You dont have javascript enabled! Please enable it!

যা পােড়ে তাই পুড়িয়ে দিচ্ছে

বাংলাদেশে জালেম ইয়াহিয়া ২৫শে মার্চ তারিখে বাঙালী জাতিকে নিচিহ্ন করার যে পরিকল্পনা নিয়েছিল এবং তাকে কার্যকর করবার জন্য সে ব্যাপক গণহত্যা চালিয়েছিল সেই অমানুষিক কাতারে’কাতারে মানুষ হত্যা আজ অবাধ চলেছে দখলীকৃত বাঙলাদেশের শহরে গ্রামে। এক্সপ্রেসেন’এর দুর প্রাচ্যের প্রতিনিধি মি: হারম্যান লিন্ডভিস এমনি এক ধ্বংসলীলার ঘটনা নিজ চোখে দেখে এসেছেন। ধ্বংসপ্রাপ্ত সেই অঞ্চলের মর্মভেদী বর্ণনা দিতে গিয়ে সাংবাদিক লিখেছেন। পাক সেনারা গ্রাম থেকে গ্রামান্তরে নিরীহ জনবসতির ওপর হামলা চালিয়ে যা কিছু পাচ্ছে তাই পুড়িয়ে দিচ্ছে। ইক্সপ্রেশনে প্রকাশিত বিদেশী সাংবাদিকের সরজমিনে দেখা এই অমানুষিকতার রিপাের্টটি নিম্নরূপ। ঢাকার পার্শ্ববর্তী বুড়িগঙ্গার উত্তরাঞ্চলে পাকফৌজ সম্প্রতি ব্যাপক হামলা চালায় ঐ হামলায় কত যে লােক প্রাণ হারিয়েছেন তার সংখ্যা নির্ণয় করা আমার পক্ষে অসম্ভব। এ অঞ্চলেরই একটি গ্রামের নাম কলামুড়ি। এ গ্রামে পাক বাহিনীরা একশ বাড়ী পুড়িয়ে দেয়, ৮০ জনকে হত্যা করে।

অনেক গুলাে মৃত দেহ তখনাে পথে প্রান্তরে পড়েছিলাে গ্রামবাসীরা আমাকে তা দেখাতে নিয়ে গেল। মৃত দেহগুলাে থেকে এত দুর্গন্ধ বেরােচ্ছে যে আমাকে মৃতদেহের আবরণ খুলতে নিষেধ করতে হলাে। একটা ডােবা। অপরিচ্ছন্ন, লতা পাতায় ঢাকা পড়ে আছে। তার ওপরে কিছু সাদাফুল। আমি কাছে। গিয়ে দেখলাম লতাপাতা আর ফুলের নীচে অন্তত: তিনশ মৃতদেহ শায়িত। স্থানীয় জনগণকে আমি জিজ্ঞেস করলাম পাকআর্মি কেন এমন করল? কেউ জানে না। কেউ উত্তর দিতে পারল না। একজন বললেন ‘এরা বাঙালীদের নিশ্চিহ্ন করতে চায়।’ আরেকজন বললেন এরা মনে করেছিল এখানে মুক্তিবাহিনী আছে।’ আমরা কিছুই জানিনে আল্লাহর কসম বিশ্বাস করুন আমরা কিছু জানিনে। আমিও এখানে কোন অস্ত্রশস্ত্র দেখলাম না প্রতিরােধের চিহ্নটুকু আমার চোখে পড়ল না।। ঐ গ্রামের একজন তরুণের সাথে আমার আলাপ হচ্ছিল। সে আমায় বলল বুধবার পাকসেনারা প্রথম আসে, সেটা হল পাঞ্জাব রেজিমেন্ট। ওরা ঘরে ঘরে তল্লাসী চালাল। সােনাদানা যা কিছু সম্বল ছিল ছিনিয়ে নিয়ে গেল বেদম মারধাের করল আমাদের। অনেককে মেরেই ফেলল। কাফু জারি করল ওরা রাইফেলের ফাকা আওয়াজ করতে লাগল আমরা ভয় পেয়ে পালানাের চেষ্টা করলাম তারা যারা পালাতে গেলে তাদের অনেককে হত্যা করা হলাে। পাক সেনারা অনেক বাড়ীর ওপর হাত বােমা ছুড়ে মারল। ফলে সেগুলাে দাউ করে জ্বলে পুড়ে গেল। সে রাত্রেই তারা চলে গেল।

অভিযান ॥ ১: ৩  ১০ ডিসেম্বর ১৯৭১

ফির মওকা নেহি মিলেগা

সাতক্ষীরা মহকুমা মুক্তিবাহিনীর প্রচন্ড আক্রমণের মুখে কালীগঞ্জ থানা এলাকায় তিনি শতাধিক পাকা বাংকার থেকে দখলদার পাক বাহিনীর পুরাে পল্টন অস্ত্রশস্ত্র ফেলে পালিয়ে চলে যাচ্ছে। পালাবার মুখে পঞ্চাশ ষাটজন সৈন্য স্থানীয় বাজারে ঢুকে লুটপাট আরম্ভ করল। বাজারটি অবশ্য আগেও তারা কয়েকবার লুট করেছে। এখন লুট করার মত অবশিষ্ট আর কিছু নেই বললেও চলে। তবু তারা ক্ষান্ত হলনা। হঠাৎ পেছন থেকে এসে তাদের সর্দার এই ব্যাপার দেখে চীৎকার করে উঠলাে, “কেয়া হােতা হ্যায়? আগে চলাে সব। কেউ তার হুকুমে কান দিলাে না। শুধু একজন ডাকু তার দিকে কয়েক প্যাকেট সিগারেট এগিয়ে দিয়ে বললাে, ‘লিজে সাহাব ফির মওকা নেহি মিলেগা।’ ছুটতে ছুটতে গ্রামের বাইরে আসবার মুখে থমকে দাঁড়িয়ে গেলাে সেই সরদার। রাস্তা থেকে কিছু দূরে প্রায় ভাঙ্গা একটা চালাঘর। চল্লিশােৰ্তীণ এক ভিখারিণী থাকে ওই ঘরটায়। ঘরের বাইরে “কিউ” দিয়ে দাড়িয়ে আছে চার-পাঁচজন পাক সৈন্য। সর্দার চীৎকার করে উঠলাে ‘কেয়া হােতা হ্যায় উধার? আগে চলাে।’ কেউ তার কথায় কান দিলােনা। কিন্তু সেই মুহূর্তে প্যান্টের বােতাম লাগাতে লাগাতে আর একজন ডাকু বেরিয়ে এলাে চালা ঘরের ভেতর থেকে। মােলায়েম কণ্ঠে সরদারকে বললাে, ‘আইয়ে সাহাব, ফির মওকা নেহি মিলেগা।’ তখুনি মুক্তিবাহিনীর একটা মর্টার এসে পড়ল সেখানে। ফেটে গেলাে চোখের পলক ফেলবার আগেই বারুদের ধোয়া কেটে গেলে দেখা গেলাে অনাহারে শীর্ণ আধা উলঙ্গ এক বুড়ী থেতলে যাওয়া পাক ডাকুদের মুখে ক্রমাগত ঝাড়ুর বাড়ি মারছে আর বলছে, “ফির মওকা নেই মিলেগা।’

অভিযান ॥ ১: ৩ ॥ ১০ ডিসেম্বর ১৯৭১

সূত্র : গণমাধ্যমে বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধ – খন্ড – ০৪

error: Alert: Due to Copyright Issues the Content is protected !!