You dont have javascript enabled! Please enable it! 1971.06.25 | মুক্তিযুদ্ধকালীন করাচীতে বাঙ্গালীদের জীবন - সংগ্রামের নোটবুক

The Bangali people living in Karachi had been suffering a lot during the course of the liberation war of Bangladesh, specially in Manghopir, Abyssinia colony and some federal areas where most of the Bangali labourers lived.

করাচীতে বাঙ্গালীদের জীবন

সম্প্রতি করাচীর প্রভাবশালী জঙ্গ পত্রিকা মারফৎ জানা গেছে করাচীতে বাঙালীদের একটি বিশেষ স্থানে অন্তরীণ করে রাখা হচ্ছে। অত্যাচার আর অবিচারের নমুনা হিসেবে ‘জঙ্গ’ পত্রিকাটি এই খবর পেয়েছেন। ইয়াহিয়ার হিংস্র হায়েনারা যে কেবল বাংলাদেশে বিভীষিকা ও অরাজকতার সৃষ্টি করেছে তা নয় তাদের ভয়ে পশ্চিম পাকিস্তানে বসবাসকারী বাঙালীদের জীবন আর নিরাপদ নয়। বাঙালীরা সন্ধ্যার পর রাস্তায় বেরােয়না। সামরিক সরকারের নির্দেশে বহু বাঙালী শ্রমিককে হত্যা করা হয়েছে করাচীতে। সুপরিকল্পিত উপায়ে ঠাণ্ডা মাথায় পৃথিবীর বুক থেকে বাঙালীদের নিশ্চিহ্ন করার যে পন্থা ইয়াহিয়াকে গ্রহণ করেছে তা বিশ্বের সভ্য দেশগুলােকে করেছে ক্ষুব্ধ ও বেদনাহত। তাই তারা এক বাক্যে সবাই বলছেন-বন্ধ করাে এই নরমেধ যজ্ঞ। বাঙালীর আত্মনিয়ন্ত্রণের অধিকার থাকবে বাঙালীদের হাতে। কথায় আছে “পিপীলিকার পাখা উঠে মরিবার তরে।” ইয়াহিয়া ও তার সাঙ্গোপাঙ্গো বড়াে বড়াে গোফ এবং ঊড়িওয়ালা জেনারেলরা আকাশে উড়ছেন ধ্বংস তাঁদের অনিবার্য। যাক এখন আসল কথায় আসা যাক। সেদিন আমাদের অফিসে এসেছিলেন এক তরুণ। তিনি দিন দশেক আগে করাচী থেকে ঢাকায় আসেন। গত কয়েকদিন আগে তিনি মুজিবনগরে এসে পৌঁছেছেন। তিনি বর্ণনা করছিলেন করাচীর অবস্থা। অনেকক্ষণ ধরে আলাপ করলেন। কথায় কথায় বললেন “বুঝলেন গত ছ’বছর ধরে করাচীতে আছি। আজ ইনসিকিউরড় মনে হয়েছে। তাইতাে পালিয়ে এলাম।” 

তার নিজের জবানিতে সব ঘটনা শােনা যাক। করাচী ছেড়ে আমার পালিয়ে আসার কারণ হলাে আমি শুধু বাঙালী নই আমি করাচী ছাত্রলীগ শাখার সাধারণ সম্পাদক ও বাংলাদেশ সমাজ কল্যাণ সমিতির প্রতিষ্ঠাতা সেক্রেটারী। পড়াশুনা করতাম করাচীর মেরিন একাডেমীতে। পঁচিশে মার্চের কয়েকদিন পর বাসায় চিঠি পাঠালাে সামরিক কর্তৃপক্ষ। তােমাকে আমাদের সাথে দেখা করতে হবে। এই হচ্ছে চিঠির নির্দেশ। কয়েকজন বাঙালী বন্ধুকে বললাম এখন কি করা যায়। সবাই বললাে তুমি পালিয়ে যাও। কোথাও গিয়ে লুকিয়ে থাকো। দেখা করতে গেলেই গুলী করে মেরে ফেলবে। সবাই আমাকে পরামর্শ দিলাে আমি যেনাে পারলে ঢাকা চলে যাই। বন্ধুদের পরামর্শ মতাে বাসা ছেড়ে পালিয়ে আত্মগােপন করে রইলাম। একাডেমিতে যাওয়াও আমার বন্ধ হয়ে গেলাে। দিনের আলাে থাকতেই শহরের এদিক ওদিক ঘােরাফেরা করে অন্যের বাসায় থাকতাম। ছাব্বিশে মার্চ থেকে পনেরােই মে পর্যন্ত এই যে কদিন আমি করাচীতে ছিলাম তা আমার কাছে এক দুঃস্বপ্ন। সতেরােই এপ্রিল সামরিক সরকারের নির্দেশে সমগ্র গুণ্ডাবাহিনী আক্রমণ চালালাে লাভী, মাঙ্গোপীর, ফেডারেল এরিয়া, মূসা কলেপানী ও আবিসিনিয়া কলােনী প্রভৃতি অঞ্চলে। এই সমস্ত এলাকায় থাকে বাঙালী শ্রমিকরা।

রাতের অন্ধকারে ঘুমন্ত নিরীহ শ্রমিকদের ওপর ঝাঁপিয়ে পড়লাে ইয়াহিয়ার গুণ্ডা বাহিনী। হত্যা করলাে তারা প্রায় কয়েক হাজার শ্রমিককে। এই ঘটনার পর বাঙালীরা রাত বিরােতে ঘােরাফেরা বন্ধ করে দিতে বাধ্য হয়। রাতের বেলা রাস্তায় কোন বাঙালীকে একা পেলেই গুণ্ডারা ছােরা চালাচ্ছে। মানে এক কথায় কি বিভীষিকার মধ্যে যে বাঙালীরা দিন গুজরান করছে তা বলার নয়। করাচীতে যে সব বাঙালী সামরিক অফিসার আছেন তাদের কারাে কারােকে হত্যা করা হয়েছে বলে আমরা খবর পেয়েছি। এছাড়া বাকীদের টাকা বন্ধ করে দেয়া হয়েছে ফলে স্ত্রী পুত্র পরিবার নিয়ে অশেষ দুর্ভোগের মধ্যে তারা দিন কাটাচ্ছেন। বরখাস্ত করা হয়েছে সামরিক অফিসারদের অনেককে। বাঙালীদের কতাে ভাবে হেনস্থা করেছে ওরা তার ইয়ত্তা নেই। করাচীতে যে সব বাঙালী সরকারী অফিসার রয়েছেন তাদের প্রতি কর্তৃপক্ষ এই মর্মে নির্দেশ দিয়েছেন যে অনুমতি ছাড়া কেউ করাচী ত্যাগ করতে পারবে না। সবাইর প্রতি কড়া নজর রাখছে তারা করাচীতে বাঙালী ছাত্র-ছাত্রীদের অবস্থা তাে আরাে কাহিল। তারা কেউ ক্লাশে যােগ দিতে পারছে না। সুযােগ পেলেই ছাত্রদের মারধর করা হচ্ছে। করাচীর একমাত্র বাংলা কলেজ দুষ্কৃতিকারীরা ভেঙ্গে চুরমার করে দিয়েছে। তবে, একটা কথা হচ্ছে যে বাঙালী বিরােধী কার্যকলাপে যারা লিপ্ত হয়েছে তারা সিন্ধী নন। তারা সবাই করাচীতে বসবাসকারী পাঞ্জাবী ও বিহারী ।

জয়বাংলা (১)  ১: ৭ ২৫ জুন ১৯৭১

সূত্র: গণমাধ্যমে বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধ – খন্ড – ০৪