শেখ মুজিবর রহমানকে বিষ প্রয়ােগে হত্যার চেষ্টা মুজিবনগর, ১৮ই আগস্ট
এখানে বঙ্গবন্ধুর প্রতি শ্রদ্ধাশীল এবং বাঙ্গালীর স্বাধীনতা আন্দোলনের প্রতি ন্যায় বিচারের পক্ষপাতী এমন একজন পশ্চিম পাকিস্তানী সেনানীর কাছ থেকে জানা যায় লায়ালপুরের ভয়াবহ কারাগারের মধ্যে শেখ মুজিবর রহমানকে বিষ প্রয়ােগে হত্যার চেষ্টা করা হয়। ঘােষণায় প্রকাশ, শেখ মুজিবরকে দেশদ্রোহী হিসেবে জঙ্গী শাসকের গােপন আদালত কক্ষে হাজির হবার জন্যে একখানি লিখিত সমন হাজির করে তাতে সহি করতে বলা হয় কিন্তু মুজিব তাতে অস্বীকৃতি জানান। দ্বিতীয় আর একখানি কাগজে তাকে তার আত্মপক্ষ সমর্থনের জন্যে নাম সহি করে দিতে বলা হয়। কিন্তু শেখ সাহেব দৃঢ় প্রতিবাদ জানিয়ে ইয়াহিয়া খানের প্রেরিত সৈনিকের দিকে কাগজখানি ছুঁড়ে দেন। এর পরেই জেলখানার মধ্যে এক কঠিন অবস্থার সৃষ্টি হয়। ডাক্তারের আসা যাওয়া বেড়ে যায়, এক ঘন্টার মধ্যে তিনবার ডাক্তার এসে বাংলাদেশের নেতাকে জিজ্ঞাসা করেছে— “আপনি কেমন বােধ করছেন?” মুজিব হেসে জবাব দিয়েছেন “ভালাে”। এরপরেই ঘটনার কথা ফাস হয়ে পড়ে এবং কারাগারে মুজিবের বিশেষ রক্ষী হিসেবে কর্নেল জুম্মান আবাদির ডাক পড়ে। এবং পরে জুম্মানকে গুলি করে হত্যা করা হয়। কিন্তু কেন? কারণ মুজিবের খাবার এবং পানীয় জলের খাদ্যে বিষ মিশিয়ে দেবার দায়িত্ব ছিল তার; কিন্তু এই মহান সৈনিক বাংলাদেশের এই মহান নেতাকে কাপুরুষের মতাে হত্যা করে সৈনিকের অমর্যাদা করতে চান নি। কিন্তু নরাধম ইয়াহিয়া কর্ণেল জুম্মনকে বেশিক্ষণ বাঁচতে দেয়নি।
বিপ্লবী বাংলাদেশ # ১: ৩ ॥ ২৯ আগস্ট ১৯৭১
সিলেটে পাক বাহিনীর অত্যাচার
(নিজস্ব বার্তা পরিবেশক) সিলেট জেলার হবিগঞ্জ ও সুনামগঞ্জ মহকুমার বানিয়াচঙ, নবিগঞ্জ, আজমিরিগঞ্জ ও শাল্লা—এই চারটি থানায় ব্যাপক এলাকা জুড়িয়া পাক হানাদার বাহিনী নির্বিচার গণহত্যা, লুণ্ঠন, অগ্নিসংযােগ, নারী নির্যাতন প্রভৃতি নৃশংস অত্যাচার শুরু করিয়াছে। স্থানীয় জনসাধারণ ও মুক্তিযােদ্ধাদের প্রবল প্রতিরােধের দরুন উল্লিখিত এলাকার বহু জায়গায়ই পাক দস্যুরা এতদিন প্রবেশ করিতে পারে নাই।। আমাদের প্রতিনিধির প্রেরিত খবরে জানা যায়, ভৈরব বাজার হইতে গানবােটযােগে পাক হানাদাররা আজমিরিগঞ্জে যায় এবং পরে সেখান হইতে আশপাশের এলাকায় ছড়াইয়া পড়ে। পাক হানাদার বাহিনী এই এলাকায় উন্মত্ত নৃশংসতা লইয়া ঝাপাইয়া পড়িয়াছে। একমাত্র মাখালকান্দি গ্রামেই পাঁচ শত নরনারী ইয়াহিয়ার বর্বর বাহিনীর হাতে নিহত হইয়াছে। পাক বাহিনীর নৃশংস আক্রমণের ফলে প্রায় এক দেড় লক্ষ নরনারী-শিশু মেঘালয় সীমান্তের উদ্দেশে রওয়ানা হইয়াছেন বলিয়া এক সপ্তাহ পূর্বে প্রাপ্ত খবরে জানা যায়। পাক সেনাদের হাত হইতে যাহারা রেহাই পাইয়াছিল তাহাদের অনেকে এখন খাদ্যাভাব ও কলেরা মহামারীতে মৃত্যু বরণ। করিতেছেন। আরও বহু লােক নিরাপদ আশ্রয়ের সন্ধানে বাড়িঘর ছাড়িয়া ইহার পার্শ্ববর্তী সুনামগঞ্জের মুক্তাঞ্চলে চলিয়া গিয়াছেন।
সুনামগঞ্জ , সিলেট জেলার সুনামগঞ্জ মহকুমা হইতে প্রাপ্ত এক খবরে জানা গিয়াছে যে, এই মহকুমার বিস্তীর্ণ এলাকায় মুক্তিবাহিনী উহার সুদৃঢ় কর্তৃত্ব প্রতিষ্ঠিত করিয়াছে। জামালগঞ্জ (সাচনা) হইতে পাক বাহিনীকে সম্পূর্ণরূপে পরাভূত ও বিতাড়িত করা হইয়াছে। জগন্নাথপুর থানা পূর্বে শত্রুবাহিনীর দখলে ছিল। এখন উহাকে সম্পূর্ণভাবে মুক্তিফৌজের কর্তৃত্বাধীনে আনা হইয়াছে। উক্ত থানার দারােগা পুলিশকে গ্রেপ্তার করা হইয়াছে। আজমিরিগঞ্জে শত্রুর সহিত মুক্তিবাহিনীর মােকাবিলা হয় এবং শত্রুবাহিনীর বিপুল ক্ষয়ক্ষতি সাধন করা হয়। বাংলাদেশে উৎপীড়ন বন্ধে সােভিয়েট আফ্রো-এশিয় কমিটির আহবান মস্কো, ৩রা অক্টোবর— টাস জানাচ্ছেন, সােভিয়েট আফ্রো-এশিয় সংহতি কমিটি বঙ্গবন্ধু মুজিবরের ওপর বিচারের প্রহসন, পূর্ববঙ্গের প্রগতিশীল রাজনৈতিক নেতাদের ওপর নির্যাতন এবং শান্তিপ্রিয় অধিবাসীদের ওপর উৎপীড়নের অবসান দাবি করেছে। কমিটি শরনার্থীদের স্বদেশ প্রত্যাবর্তনের শর্তের ব্যবস্থা, তাদের পূর্ণ নিরাপত্তা এবং শান্তিপূর্ণ জীবন। ও কর্মের সম্ভাবনার গ্যারান্টি ও দাবী করেছে। কমিটি আজ একটি বিবৃতি প্রচার করে পাকিস্তান সরকারকে বিশ্ব জনমতের প্রতি কর্ণপাত এবং পূর্ববঙ্গের অধিবাসীদের ইচ্ছা, অধিকার ও আকাঙ্ক্ষা পূরণের অনুরােধ করা হয়েছে। কমিটি উহার বিবৃতিতে জোর দিয়ে বলেছে যে, ঔপনিবেশিক জোয়াল দূরে ছুড়ে ফেলে যারা উন্নত জীবনযাত্রার জন্য, শান্তি ও প্রগতির জন্য সংগ্রাম করেছেন, সােভিয়েটের জনগণ সর্বদা তাঁদেরই অনুগত। ও সুহৃদ আছেন ও থাকবেন।
বাংলাদেশ (১) ! ১: ॥ ৪ সেপ্টেম্বর ১৯৭১।
সূত্র : গণমাধ্যমে বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধ – খন্ড – ০৪