বৃহৎ শক্তিবর্গের কেউই বাঙলা দেশে পাকিস্তানী গণহত্যা বন্ধ করতে বলেনি
সম্প্রতি ভারতের প্রধানমন্ত্রী শ্রীমতি ইন্দিরা গান্ধী নয়াদিল্লীতে কংগ্রেস কর্মীদের এক সমাবেশে ভাষণদানকালে বলেন, কোনাে দেশ তিন চার হাজার মাইল দূর থেকে তাদের বর্ণগত শ্রেষ্ঠত্বের দাবীতে ভারতকে নির্দেশ দিয়ে কথামত চালাবে সে দিন অতীত হয়ে গেছে। তিনি বলেন, ভারতের অবস্থা এখন অনেক পরিবর্তিত, এখন ভারত নেটিভদের নিবাসভূমি নয়। জাতীয় স্বার্থে যা করা প্রয়ােজন আমরা তাই করবাে, তথাকথিত বৃহৎ শক্তিবর্গ যা আমদের দিয়ে করাতে চায় তা করবাে না। আমরা তাদের বন্ধুত্ব, সাহায্য এবং সহযােগিতার মূল্য দেই, কিন্তু তার মানে এই নয় যে তার বদলে আমরা আমাদের আঞ্চলিক অখন্ডত্ব এবং জাতীয় সার্বভৌমত্ব বিকিয়ে দেব। বৃটেন প্রসঙ্গে মন্তব্য করতে গিয়ে শ্রীমতী গান্ধী বলেন, ১৯৬৫ সালের পাক-ভারত সংঘর্ষে বৃটেন ভারতকে আক্রমণকারী বলে গণ্য করে ভুল করেছে। এখন তাঁদের ঘটনার গতিধারা অনুধাবন এবং বাঙলাদেশ নিয়ে সীমান্তের উদ্ভূত পরিস্থিতির যথার্থ মূল্যায়ন করা উচিত। তিনি বলেন, বৃটেনের কাছে আমার একমাত্র প্রত্যাশা এই যে বৃটেন যেন পরিস্থিতি নিরপেক্ষ এবং নির্মম ভাবে বিচার করে দেখেন। বাঙলা দেশের অভ্যন্তরে জাতিসঙ্ঘের পর্যবেক্ষক নিয়ােগ করার পাকিস্তানী প্রচেষ্টা সম্পর্কে তিনি বলেন, তার ফলে কোন উদ্দেশ্য সাধিত হবে বলে তিনি মনে করেন না। বহুসংখ্যক বিদেশী খ্যাতনামা ব্যক্তি, পরিষদ সদস্যবৃন্দ মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের সেনেটর বৃন্দ, ত্রাণ সংস্থাগুলাে, স্বাধীন প্রতিষ্ঠান সমূহ এবং নানা দেশের মন্ত্রীবর্গ পূর্ববাঙলা এবং পশ্চিম বাঙলায় সীমান্ত এলাকা পরিদর্শন করে দেখেছেন নিজের চোখে, কি পরিমাণ শরণার্থী এসেছেন। বাঙলাদেশের জনগণের উপর পাকিস্তানী সৈন্যের নৃশংস অত্যাচারের মুখে তারা চলে আসতে বাধ্য হয়েছেন।
তাঁরা এসব দেখেছেন, কিন্তু কি ফল হয়েছে? বাঙলাদেশ সমস্যার কি সমাধান হয়ে গেছে? বৃহৎ শক্তিবর্গের কেউ কি পাকিস্তানকে এইভাবে ব্যাপকহারে হত্যা করতে বারণ করেছে? না তারা তা করবে না।’ তিনি বলেন, বাঙলাদেশ সমস্যার একমাত্র সমাধান পাকিস্তানী সৈন্যদের পুরােপুরি বাঙলাদেশ ত্যাগ করা, যাতে করে যে লক্ষ লক্ষ শরণার্থী ঘর বাড়ী ছেড়ে চলে আসতে বাধ্য হয়েছেন, তারা নিরাপদে ফিরে যেতে পারেন এবং শান্তিপূর্ণ জীবন যাত্রা রচনা করতে পারেন। শ্রীমতী গান্ধী আরও বলেন, পূর্ব এবং পশ্চিম সীমান্ত থেকে পাকিস্তানী সৈন্য সরিয়ে না নেয়া পর্যন্ত উপমহাদেশের শান্তি ফিরে আসা সম্ভব নয়।’ তিনি আরাে বলেন, পাকিস্তান যখন ভারত সীমান্তে সেনা সমাবেশ করেছে তখন হতে বৃহৎ শক্তিবর্গ কিংবা জাতিসঙ্ টুশব্দটিও করেনি। কিন্তু যে সময় থেকে ভারত তার আঞ্চলিক নিরাপত্তা অক্ষুন্ন রাখার তাগিদে সেনাবাহিনী তলব করেছে, চারদিক থেকে রব উঠছে যে শান্তি বিঘ্নিত হচ্ছে।’ তিনি বলেন, এর কিছুই আমি বুঝিনা। একঘণ্টা ব্যাপী বক্তৃতায় শ্রীমতী গান্ধী বলেন, পাকিস্তান যে ভারত আক্রমণ করবে না এরকম কোনাে নিশ্চয়তা জাতিসঙ্ঘ দিতে পারে কি?
তিনি বলেন, যারা সৈন্য অপসারণ করতে বলেন, তাঁদের মনে রাখা উচিত পূর্ব এবং পশ্চিম সীমান্তে পাকিস্তান অতীতে তিনবার ভারত আক্রমণ করেছে, কিন্তু তারা একবারও পাকিস্তানের নিন্দা করেননি। তারা কিভাবে আশা করেন যে তাদেরকে বিশ্বাস করা যায়? তিনি বলেন, পাকিস্তানী সৈন্যের অগ্রঘাঁটিগুলােতে মােতায়েন করার দশদিন পর্যন্ত সময়ের মধ্যে পশ্চিম সীমান্তে ভারত কোনাে সৈন্য তলব করেনি। আমরা জাতিসঙ্ঘ পর্যবেক্ষকদের কাছে অভিযােগ করেছি এবং দাবী করেছি পাকিস্তানী সৈন্যদের অগ্রবর্তী অঞ্চলে আসতে দেয়া হবে না। বিশেষজ্ঞেরা অনুসন্ধান করে আমাদের জানিয়েছেন যে পাকিস্তানী সৈন্যরা শুধু সামরিক কুচকাওয়াজ করতে এসেছে দশদিনের জন্য, সে দশদিন কি এখনাে গত হয় নাই? একটা কিছু ঘটে পড়বার পরে তাদেরকে কিভাবে। বিশ্বাস করতে পারা যায়, আমি জানিনা। মুক্তিবাহিনীর গতিবিধি নিয়ন্ত্রণ করার উদ্দেশ্যে জাতিসঙ্ঘের পর্যবেক্ষক নিয়ােগের প্রশ্নে শ্রীমতী গান্ধী বলেন, তাঁরা ভুলে যান যে সমস্ত নিয়ন্ত্রণ এবং ঘাটি সত্বেও ভিয়েতনামের গারিলা কার্যকলাপ বন্ধ করা সম্ভব হয় নাই।
তিনি আরও বলেন, ভারতের বিরুদ্ধে একটা অভিযােগ হামেশাই শােনা যায় যে তার এলাকা থেকেই মুক্তি বাহিনীর কার্যকলাপ চালিয়ে যাচ্ছে। আমরা কিভাবে বাধা দিতে পারি? ভারত যদি তার। সমস্ত সেনাবাহিনীও নিয়ােগ করে, বাঙলাদেশের সঙ্গে তার সীমান্ত এত সুবিস্তৃত যে তাদের ঠেকিয়ে রাখা সম্ভবপর হবে না। ভারত প্রতিবেশীর ঘরােয়া ব্যাপারে হস্তক্ষেপ করেছে বলে যে অভিযােগ উঠেছে শ্রীমতী গান্ধী তাকে সম্পূর্ণ ভিত্তিহীন বলে উল্লেখ করেন। পাকিস্তান যখনই সুযােগ পেয়েছে অপরের ঘরােয়া ব্যাপারে হস্তক্ষেপ করেছে কিন্তু ভারত কখনও তেমন আচরণ করেনি, অথচ ভারতের নামে সে অপবাদ দেয়া হচ্ছে। যে যাই বলুক আমরা পরােয়া করিনা।
অভিযান ॥ ১ : ৩ | ১০ ডিসেম্বর ১৯৭১
সূত্র : গণমাধ্যমে বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধ – খন্ড – ০৪