You dont have javascript enabled! Please enable it!

লক্ষ লক্ষ মানুষের ট্রাজেডি (প্রাভদায় প্রকাশিত)। অগণিত মানুষের অন্তহীন এক বিষন্ন মৌন মিছিল,খালি পায়ের নীচে কাদাভাঙ্গার শব্দ শুধু শােনা যায় শিশু, অসুস্থ বৃদ্ধ এবং বে-দম হয়ে পড়া মানুষগুলাে যারা হাঁটতে পারছে তাদের কাঁধে ভর দিয়ে কোনমতে পা টেনে টেনে চলছে। কম্বলের চটের ফেঁসাে দিয়ে মাথা জড়িয়ে বৃষ্টিকে আড়াল দিয়ে তারা চলছে। কারাে হাতে ঝুলছে হাঁড়ি-কড়াই রান্নার বাসনপত্র। কখনাে কোন শিশুর কান্নায় মেীন মিছিলের নিস্তব্ধতা ভেঙ্গে খান খান হয়ে। তাদের অনেকেরই পায়ে ফোস্কার দাগ রক্ত ঝরছে ফেটে  অসুস্থদের মধ্যে অনেকেই কলেরা আক্রান্ত। পথ চলতি যাদের জীবন-দীপ নিভে যাচ্ছে তাদের দাহ বা সমাহিত করার কেউ নেই। শুধু নতুন খাদ্যের আশায় শকুন আর কাকেরা মিছিলের মাথার উপরে পাক খেয়ে চলেছে। রাস্তার পাশে গলিত মৃতদেহগুলির কাছে এসে মানুষেরা ক্ষণিকের তরে থমকে দাঁড়ায়। তারপর নাকে কাপড় চাপা দিয়ে পার হয়ে আসে। দিনে রাতে অসংখ্য মানুষের এই অন্তহীন মিছিলের শেষ নেই।  পূর্ব পাকিস্তান আর ভারতের সীমান্তে “টাইমের” সংবাদদাতা যা দেখেছেন উপরে তারই বর্ণনা দেওয়া হলাে। ঐ মিছিলের যে অসংখ্য মানুষের কথা তিনি লিখেছেন তারা পূর্ব পাকিস্তান থেকে আসা শরণার্থী।

কয়েকমাস হলাে দিনের পর দিন লক্ষ লক্ষ মানুষ ভারতে চলে আসছে। পনের দিন আগের হিসেব হলাে ৮৫ লক্ষ শরণার্থী ইতিমধ্যে ভারতে প্রবেশ করেছে। বর্তমানে এই সংখ্যা ৯০ লক্ষ ছাড়িয়ে গেছে।  এদের বেশিরভাগ প্রায় ৭০ লক্ষ শরণার্থী পশ্চিমবঙ্গে এবং প্রায় ১৫ লক্ষ ভারতের পূর্ব সীমান্ত ত্রিপুরায় রয়েছে। বাকিরা রয়েছে আসাম, বিহার ও মেঘালয়ে ছড়িয়ে। ভারতের সংবাদপত্রগুলির তথ্য অনুযায়ী পূর্ব পাকিস্তানের শরণার্থীদের জন্য কমবেশি প্রায় দুশাে শিবির স্থাপিত হয়েছে। শিবিরগুলিতে অত্যন্ত গুরুতর পরিস্থিতির সৃষ্টি হয়েছে। ঘিঞ্জি শিবির, চিকিৎসকদের সংখ্যাল্পতা, পয়ঃপ্রণালীর অব্যবস্থা এবং খাদ্য সঙ্কট থেকে প্রায় মহামারীর অবস্থার সৃষ্টি হয়েছে মৃত্যুও হয়েছে। অনেকের। যারা শিবিরে রয়েছে বর্ষাকাল তাদের কাছে অভিশাপ হয়ে দেখা দিয়েছে। মৌসুমী বৃষ্টি বহু শরণার্থী শিবিরে কর্দমাক্ত হ্রদে পরিণত হয়েছে বলে “টাইম”-এর সংবাদদাতা লিখেছেন। “ফিগারাে”-এর সংবাদদাতা কৃষ্ণনগরের অদূরবর্তী একটি শরণার্থী শিবিরের বর্ণনা দিয়েছেন।

সবাই জানেন যে, মানবিক চেতনা থেকে সােভিয়েত সরকার ভয়াবহ পরিস্থিতির সম্মুখীন পূর্ব পাকিস্তানের লক্ষ লক্ষ শরণার্থীদের জন্য খাদ্য সরবরাহ করেছে এবং এই সরবরাহ চলতে থাকবে। সম্প্রতি সােভিয়েত জাহাজ ভূলাদিভষ্টক থেকে শরণার্থীদের জন্য চালের নতুন সরবরাহ নিয়ে কলকাতা বন্দরে পৌঁছেছে। ভারতীয় সংবাদপত্র “প্যাট্রিয়ট” জানিয়েছে, গত ২ অক্টোবর কলকাতায় ভারতীয় রেডক্রশের প্রতিনিধিদের কাছে সােভিয়েতের পাঠানাে ঐ খাদ্য হস্তান্তরিত করা হয়েছে। চাল, চিনি এবং কাপড়-চোপড় শরণার্থীদের বিলি করা হবে। পােলিও রােগ প্রতিষেধক ইঞ্জেকশনের ওষুধও সােভিয়েত থেকে পাঠানাে হয়েছে। শরণার্থীদের দুর্দশা মােচনের জন্য ভারত সরকার অনেকগুলি ব্যবস্থা নিয়েছেন। বর্তমান আর্থিক বৎসরে শরণার্থীদের জন্য এক’শ কোটিরও বেশী অর্থ বরাদ্দ করা হয়েছে। কিন্তু শরণার্থী আগমণের বর্তমান হার বজায় থাকলে (দৈনিক যা প্রায় ৩০ হাজার) আগামী ৬ মাসে প্রায় চার’শ কোটি টাকার দরকার হবে বলে ভারত সরকারের তথ্য এবং প্রেস ব্যুরাে জানিয়েছে।

পূর্ব পাকিস্তান থেকে আগত লক্ষ লক্ষ শরণার্থী প্রকৃতই ট্রাজেডির মধ্যে জীবন ধারণ করছেন। এই মানুষগুলির দুর্ভাগ্যে বিশ্বের প্রগতিশীল জনগণ উদ্বিগ্ন। বিভিন্ন দেশের সংবাদপত্রগুলি প্রকৃতই বলেছে যে, পূর্ব পাকিস্তান থেকে ভারতের দিকে এই জনস্রোতের মূল কারণ হলাে তাদের নিজেদের দেশে অসহনীয় অবস্থা। লক্ষ লক্ষ মানুষ যে কারণে ঘরবাড়ি আর সম্পত্তি ছেড়ে প্রতিবেশী রাষ্ট্রে আশ্রয় নিতে বাধ্য হয়েছেন পাক কর্তৃপক্ষের সেই ব্যবস্থার বিরুদ্ধে সর্বত্রই ঘৃণার সঞ্চার করেছে। এই ধরণের কাজের কোন যুক্তি থাকতে পারে না। লক্ষ লক্ষ নিরাপরাধ মানুষ যে দুর্দশা বােধ করছেন পৃথিবীর মানুষ তার থেকে উদাসীন থাকতে পারে না। তারা পাকিস্তানী কর্তৃপক্ষের কাছে আশা করে যে, শরণার্থীদের গৃহে প্রত্যাবর্তনের এবং শান্তিপূর্ণ ও নিরুপদ্রব জীবন ধারণের জন্য অনতিবিলম্বে ব্যবস্থা নেওয়া হােক। স্থানাভাবে এখানে রাজ্য সরকারের একটি “ডেয়ারী ফার্মেই ৬৪ হাজার মানুষ আশ্রয় নিয়েছে। ফার্মের বাঁধানাে মেঝেতে গরুর গােবরের মধ্যেই এক একটি ছাদের তলায় ৫ হাজার করে মানুষ বসবাস করছে। ফার্মের সুপারিণটেন্ডেন্ট, একজন অবসরপ্রাপ্ত অফিসার শ্রীবারওয়া জানান যে, প্রতিদিন ২০ জন করে লােকের কলেরায় মৃত্যু ঘটছে। এখানে ভাল ওষুধ পত্র এবং কম্বলের অভাব । শিবিরে সব মিলিয়ে ডাক্তার মাত্র তিনজন।” “টাইমস” লিখেছে, কিন্তু শিবিরে এই দুঃখ-দুর্দশা সত্ত্বেও শরণার্থীরা যেখান থেকে পালিয়ে এসেছেন তা আরও ভয়াবহ। কারণ, শরণার্থীদের প্রত্যেকের মনে পাক সৈন্যদের ভয়ঙ্কর হত্যালীলা, হিংস্রতা আর নিষ্ঠুরতার কথা দগদগে হয়ে আছে।  ভারতীয় সংবাদপত্র “হিন্দুস্তান টাইমস”-এ বলা হয়েছে যে কেবল হিন্দুরাই নয়, পাক সেনাদের সমধর্মী মুসলমানরাও বর্বর অত্যাচারের সম্মুখীন হয়েছে।

স্বদেশ ॥ ১ : ৪ 

২১ অক্টোবর ১৯৭১

সূত্র : গণমাধ্যমে বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধ – খন্ড – ০৪

error: Alert: Due to Copyright Issues the Content is protected !!