তবে কি তিনি লাখাে ইদুর মেরে বিড়াল তপস্বী বনে গেলেন?
আজ দু’মাসেরও বেশী দিন হয়ে গেল পাকজঙ্গী বাহিনী বাঙলাদেশে ব্যাপক গণহত্যা চালিয়েছে। তাদের বর্বর হামলা থেকে বাঙলাদেশের চিন্তাশীল ও বুদ্ধিজীবি সমাজ থেকে শুরু করে সাধারণ কৃষক শ্রমিক—নারী শিশু ও বৃদ্ধ কেউই রেহাই পায়নি। বর্বর পাকবাহিনী বাঙলাদেশের বিশ্ববিদ্যালয় স্কুল কলেজ শিক্ষা প্রতিষ্ঠানসহ, বাজার হাট কল কারখানা সবকিছুই ধ্বংস করেছে। বাঙলাদেশের নিরস্ত্র ও শান্তিপ্রিয় মানুষের ওপর স্থল নৌ ও বিমান বাহিনীর সাহায্যে তারা সর্বাত্মক হামলা চালিয়েছে। গ্রামের পর গ্রাম তারা পুড়িয়ে দিচ্ছে, হাজার হাজার লক্ষ লক্ষ নিরীহ ও অসহায় মানুষকে তারা নির্বিচারে হত্যা করে চলেছে। বাঙলাদেশে এই ইতিহাস চমকানাে হত্যাযজ্ঞের খবর যাতে বাইরে ছড়াতে না পারে পাকিস্তান। সরকার ও পাকজঙ্গী বাহিনী তার কোনাে চেষ্টার ত্রুটি রাখেনি। গত ২৫শে মার্চ পাক হানাদার বাহিনীর সর্বাত্মক হামলার সময় যে সব বিদেশী সাংবাদিক বাঙলাদেশে ছিলেন তাদের কাগজপত্র ফিল্ম ক্যামেরা সবকিছু কেড়ে নিয়ে তাদের বের করে দেয়া হয়। কিন্তু এসব ত্রুটিহীন সতর্কতামূলক ব্যবস্থাদি সত্বেও পাকবাহিনীর বর্বরতা ও ব্যাপক হত্যা যজ্ঞের খবর বহির্বিশ্বে পৌছে গেছে। পাকিস্তানী হানাদার বাহিনীর অত্যাচারের ফলে নারী-শিশু-বৃদ্ধসহ ৩৫ লক্ষের মতাে শরণার্থী ভারতে আশ্রয় নিতে বাধ্য হয়েছে। সারা দুনিয়ার সাংবাদিক, কূটনৈতিক মিশনের প্রতিনিধিগণ ও মানব দরদী সংস্থা সমূহের প্রতিনিধিবৃন্দ | এইসব শরণার্থীদের কাছ থেকে পাকিস্তানী জল্লাদ বাহিনীর নির্মম অত্যাচারের কাহিনী শুনেছেন এবং এদের মর্মান্তিক অবস্থা প্রত্যক্ষ করেছেন। অর্থাৎ বাঙলাদেশে পাক তস্কর বাহিনী যে নারকীয় হত্যাযজ্ঞ ও ব্যাপক ধ্বংস লীলা চালিয়েছে পৃথিবীর মানুষের কাছে তা আজ আর অজানা নয়।
কিন্তু বাঙলাদেশের মুক্তি পাগল মানুষ ইয়াহিয়া ও তার বর্বর বাহিনীর এই হত্যাযজ্ঞকে মেনে নেয়নি। হানাদারদের বিরুদ্ধে আজ তারা মরণ পণ করে রুখে দাড়িয়েছে। সারা বাংলা দেশে পাকিস্তানী হানাদারদের বিরুদ্ধে দুর্বার লড়াই চলেছে। বাঙালীর প্রতিরােধের মুখে এক দিকে তারা বাঙলাদেশে ব্যাপক গণহত্যা ও ধ্বংশযজ্ঞ চালাচ্ছে এবং অন্য দিকে তাদের ভেঙে পড়া অর্থনীতি ও বেকায়দায় পড়া সামরিক ব্যবস্থাকে টিকিয়ে রাখার জন্যে ভিক্ষের ঝুলি হাতে বিভিন্ন রাষ্ট্রে প্রতিনিধি পাঠাচ্ছে। এখানে স্মরণ থাকতে পারে যে মাত্র কয়েকদিন আগেই ব্যাপক গণহত্যার নায়ক জল্লাদ ইয়াহিয়া খাঁ এক বিবৃতিতে ঘােষণা করেছিলাে যে বাঙলাদেশে খাদ্যশষ্য ঔষধপত্র ও নিত্যপ্রয়ােজনীয় দ্রব্য সামগ্রির। কোনাে প্রয়ােজন নেই। ইয়াহিয়ার এই ঘােষণা অবশ্য হানাদার বাহিনীর চন্ডনীতির দিক থেকে ঠিকই ছিলাে। কারণ জঙ্গী বাহিনীর রণনীতির মূল কাজ যেখানে বাঙলাদেশে ব্যাপক গণহত্যা ও বাঙলাদেশের সামগ্রিক অর্থনীতিকে গুঁড়িয়ে মিশমার করে গােটা বাঙালী জাতটাকে ধ্বংস করা সেখানে বাঙালীদের। জন্যে খাদ্য সামগ্রী ঔষধপত্রও নিত্যব্যবহার্য সামগ্রির প্রয়ােজন থাকে কি করে? কিন্তু ইয়াহিয়ার বিবৃতির মাত্র কয়েক দিন পরেই পাকিস্তানের পরিকল্পনা কমিশনের ডিপুটি চেয়ারম্যান ও পাকিস্তানের প্রেসিডেন্টের প্রধান অর্থনৈতিক উপদেষ্টা এম, এম, আহমেদ বৃটেন মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র ও অন্যান্য দেশে ভিক্ষের ঝুলি নিয়ে হাজির হলেন। বাঙালীদের বিরুদ্ধে ‘জঙ্গ’ লড়তে গিয়ে পাকিস্তান যে দেউলিয়া হয়ে গেছে সে কথা জানিয়ে সাহায্যের জন্যে বহু কান্নাকাটি করে এলাে। এখানে সবার মনেই একটি প্রশ্ন উঠতে পারে যে পাকিস্তানের সামরিক প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়া খা যেখানে বললেন-“না, আমাদের কোন সাহায্যের প্রয়ােজন নেই।
বাঙলাদেশের জন্য খাদ্য শষ্য ইত্যাদি ওই ধরনের কোন সাহায্যের প্রয়ােজন। নেই, সেখানে তারই প্রধান উপদেষ্টা ও বিশেষ দোস্ত এম, এম, আহমদ বিভিন্ন রাষ্ট্রের কাছে ভিক্ষের ঝুলি নিয়ে হাজির হলেন কেন? তবে কি ইয়াহিয়া লক্ষ ইদুর মেরে বিড়াল তপস্বীর মতাে শেষ পর্বে সাধু হয়ে গেলেন?-না, তা নয়। এর প্রকৃত তথ্য পাওয়া যাবে পাকিস্তান সরকার মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র, বৃটেন, ইরান ও তুরস্ক প্রভৃতি দেশগুলাের কাছে যে সব জিনিস চাইছে সেগুলাের আসল তাৎপর্য বিশ্লেষণ করলেই। পাকিস্তান সরকার অবশ্য দায় এড়ানাের জন্যে জানিয়েছে যে অল্প স্বল্প খাদ্য শস্যেরও তা তাদের প্রয়ােজন রয়েছে, তবে তাদের এখন সবচেয়ে বেশী প্রয়ােজন হলাে উপকূল অঞ্চলে ও বাঙলাদেশের নদনদী সমূহে চলাচলের উপযােগী দ্রুতগামী নৌযান মালও যানবাহনবাহী বজরা ইত্যাদি। একথা বুঝতে আজ আর অসুবিধে হয় না যে এতােদিন পর পাক বাহিনীর এই সব যানবাহনের প্রয়ােজন হলাে কি করে? বর্ষা সমাগত। বর্ষা কালেই বাঙলাদেশের প্রায় সকল এলাকারই স্বাভাবিক যােগাযােগ বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়ে। বর্ষাকালে মুক্তিবাহিনীর হাতে পাক হানাদারদের মার খাওয়ার সমূহ সম্ভাবনা। কারণ বর্ষায় স্বাভাবিক সৈন্য চলাচল ও সামরিক সরবরাহ ব্যাপক ভাবে বিঘ্নিত হবে এবং পরে বিমানবাহিনীও প্রায় অকেজো হয়ে উঠবে। বর্ষার এই সুযােগেই মুক্তি সেনারা গ্রাম বাঙলা। থেকে হানাদার পাক বাহিনীকে ঝেটিয়ে দূর করতে পারবে। বর্ষার পাক বাহিনীকে অবশ্যম্ভাবী চরম বিপর্যয়ের কথা চিন্তা করেই ইয়াহিয়া সরকার বিদেশের কাছ থেকে এই ধরনের সাহায্য চেয়েছে। বাঙলাদেশ ও বাঙলাদেশের মানুষের কল্যাণের জন্যে তারা কোনাে সাহায্য চায়নি কারণ তারা।
বাঙলাদেশের কৃষকদিগকে তাদের ক্ষেত থেকে পাকা ধান কাটতে দিচ্ছে না। পাকা ধানের খেতে তারা আগুন ধরিয়ে দিচ্ছে, ধান ক্ষেত মাড়িয়ে দিচ্ছে। মাঠে কৰ্ষণরত কৃষকদের নির্বিচারে গুলি করে মারছে। ঢাকা, ফরিদপুর, পাবনা, কুষ্টিয়া, যশাের, সিলেট, দিনাজপুর ও রংপুরে তারা বিমান থেকে ক্ষেতের ওপর ফসল নষ্টকারী রাসায়নিক বিষ ছিটিয়েছে। তাছাড়া বাঙলাদেশের জনগণের অসহযােগিতার জন্যে তারা এখন ও কোথাও অসামরিক প্রশাসন ব্যবস্থা চালু করতে পারেনি। বাঙলাদেশের সর্বত্রই যােগাযােগ ব্যবস্থা এখনও অচল হয়ে আছে। পাক সরকারের এই নারকীয় চক্রান্ত ও দূরভিসন্ধির প্রকৃত তাৎপর্য উপলব্ধি না করতে পেরে বিশ্বের কোনাে কোনাে রাষ্ট্র নাকি ইয়াহিয়া সরকারকে সাহায্য দানের কথা চিন্তা করছেন। কিন্তু পাকিস্তান সরকারকে যে কোনাে ধরনের সাহায্য ও সহযােগিতা দেবার আগে বাঙলাদেশে হানাদার পাক বাহিনী। ও পাক সরকারের নারকীয় তৎপরতা সম্পর্কে খোঁজ খবর নেয়ার প্রয়ােজন রয়েছে বলে আমরা মনে করি। কারণ বাঙলাদেশের জনগণের নামে পাক সরকার যে সাহায্যই নিক না কেন তা ব্যবহার করা। হবে বাঙলাদেশে সম্পদ ধ্বংসে ও মানুষ নিধনে পাকহানাদার বাহিনীর সাহায্যের কাজে। সমগ্র বাঙালী জাতটাকেই তারা যেখানে খতম করার জন্যে এক প্রাগৈতিহাসিক বর্বরতায় মেতেছে সেখানে তাদের মাধ্যমে বাঙলাদেশের মানুষ ও বাংলাদেশকে সাহায্যের কোনাে প্রশ্নই উঠতে পারে না।
বাঙলাদেশের মানুষ ও সম্পদ নষ্টের জন্যে তারা বুলেট ও আগুন ছাড়া আর কোন কিছুই দিচ্ছে না। বাঙলাদেশে তারা। ব্যাপক গণ হত্যা ও ধ্বংসযজ্ঞ চালিয়েছে। ইয়াহিয়ার পাঞ্জাবী চক্র ও তাদের সরকারের সঙ্গে বাঙলাদেশের মানুষের কোনাে সম্পর্ক নেই। গত ২৫শে মার্চের পর থেকে পাকিস্তান সরকারের সঙ্গে বাঙলাদেশের মানুষের কোনাে সম্পর্ক নেই একথা আমরা আর একবার দ্ব্যর্থহীন কণ্ঠে সারা বিশ্বকে জানিয়ে দিতে চাই। বাঙলাদেশের মাটি থেকে হানাদার প্রতিটি পশ্চিম পাকিস্তানীকে নিধন না করা পর্যন্ত। আমাদের বিরাম নেই। আমাদের এ যুদ্ধ বাঙালী জাতির বাঁচা মরার যুদ্ধ। অতএব এ অবস্থায় পাকিস্তান সরকারের সঙ্গে যে কোনাে সাহায্য ও সহযােগিতার অর্থ দাঁড়াবে বাঙলা দেশে পশ্চিম পাকিস্তানী হানাদার বাহিনী যে গণহত্যা ও ধ্বংসযজ্ঞ চালিয়েছে তাতে প্রত্যক্ষ ভাবে অংশ গ্রহণ করা। আমরা বিশ্বের সকল দেশের শান্তিকামী জনগণের প্রতি আহ্বান জানাচ্ছি যে তারা যেন তাদের সরকারকে পাকিস্তানের জঙ্গী সরকারকে সাহায্য ও সহযােগিতা করা থেকে বিরত থাকেন।
জয়বাংলা (১) ! ১: ৫ ॥ ৯ জুন ১৯৭১
সূত্র : গণমাধ্যমে বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধ – খন্ড – ০৪