You dont have javascript enabled! Please enable it! বিদেশী সাংবাদিকের জিজ্ঞাসা পশ্চিম পাকিস্তানী-পাক সেনার নির্বিচারে গণহত্যা - সংগ্রামের নোটবুক

বিদেশী সাংবাদিকের জিজ্ঞাসা পশ্চিম পাকিস্তানী

জল্লাদ বাংলাদেশের কত লাখ লােক খুন করেছে? গত ২৫শে মার্চ বাংলাদেশের স্বাধীনতাকামী নিরস্ত্র নাগরিককে সুপরিকল্পিতভাবে হত্যা করার জন্য ইয়াহিয়া-টিক্কা এবং তাদের জল্লাদ বাহিনী যে ঘৃন্য পথ গ্রহণ করে তার কুকীর্তি বিশ্ববাসীর চোখে ঢাকা। দেওয়ার জন্য ঢাকায় অবস্থানরত ৩৫ জন বিদেশী সাংবাদিককে ২৬শে মার্চ জোর করে ধরে তাদের ফিল্ম ক্যামেরা কেড়ে নিয়ে বিমানে করে পশ্চিম পাকিস্তানে ছেড়ে দেওয়া হয়। তারপর থেকে সংবাদপত্র বেতার টেলিভিশনের উপর কঠোর সামরিক সেন্সরশীপ আরােপ করে পাক হানাদার বাহিনী সারা বাংলাদেশে এক লােমহর্ষক গণহত্যা, লুণ্ঠন, অগ্নিসংযােগ ও ধর্ষণ অভিযান চালিয়ে যায়। পৃথিবীর শান্তি কামী মানুষ বাংলাদেশের সত্যকার ঘটনা থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়লাে। তবু লৌহ যবনিকার অন্তরালে এবং পাকফৌজের কঠোর দৃষ্টিকে ফাকি দিয়ে যে সব সাংবাদিক প্রাণভয়কে তুচ্ছ করে সীমান্ত ডিঙ্গিয়ে যে টুকরাে টুকরাে খবর সংগ্রহ করলেন তা দিয়ে বিশ্ববাসী জোড়া করলেন বাংলাদেশের একটি বিভৎসতা চিত্র।

আর তখন সমগ্র বিশ্ব আজকের বিক্ষুদ্ধ ও বিধ্বস্ত বাংলার চিত্র দেখে আতঙ্কিত হয়ে উঠলেন। বিশ্বজনমত মূল তথ্য জানবার জন্য চাপ শুরু করে দিলেন। গুটিকতক স্থান ঠিকঠাক করে ইয়াহিয়া খান বাধ্য হয়ে ৬ জন বিদেশী সাংবাদিক, যারা এর আগে কোনেদিন বাংলাদেশে আসেনি, তাদের আমন্ত্রণ করলেন। এসব নতুন সাংবাদিককে সফরে আনায় ইয়াহিয়া খানের একিট লাভ হলাে—এরা রেসকোর্স ময়দানের ঢাকার জনসংখ্যা দেখেনি, দেখেনি সদরঘাটের বাস, নবাবপুরের রাস্তায় ভীড় আর দেখেনি। ঢাকার পথে সাইকেল রিক্সা, বেবীট্যাক্সি মােটর গাড়ীর প্রচন্ড ভীড়। সে যাহােক সামরিক গাড়িতে সামরিক নিয়ন্ত্রণে এ সব সাংবাদিককে ৬ দিনের জন্য বাংলাদেশে সফরের অনুমতি দেওয়া হল। এই সফরের আগে ইয়াহিয়া সাহেব বায়না ধরলেন যে সব সাংবাদিক ২৫শে মার্চ পর্যন্ত ঢাকায় অবস্থান করেছিলেন তাদের এই সফরে আসতে দেয়া হবে না। কারণ তাদেরকে এই নিয়ন্ত্রিত সফরে আসতে দিলে আদিম পৈশাচিকতার মূল তথ্যকে ফাঁকি দেয়া যাবে না। তবু এই নিয়ন্ত্রিত সফরে ব্যবস্থা করেও বাংলাদেশে নবাগত সাংবাদিকের চোখকে যথার্থভাবে ফাকি দিতে পারলেন না বেঈমান ইয়াহিয়া-টিক্কা চক্র।

এসােসিয়েট প্রেসের প্রতিনিধি সাংবাদিক মর্ট রােসেন রুম বলেন যে, সামরিক কর্তৃপক্ষ এই সফরের নিয়ন্ত্রিত পথে বিভিন্ন স্থানে ভাড়া করা লােক দাড় করে রাখে। পথঘাট মেরামত করে মূল। তথ্যকে ঢাকতে চেষ্টা করে। কিন্তু তার মধ্যে থেকেও বাংলাদেশের এক ভয়ঙ্কর বীভৎস চিত্র ফুটে উঠেছে। তার সফরের অভিজ্ঞতার বর্ণনা করতে গিয়ে একটা মাত্র দৃষ্টান্তের মধ্যে তিনি সারা বাংলাদেশের সামরিক বাহিনীর পৈশাচিক নরহত্যার একটি খন্ডাংশ তুলে ধরতে চেষ্টা করেছেন। তিনি লিখেছেন, গলিত লাশের মাংসে শকুনি গৃহিধীদের পেট এত পূর্ণ হয়েছে যে পদ্মার তীর ধরে উঠে যেতেও তাদের কষ্ট হচ্ছে। তার মতে, মাত্র ৫ সপ্তাহে হানাদার বাহিনীর হত্যালীলার বাংলাদেশের ৫ লক্ষ লােকের লাশ শকুনীরা মেজবাণীর জন্য পেয়ে গেছে। রােজেন ব্লম লিখেছেন, বাংলাদেশে পাক-ফৌজ কত লাখ লােককে হত্যা করেছে তা কারও পক্ষে বলা সম্ভব নয়। কিন্তু নির্ভরযােগ্য ও নিরপেক্ষ হিসাবের ভিত্তিতে এ সংখ্যা কমপক্ষে দশ লক্ষ হবে বলে তার ধারণা। কিন্তু আমাদের কাছে আওয়ামী লীগ ও অন্যান্য সূত্রে যে সমস্ত হিসাব এসেছে তার থেকে বলা যায় যে এ যাবৎ অন্তত: ৩০ থেকে ৫০ লক্ষ লােককে তারা হত্যা করেছে।

জয়বাংলা (১) ॥ ১: ২ ৪ ১৯ মে ১৯৭১

পাক সেনার নির্বিচারে গণহত্যা

কিছুদিন পূর্বে নওগাঁ মহকুমার আতাইকুলা গ্রামে অগ্নিসংযােগ কয়েক লক্ষ টাকা ও সােনা লুণ্ঠন। এবং ৫২ জনকে হত্যা—তৎসহ নারী ধর্ষণের ফলে এক ভয়াবহ পরিস্থিতির সৃষ্টি হয়। লাকসাম থেকে ফেনী যাবার পথে বর্বর পাক ফৌজ কয়েকটি গ্রাম পুড়িয়ে দেয়। নওগাঁর উত্তর অঞ্চলে কয়েকজন নারীর উপর পাশবিক নির্যাতনের ফলে ৩ জনের মৃত্যু ঘটে। প্রায় দুই হাজার ভারতগামী বাঙ্গালীদের উপর পাক সেনা ও বিহারীদের আক্রমণের ফলে বহু জনের মৃত্যু ঘটে—কয়েকজন নারীকে অপহরণ করে এবং লুণ্ঠন করে সকলকে সৰ্ব্বশান্ত করে। বগুড়া জেলার আদমদিঘী, তালােড়া, নশরৎপুর প্রভৃতি এলাকায় অগ্নিসংযােগ করে এবং গােলা গুলিদ্বারা তিনশতাধিক নিরীহ গ্রামবাসীকে হত্যা করে, এ ছাড়া। নওগাঁ, নাটোর, বগুড়া, পাবনা প্রভৃতি স্থানের গ্রামগুলিতে প্রবেশ করে তারা অকথ্য নির্যাতন ও লুণ্ঠন। চালায়। তাদের ভয়ে লক্ষ লক্ষ লােক ভারতে আশ্রয় গ্রহণের জন্য বাস্তুভিটা পরিত্যাগ করতে বাধ্য হয়।

বঙ্গ বাণী ॥ ১:১ ॥ ২৩ মে ১৯৭১

সূত্র : গণমাধ্যমে বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধ – খন্ড – ০৪