বিশ্ব জনমত দুনিয়ার মানুষ আর কতদিন চোখ বুঝে বাংলাদেশে নৃশংসতার দৃশ্য দেখে যাবে?
সিনেটর এডওয়ার্ড কেনেডী গত ২রা জুন মার্কিন সিনেটে তার সর্বশেষ বক্তৃতায় জিজ্ঞেস করেন সারা বিশ্ব আর কতদিন বাংলাদেশে পাকিস্তানী সেনাবাহিনীর নৃশংসতা চোখ বুঝে দেখে যাবে? তিনি আরাে জিজ্ঞেস করেন, পাকিস্তান সরকারই বা আর কত দিন ‘বাংলাদেশে স্বাভাবিকতা ফিরে। আসছে’ বলে চীকার করে বিশ্ববাসীকে বিভ্রান্ত করার চেষ্টা করবে। সিনেটর কেনেডী বলেন, লক্ষ লক্ষ বাঙালী যখন প্রাণ বাঁচানাের জন্য ভারতে আশ্রয় নিচ্ছে তখনও পাকিস্তান সরকার বাংলাদেশে অবস্থা স্বাভাবিক বলে চীৎকার করতে ছাড়ছে না। তিনি বাংলাদেশের নির্যাতিত মানুষের সাহার্যার্থে এগিয়ে আসার জন্য বিশ্ববাসীর প্রতি আবেদন জানান। সিনেটর এডােয়ার্ড কেনেডি সম্প্রতি একটি চিঠিতে মার্কিন সরকারের পররাষ্ট্র বিষয়ক সেক্রেটারি মি: উইলিয়াম রজারসকে জানিয়েছেন যে বাংলাদেশের ব্যাপারে বৃহৎ শক্তিবর্গের মধ্যে যুদ্ধের সম্ভাবনাকে উড়িয়ে দেওয়া যায় না। কেনেডী তার চিঠিতে বলেছেন, যুক্তরাষ্ট্র সরকারের নিষ্ক্রিয়তা ও উদাসীনতা দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ায় সঙ্কটের সৃষ্টি করছে। এই সঙ্কটের ফলে বৃহৎ শক্তিগুলির মধ্যে সঘর্ষ শুরু হওয়া অসম্ভব নয়। ভারত উপমহাদেশে বর্তমানে যা ঘটেছে তা খুবই উদ্বেগজনক।
বিদেশ থেকে যে ছয়জন সাংবাদিককে পাক সরকার বাংলাদেশ দেখাতে নিয়ে এসেছিলেন, তাদের অন্যতম জর্জ সাইকার বলেছেন, চট্টগ্রাম সহরের অনেক অঞ্চলে এখন আর ঘরবাড়ীর কিছু অবশিষ্ট নাই। এই সব ঘরবাড়ি কামানের গােলার আঘাতে নিশ্চিহ্ন হয়ে গিয়েছে। বাংলাদেশের মুক্তিবাহিনী চট্টগ্রাম থেকে কুমিল্লা পর্যন্ত বিস্তীর্ণ অঞ্চলের অনেক যায়গার রেলপথ উঠিয়ে ফেলেছে। ফলে গুরুত্বপূর্ণ স্থান সমূহের মধ্যে রেল যােগাযােগ বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়েছে। কুমিল্লা ও ফেনীর মধ্যেকার সড়কটি একেবারেই ধ্বংস করে দেওয়া হয়েছে। থাই পররাষ্ট্র মন্ত্রি ঘােষণা করেছেন, চীনের উপর দিয়ে থাইল্যান্ড হয়ে যেসব পাক বিমান আসত, থাইল্যান্ড তাদের তেল সরবরাহ করত। কিন্তু এখন থাইল্যান্ড পাক বিমানকে আর তেল সরবরাহ করবে। থাই-পররাষ্ট্র মন্ত্রির এই ঘােষণা খুবই গুরুত্বপূর্ণ। কারণ, তেলের অভাবে পাক বিমান থাইল্যান্ড হয়ে আর বাংলাদেশে আসতে পারবে না। এর ফলে চীন থেকে থাইল্যান্ড হয়ে অস্ত্রশস্ত্র আনা চলবে। ফলে পাকিস্তানের অস্ত্র সরবরাহে আরাে জটিলতা সৃষ্টি হল। প্রসঙ্গত: বলা দরকার যে ইতিপূর্বে বার্মা সরকারও পাক-বিমানকে তেল সরবরাহ করতে অস্বীকার করেছে।
বৃটিশ শ্রমিক দলের সদস্য মিষ্টার বার্ণস বলেছেন, বাংলাদেশ সমস্যার সমাধানে পাকিস্তান রাজী হলে, পাকিস্তানকে ব্রিটেনের কোন অর্থনৈতিক সাহায্য দেওয়া চলবে না। তিনি বলেন পশ্চিমী দেশগুলির পাকিস্তানকে অর্থনৈতিক সাহায্য বন্ধ করতে হবে, পাকিস্তানের অর্থনীতি ভেঙ্গে পড়লে বিশ্বের কোন দেশ যাতে তাদের সাহায্যে এগিয়ে আসতে না পারে তেমনি অবস্থার সৃষ্টি করতে হবে এবং ভারতের শরণার্থী শিবিরগুলিতে বিপুল পরিমাণে আন্তর্জাতিক সাহায্যের ব্যবস্থা করতে হবে। শ্রমিকদলের আর একজন সদস্য মিষ্টার বেসওয়ার্থ বলেন: বাংলাদেশের মানুষের উপর ইয়াহিয়া সরকার। কি নারকীয় অত্যাচার চালিয়েছে, তা লন্ডন, নিউইয়র্ক বা প্যারিসে বসে অনুমান করা যাবে না। ইতিহাসে এ রকম বর্বর, বীভৎস-গণহত্যার দৃষ্টান্ত নেই। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের একজন উর্ধ্বতন সেনাপতি বলেছেন, পাক ফৌজের পক্ষে কখনই বাংলাদেশকে পদানত রাখা সম্ভব হবে না। কারণ, সে দেশের সমস্ত লােকই তাদের বিরােধী। বাংলাদেশে এখন পুরােপুরি শাসনতান্ত্রিক অচলাবস্থা চলেছে। সেনা শক্তির দ্বারা এই শাসনতান্ত্রিক অচলাবস্থার অবসান ঘটান সম্ভব নয়। ফিনল্যান্ডের রাজধানী হেলসিঙ্কিতে অনুষ্ঠিত সমাজতান্ত্রিক আন্তর্জাতিক-এ প্রস্তাব নেওয়া হয়েছে। যে, বাংলাদেশের যুদ্ধ অবিলম্বে বন্ধ করা হােক। এই আন্তর্জাতিক সম্মেলনে পৃথিবীর ৪০টি দেশের ১৫০ জন সদস্য উপস্থিত ছিলেন।
জয়বাংলা (১) ॥ ১ : ৫ ॥ ৯ জুন ১৯৭১
বাঙ্গালীদের ওপর নির্মম নির্যাতন
পূর্ববাংলা পুরাে শান্ত জঙ্গীশাহীর এই দাবী সত্ত্বেও সেখানে চলেছে সন্ত্রাসের রাজত্ব। চলেছে জুলুমবাজি করে সবাইকে দাবিয়ে রাখার চেষ্টা। প্যারিসের দৈনিক পত্রিকা ‘লা মদ’-এর সংবাদদাতা জেরার ভিরাতেল এ কথা জানিয়েছেন। সম্প্রতি সামরিক আইন কর্তৃপক্ষ যে সাংবাদিক দলটিকে পূর্ব বাংলার কয়েকটি জেলা ঘুরিয়ে দেখান, ইনি সেই দলেই ছিলেন। গত সপ্তাহে প্যারিসের ওই পত্রিকার প্রথম পাতায় ছাপা ‘বাঙালীদের ওপর নির্মম নির্যাতন’ শীর্ষক নিবন্ধে তিনি বলেছেন : আলজিয়ারস এ সন্ত্রাস বিরােধী সংগ্রামের ধাঁচে একদা জনবহুল নগরী ঢাকার ওপর বােমা বর্ষণ করা হয়। তিনি আরও বলেন : বিশ্বকে ভাঁওতা দেওয়ার জন্য একটা গোঁজামিল অসামরিক শাসন চালু করার সব চেষ্টা ব্যর্থ হয়েছে। তিনি লিখেছেন : সামরিক ও অসামরিক অফিসারেরা, যারা সাংবাদিক দলটিকে সব কিছু ঘুরিয়ে দেখান, তারা সাংবাদিকদের সেনা বাহিনীর ‘ভালােমানুষী’ এবং সামরিক হস্তক্ষেপের যথার্থতা বােঝাতে কোনরকম কসুর করেন নি। সাংবাদিকদের বলা হয়েছে, বেশির ভাগ ধ্বংস ও রক্তপাতের মূলে রয়েছে বাঙালী ও বিহারীদের মধ্যে রক্তক্ষয়ী সংগ্রাম। তিনি আরও লিখেছেন, ভারতের বিরুদ্ধে পাকিস্তানী অপপ্রচার পশ্চিম পাকিস্তানীদের ওপর দারুণ প্রভাব ফেলেছে। কিন্তু বাংলাদেশের জনগণ ভারতকে খতম কর’-এই শ্লোগানকে কোন আমলই দিচ্ছে।
স্বদেশ ॥ ১:১ ॥ ১৬ জুন ১৯৭১
সূত্র : গণমাধ্যমে বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধ – খন্ড – ০৪