গণহত্যার নায়কদের বিচার করা হইবে
(নিজস্ব বার্তা পরিবেশক) বাঙলাদেশের অস্থায়ী রাষ্ট্রপ্রধান সৈয়দ নজরুল ইসলাম এক সাংবাদিক সাক্ষাৎকারে বলেন যে, গণহত্যার অপরাধে দোষী পাক সামরিক অফিসার ও অন্যান্যদের বিচার করা হইবে এবং বিচারের উদ্দেশ্যে তাহাদিগকে বাঙলাদেশ সরকারের নিকট সমর্পণের জন্য ভারত সরকারের কাছে অনুরােধ জানান হইবে। আত্মসমর্পণের পূর্ব মুহূর্তে পাক সামরিক বাহিনীর কিছু সংখ্যক কর্মকর্তা উগ্র দক্ষিণপন্থী সাম্প্রদায়িক জামাতে ইসলামীর জল্লাদচক্র ‘আল বদর’ ও ‘আল শামস’-এর সাহায্যে বাঙলাদেশে দুই শতাধিক বিশিষ্ট বুদ্ধিজীবীকে হত্যার কথা প্রকাশ পাওয়ার পর সারা দেশে তীব্র বিক্ষোভ দেখা দেয় এবং খুনী সামরিক অফিসারদিগকে যুদ্ধবন্দী রূপে গণ্য না করিয়া যুদ্ধাপরাধী হিসাবে বিচারের জন্য সকল মহল হইতে দাবি জানান হয়। এই দাবির পরিপ্রেক্ষিতেই জনাব নজরুল ইসলাম উক্ত সিদ্ধান্ত ঘােষণা করিয়াছেন। জনাব ইসলাম বলেন যে, দেশের আইন অনুযায়ীই তাহাদের বিচার করা হইবে। যে-দশ জন পাক সামরিক অফিসারের নাম এই হত্যাকান্ডের সহিত জড়িত বলিয়া শােনা যাইতেছে উহাদের মধ্যে “পূর্ব পাকিস্তানের গভর্নরের সামরিক উপদেষ্টা মেজর জেনারেল রাও ফরমান আলীও রহিয়াছে।
এই হত্যাকান্ডের পিছনে পাকিস্তানে মার্কিন রাষ্ট্রদূত সি, আই, এ, এজেন্ট হিসাবে কুখ্যাত ফারল্যান্ডের নামও শােনা যাইতেছে। ঠান্ডা মাথায় হত্যাকান্ড পরাজয়ের মুহূর্তে দখলদার পাক বাহিনী বাঙালী জাতির উপরে শেষ আঘাত হিসাবেই ঢাকা, রাজশাহী, কুমিল্লা, জামালপুর, ব্রাহ্মণবাড়িয়া প্রভৃতি কয়েকটি শহরে এই সব বুদ্ধিজীবীকে হত্যা করে। ঢাকায় পাকবাহিনীর আত্মসমর্পণের একদিন পূর্বে ১৪ই ডিসেম্বর রাত্রে আল বদর বাহিনী পাক বাহিনীর সহায়তায় ঢাকায় বিশিষ্ট বুদ্ধিজীবীদের হত্যা করে। ঢাকা নগরী মুক্ত হওয়ার পর ধানমন্ডীর পেছনে শহরতলী এলাকায় একটি খাদে ১৪ জনের মৃতদেহ পাওয়া যায়, যাহার মধ্যে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের বাঙলা বিভাগের অধ্যক্ষ মুনীর চৌধুরী, ডা: ফজল রাব্বি ও অধ্যাপক আবুল কালাম আজাদের মৃতদেহ সনাক্ত করা সম্ভব হয়। মৃত ব্যক্তিদের প্রত্যেকের চোখ ও হাত বাঁধা এবং অনেকের বিভিন্ন অঙ্গ প্রত্যঙ্গ কাটা। মৃতদেহগুলির মধ্যে কিছু মহিলারও মৃতদেহ ছিল। হেলেন পারভিন নামে এক মহিলা সাংবাদিকের মৃতদেহ সনাক্ত করা গিয়াছে। ঢাকা হইতে প্রাপ্ত খবরে জানা গিয়াছে, ১৪ই ডিসেম্বর শেষ রাতে মুখােশধারী কিছু লােক এই সব। বুদ্ধিজীবীদের নিজ নিজ বাড়ি হইতে ধরিয়া নিয়া যায়। ইহাদের মধ্যে আরও ছিলেন বিশিষ্ট সাংবাদিক সাহিত্যিক শহিদুল্লা কায়সার, অধ্যাপক মােফাজ্জল হায়দার চৌধুরী, ডা: আলিম চৌধুরী, ডা: মুরতজা, সাংবাদিক সিরাজউদ্দিন হােসেন, সাংবাদিক গােলাম মােস্তফা, অধ্যাপক গিয়াসুদ্দিন আহমদ, অধ্যাপক আনােয়ার পাশা, সাংবাদিক নিজামুদ্দিন, নজমুল হক ও এস, বি, মাসুদ।
ইহাদের কোন খোজ নাই। ইহাদিগকে হত্যা করা হইয়াছে। ইহা একরূপ নিশ্চিত। ঢাকা শহর মুক্ত হওয়ার পর ঢাকা সেন্ট্রাল জেল হইতে ৪০০ রাজবন্দীকে মুক্ত করা হয়। ইহাদের মধ্যে সর্দার ফজলুল করিম ও ড: ওয়াদুদ রহিয়াছেন। রাজশাহী হইতে প্রাপ্ত খবরে জানা গিয়াছে, পাকবাহিনীর আত্মসমর্পণের পূর্বে অনুরূপভাবে রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয় ও কলেজের ১৩ জন অধ্যাপককে হত্যা করা হইয়াছে। পরাজয়ের পূর্ব মুহূর্তে বাছাই করা বুদ্ধিজীবীদের এই হত্যা ছিল পাক বাহিনীর ও জামাতে। ইসলামের সুপরিকল্পিত। আল বদর বাহিনীর দুই বিশিষ্ট নেতা আবদুল খালেক ও আবদুল মান্নান মুক্তিবাহিনীর হাতে ধরা পড়িয়াছে।
মুক্তিযুদ্ধ ॥ ১: ২৫ ॥ ২৬ ডিসেম্বর ১৯৭১
সূত্র : গণমাধ্যমে বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধ – খন্ড – ০৪