You dont have javascript enabled! Please enable it!

একটি সাক্ষাৎকার

(নিজস্ব প্রতিনিধি) পাক হানাদার বাহিনী নবাবগঞ্জ থেকে ঢাকা যাওয়ার পথে খারশুলের শ্রী হীরালালকে ধরে নিয়ে যায়। এবং জোরপূর্বক দু’দিন আটক রাখে ও নির্যাতন চালায়। আমাদের নিজস্ব প্রতিনিধি তার সঙ্গে এক সাক্ষাৎকারে মিলিত হন। উক্ত প্রত্যক্ষদর্শীর বিবরণ থেকে জানা গেছে যে, গত ২৫শে নভেম্বর ঐ ব্যক্তি জমিতে কাজ করছিল। হানাদার বাহিনী যখন খারশুলে পৌছে তখন গুলির আওয়াজ পেয়ে সে নিরাপদ স্থানে আশ্রয় নেয়। কিন্তু দুর্ভাগ্যবশত: বর্বর বাহিনী কর্তৃক ধৃত হয়। জিজ্ঞাসাবাদের পর তার উপর অমানুষিক অত্যাচার চালানাে হয়, এমনকি তিন তিনবার তাকে গুলি করার প্রস্তুতি নেয়। অবশেষে তার মাথায় দুই পেটি বুলেট চাপিয়ে গােয়ালখালী নিয়ে যায়। ঐ দিন রাত্রে পাকবাহিনী গােয়ালখালী অবস্থান করার চেষ্টা করে, কিন্তু প্রচন্ড আক্রমণে তারা গােয়ালখালী থেকে পালিয়ে যেতে বাধ্য হয়। হানাদার বাহিনী ফুলার পৌছুলে মুক্তিবাহিনী তিনদিক থেকে আক্রমণ চালায়। যুদ্ধ চলাকালীন হানাদার বাহিনী বেল, বেগুন ও সীম বােঝাই একটি নৌকা আটক করে এবং পশুর মত ঐ সব কাচা তরকারী ভক্ষণ করে। বর্বর বাহিনীর উচ্চপদস্থ অফিসার নৌকায় উঠলে মুক্তিবাহিনী তাকে লক্ষ্য করে গুলি চালায় এবং সঙ্গে সঙ্গে উক্ত অফিসার নদীর পানিতে পড়ে যায়। পশুর দল তাকে পানি থেকে টেনে তুলে নদীর তীরে নিয়ে আসে ও কেটে টুকরাে টুকরাে করে ধলেশ্বরী নদীর কাটার নীচে গুজে রাখে। প্রত্যক্ষদর্শীর বিবরণে আরাে জানা গেছে যে, ৪ জন পাক সেনা মুক্তিবাহিনীর গুলিতে মারাত্মকভাবে আহত হয়। অবশেষে হীরালাল হানাদার বাহিনীর কবল থেকে পালিয়ে আসতে সক্ষম।

 বাংলাদেশ (৪) ॥ ১ : ৬ ॥ ৩ ডিসেম্বর ১৯৭১

বিধির বিশ্ব শােনাে!  পাকিস্তানী জল্লাদরা হিটলারের বন্দী শিবিরের নৃশংসতাকেও হার মানিয়েছে।

মায়েদের বােনেদের প্রতি এই বর্বরতা

বাঙালীরা কখনাে ক্ষমা করবে না বাংলাদেশের অধিকৃত এলাকায় হানাদার নেকড়ে বাহিনী মুক্তিফৌজের বেপরােয়া মারের প্রতিশােধ গ্রহণের জন্য শতাধিক বন্দী নিবাসে লক্ষাধিক নরনারীর ওপর অকল্পনীয় বীভৎস নির্যাতন চালাচ্ছে। হিটলারের নাৎসী বন্দী শিবিরও এর তুলনায় অনেক মানবিক ছিল বলে প্রত্যক্ষদর্শীর বিবরণে প্রকাশ।  বন্দী শিবিরে নির্বিচারে বাঙ্গালী নারী, পুরুষ ও শিশুদের ধরে এনে আটকে রেখে অবর্ণনীয় নিৰ্যাতন চালানাে হচ্ছে। এই নিরপরাধ বাঙ্গালীদের পাকড়াও করে নির্যাতন চালানাের ব্যাপারে সেনাবাহিনীকে রাজাকার ছাড়াও বাংলাদেশের উর্দুভাষী মুসলমানরা মদত দিচ্ছে। আগা খানীরা পূর্বে গােপনে হানাদার পশু বাহিনীকে মদত দিতাে। বর্তমানে তারা বাঙ্গালী নিধন যজ্ঞে সেনাবাহিনীর সাথে প্রকাশ্যে কাজ করছে।  এই বন্দী শিবিরগুলিতে বন্দীদের সারা দিনে দু’খানি আটার রুটি এবং কিছু ডাল আহাৰ্য্য হিসেবে দেওয়া হয়। চারদিকে কাটা তারের বেড়া দিয়ে ঘেরা যায়গায় শুতে হয় এবং মাথার ওপর সামান্যতম আচ্ছাদনেরও ব্যবস্থা নেই। প্রত্যহ তাদের দিয়ে পায়খানা ও নর্দমা পরিষ্কার করা, মাটী কাটা, মাটী বহন করা ইত্যাদি কঠোর পরিশ্রমের কাজ করানাে হয়। কাজ করতে অক্ষম হলে তাদের নির্দয়ভাবে প্রহার করা হয়।

এ ছাড়াও বন্দীদের ওপর মধ্যযুগীয় পন্থায় নির্যাতন চালানাে হয়। বন্দীদের হাত পা বেঁধে টাঙ্গিয়ে পিটানাে, আঙ্গুলে সূচ ফোটানাে, নখ উপড়ে ফেলা, পায়ে ঠুকে ঠুকে পেরেক গেঁথে দেওয়া, ব্লেড দিয়ে কেটে চামড়া টেনে উল্টে দেওয়া, যৌনাঙ্গে বিদ্যুৎ প্রবাহ দিয়ে ও গুহ্যদ্বারে শলাকা বিদ্ধ করে যন্ত্রণা দেওয়া, উলঙ্গ করে বরফে বসিয়ে রাখা, পানির গামলায় মাথা ডুবিয়ে দিয়ে পানিতে বিদ্যুৎ প্রবাহিত করে দেওয়া, মাংস কেটে ক্ষত স্থানে জ্বলন্ত দেশলাই কাঠি বা লাইটার চেপে ধরা এবং দিনের পর দিন বন্দীদের ঘুমােতে না দেওয়া।  বাংলাদেশের অধিকৃত এলাকা থেকে প্রাপ্ত খবরে প্রকাশ, হিংস্র নেকড়ে বাহিনী বহু ক্ষেত্রে অন্যদের ভয় দেখাবার জন্য বন্দীদের জীবন্ত কবর দেওয়া বা তাদের অর্দ্ধ প্রােথিত করে পাথরের আঘাতে তাদের খুন করার পদ্ধতি অবলম্বন করেছে। মেয়েদের দিয়েও সব ধরনের কঠোর শ্রমের কাজ করানাে ছাড়াও তাদের যে কোন সময়ে হানাদার সৈন্যদের লালসা চরিতার্থ করতে বাধ্য করা হয়।

এই দুঃসহ অত্যাচারে অতিষ্ট হয়ে কয়েকজন বন্দিনী গলায় শাড়ীর ফাস জড়িয়ে আত্মহত্যার চেষ্টা করেছিলেন। এ সমস্ত বন্দী শিবির নরপশু ইয়াহিয়া বাহিনীর সৈন্যদের ঘাটীগুলির কাছেই করা হয়েছে। গত ১৪ ও ১৫ তারিখে তীব্র লড়াইয়ের পর বাঙলাদেশের মুক্তিবাহিনী রংপুরের ভুরুঙ্গামারী শহর দখল করার পর এমনি একটি বন্দী শিবির আবিষ্কার করেন। এটি সেখানকার পাক ফৌজের কম্যাডিং অফিসারের বাসভবনে অবস্থিত ছিল। একটি বন্ধ ঘর থেকে আর্ত চীৎকার শুনে মুক্তি সেনারা সেই ঘরের দরজা ভেঙ্গে ২৫ জন অর্ধনগ্ন, অর্ধাহার ক্লিষ্ট বিভিন্ন বয়সের মেয়েকে উদ্ধার করেন। এর মধ্যে ১০-১১ বছর থেকে ৫০ বছর বয়সের মেয়েরা পর্যন্ত ছিলেন। ঐ বাড়ি থেকে প্রায় হাজার গজ দূরে একটি স্কুলে শিশু ও বৃদ্ধ পুরুষদের বন্দীদশা থেকে মুক্তি সেনারা উদ্ধার করেন। এখানে একজন বন্দিনী হলেন আবদুল লতিফের স্ত্রী ধর্মপ্রাণ লতিফ তার স্ত্রীকে সেনাবাহিনীর লালসা চরিতার্থ করার জন্য ছেড়ে দিতে রাজী না হওয়ায় পাকিস্তানীরা তাকে হত্যা করে এবং তার স্ত্রীকে জোর করে পাকিস্তানী ক্যাপ্টেন আতাউল্লার ঘরে নিয়ে যাওয়া হয়।

মায়ের সামনেই একটি সন্তানকে বেয়নেট দিয়ে হত্যা করে ও অপর দুই সন্তানকে জোর করে মায়ের কাছ থেকে সরিয়ে নিয়ে যাওয়া হয়। এর পর পাঁচ মাস ঐ মহিলাকে নারীর চরম লাঞ্ছনা ভােগ করতে হয়েছে। ভুরুঙ্গামারী মুক্ত হবার পর মা তার সর্ব কনিষ্ঠ সন্তানটির সঙ্গে পুনর্মিলিত হয়েছেন, কিন্তু অপর সন্তানের এখনাে কোনও খোঁজ পাওয়া যায় নি। ভুরুঙ্গামারী মুক্ত হবার কয়েকদিন আগে পাকিস্তানীরা পরাশর গ্রাম থেকে ১১ বছরের অপাপবিদ্ধ মেয়ে জামিলা খাতুন আর তার মাকে ধরে নিয়ে আসে। মুক্তিবাহিনী এসে পড়ার ফলে দু’ দিনের বেশি তাদের চরম লাঞ্ছনা ভােগ করতে হয়নি, এটাই বােধ হয় একমাত্র সান্ত্বনী। ৪০ বছরের অন্তসত্বা আমিনা খাতুন পাকসৈন্যের লালসা চরিতার্থ করতে বাধা দিলে বর্বর সৈন্যরা তার পেটে লাথি মারে। ফলে আমি একটি মৃত সন্তানের জন্ম দেয়। কিন্তু তার পরদিনই তিনি একাধিক সৈন্য দ্বারা ধর্ষিতা হন। স্কুল বাড়িতে বন্দী অন্যতম পুরুষ এবারুদ্দীন মন্ডল তাঁর স্ত্রীকে সৈন্যদের হাতে তুলে দিতে অস্বীকার করলে বেয়নেট দিয়ে তার পা এফোঁড় ওফোড় করে দেওয়া হয়। সৌভাগ্যবশত: জনাব মন্ডলের স্ত্রী পালিয়ে গিয়ে আত্মরক্ষা করতে সমর্থ হয়েছেন।

জয়বাংলা (১) ॥ ১ : ৩০ ॥ ৩ ডিসেম্বর ১৯৭১

সূত্র : গণমাধ্যমে বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধ – খন্ড – ০৪

error: Alert: Due to Copyright Issues the Content is protected !!