রাজাকার হত্যা কর
বাঙ্গালীদের একটা নিষ্ঠুর সত্য স্বীকার করে নিতেই হবে, যে আজ পর্যন্ত তাদের দুঃখ এবং দুর্দশার প্রধান কারণ তারা নিজেই। নিজেদের মধ্যে বিভেদ অসংহতি, দ্বন্দ্ব সৃষ্টি করিয়েই এতদিন পর্যন্ত বিদেশীরা আমাদের শােষণ করেছে। শাসক গােষ্ঠী সব সময় সন্তুষ্ট হয়ে থাকে যে, এক শ্রেণী থাকবেই যাদেরকে তাদের নিজেদের বিরুদ্ধে লেলিয়ে দেওয়া যাবে, যাদের বিভ্রান্ত করা কঠিন নয় কিনে নেওয়া। আরও সহজ।আজ আমরা যখন ভেবেছিলাম যে পাকিস্তানী মিলিটারী জন্তার নৃশংস বিশ্বাসঘাতকতায় সমগ্র বাঙ্গালী জাতি তাদের বিরুদ্ধে জাগ্রত তখন একদল লােকের উদ্ভব দেখেছি যারা বিবেকবুদ্ধিহীন লােভে অন্ধ, সুবিধাবাদী, যারা রাজাকার হয়ে বাঙ্গালীর বিরুদ্ধে অস্ত্র ধরতে সাহস পেয়েছে। যে পাকিস্তানী মিলিটারি আমাদের নিরস্ত্র জনগণকে হত্যা করেছে, শিশুদের জবাই করেছে মেয়েদের ইজ্জত কেড়ে নিয়েছে তাদের এই অপরাধ ক্ষমা করে দিয়ে তাদের সমর্থন করবে কিংবা বাঙ্গালী নিধন অভিযানে তাদের সাহায্য করবে এটা যেমন লজ্জার কথা তেমনি ঘৃণার কথা তেইশ বছরের অত্যাচার, অনাচার লাঞ্ছিনা, উপদ্রব যদি যথেষ্ট না হয় তবে এই কয়েকমাসের নৃশংসতা নিশ্চয়ই এইটুকু বুঝে নিতে যথেষ্ট | পাঞ্জাবী আমাদের বাঙ্গালী হিসেবে, জাতি হিসেবে সম্পূর্ণভাবে নিশ্চিহ্ন করে দিতে চায়। শুধুমাত্র প্রতিহিংসার ইচ্ছাতে, প্রতিশােধের ইচ্ছাতেই এবং বাঙ্গালী হয়ে বেঁচে থাকার ইচ্ছাতেই আজ সবাই এক এবং অটল হয়ে থাকবে এটাই স্বাভাবিক। কারণ এটা একটা সামগ্রিক যুদ্ধ। এক জাতির বিরুদ্ধে এক হানাদার রাষ্ট্রের বিরুদ্ধে, এক অন্যায়ের বিরুদ্ধে এ যুদ্ধ, এখানে স্বাধীনতা বিলাসিতা নয় কোন রােমান্টিক ইচ্ছা নয়, এটা একান্তভাবে প্রয়ােজন আমাদের শুধুমাত্র বেঁচে থাকার জন্যই। হয় বাঙ্গালী হয়ে বাঁচতে হবে নইলে ক্রীতদাসের মত, কুকুরের মত, পাঞ্জাবীর পায়ের তলায় দয়া ভিক্ষা করতে হবে আগামী শতাব্দীর ইতিহাসে।
তাই আশ্চর্য লাগে। যে অস্ত্র দিয়ে আমাদর জনগণকে হত্যা করা হয়েছে, সেই অস্ত্র কিভাবে আমার ভাইয়ের বিরুদ্ধে বাঙালী হয়ে একজন তুলতে পারে? সেই পৈশাচিক বর্বরদের সঙ্গে কিভাবে। সহযােগিতা করতে পারে? কিভাবে যারা মা বােনের উপর অকথথতি অত্যাচার করেছে, লক্ষ লক্ষ ঘর বাড়ি জ্বালিয়ে দিয়েছে, কত সােনার সংসার মাটির সাথে মিশিয়ে দিয়েছে কত নিস্পাপ শিশুকে বায়েনেট দিয়ে খুঁচিয়ে খুচিয়ে মেরেছে, সেই নরঘাতকদের সাথে কোন অজুহাতে এক বাঙালী তাদের সমর্থন করতে পারে? তাই রাজাকার বাহিনী গঠিত হওয়া এবং তার মধ্যে যত নগণ্য সংখ্যকই হােক না কেন বাঙ্গালীর যােগদান করা আমাদের ইতিহাসকে মসী লিপ্ত করেছে, এই লজ্জা, এই কলঙ্ক আমাদের মুছে ফেলতেই হবে। এই রাজাকার বাহিনীতে সাধারণত গুন্ডা, পান্ডা, চোর ডাকাত দুষ্ট প্রকৃতির লােক রয়েছে, যারা ভেবেছে এই অবস্থারপূর্ণ সুযােগ গ্রহণ করে লুটতরাজ এবং অন্যান্য নষ্টামি করবে। যাদেরকে আমাদের সমাজ কোনিদনও গ্রহণ করতে পারত না তারাই উচ্ছাসের সাথে রাজাকার বাহিনী করছে। এটা স্বাভাবিক। আরও রয়েছে একদল বিভ্রান্ত লােক যাদেরকে সম্পূর্ণ ভাবে কিনে নেওয়া হয়েছে টাকা দিয়ে, নারী কিংবা ক্ষমতার লােভ দেখিয়ে। কিছু সংখ্যক আছে যারা চিরজীবনই বাঙ্গালীদের শত্রু যারা অন্য প্রভাবে পড়ে বাঙ্গালীত্ব সম্পূর্ণ ভাবে হারিয়েছে যাদের slave mentality বা গােলাম মনােবৃত্তি কোনদিনও যায়নি, আর যাদের বাঙ্গালীদের উপর এক অদ্ভুত অবিশ্বাস।
এই সব লােকজন পাকসরকারকে সমর্থন করবেই। এবং এক দিক থেকে আমাদের বিরাট সুবিধা যে এই ধরনের সমাজ বিরােধী এবং বাঙ্গালী বিরােধী লােকজনদের হাতে অস্ত্র তুলে দিয়ে তাদের আসল নির্লজ্জ পরিচয় স্পষ্ট হয়ে প্রকাশ করেছে। এদের চিনে নিতে কোন অসুবিধা হবে না, শেষ করে দিতেও অসুবিধা হবে না। জাতি এবং সমাজ হিসেবে আমরা অনেক বিশুদ্ধ হয়ে থাকব। এই সব রেজাকারদের বিরুদ্ধে আমাদের আক্রোশ কোনদিনও মিটবে না। এরা এক বিরাট অন্যায়ের অংশীদার, পাকিস্তানি অপরাধের বােঝা নিজেদের ঘাড়ে নিয়েছে। এদের ক্ষমা করা হবে না। কিন্তু এক দল হয়ত আছে যারা ভুল পথে পরিচালিত হয়েছে, মিথ্যা অপপ্রচারে বিভ্রান্ত হয়ে শত্রুদের হাতের মধ্যে চলে গেছে। এখনও কয়েকজন আছে যারা মুক্তিবাহিনীর হাতে ধরা পড়ে বিবৃতি দিয়েছে যে তাদের রেজাকার বাহিনীতে যােগ দিতে বাধ্য করা হয়েছে। এই সব কথায় সততায় বিশ্বাস করলেও ঘৃণা কমে না। এদের অপরাধও কোন অংশে কমে যায় না। কারণ প্রথমত: তাদের এই ভুল। করা উচিৎ হয়নি, দ্বিতীয়তঃ এতদিনে তাদের ভুল শুধরে নেবার যথেষ্ট সময় পেয়েছে। আর যারা ভয়ে রেজাকারদের সদস্য হয়েছে তাদেরও হুশিয়ার হয়ে যাওয়া উচিৎ যে এই অজুহাত তাদের জীবন রক্ষার জন্যে যথেষ্ট নয়।
আজ অবশ্য অনেক রেজাকার অস্ত্রশস্ত্র সহ মুক্তি বাহিনীর কাছে আত্মসমর্পণ করছে। নিজের জাতির। কাছে দেশের মানুষের কাছে ক্ষমা প্রার্থনা চাওয়ার এই একমাত্র উপায়। অনেকেই ভুল বুঝতে পেরে চলে আসছে। তারা বুঝেছে যে পাক সেনার তাদের জীবন রক্ষার্থে মােটেই উৎসাহি নয়। তাদের শুধু ব্যবহার করা হচ্ছে মুক্তিবাহিনীর আক্রমণের সামনে যারা যাবার জন্য যাতে মুক্তিবাহিনীর কিছু বুলেট নষ্ট হয় আর শুধুমাত্র এদের মৃত্যুর মুখে ঠেলে দিয়ে নিজেরা যেন কিছু ক্ষণের জন্যেও একটু নিরাপদ থাকতে পারে। অবশ্য এদের থাকা খাওয়া আয়েশ করার আর নারী সংগ্রহ করে দেওয়া এদের এক বিরাট দায়িত্ব। তা ছাড়া, মুক্তিবাহিনীর সামনে দাঁড়াবার ক্ষমতা তাদের নেই। তাই প্রত্যেক দিন হাজার হাজার রাজাকার প্রাণ হারাচ্ছে আমাদের গেরিলাদের প্রচন্ড আক্রমণের সম্মুখে। এখন বুঝে নিয়েছে যে বিশ্বাসঘাতকের একমাত্র পরিনাম মৃত্যু। তাই অনেক রাজাকার ভীত, সন্ত্রস্থ হয়ে, মরিয়া হয়ে চলে আসতে চাইছে। মুক্তিবাহিনীতে। এরা আরও বুঝেছে যে পাক সামরিক সরকার এদেরকে কি রকম অবিশ্বাস এবং ঘৃণার চোখে দেখে। এবং পাক সেনাদের কাছে কি ধরনের কৌতুকের বন্ত হয়ে দাড়িয়েছে। অধিকাংশ রাজাকারদেরই কোন দেশপ্রেম নেই, তারা পাকিস্তানে বিশ্বাস করে বলে এই বাহিনীতে যােগ দেয়নি। তাদের অনেক ভুল ভাঙ্গছে, বিশেষ করে যখন রাজাকারদের সঙ্গে চরম দুৰ্ব্বব্যবহার করে।
পাকসেনারা অনেক জায়গায় তাদের মেরেও ফেলা হয়, তাদের নিজেদের স্ত্রী কন্যাকে তুলে দিতে হয়। এদের হাতে। তাদের প্রভুদের যথেষ্ট পরিমাণে খুশি না রাখতে পারলে তাদের অবস্থা নিদারুন হয়ে দাঁড়ায়। অন্যদিকে নিজের দেশের জনগণের বিরুদ্ধে গিয়ে তাদের অবস্থা শােচনীয় হয়ে উঠছে। পাকিস্তানের ধ্বংসস্তৃপের সাথে এদের মৃত্যুও সুনিশ্চিত। যদি সত্যি তারা একটা অসম্ভব নিবুদ্ধিতার পরিচয় না দিতে চায়, শুধু জাতিকে সবার জন্যই নয়, নিজের নিরাপত্তার জন্যেই। এই বােধ হয় শেষ মুহুর্ত যখন তারা তাদের সমস্ত অস্ত্র শস্ত্র সমেত মুক্তিবাহিনীর কাছে ক্ষমা চেয়ে তাদের এই সংগ্রামে যেমন ভাবেই সম্ভব সামিল হওয়া। মনে রাখতে হবে যে সংগ্রাম বড় নির্দয় বড় নির্মম। এবং আমাদের শত্রুদের সঙ্গে আমাদের এক মাত্র ভাষা হচেই অস্ত্রের ভাষা। বাঙ্গালীর এই কলঙ্ক মুছে ফেলতে আমাদের সময় লাগবে না। কিন্তু তাদের শেষ করার আগে শুধু এইটুকু বুঝিয়ে দিতে চাই যে কত মানুষের কত ঘৃণা কত ধিক্কার কত ক্রোধ নিয়ে তাদের মরতে হবে। বাংলাদেশের জনগণের প্রতি তাই আহ্বান: আপনার দা কুড়াল দিয়ে বিশ্বাসঘাতক রাজাকাদের হত্যা করুন।
লড়াই (পূর্বাঞ্চালী যুদ্ধ বুলেটিন-১) অক্টোবর ১৯৭১
রেজাকার বাহিনীতে যােগ না দেওয়ায় হানাদারেরা গ্রামে গ্রামে গিয়ে যুবক ও সক্ষম ব্যক্তিদের রেজাকার বাহিনীতে যােগদানের জন্য জোর জুলুম চালাচ্ছে। কুষ্টিয়া জেলার দামুরহুদা থানার বিভিন্ন গ্রামে পাক-সৈন্য বাহিনীর মেজর হাফিজ গ্রামবাসীদেরকে রেজাকার দলে যােগাদনের জন্য আদেশ জারী করে। কিন্তু গ্রামবাসীরা রেজাকার দলে ভর্তি না হওয়াতে ১৭ই অক্টোবর গােপালপুর নামক গ্রামটিকে পুড়িয়ে দিয়েছে।
মুক্ত বাংলা (১) ॥ ১ : ৭ ॥ ১ নভেম্বর ১৯৭১
সূত্র : গণমাধ্যমে বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধ – খন্ড – ০৪