You dont have javascript enabled! Please enable it!

অধিকৃত এলাকার চিঠি

রেজাকাররা বিভ্রান্ত। চেয়ারম্যান-মেম্বারদের চোখে ঘুম নেই। জামাতে ইসূলামীকে জনগণের দারুণ ঘৃণা। পাঞ্জাবীরা মানুষ নয় শয়তান। কারী সাবের সমুচিত শিক্ষা। একশাে টাকা ও পাঁচশাে টাকার নােট জমা দিয়ে ২০ হাজার পরিবারের হাহাকার। পাঞ্জাবী সৈন্যদের দৃষ্টি এয়ারপাের্টের দিকে। জনগণ। মুক্তিফৌজের আগমনের জন্য প্রতীক্ষারত।

জাফরী ভাই,

এইমাত্র একটা বিরাট এলাকা ভ্রমণ শেষ করে আমদের গােপন আড্ডায় ফিরে এসেছি। এসেই তােমাকে লিখতে বসেছি। কারণ আমার চিঠির জন্য তােমরা যে উদগ্রীব হয়ে পথ চেয়ে রয়েছে সেটা তাে জানা কথা। কিন্তু সমস্যা হলাে কোথা থেকে যে প্রথমে শুরু করবাে সেটা ঠিক করা—একসঙ্গে অনেকগুলাে ব্যাপারই চোখের সামনে ভিড় করেছে। আচ্ছা, একটা ইউনিয়নের চেয়ারম্যান থেকেই শুরু করি, কি বলাে? | ঐ চেয়ারম্যানটা লেখাপড়া বিশেষ কিছু নাজানলেও তাদের স্রষ্টা আয়ুব খানের মতােই কিন্তু উচ্চাভিলাষী। একদিন দুর্ভাগ্যক্রমে আমাকে ওরি ঘরে মুসাফিরী করতে হয়েছিলাে। এর তিনটা ছেলে। একটা ছেলে বিলেতে রয়েছে। বাকি দুটো থাকে বাড়ীতে। যখন বাধ্য হয়ে ওদের বাড়ীতে যেয়ে একটা। রাত্রির জন্য আশ্রয় চাইলুম তখন চেয়ারম্যান নিজের বৈঠকখানায় গুটি কয়েক ‘জি হ্যা’র দ্বারা পরিবৃত হয়ে হুঁকো টানছিলাে। আমি সালাম করে বিনীতভাবে ওদের সামনে যেয়ে দাঁড়ালাম। কিতা চাও? জিজ্ঞাসা করলাে চেয়ারম্যান নয় ওরি জনৈক পরিষদ। | আইজ রাতকুর লাগি আশ্রয় চাই। বাড়ী ক্যাননা?

একটা বানানাে কথাই বললাম। এবার পরিষদটা কিন্তু চুপ হয়ে গেলাে। কারণ একটা সুখ টান। দিয়ে ধুয়ে ছেড়ে চেয়ারম্যান আমার দিকে চোখ তুলেছেন। ক্যানাে যাইতায়? চেয়ারম্যানের প্রশ্ন। এবার আর বানানাে নয়, প্রায় দশ মাইল দূরের একটা গ্রামের নাম করলাম। কিতা লাগি যাইতায়? জিজ্ঞাসা করলাে চেয়ারম্যান। বাধ্য হয়েই আমাকে এমন কিছু বলতে হলাে যাতে চেয়ারম্যান আমাকে আর ফিরিয়ে দিতে পারলাে না। বেশ আদর করেই আশ্রয় দিলাে। রাতের আহারটা করলাম একত্রে বসে। আহারে বসলে পরে বাঙালীদের প্রাণের কথা বেরিয়ে আসে। তাই নিজেই কৌশলে দেশের কথাটা উত্থাপন করলাম। অবশ্যি মুখবন্ধে আমাদের নেতার নিন্দে করতে হলাে কষে। মুক্তিফৌজের প্রতি বর্ষণ করতে হলাে গালাগালি! হায়েনা সর্দার ইয়াহিয়াকে ডুবিয়ে দিলাম তারিফের বন্যায় । আর যায় কোথায়? চেয়ারম্যানের প্রাণটায় আনন্দের বান ডাকলাে। নিজের হাতে পেয়ালা থেকে একটুকরাে বড়াে মাছ তুলে দিলাে আমার প্লেটে। কিন্তু আহার শেষ করে উঠেছি আর অমন সময় দৌড়ে এলাে দুজন রেজাকার। জানালাে, গােপনসূত্রে তারা খবর পেয়েছে আজ মধ্যরাত্রের দিকে গ্রামটায় একদল মুক্তিফৌজ ঢুকবে বলে। | মুহূর্তের মধ্যেই আসে হয়ে গেলাে চেয়ারম্যানের মুখখানা। কিন্তু রেজাকারদের প্রতি গর্জে ওঠলােঃ তােমরা কিতা লাগি আছাে? পাঞ্জাবীরা তােমরারে ট্রেনিং দিছে কিতা লাগি? রাইফেল দিছে কিতা লাগি? গুল্লি দিছে কিতা লাগি? যাও, গাউর হকলটিরে লইয়া যাও। যতাে সব বেহুদার বাচ্চাইন।

ওরা চলে গেলাে গ্রামের বাকি রেজাকারদের ডেকে নিয়ে আসতে। আর চেয়ারম্যান চাইলাে দরজা জানালা বন্ধ করে দিয়ে ঘরের মধ্যে বসতে। চেয়ারম্যানের অমন বীরত্বে হাসি পাওয়া স্বাভাবিক। কিন্তু হাসিকে সামলে নিয়ে বললাম এখন ঘরাের দুয়ার-খিড়কী বন্ধ করি কিতা করতা? আউকা, বারিন্দায় গিয়া বই। আমার প্রস্তাবটা শুনে চমকে উঠলাে চেয়ারম্যান। বললাে: না, না, বাবা, ইতা কইওনা। ইতা। কইওনা। জিজ্ঞাসা করলাম: কেনে? এবং এসময়ে দূরে কোথাও কোনাে কিছু বিস্ফোরণের মতাে একটা আওয়াজ শুনা গেলাে । অতি চিৎকারে থরথর করে কেঁপে ওঠলাে চেয়ারম্যান। তার স্ত্রী এবং যুবতী কন্যা এতােক্ষণে আমার মতাে এক বেগানা যুবকের সামনে বের হওয়াকে গােনাহ মনে করে পাশের কামরাটিতেই অবস্থান করছিলাে। ওরা বেরিয়ে এলাে। দেখি ওদের মুখগুলােও বিবর্ণ।

মানবতা বােধ জেগে ওঠলাে। চেয়ারম্যানকে ধরে বসালাম। অভয় দিলাম। বললাম যে সত্যিই যদি মুক্তিফৌজ আসে তাহলে ওদেরকে থামাবার মতাে কৌশল আমার জানা আছে। আমার সামনে মুক্তিফৌজ তার কোনাে ক্ষতি করবে না। ফ্যালফ্যাল দৃষ্টিতে আমার দিকে তাকিয়ে অবশেষে সে প্রকৃতিস্থ হলাে। স্ত্রীকে বললে চা তৈরী করে। দেবার জন্য। তার মেয়েটিকে বললাে: তুমিও তােমার মা’র লগে যাও ফজিলা। ফজিলা’ পিতৃ আদেশ। পালন করলাে। যাবার সময় একবার কিন্তু পেছন ফিরে তাকালাে। দোষ নেবেন না জাফী ভাই, তােমাকে গােপন করে পাপী হতে চাইনে। ফজিলার ডাগর চোখ দুটি সত্যিই পুরুষের মনে যাকে বলে-না, থাক্। অন্য কথা বলি। চা খেতে-খেতে কিন্তু চেয়ারম্যান বলে গেলাে অনেক কিছু। বুঝতে পারলাম যে আয়ুবের কৃপায় চেয়ারম্যানগিরী সৃষ্ট হওয়ার পরে আজ পর্যন্ত তার গদীটা ঠিকই আছে এবং দীর্ঘ দশ বছরে জনগণ ও সরকারকে প্রবঞ্চনা করে যা কামাই করেছে সেটা তার স্বপ্নাতীত । কিন্তু। আরাে কিছুদিন সে গদীটা আঁড়িয়ে থাকতে চায়। কিন্তু  কিন্তু  ওর কটা জানতে চাইলাম। -তা আর কইয়া কিতা অইতাে বাবা -কউকা না হুনি?

তখন জানতে পারলাম তার উভয় সংকট। পাঞ্জাবীদেরকেও সে পরিপূর্ণ ভাবে বিশ্বাস করেনা আর ওদিকে মুক্তিফৌজের ভয়ে তার চোখে রাত্রের বেলা ঘুম নেই।  -পাঞ্জাবীরা তাে ইসলাম ধর্ম বাচাইবার লাগিয়াই আইছে, মন্তব্য করলাম এবং তাতে সহসাই উত্তেজিত হয়ে উঠলাে সে। -কেনে? কিতা অইছে? গােবেচারীর মতাে প্রশ্ন করলাম ওকে। আর তখনই কম্বলের নীচে থেকে বেরিয়ে পড়লাে কালাে সাপটা। কারী ছমেদ আলী ওরি গ্রামের এক জামায়েতপন্থী আমী। ওর কথাবার্তায় হামেশাই বাংলার পরিবর্তে উর্দু ফারসী লফজের ব্যবহার। কথায় কথায় “ইসলাম” আর বেহেশত’ ‘দোজখের দীর্ঘবয়ান। কিন্তু সেদিন হয়েছেকি-সহসাই দুজন পাঞ্জাবী সিপাহীজি কারী ছমেদ আলীর গৃহে এসে হাজির। আর তা দেখে ছমেদ আলী খুশির চোটে উর্দু জবান শুরু করে দিলেন।-‘আইয়ে আইয়ে খাঁ ছাহাব, তশরিফ রাখিয়ে।’ পরম যত্নে খাঁ সাব দুজনকে বারান্দায় তক্তপােশে বসিয়ে নারকেল গাছ থেকে ডাব পেরে খাওয়ালেন ওদেরকে। তৃপ্তি সহকারে ডাবের জলপান করে কিন্তু ওদের একজন জিজ্ঞাসা করলাে: আচ্ছা ভাইয়া, ভাবী ছাহাবা কাহা হ্যায়?

তখন আর কথা সরে না কারী ছমেদ আলীর মুখ দিয়ে। প্রথম পক্ষের মৃত্যুর পরে অনেক কাঠখড় পুড়িয়ে শাদী করেছেন সুন্দরী এক তরুণী। রেখেছেন পর্দাপুশিদায়। আর এখন ওরা বলে কি? আমতা-আমতা করে ছমেদ আলী বললেন, উয়াে তাে অন্দরমে হায়, ভাই। -কেও? একজন পাঞ্জাবীর প্রশ্ন। -বেগানা মরকে ছামনে….. কৈফিয়তের সুরে বলতে চাইলেন ছমেদ আলী। কিন্তু ততােক্ষণে। ওদের একজন উঠে দাড়িয়েছে। পলকের মধ্যে চলে গেলাে লােকটা অন্দরে। পেছন পেছন কারীসাবও সেখানে যেয়ে পৌঁছলেন। কারী-পত্নী ততােক্ষণে একহাত ঘােমটা টেনে দাঁড়িয়ে থরথর কাপছেন। পাঞ্জাবীটা একটানে ঘােমটা সরিয়ে ফেললাে। সুন্দর মুখখানি দেখে বললাে: বহুৎ খুব সুরত। এবং পরক্ষণে উর্দু ভাষায় কি যেনাে বললাে। সঙ্গে সঙ্গেই অন্য পাঞ্জাবীটা এসে কারীসাবকে টেনে হেচড়ে বাইরে নিয়ে গেলাে। এরপর? এর পর অর্ধবেহুশ কারীসাব নিজের স্ত্রীর ফুঁপিয়ে কান্না শুনতে পেলেন। যাওয়ার সময় পাঞ্জাবীরা একখানা দশ টাকার নােট কারীসাবের হাতে গুঁজে দিয়ে মৃদু হেসে বললে: ঘাবড়াইয়ে মাং ভাইয়া, ফির মিলােগে।।

এর পরের ঘটনাটা বড়ােই করুণ কারীসাবের স্ত্রী ইন্তেকাল করেছেন। এখন কারীসাব উন্মাদের মতাে রাস্তায় রাস্তায় ঘুরেন আর বিলাপের সুরে বলেন, তুমি আমারে কইছলায় দেশের মানুষ পাঞ্জাবীর ডরে দেশ ছাড়ি যায়গি, আও, আমরাও যাইগি । কিন্তু আমি হুনিনি। আমি তখন কইছলাম, যারা দৌড়ায় তারার ঈমান কমজোর। তারা কাফির। ওরা ইসলামী সিপাই। ইসলামরে বাচাইবার লাগিউ আইছে। ডরাইবার কারণ নাই। হ্যায় হ্যায়, এই আছিল আমার তকদিরাে। এরপর জামাতে। ইসূলামীদেরকে গালাগালি দিতে শুরু করেন। ইয়াহিয়ার চৌদ্দোপুরুষকেও ছেড়ে কথা কন্না। চিৎকার করে বলেন, পাঞ্জাবীরা কাফের, কাফের। বদমাশ মাশ। হাত তুলে মােনাজাতের ভংগীতে বলেন, “আল্লাহ, আমারে মুক্তি দেও, মুক্তি দেও, ওই ফেরাউনের আত্ থাকি” …

ঘটনাটা বিবৃত করে চেয়ারম্যান বললেন যে, এরপর থেকে গ্রামের লােকগুলাে নিজেদের বৌঝিদের চিন্তায় আধমরার মতাে দিন কাটাচ্ছে। ওদিকে রেজাকাররাও আর তেমন উৎসাহ প্রকাশ করছেনা মুক্তিফৌজের সংগে যুদ্ধ করার জন্য। কারণ কোথাও মুক্তিফৌজের সংগে লড়তে হলেই রেজাকারদেরকেই প্রথমে এগিয়ে যাওয়ার হুকুম দেয় পাঞ্জাবীরা। তাই রেজাকাররা এখন ঠিক ঠিক বুঝতে পারছেনা যে তাদের কর্তব্য কি? কি করা উচিত? পাঞ্জাবীরা নাকি সর্বদা এয়ার পাের্টের দিকেই নজর রাখে। আর তা দেখে রেজাকাররা ভাবছে, ওরা পালিয়ে যাওয়ার পথটাকে খােলা রাখতে চায়। হামেশা। নাজানি কোন মুহূর্তে পালিয়ে যাওয়ার আদেশ এসে পৌঁছে। চেয়ারম্যান দুঃখ করে বললেন যে, ইয়াহিয়া খানের কর্মচারীদের প্রচারণায় বিভ্রান্ত হয়ে তিনি নিজেই দশহাজার টাকার-একশাে ও পাঁচশাে টাকার নােট জমা দিয়েছিলেন। কিন্তু এখনাে টাকা ফেরত পাননি। তার মতাে আরাে যারা শাে-টাকাও পাঁচশাে টাকার নােট জমা দিয়েছিলাে তারা সকলেই দারুণ অর্থ কষ্টের মধ্যে দিন যাপন করছে।

চেয়ারম্যান থামলেন। কারণ ততােক্ষণে রেজাকারদল এসে পৌছে গেছে। রাতভর চেয়ারম্যানের বাড়ী পাহারা দেয়ার নামে ওরা নাক ডাকিয়ে ঘুমলাে। কিন্তু ঘুমালেন না চেয়ারম্যান ও তার পরিবারের লােক জন। পরদিন দেখা হলাে জনৈক মেম্বারের সংগে। আলাপে জানতে পারলাম মেম্বার সাবও অদ্রিায় ভুগছেন। তিনি গালি পেড়ে বললেন, কিতা কইতাম সাব, গাউর মানুষ বেইমান অই গেছে। মুখে বলে, পাঞ্জাবী আর পাকিস্তান কিন্তু তলে তলে খোঁজ নেয় মুক্তিফৌজ কোনদিন আইবাে। দীর্ঘশ্বাস ত্যাগ করলেন মেম্বার সাব। চেয়ে দেখি চেয়ারম্যান মনে মনে কি যেনাে জপছেন। হয়তাে কোনাে মােল্লার শিখিয়ে দেয়া আত্মরক্ষার জন্য কোনাে দোআ। আচ্ছা, আজ আর থাক্। প্রীতি নিও। ইতি-তােমারই মন্টু।

মুক্ত বাংলা (১) ! ১ : ৪ ॥ ১১ অক্টোবর ১৯৭১

সূত্র : গণমাধ্যমে বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধ – খন্ড – ০৪

error: Alert: Due to Copyright Issues the Content is protected !!