ঐক্যবদ্ধ বাঙালী আজ সাম্প্রদায়িক মনােভাবের উর্ধ্বে
পৃথিবীর সভ্য মানুষ মাত্রেই রাষ্ট্রে রাষ্ট্রে বা একই রাষ্ট্রের মধ্যকার ধর্মসম্প্রদায়ের হানাহানিকে ঘৃণা করে। এই সাম্প্রদায়িকতা ক্ষয়িষ্ণু শাসকচক্রের আত্মরক্ষার কবচস্বরূপ। বর্তমান পাকিস্তান সরকারও নিজের অস্তিত্ব রক্ষার জন্যে বাংলাদেশকে শাসনের হাতিয়ার হিসাবে বেছে নিয়েছে। এখন বাংলাদেশে সাম্প্রদায়িকতার যে বিষ পাকিস্তান সরকার ছড়াচ্ছে তার পশ্চাতে আছে শাসকগােষ্ঠী পাকিস্তান সরকারের অনেক কৌশল, অনেক চক্রান্ত এবং অনেক স্বার্থের দ্বন্দ্ব। একনায়ক শাসন ব্যবস্থায় শাসক শ্রেণী শাসন ও শােষণ যন্ত্রকে অব্যাহত রাখতে বিভিন্ন সম্প্রদায়ের মধ্যে অবিশ্বাস, দ্বিধা-সন্দেহ সৃষ্টি করে পরিণামে রক্তক্ষয়ী সংঘর্ষ বাঁধিয়ে দেয়। পাকিস্তানে যতবার সাম্প্রদায়িক দাঙ্গা বেঁধেছে ততবারই তার মূলে পশ্চিম পাকিস্তান শাসক শ্রেণীর চক্রান্ত ক্রীয়াশীল ছিল। উদ্দেশ্য হচ্ছে মূল সমস্যা থেকে বাঙালীদের দৃষ্টি অন্যদিকে সরিয়ে দেয়া ও বাঙালী জাতির আত্মপ্রতিষ্ঠা ব্যহত করা। ফলে পশ্চিম পাকিস্তান কর্তৃক বাঙলার শােষণ সহজতর হবে। পশ্চিম পাকিস্তানী শাসকচক্র।
বরাবরই চেয়েছে পূর্ববাংলার জনগণ যেন একতাবদ্ধ না হতে পারে। কারণ পূর্ববাংলার হিন্দু-বৌদ্ধ। মুসলমান-খৃস্টান যদি একতাবদ্ধ হয় তবে তাকে কিছুতেই পশ্চিম পাকিস্তান রুখতে পারবে না। এ জন্যেও সাম্প্রদায়িকতার পক্ষে তার এত উৎসাহ। ১৯৫২ সালের ভাষা আন্দোলনের পথ ধরেই পূর্ববাংলার মানুষ ধীরে ধীরে সাম্প্রদায়িকতার বিরুদ্ধে মতামত গড়ে তােলে; এই অভিজ্ঞানের পর থেকে সাধারণ মনােভঙ্গী গড়ে ওঠতে থাকে। ১৯৫২ সালের ভাষা আন্দোলন ও ১৯৫৪ সালে জনাব হােসেন শহীদ সােহরাওয়ার্দীর প্রচেষ্টায় যুক্ত নির্বাচন প্রথা প্রবর্তন ও বাংলাদেশের বৃহত্তর রাজনৈতিক প্রতিষ্ঠান। আওয়ামী লীগের ধর্মনিরপেক্ষ রাজনীতির প্রভাবে সাম্প্রদায়িক চক্রান্ত সৃষ্টির সমাধি রচনা হলাে। আজ যারা স্বাধীনতা যুদ্ধের পুরােভাগে তাদের দ্বারা সাম্প্রদায়িকতার বিরুদ্ধে এবং স্বাধিকার প্রতিষ্ঠার পক্ষে।
সংগ্রাম শুরু হয়েছিল সেদিনই। আর এই ধর্মনিরপেক্ষ ও অসাম্প্রদায়িক সংগ্রাম চালাতে গিয়ে শেখ মুজিবুর রহমানসহ অসংখ্য রাজনৈতিক নেতা ও কর্মীকে দিনের পর দিন, বছরের পর বছর বিভিন্ন । নির্যাতনমূলক আইনের মাধ্যমে জেল ও নির্যাতন ভােগ করতে হয়েছে। ১৯৬৪ সালে আইউব খানের প্রধান সহচর পূর্ববাংলার তদানিন্তন গভর্ণর মােনয়েম খান পুনরায় এই সাম্প্রদায়িক দাঙ্গা লাগানাের চেষ্টা করেন। শেখ মুজিবর রহমানসহ অন্যান্য নেতৃবর্গ বাংলাদেশের সর্বত্র দাঙ্গাবিরােধী আন্দোলন। গড়ে তােলার আহ্বান জানালেন। এই সময় ঢাকার সকল পত্রিকায় পূর্ববাংলা রুখিয়া দাঁড়াও’ শিরােনামায় বাঙালীর প্রতি এক আকুল আবেদন করা হয়। সেই আহ্বানে এক অপার মানবতাবােধে। উদ্বুদ্ধ হয়ে সমস্ত চক্রান্তের বিরুদ্ধে বাঙালী জাতি সাড়া দিল। দাঙ্গা রােধ করতে গিয়ে সেদিন আমির। হােসেন চৌধুরীর মত বহু মুসলমান অকাতরে মৃত্যুবরণ করে নিল। কথার ফানুস দিয়ে নয়, বুকের তাজা রক্ত দিয়ে বাঙালী এবারও তার মানবতাপ্রীতি প্রমাণ করলাে। তারপর থেকে শাসক শ্রেণী চেষ্টা করতে লাগলাে বাঙালী অবাঙালী দাঙ্গা বাধিয়ে তাদের উদ্দেশ্য সফল করতে। কিন্তু বাংলাদেশের মানুষ সে ঘৃণ্য চেষ্টাও ব্যর্থ করে দিয়ে তাদের নিরাশ করলাে। বর্তমান সংগ্রামের এক পর্যায়ে আবার পশ্চিমী। শাসকচক্র সাম্প্রদায়িকতার ধুয়া তুললাে। পাকিস্তানী বেতার যন্ত্র হিন্দুদের বিরুদ্ধে মিথ্যা প্রচারে তৎপর হয়ে উঠলাে। এই পর্যায়ে ইয়াহিয়ার জঙ্গীচক্র সুপরিকল্পিতভাবে বেশ কিছু হিন্দু অধ্যুষিত গ্রাম পুড়িয়ে। দিয়ে অসহায় জনগণকে ঘর ছেড়ে বেরিয়ে পড়তে বাধ্য করেছে। হিন্দুদের সঙ্গে সঙ্গে মুসলমান গ্রামও পুড়লাে, অগণিত হিন্দু-মুসলমান বাঙালী জঙ্গী মেশিনগানের গুলীতে প্রাণ দিল। তার ফলে সারা বাংলাদেশ আজ শ্মশান ভূমি।
এই অত্যাচার চালানাের জন্যে বর্বর সৈন্যবাহিনী ভয় দেখিয়ে কিছু লােককে গ্রামে গ্রামে অগ্নি। সংযােগ ও লুঠতরাজের কাছে নিয়ােগ করে। এবং সেই অগ্নি সংযােগকারীকে দুষ্কৃতকারী প্রতিপন্ন করার উদ্দেশ্যে ক্যামেরার সাহায্যে তাদের ছবি তুলে নিয়েছে। আবার পরক্ষণেই গুলি করে তাদেরকে হত্যা করেছে। তবু বাংলাদেশের ঐক্যবদ্ধ স্বাধীনতা প্রিয় মানুষ সাম্প্রদায়িক উস্কানিতে উত্তেজিত হয়নি। ইস্পাতের মত কঠিন একতা নিয়ে অপেক্ষা করছে শত্রুর ধ্বংস দেখার জন্য। আজ সর্বত্র সামরিক বাহিনী সাধারণ মানুষকে হত্যা করে, ভয় দেখিয়ে নিজেদের এই লুটপাটে নিয়ােজিত করেছে, এই সমস্ত জঘন্য অত্যাচারে জর্জরিত হয়ে নিরুপায় নিরীহ জনগণ দলে দলে পালিয়ে ভারতবর্ষে যেতে শুরু করে, হিন্দু-মুসলমান বৌদ্ধ-খৃস্টান সকলেই পালাচ্ছে—এতেই প্রমাণিত হয় অত্যাচার এসেছে বাঙালী জাতির ওপর। কোন ব্যক্তি বিশেষ, কোন গােষ্ঠী বিশেষ বা কোন সম্প্রদায় বিশেষের উপর নয়। বহু বৌদ্ধ অধ্যুষিত এলাকা, খৃস্টান গীর্জা আজ ধ্বংসপ্রাপ্ত, হিন্দুদের মন্দির, মুসলমানদের মসজিদ কিছুই রেহাই পায়নি এই বর্বর অত্যাচারীদের হাত থেকে। বাঙালীদের নিশ্চিহ্ন করতে যেভাবে বুদ্ধিজীবীদের হত্যা করা হয়েছে সেখানে হিন্দু-মুসলমান সমান। হারে মরেছে। এর কারণ বাঙালীকে নেতৃত্বহীন করে দেওয়া। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের দর্শন বিভাগের অধ্যক্ষ ড: গােবিন্দ দেব-এর পাশাপাশি পরিসংখ্যান বিভাগের প্রধান জনাব মনিরুজ্জামান এবং অধ্যাপক জ্যোতির্ময় গুহ ঠাকুর তার পাশে অধ্যাপক মােক্তাদিরও একই হাতের শিকার। তাই দীর্ঘ চব্বিশ বছরের ইতিহাসের দিকে তাকালে বােঝা যায় অত্যাচারী পাকিস্তান সরকারের অতীত ও বর্তমান রাজনীতির প্রধান হাতিয়ার এই সাম্প্রদায়িকতা। আজ বাংলাদেশের মুক্তির প্রচেষ্টায় যে ঐক্যবদ্ধ শক্তির বিকাশ ঘটেছে তা বানচাল করার উদ্দেশ্যে প্রতিক্রীয়াশীল জঙ্গী সরকার বাঙালীর মধ্যে অনৈক্য সৃষ্টির জন্যে হন্যে হয়ে উঠেছে।
তারা অবাঙালীদের হাতে প্রচুর অস্ত্র দিয়ে গ্রামে গ্রামে পাঠিয়ে দিচ্ছে, সেখানে তারা নতুন করে অত্যাচার শুরু করছে, রাস্তায় রাস্তায় এই সব অবাঙালীরা টহল দিয়ে বেড়াচ্ছে। এদিকে ইয়াহিয়া সরকারের প্রচার যন্ত্র একথা প্রচার করছে যে, বাঙলা ও বাঙালীদের স্বাধিকারের জন্য যারা সংগ্রাম করেছে এবং এই সংগ্রামে যারা সাহায্য ও সহযােগিতা করেছে তারা এবং যেহেতু বাংলার সংখ্যালঘুরা ধর্মনিরপেক্ষ এবং অসাম্প্রদায়িক স্বাধিকার সংগ্রামের সাথে একাত্মতা করেছে, কাজেই তারাই পূর্ববাংলার এই দুরবস্থার জন্য দায়ী। এই ঘৃণ্য অপ-প্রচারের একমাত্র উদ্দেশ্য হচ্ছে ভারত ও বাংলাদেশের সর্বত্র সাম্প্রদায়িক দাঙ্গা বাধানাে। লক্ষ লক্ষ বাঙালী আজ ভারতে আশ্রয় নিয়েছে, এ অবস্থায় যদি পাকিস্তানের উস্কানির ফলে কোথাও সাম্প্রদায়িক দাঙ্গা বাঁধে তাহলে পাকিস্তান সরকারের উদ্দেশ্য সিদ্ধ হবে। তাই এই মুহূর্তে সব থেকে যা প্রয়ােজন তা হচ্ছে বাংলার শত্রু ঘৃণ্য পশ্চিমী কুচক্রীদের ষড়যন্ত্র ব্যর্থ করা, তাদের কোন প্রকার উস্কানিতে কান না দেওয়া বরং দিনের পর দিন মুক্তি যুদ্ধ চালিয়ে যাওয়ার জন্যে নিজেদের তৈরী করা। একথা মনে রাখতে হবে যে কোন স্বাধীনতা যুদ্ধেই সহজে সাফল্য অর্জন করা যায় না। সুতরাং সংগ্রাম যত কঠিন ও দীর্ঘ হােক না কেন তা চালিয়ে যাওয়ার জন্য তৈরী থাকতে হবে।
জয়বাংলা (১) ॥ ১: ৬ ॥ ১৮ জুন ১৯৭১
সূত্র : গণমাধ্যমে বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধ – খন্ড – ০৪