ডা নুরুল হুদার নিহত হওয়ার এবং এমনি কত ছােট ও বড় দালালদের খতম হওয়ার ঘটনা বাংলাদেশের মাটিতে নিত্য নৈমত্তিক ব্যাপার হইতেছে। ফলে এই ধরনের নানা রকমের দালাল ঢাকা শহরে আসিয়া আসর জমাইতেছে। এই সমস্ত দালালদের অধিকাংশই আইয়ুবী আমলের নামকরা দালাল বর্তমানে ইয়াহিয়ার পাতি দালালদের সঙ্গে একত্রে থাকার জন্য ঢাকায় বিভিন্ন বস্তিতে শরণাপন্ন হইতেছে। অবশ্য এদের ভাগ্যে বেশীদিন দখলকৃত বাংলার রাজধানীর সুখ নাই বলিয়া সাধারণ লােকেরা বলাবলী ইতিমধ্যেই শুরু করিয়াছে…
নতুন বাংলা ॥ ১: ১৩ ॥ ১১ নভেম্বর ১৯৭১
কাশীগঞ্জে ১৪টি রাইফেল উদ্ধার
(নিজস্ব সংবাদদাতা) ফুলবাড়ীয়া ২৫ শে অক্টোবর-বীর গেরিলারা কাশীগঞ্জের রাজাকার ঘাটিতে আজ এক আক্রমণ চালিয়ে পয়ত্রিশ জন রাজাকারকে নিহত করেছেন। ঘটনার বিবরণে প্রকাশ, রাজাকাররা আত্মসমর্পণ করবে—এই মর্মে এক খবর মুক্তিবাহিনীর ঘাটীতে প্রেরণ করে। মুক্তিবাহিনীর কমান্ডার মাে: আনছার উদ্দীন তাহাদের কথায় বিশ্বাস স্থাপন করে অনুমতি দেন। সন্ধ্যার সময় মুক্তি যােদ্ধারা যখন ইফতার করতে ব্যস্ত ঠিক সে সময়ে পঞ্চাশ জন রাজাকার চরম বিশ্বাসঘাতকতা করে আনছারউদ্দীন সাহেবকে ধরে নিয়ে যায়। এ ঘটনায় স্থানীয় জনসাধারণ বিশেষভাবে মর্মাহত হন। তারা রাজাকারদের এ ব্যবহার বেশীক্ষণ সহ্য করতে পারেননি ক্ষিপ্ত হয়ে স্থানীয় জনগণ দাও, বল্লম সড়কী নিয়ে বিশ্বাসঘাতকদের উপর ঝাপিয়ে পড়েন এবং আনছার সাহেবকে উদ্ধার করেন। এ আক্রমণে দু’জন রাজাকার ঘটনা স্থলেই মারা যায় এবং আটজন। আত্মসমর্পণ করে। আনছার সাহেবের বন্দী হওয়ার সংবাদ শুনে আফসার সাহেব কাশীগঞ্জে উপস্থিত হয়ে রাজাকার | ঘাটিতে এক প্রচন্ড আক্রমণ চালান এবং শত্রুঘাটা নিশ্চিহ্ন করে দেন। বিভিন্ন আক্রমণের ফলে এখানে | পয়ত্রিশ জন রাজাকার নিহত হয় এবং মুক্তিযােদ্ধারা ১৪টি রাইফেলসহ বিপুল পরিমাণ গােলাবরুদ হস্তগত করেন।
জাগ্রত বাংলা ॥ ১: ৬ ॥ ১২ নভেম্বর ১৯৭১
কালবার্ট পাহারারত
রাজাকার ঘাটিতে আক্রমণ চারিপাড়া (গফরগাঁও), ২৬শে নবেম্বর : আজ মুক্তিযােদ্ধারা এখানের রেলওয়ে কালবার্টে পাহারারত রাজাকারদের ঘাঁটিতে এক আক্রমণ চালান। আক্রমনটি মুক্তিবাহিনীর দুটি সেকসন কমান্ডার শামছুদ্দিন এবং ফজলুল হক এবং কমান্ডার মােস্তফার যৌথ উদ্যোগে ও নেতৃত্বে পরিচালিত হয়। আক্রমণের পর ৬১ জন রাজাকার নিহত হয় এবং বহু সংখ্যক আহত হয়। আক্রমণ সমাপ্ত হওয়ার পরপরই একটি । বিশেষ পাকসেনা ভর্তি ট্রেন এসে পড়ে। ফলে রাজাকারদের ফেলে রাখা অস্ত্রসস্ত্র উদ্ধার করা সম্ভব হয়নি। উল্লেখ করা যেতে পারে, গত ২১শে (একুশে) অক্টোবর মুক্তিবাহিনীর একটি সেসন কমান্ডার মােস্তাফার নেতৃত্বে এ কালবার্টেই এক আচমকা আক্রমণ চালিয়েছিলেন। সেই আক্রমণে ১১ জন | রাজাকারকে নিহত করা হয়ে ছিল।
জাগ্রত বাংলা ॥ ১: ৬ ॥ ১২ নভেম্বর ১৯৭১
প্রসাদপুর ১৭ জন রাজাকার আত্মসমর্পণ করেছে।
(নিজস্ব সংবাদদাতা) গফরগাও। গত ২১ অক্টোবর এই থানার প্রসাদপুর গ্রামে একদল পাকসেনা কাওরাইদ ঘাটি থেকে এসে |নিরীহ গ্রামবাসীদের উপর অকথ্য অত্যাচার শুরু করে এবং কোন কোন বাড়ীতে অগ্নিসংযােগ করে। সংবাদ পেয়ে মুক্তিযােদ্ধারা প্রসাদপুরে উপস্থিত হন এবং কৈল্লার পাড়া নামক স্থানে পাক সেনারা আসলে পাকসেনাদের সাথে এক প্রচন্ড যুদ্ধে লিপ্ত হন। এ সংঘর্ষে দু’জন পাকদস্যু নিহত হয়। সুযােগ পেয়ে সতের জন রাজাকার আত্মসমর্পণ করে।
জাগ্রত বাংলা ॥ ১: ৬ ॥ ১২ নভেম্বর ১৯৭১
গত মঙ্গলবার ৭ জন রাজাকার ধরা হয়েছে
মল্লিকবাড়ী থেকে পাকদস্যরা পালিয়ে গেলে তাদের পরিত্যাক্ত ব্যাংকারের পাশে দু’জন রাজাকারকে | মুক্তিযোেদ্ধারা ধরে ফেলেন। রাজাকার দু’জন উপযুক্ত সুযােগের অভাবে পালিয়ে যেতে পারেনি। সাধারণ ক্ষমা ঘােষণার (বাংলাদেশ সরকারের) নির্দেশানুসারে তাদের ব্যবস্থা করা হয়েছে। আরও দুজন। রাজাকার মল্লিকবাড়ী থেকে পাকসেনারা পালিয়ে যাবার পর দু’জন রাজাকার তাদের পরিবারবর্গকে সরিয়ে ফেলার জন্য বাড়ী আসলে মুক্তিযােদ্ধারা স্থানীয় রক্ষীবাহিনীর সাহায্যে ধরে ফেলেন। এ ছাড়াও বরাইদ থেকে তিনজন রাজাকারকে ধরে আনা হয়।
জাগ্রত বাংলা ॥ ১ : ৬ ॥ ১২ নভেম্বর ১৯৭১
মমানেমের ভাগ্য সব দালালকেই বরণ করতে হবে
মসনদের লােভে পড়ে যে মীরজাফর আলি খান পলাশীর আম্র কাননে বাংলা-বিহার উড়িষ্যার স্বাধীনতা বিকিয়ে দিয়েছিল ইতিহাসে কুখ্যাত হয়ে থাকলেও মৃত্যুর পরে সে বাংলারই মাটিতে শায়িত থাকার সুযােগ পেয়েছিল। এর ফলে মৃত্যুর পরেও সে বাংলাদেশের পবিত্র মাটিকে অপবিত্র করার সুযােগ পেয়েছিল। কিন্তু বাংলার লাটগিরির আশায় যে কুখ্যাত মােনেম খান বাংলাদেশের সাড়ে সাত কোটি মানুষের সাথে বেঈমানী করেছে এমনকি লাথি খেয়ে গদি হারাবার পরও জীবনের শেষ মুহূর্ত পর্যন্ত সাড়ে সাত কোটি বাঙ্গালীকে পরাধীনতার জিঞ্জিরে আবদ্ধ রাখার প্রয়াস পেয়েছে আজিকার বাঙ্গালী সমাজ তাকে কোনদিনও ক্ষমা করতে পারে না। বাঙ্গালী বীর মুক্তিযােদ্ধারা তাকে ষ্টেনগানের গুলীতে কুকুরের মত হত্যা করেছে। মােনেমের আত্মীয়রা ভেবেছিল ওখানেই সব কিছুর শেষ।
মৃত্যুর পরে অন্ত ত: মােনেম খান বাংলার মাটিতে শান্তিতে ঘুমিয়ে থাকতে পারবে। তাই তারা জায়গা কিনে আজিমপুরার নয়া গােরস্তানে তার লাশ সমাহিত করেছিল। কিন্তু তারা ভুলে গিয়েছিল যে বাঙ্গালী তরুণেরা মৃত্যুর পরও মােনেম খানকে ক্ষমা করতে পারে না, তাকে বাংলার মাটি অপবিত্র করতে দিতে পারে না। মােনেমের আত্মীয়রা আরাে ভুলে গিয়েছিল যে, এই আজিমপুরা গােরস্তানেই শায়িত রয়েছেন ভাষা আন্দোলনের অমর শহীদান বরকত, সালাম ও রফিক। আরাে রয়েছেন বঙ্গবন্ধুর দক্ষিণ হস্ত দৈনিক ইত্তেফাকের প্রতিষ্ঠাতা সম্পাদক জনাব তফাজ্জল হােসেন (মানিক মিয়া) এবং আজীবন সংগ্রামী জনাব আবু হােসেন সরকার প্রমুখ। তাই, আমাদের বীর মুক্তিযােদ্ধারা হাজার হাজার পশ্চিমা সৈন্য ও তাদের দালালদের চোখকে ফাঁকি দিয়ে রাতের বেলায় মােনেম খানের লাশটি গােরস্তান থেকে তুলে নিয়ে নদীতে ফেলে দিয়েছেন। প্রকাশ, মােনম খানের অপবিত্র লাশ তুলে-নেওয়ার সময় মুক্তিযােদ্ধারা, সেখানে একখানা কাগজে কতিপয় কথা লিখে রেখে গেছেন। তাতে লেখা হয়েছে, অন্যান্য দালালদেরও মােনেমেরই দশা হবে । তাদেরকে কুকুরের মত হত্যা করা হবে। তারপর তাদের লাশ নদীতে ফেলে দেয়া হবে বা শিয়ালকুকুরের উদরপূর্তির কাজে লাগান হবে যাতে মৃত্যুর পর তারা বাংলার মাটিকে অপবিত্র করতে না পারে।
জয়বাংলা (১) ॥ ১: ২৭ ॥ ১২ নভেম্বর ১৯৭১
দালাল খতম
ঢাকা থেকে প্রাপ্ত খবরে জানা যায়, যে খােদ ঢাকা শহরেই মুক্তিবাহিনীর গেরিলা তৎপরতা আশাতীতভাবে বেড়ে গেছে। ফলে পাক দালালরা তাে বটেই সৈন্যরাও ভীত সন্ত্রস্ত হয়ে উঠেছে। মুক্তিবাহিনীর গেরিলারা নবেম্বর মাসের ১লা থেকে ৭ তারিখের মধ্যে মােট ২৩ জন দালালকে হত্যা করেছেন। তারমধ্যে বিনা প্রতিদ্বন্দ্বিতায় নির্বাচিত একজন তথাকথিত পরিষদ সদস্যও রয়েছে। তার। নাম সুলতান উদ্দিন খান। এই দালাল একজন মুসলীম লীগ পন্থী, তাকে নারায়ণগঞ্জ থেকে বিনাপ্রতিদ্বন্দ্বিতায় নির্বাচিত করা হয়েছে। তাকে প্রকাশ্য দিবালােকে ঢাকা-নারায়ণগঞ্জ রাস্তায় চাষাড়ায়। গুলি করে হত্যা করা হয়েছে। তারই সাথে খুলনার কুখ্যাত সবুর খানের ঘেটু হিসাবে পরিচিত কুখ্যাত আমির। হােসেনকেও হত্যা করা হয়েছে। তাদের সাথী অপর এক দালাল আহত হয়েছে। রেডিও পাকিস্তানের পাঞ্জাবি সামরিক শাসকচক্র ও তাদের দালাল পুলিশ-রাজাকাররা এখনও পর্যন্ত হত্যাকারীদের’ কোন সন্ধান করতে পারেনি। এর আগে মুক্তিবাহিনীর গেরিলারা আইয়ুবের গর্দভ কুখ্যাত মােনেম খানকে ষ্টেন গানের গুলীতে হত্যা করে এবং পরে গােরস্তান থেকে তার লাশ তুলে নিয়ে নদীতে নিক্ষেপ করে। দালালদের মনে যে । ত্রাসের সঞ্চার করেছে তারা এখনও তা কাটিয়ে উঠতে পারেনি। এছাড়া গেরিলারা কাইয়ুম খান পন্থী কনভেনশন লীগের সাধারণ সম্পাদক খান আবদুস সবুর। খানের ঢাকাস্থ বাসভবনে গত ৪ঠা নবেম্বর বােমা বিস্ফোরণ ঘটিয়েছে। দালাল সবুর অল্পের জন্য প্রাণে বেঁচে গিয়েছে। তবে ওয়াকেফহাল মহলের ধারণা সবুর খানের দিন শেষ হয়ে এসেছে। এছাড়া গেরিলারা ৪ঠা নভেম্বর নৌ-বাহিনীর একজন পদস্থ অফিসারের ৪ পুত্রকে মেশিনগানের | গুলিতে নিহত করেছে। তার পত্নী এবং একটি শিশু সন্তান আহত হয়েছে। গেরিলারা আলােচ্য নৌঅফিসারের বাসগৃহে মেশিনগানের গুলি চালায়।
উক্ত অফিসার ও তার এক পুত্র বাঙ্গালী হয়েও নগ্নভাবে পশ্চিমাদের দালালী করছিল। একইদিনে গেরিলারা ঢাকার একটি বিশেষ এলাকায় তিনজন দোকানদারকে গুলি করে হত্যা করেছে। এরা জোর করে বাঙ্গালীদের এই দোকানগুলাে ভােগদখল করছিল। এতাে গেল দালাল হালাল করার দিক। অন্যদিকে গেরিলারা ঢাকা-নারায়ণগঞ্জ রেল যােগাযােগ | বানচাল করে দিয়েছে। তারা ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়েও একটা বােমা বিস্ফোরণ ঘটায়। ফলে দালালদের যে দু’চারজন সন্তান বিশ্ববিদ্যালয়ে আসত তারাও এখন আসা বন্ধ করে দিয়েছে। তার আগে গেরিলারা ঢাকা শহরের কাছে সৈন্যবাহী একখানা নৌকা ডুবিয়ে দিয়ে ৫ জনকে হত্যা ও ৬ জনকে আহত করেছে। সৈন্যরা তেজগাঁও থেকে বেরইল হয়ে নৌকা যােগে ঢাকায় আসছিল।
ঢাকা শহরে বিদ্যুৎ সরবরাহ ব্যবস্থা অচল করে দেয়া ত নিত্যনৈমিত্তিক ব্যাপার হয়ে দাঁড়িয়েছে। গেরিলারা প্রায়ই ডেমরা ও কাঞ্চনের বিদ্যুৎ সরবরাহ কেন্দ্র অচল করে দেন। | অন্যদিকে সামরিক বাহিনী ও পুলিশ বাহিনীর বিক্ষোভও এতদিনে দাগ বেঁধে উঠেছে। প্রকাশ, বাংলাদেশে ‘কাফের নিধনের জন্য পশ্চিম পাকিস্তান থেকে আনা পুলিশ বাহিনী বাড়ী ফেরার জন্য অস্থির হয়ে উঠেছে। তারা নাকি একটা নির্দিষ্ট সময়ের মধ্যে দেশে ফেরৎ না পাঠালে বিদ্রোহের হুমকী দিয়েছে। | একটি বিদেশী সংবাদ সরবরাহ সংস্থার প্রতিনিধি এ প্রশ্ন পুলিশের ইন্সপেক্টর জেনারেলকে জিজ্ঞেস করলে তিনি বিদ্রোহের কথা অস্বীকার করলেও “নির্দিষ্ট ৬ মাসের সময় সীমা উত্তীর্ণ হওয়ার পর পুলিশরা ঘরে ফিরতে উদগ্রীব” বলে জানিয়েছেন।
জয়বাংলা (১) ॥ ১: ২৭ ॥ ১২ নভেম্বর ১৯৭১
পাবনায় ৪৫ জন দালাল খতম
পাবনা, ৯ই নভেম্বর সম্প্রতি মুক্তিবাহিনী সুজানগর, সাগরকান্দি, খালিলপুর, বেড়া, কাশিনাথপুর, সাঁথিয়া, গােয়ালবাড়ী, শিবরামপুর, দুলাই, সাতবাড়িয়া, নাজিরগঞ্জ প্রভৃতি এলাকায় প্রচন্ড আক্রমণ চালিয়ে ৪৫ জন কুখ্যাত রাজাকার ও দালালকে নিশ্চিহ্ন করে দিয়েছেন। এইসব এলাকায় সম্প্রতি এসব বেঈমানরা এক ত্রাসের রাজত্ব কায়েম করেছিল। মুক্তিবাহিনীর সফল অভিযানের পর গ্রামবাসী স্বস্তির নিশ্বাস ফেলেছেন।
জয়বাংলা (১) ॥ ১: ২৭ ॥ ১২ নভেম্বর ১৯৭১
শান্তি কমিটির চেয়ারম্যান নিহত
গত ৭ই নভেম্বর মুক্তিবাহিনীর গেরিলা যােদ্ধারা নারায়ণগঞ্জের সােনাকান্দার তথকাথিত শান্তি কমিটির চেয়ারম্যান হাজী সাহেব আলীকে গুলি করে হত্যা করেছেন। একই দিনে একজন এম পিএ সহ ১১ জনকে প্রকাশ্য দিবালােকে মুক্তিবাহিনীর গেরিলা যােদ্ধারা গুলি করে হত্যা করেছেন।
জয়বাংলা (১) ॥ ১: ২৭ ॥ ১২ নভেম্বর ১৯৭১
দালাল নিধন
গত ৭ই নভেম্বর আমাদের অতন্দ্রপ্রহরী গেরিলারা কুখ্যাত দালাল হাবিব আলমকে পূর্বপাড়া গ্রামে তার নিজস্ব বাসভবন থেকে গ্রেফতার করে পরে পাক বাহিনীর সাথে সহযােগিতা এবং দেশমাতৃকার প্রতি চরম বিশ্বাসঘাতকতার অপরাধে তাকে মৃত্যুদন্ড দেয় ।
বাংলাদেশ (৪) ॥ ১: ৩ [ ১২ নভেম্বর ১৯৭১
চাদ মিয়ার চাদে যাত্রা
ঢাকা, ১৩ই নভেম্বর : দক্ষিণপন্থী রাজনৈতিক কর্মী এবং পাক সরকারের দালাল বলে বর্ণিত চাদ মিঞা সর্দার গতরাত্রে বাংলাদেশের গেরিলাদের গুলীতে নিহত হয়েছে। এদের গুলিতে একজন পুলিশসহ আরও পাঁচজন সাংঘাতিকভাবে আহত হয়েছে। | আজ সরকারীভাবে উপরােক্ত সংবাদ দেওয়া হয়েছে। স্থানীয় বাসিন্দারা এই মর্মে অভিযােগ করেন যে, চাঁদ মিঞা পাক সামরিক বাহিনীকে সাহায্য করত।
বাংলাদেশ (১) # ১; ২১ ! ১৫ নভেম্বর ১৯৭১
বাঙ্গালী রাজাকাররা সাবধান
নরপিশাচ ইয়াহিয়া খান তার বর্বর সামরিক বাহিনীকে সাহায্য করার জন্য বাঙ্গালী যুবকদের জোর করিয়া রাজাকার বাহিনীতে যােগদান করিতে বাধ্য করিয়াছেন। সমাজ বিরােধী এক শ্রেণীর গুন্ডাবদমায়েশ লম্পটরাও এই সুযােগে রাজাকার বাহিনীতে ঢুকিয়া পড়িয়াছিল। ইহারা জনসাধারণের জানমালের যথেষ্ট ক্ষতি সাধন ও ধন-সম্পত্তি লুণ্ঠন করিয়া অরাজকতা সৃষ্টি করিয়াছিল। কিন্তু ইদানিং মুক্তিফৌজের ক্রমাগত সাফল্যের ফলে এক শ্রেণীর রাজাকার যারা নিজের ইচ্ছার বিরুদ্ধে রাজাকার বাহিনীতে যােগদান করিতে বাধ্য হইয়াছিল তাহারা মুক্তিফৌজ গেরিলাদের হাতে প্রত্যহ আত্মসমর্পণ করিয়া চলিয়াছে। রাজাকারদের মনে আরও ভীতির সঞ্চার করিয়াছে যখন তাহারা দেখিতে পায় পাঞ্জাবী হানাদার বাহিনী মুক্তিফৌজের ভয়ে তাহাদিগকেই প্রথমে সম্মুখে ঠেলিয়া দেয়। রাজাকাররা ইদানিং তাদের ভবিষ্যৎ সম্বন্ধে অত্যন্ত চিন্তিত হইয়া পড়িতেছে। তাদের মানসিক অবস্থার দিকে লক্ষ্য রাখিয়া এই কথাই বলিব অবিলম্বে যেন তারা তাদের অস্ত্র সস্ত্রসহ মুক্তিফৌজের হাতে আত্মসমর্পণ করেন। তাদের অপকীর্তি দেশদ্রোহিতার সামিল এবং দেশদ্রোহিতার একমাত্র শাস্তি মৃত্যুদন্ড । এই মৃত্যুদন্ড এড়াইবার একমাত্র পথ হইল নিকটস্থ মুক্তিফৌজ শিবিরে অবিলম্বে আত্মসমর্পণ ।।
বাংলাদেশ (১) ১: ২১ ॥ ১৫ নভেম্বর ১৯৭১
সূত্র : গণমাধ্যমে বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধ – খন্ড – ০৪