ময়মনসিংহ ও সিলেট রণাঙ্গনে
দুই শতাধিক রাজাকারের আত্মসমর্পন বিভিন্ন রণাঙ্গন থেকে প্রাপ্ত খবরে প্রকাশ, আমাদের অসম সাহসী বীর মুক্তিযােদ্ধদের অব্যাহত আক্রমণের ফলে হানাদার খান সেনাদের তাবেদার রাজাকাররা এক্ষণে প্রতিদিন মুক্তিবাহিনীর হাতে অস্ত্রশস্ত্রসহ আত্মসমর্পন করছে। এদিকে দিশেহারা পাক জঙ্গী সরকার রাজাকার ও হানাদারদের ধ্বসে পড়া মনােবলকে চাঙ্গা করার উদ্দেশ্যে দখলীকৃত ঢাকা বেতার থেকে আর্তচীকার করে বলে চলেছে মুক্তিবাহিনীর বীর যােদ্ধারা নাকি হানাদারদের কাছে একেবারে অস্ত্রশস্ত্রসহ ‘সারেন্ডার করছে।’। পাকিস্তানী জঙ্গী সরকারের এমনি অপপ্রচারের প্রমাণ পাওয়া যায় ময়মনসিংহ ও সিলেট রণাঙ্গনে। উক্ত দুটি অঞ্চলে গত এক পক্ষকালে মুক্তিবাহিনীর ক্যাম্পে সদলবলে ২শত রাজাকার আত্মসমর্পন করে।
জয়বাংলা (১) ॥ ১: ২৩ ॥ ১৫ অক্টোবর ১৯৭১
জাতিসংঘে পাক দালাল
নাজেহাল চাবি দেওয়া পুতুলের মতে বাংলাদেশের কীটদ্রংষ্ট দালাল মাহমুদ আলী জাতিসংঘে পাকিস্তানী প্রতিনিধিদলের নেতা তার প্রভু ইয়াহিয়া জঙ্গী শাহীর নির্দেশ অনুযায়ী পাকিস্তানের কদর্য বীভৎস রূপ ঢেকে রাখার জন্য ৯০ লক্ষ শরণার্থীর আশ্রয়দানকারী ভারতের বিরুদ্ধে যুদ্ধ প্রস্তুতির অভিযােগ তুলেছেন। পাকিস্তানের ইতিহাসে এই প্রথম বাঙ্গালী নামধারী এক ব্যক্তিকে জাতিসংঘে পাকিস্তানী প্রতিনিধিদলের নেতা মনােনীত করা হয়েছে। ইয়াহিয়া শাহী বাংলাদেশে তার হিংস্রতম ও বর্বরতম কার্যকলাপ একজন বাঙ্গালী বেঈমানকে দিয়ে বিশ্বের কাছে চেপে রাখবার মধ্যযুগীয় প্রচেষ্টায় মাহমুদ আলীর মতাে ঘৃণ্য কীটকে প্রতিনিধিদলের নেতা করেছে। মাহমুদ আলীর গুণ অনেক। তার রাজনৈতিক জীবনে কোন দিন সে বাঙ্গালীর আবেগ অনুভূতির সাথে নিজেকে একাত্ম করেনি। এই গুণধর মাহমুদ আলী জাতিসংঘে একটি সাংবাদিক সম্মেলন করার দুঃসাহস প্রদর্শন করেছিল। মাহমুদ আলী নাকি প্রথমে বিশ্ব সংবাদপত্র প্রতিনিধিদের মুখােমুখি হতে রাজী হয়নি। কিন্তু প্রতিনিধিদলের আসল নেতা পাঞ্জাবী আগাশাহী তাকে সাংবাদিক সম্মেলনে চাবি দিয়ে বসিয়ে দেয়। মাহমুদ আলী কথা বলতে শুরু করতেই সাংবাদিকরা তাকে নানাবিধ প্রশ্নবানে জর্জরিত করে। কি গুণে তিনি জাতিসংঘে পাকিস্তানী প্রতিনিধিদলের নেতার পদে মনােনীত হয়েছেন এ প্রশ্ন তাকে করা হয়। তাকে আরও প্রশ্ন করা হয়, যে ব্যক্তি নির্বাচনে পরাজিত হয়েছে তার মতাে লােককে কেন নেতা। নির্বাচিত করা হয়েছে। অর্থাৎ জনগণ যাকে ঘৃণার আবর্জনার স্তুপে নিক্ষেপ করেছে সে জাতীয় গণ ধিকৃত লােক পদ পায় কিভাবে?
কিন্তু মাহমুদ আলীর চরিত্রই আলাদা। গণিকাদের যেমন লজ্জা থাকতে নেই মাহমুদ আলীদেরও। তা থাকতে নেই। এ বস্তু থাকলে কারাে পক্ষে মীরজাফর হওয়া যায় না, কুইসলিং হওয়া যায় না। মাহমুদ আলী কিন্তু এ প্রশ্নেরও জবাব দিয়েছে সে বলেছে : “নির্বাচিত হতে হবে এমন কোন ধরা বাঁধা নিয়ম নেই।” মাহমুদ আলীকে সাংবাদিকরা প্রশ্ন করেন অতি পরিচিত কারণেই ওয়াশিংটন এবং পিকিং বাংলাদেশ প্রশ্নে ইয়াহিয়া জান্তাকে সমর্থন করছে। কিন্তু এছাড়া পৃথিবীর আর বিশেষ কোন দেশ ইয়াহিয়াকে সমর্থন করছে না কেন? মাহমুদ আলী উত্তর দান থেকে বিরত থাকে তাকে আরও প্রশ্ন করা
হয় বিশেষভাবে সােভিয়েত ইউনিয়ন এবং যুক্তরাজ্য কেন বাংলাদেশ প্রশ্নে পাকিস্তান সরকারের প্রতি কঠোর নীতি গ্রহণ করেছেন এবং কেনই বা এ দুটি দেশ পাকিস্তানের বক্তব্য বিশ্বাস করছে না। এবার মাহমুদ আলী মুখ খােলে। কুইসলিং কণ্ঠ থেকে একটি বাক্য বেরিয়ে আসে: “এ প্রশ্নের উত্তর তারাই দিতে পারবে।” মাহমুদ আলী এরপর আগা শাহীর নির্দেশক্রমে ভারতের বিরুদ্ধে অভিযােগ করে বলেন যে, ভারত সীমান্ত এলাকায় গােলযােগ সৃষ্টি করছে। আন্তর্জাতিক সমাজ এ ব্যাপারে ভারতকে নিবৃত্ত করতে না পারলে “তৃতীয় মহাসমর বেঁধে যেতে পারে। মাহমুদ আলী তার বক্তব্য শেষ করার আগেই একজন বিদেশী সাংবাদিক উত্তেজিত হয়ে তাকে প্রশ্ন করে বসেন যে, আপনি তাে ভারতের গােলযােগ সৃষ্টির প্রচেষ্টা সম্পর্কে বলেছেন কিন্তু দয়া করে। বলবেন কি যে, কি কারণে ৯০ লাখ বাঙ্গালী দেশ ত্যাগ করে ভারতে আশ্রয় নিয়েছে? এ জাতীয় প্রশ্ন অনবরত বর্ষণ হতে শুরু করলে মাহমুদ আলীর সাংবাদিক সম্মেলন ভেঙ্গে যায়।
জয়বাংলা (১) ॥ ১: ২৩ ॥ ১৫ অক্টোবর ১৯৭১
সূত্র : গণমাধ্যমে বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধ – খন্ড – ০৪