You dont have javascript enabled! Please enable it!

কাউখালীতে ১০০ জন রাজাকার ও পাঞ্জাবী পুলিশ খতম

বরিশাল : অক্টোবর মাসের প্রথম সপ্তাহে কাউখালীর কেউন্দিয়া গ্রামে ২০০ শত রাজাকার ও পাঞ্জাবী  পুলিশ হানা দিয়ে নিরীহ গ্রামবাসীর উপর বর্বরােচিত অত্যাচার চালাতে থাকলে স্থানীয় মুক্তিযােদ্ধারা সংবাদ পেয়ে বীর বিক্রমে ঝাপিয়ে পড়ে ১০০ জন রাজাকার ও পাঞ্জাবী পুলিশকে খতম করতে সক্ষম হয়। এরপর বাকী ৪০ জন পালিয়ে যায়। জানা গেছে স্থানীয় জনসাধারণ এই আক্রমণ ঠেকাতে সক্রিয়। অংশ গ্রহণ করে। বর্তমানে কাউখালী মুক্ত এলাকা। আশা করা যাচ্ছে কিছুদিনের মধ্যে বাংলাদেশ। সরকার এখানে প্রশাসনিক কাজকর্ম শুরু করতে পারবেন। আর এক সংবাদে জানা গেছে মুক্তিবাহিনী বরিশাল ও খুলনার মধ্যে সমস্ত জল্যান বন্ধ করে দিতে সক্ষম হয়েছে। রকেট, স্টীমার এবং লঞ্চ কিছুই এখন যাতায়াত করছে না।

পটুয়াখালি

পটুয়াখালি জেলার বিভিন্ন অঞ্চলে মুক্তিবাহিনী বিশেষ তৎপরতার সঙ্গে রাজাকার, দালাল ও পাক লুটেরা বাহিনী খতম করে চলছে। ভীত সন্ত্রস্ত সাধারণ দেশবাসী মুক্তিবাহিনীর ব্যাপক তৎপরতায় এখন অনেকটা শান্তিতে দিনযাপন করতে সমর্থ ।।

বিপ্লবী বাংলাদেশ ॥ ১: ৯ ১৭ অক্টোবর ১৯৭১

 আত্মসমর্পণের হিড়িক

২০ শে অক্টোবর মনােহরদিস্থিত পাকবাহিনীর ঘাটি হইতে পলায়ন করিয়া বেঙ্গল রেজিমেন্টের ২২ জন ও ৭ জন রাজাকার অস্ত্র-শস্ত্রসহ মুক্তিবাহিনীর নিকট আত্মসমর্পণ করেন। সাক্ষাতকারে তাহারা আমাদের প্রতিনিধিকে জানান যে, মাতৃভূমির স্বাধীনতা রক্ষার পবিত্র দায়িত্বে অংশ গ্রহণ করার জন্য অনেক দিন হইতেই সুযােগের অপেক্ষায় ছিলেন। সুযােগ পাইলেই পাক বাহিনীর বাঙ্গালী সৈন্যগণ মুক্তিযুদ্ধে অংশ গ্রহণ করিবে। ইতিমধ্যেই কাপাসিয়া, কালীগঞ্জ, জয়দেবপুর, শিবপুর, রায়পুর থানাসহ বিভিন্ন স্থান হইতে আত্মসমর্পণের খবর আসিয়াছে। “তােমরা আমাকে রক্ত দাও আমি তােমাদের স্বাধীনতা দিব।”

মুক্ত বাংলা (২) ॥ ২৩ অক্টোবর ১৯৭১

বিজয় বার্তা

রাজাকার কমান্ডারের আত্মসমর্পণ রংপুর-দিনাজপুর-রাজশাহী রণাঙ্গণ : ৯ই অক্টোবর পুখিলগাঁও অঞ্চল মুক্তিবাহিনীর অতর্কিত আক্রমণে ৩ জন পাক সেনা খতম হয় । অদিতমারির উত্তরাঞ্চলে ভূতেশপুর পাক ঘাটি মুক্তিবাহিনী দ্বারা আক্রান্ত হয় এবং এই আক্রমণে তিনজন পাক সেনা নিহত ও পাঁচ জন গুরুতরভাবে আহত হয়। ৯ই অক্টোবর গাইবান্ধা অঞ্চলে মুক্তিবাহিনীর কাছে বিপুল সংখ্যক রাজাকার আত্মসমর্পন করে। এ ছাড়া রংপুর জেলার হলিদাবাড়ি অঞ্চলের রাজাকার কমান্ডার হবিবুর রহমান মুক্তিবাহিনীর কাছে অনেক অস্ত্রশস্ত্রসহ আত্মসমর্পণ করতে বাধ্য হয়। ১৬ই অক্টোবর মুক্তিবাহিনীর মর্টার আক্রমণে দিনাজপুর জেলার ভাওয়ালগঞ্চ অঞ্চলের পাক ঘাটির বিপুল ক্ষতি সাধিত হয়—এই আক্রমণে ১৭ জন শত্রু সৈন্য নিহত হয়। এই দিন রাতে অপর এক আক্রমণে কালার অঞ্চলে পাক হানাদার বাহিনীর ১০ জন সৈন্য নিহত হয়। মুক্তিবাহিনী নিজেদের মুক্তাঞ্চলে প্রত্যাগমনের পথে মুরাদপুর অঞ্চলে পাক আক্রমণকারীদের সাথে এক মুখােমুখি সংগ্রামের সম্মুখীন হন, দীর্ঘ সময় প্রবল গুলিবর্ষনের পর পাকবাহিনী ছিন্নবিচ্ছিন্ন হয়ে যায় এবং একজন ক্যাপ্টেনসহ ১৫ জন আক্রমণকারী পাক সেনা খতম হয়। পাঁচবিবি অঞ্চলে অপর এক আক্রমণে মুক্তিবাহিনী ১৬ জন পাক শত্রু সৈন্য এবং পাঁচজন রাজাকারকে খতম করেন। গত ১৩ই ও ১৭ই অক্টোবর মুক্তিবাহিনীর অতর্কিত আক্রমণে ১০ জন পাকসেনা ও তাদের সাহয্যকারী ৪ জন। রাজাকার খতম হয়। দিনাজপুর অঞ্চলে ১৫ই অক্টোবর মুক্তিবাহিনীর আক্রমণে ভীত সন্ত্রস্ত ২০ জন রাজাকার অস্ত্রশস্ত্রসহ আত্মসমর্পণ করে।

বিপ্লবী বাংলাদেশ ॥ ১:১  ২৪ অক্টোবর ১৯৭১ দালাল শিবিরে কোন্দল

[নিজস্ব প্রতিনিধি] পাকিস্তানের অখন্ডতা, জাতীয় সংহতি ও ইসলামের নামে ইয়াহিয়া গােষ্ঠী তাহাদের গণহত্যার রাজনীতির পশ্চাতে সমগ্র দক্ষিণপন্থী রাজনীতিক ও শক্তিসমূহকে সংহত ও ঐক্যবদ্ধ করিতে চাহিয়াছিল। কিন্তু ইহারা ঐক্যবদ্ধ হওয়া দূরের কথা পারস্পরিক কোন্দলে লিপ্ত হইয়াছে। ভুট্টো, কাইয়ুম, ফজলুল কাদের প্রভৃতি দক্ষিণপন্থী “গায়ে মানে না আপনি মােড়ল” নেতারা পরস্পর পরস্পরের গায়ে থুথু ছিটাইতেছে।  একচেটিয়া পুঁজিপতি, সামন্ত ভূস্বামী ও সাম্রাজ্যবাদের স্বার্থরক্ষাকারী পাকিস্তানের প্রাসাদ রাজনীতির বনেদীদল মুসলিম লীগের তিন উপদলকে একত্রিত করিবার জন্য শাসকগােষ্ঠী আদাজল খাইয়া লাগিয়াছিল। অথচ বর্তমানে কাইয়ুম খান ও মালিক কাশেম পরস্পরের বিরুদ্ধে রণহুঙ্কার দিয়া ফিরিতেছে। কাইয়ুম খান বাংলাদেশের অধিকৃত অঞ্চলের কনভেনশন মুসলিম লীগের নেতা শামসুল হুদাকে প্রধান সংগঠক নিযুক্ত করিয়াছিল। পেশাদার দালাল কুখ্যাত ফজলুল কাদের চৌধুরী এই হুদানেতৃত্বের কমিটি ভাঙিয়া দিয়াছে। অন্যদিকে ফজলুল কাদের মনােনীত প্রাদেশিক সভাপতি ও বাংলাদেশের অধিকৃত এলাকার পুতুল সরকারের মন্ত্রী আখতারউদ্দিন এই লীগের সদর দফতরে প্রবেশাধিকারও পায় নাই বলিয়া অধিকৃত অঞ্চলের দৈনিক ইত্তেফাক জানাইতেছে। ভূট্টোর দলে ভাঙন।

তবে হাল জামানার বড় তরফের নেতা ভূট্টোর নাটক সম্ভবত সর্বাধিক জমিয়াছে। এই ব্যক্তি ক্ষমতা লাভের জন্য শােষক গােষ্ঠীর গণহত্যার রাজনীতির প্রধান প্রবক্তার ভূমিকা গ্রহণ করিয়াছিল। কিন্তু আজ সামরিক গােষ্ঠীর ক্ষমতা আঁকড়াইয়া থাকার নীতি ও তাহাদের কাইয়ুম প্রীতির ফলে তাহার ক্ষমতা লাভের স্বপ্নসৌধ ভাঙিয়া যাইতে বসিয়াছে। ক্ষমতা লাভের আশা স্তিমিত হওয়ায় পি পি পি’র ভাঙন। অপ্রতিরােধ্য হইয়া পড়িয়াছে। ইহার লায়ালপুর শাখার সভাপতি মােখতার রানা পদত্যাগ করিয়াছে ও সুযােগ সন্ধানী নেতাদের গণ-আদালতে বিচার করিবে বলিয়া হুমকি দিতেছে। এ খবর জানাইয়াছেন ক্ষমতাসীন গােষ্ঠীর অন্যতম প্রধান মুখপত্র দৈনিক পাকিস্তান। ঐ পত্রিকাটি আরও জানায় যে, অপর এক এম, এন, এ, আহমদ রাজা কাসুরী ভূট্টোকে চেয়ারম্যান পদ হইতে বরখাস্ত করিয়া নিজেকে চেয়ারম্যান বলিয়া ঘােষণা করিয়াছে এবং গত ২৪ সেপ্টেম্বর লাহােরে ঘােষণা করিয়াছে যে, মােট ৬৩ জন প্রাদেশিক পরিষদ সদস্য তাহার পক্ষে। এই রাজা গ্রুপই নাকি ভূট্টোর তথাকথিত “ক্ষমতার উৎস” পাঞ্জাবে মন্ত্রীসভা গঠন করিবে। ভাষা আন্দোলনের খুনী নুরুল আমীনও মহা ফাপরে পড়িয়াছে। গত ২২ সেপ্টেম্বর পশ্চিম পাকিস্তানের পত্র-পত্রিকায় প্রকাশ পায় যে, শেখ মুজিবর রহমানকে মুক্তি দিলে বাঙলাদেশে বিরূপ প্রতিক্রিয়া হইবে। বলিয়া তিনি উক্তি করিয়াছেন। ২৫শে সেপ্টেম্বর তারিখে তিনি উহা বেমালুম অস্বীকার করিয়া বসেন।

সমর নায়কদের কোন্দল

অন্যদিকে সরিষাতেও ভূত দেখা দিয়াছে। সমর নায়কেরা নিজেরাও অন্তর্দ্বন্দ্বে ক্ষতবিক্ষত হইয়া পড়িয়াছে। টিক্কা-নিয়াজী-ইয়াহিয়া দ্বন্দ্ব আজ দিবালােকের মত স্পষ্ট। টিক্কা গদিচ্যুত হইয়াছে। জেনারেল ওমর প্রাণ হারাইয়াছে। সাবেক এয়ার মার্শাল আসগর খান খােলাখুলিভাবে সামরিক জান্তার নীতিসমূহের প্রতিবাদ করিতেছে। পক্ষান্তরে মুক্তি সংগ্রামের ছয় মাস অতিবাহিত হইয়া যাইবার পর সামরিক কর্তারা তথাকথিত “বিদ্রোহ দমন করিতে পারা দূরের কথা সারা বাংলাদেশব্যাপী প্রশাসন ও যােগাযােগ ব্যবস্থা দাঁড় করাইতেও অসমর্থ হইয়াছে। স্বাভাবিক অর্থনৈতিক জীবন আজও দাঁড়ায় নাই। খােদ ঢাকা শহরে প্রকাশ্য দিবালােকে ব্যাংক আক্রান্ত হইতেছে, চালনা-চট্টগ্রামে গেরিলাবাহিনীর ভয়ে বিদেশী জাহাজ চলাচল প্রায় বন্ধ হইতে চলিয়াছে। বৃটিশ বীমা সংস্থা পাকিস্তানের যুদ্ধাবস্থার দরুণ বীমার প্রিমিয়াম দ্বিগুণ বাড়াইয়া দিয়াছে। ক্যান্টনমেন্টের বাহিরে শহর এলাকাসমূহও পাক-সেনাদের কাছে নিরাপদ নহে। আজ তাই পশ্চিম পাকিস্তানী পুঁজিপতিরা পাক সরকারের বিজয় সম্পর্কে আস্থা হারাইতে শুরু করিয়াছে। অথচ বিপুল যুদ্ধ-ব্যয় ও বাঙলাদেশের বর্তমান অর্থনৈতিক অচলাবস্থার দরুন পশ্চিম পাকিস্তানী পুঁজিপতিদের নাভিশ্বাস উঠিয়াছে। পশ্চিম পাকিস্তানও খন্ড খন্ড হইতে চলিয়াছে।

পাকিস্তানের অখন্ডতা ও সংহতির জন্য যাহারা জান কোরবান দিয়া পড়িয়াছিল এখন সেই মহামানবেরা পশ্চিম খােদ পাকিস্তানের অখন্ডতা লইয়া ভাবিতে হইয়া পড়িয়াছে। পেশােয়ার হইতে ২৩মে সেপ্টেম্বর ক্ষমতাসীন গােষ্ঠীর সংবাদ এজেন্সী এ পি পি জানাইতেছে যে, ‘ভারতীয় অনুপ্রবেশকারীরা নাকি বেলুচিস্তান ও সীমান্ত প্রদশে ধ্বংসাত্মক কার্যকলাপ করিতেছে। বুঝিতে কষ্ট হয় না যে, বিগত ২৪ বছর ধরিয়া পাখতুনিস্তান ও বেলুচিস্তানের যে বীর জনগণ তাহাদের জাতীয় অধিকারের জন্য সংগ্রাম করিতেছিলেন তাহা চূড়ান্তরূপ লইতে চলিয়াছে। স্মরণ করা যাইতে পারে যে, পাখতুনিস্তানের অবিসংবাদিত নেতা গফফার খানের পুত্র ওয়ালী খান কিয়কাল পূর্বে বলিয়াছিলেন যে, শােষকগােষ্ঠীর নীতিসমূহের ফলে পাকিস্তান ভাঙ্গিয়া খন্ড-বিখন্ড হইয়া যাইতেছে। তাই সকল রাজনৈতিক শক্তিকে ঐক্যবদ্ধ করিবার বজ্র আঁটুনি ফস্কা গেরােয় পরিণত হইয়াছে।

মুক্তিযুদ্ধ ॥ ১: ১৬ ॥ ২৪ অক্টোবর ১৯৭১

সূত্র : গণমাধ্যমে বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধ – খন্ড – ০৪

error: Alert: Due to Copyright Issues the Content is protected !!