এ যুদ্ধ আপনার আমার সকলের
রক্তের অক্ষরে লেখা হচ্ছে আমাদের স্বাধীনতা যুদ্ধের ইতিহাস। যেমন লেখা হয়েছে আরাে অনেক দেশের। অন্যান্য দেশের মানুষের দেশপ্রেমের কাছে হার মেনেছে বিদেশী হানাদারেরা। আমাদের কাছেও মানবে। ঘাতকের ক্ষমা নেই। শত্রুকে নির্মূল না করে ক্ষান্ত হব না আমরা। আমরা এ যুদ্ধ চাইনি। কিন্তু যুদ্ধ আমাদের উপর চাপিয়ে দেওয়া হয়েছে। রাতের অন্ধকারে ঝাঁপিয়ে পড়েছে আমাদের উপর জঙ্গীশাহীর সেনাবাহিনী। হাতে তার সর্বাধুনিক মারণাস্ত্র । সমস্ত শক্তি নিয়ে সে আক্রমণ করেছে। কিন্তু লক্ষ্য সিদ্ধ হয়নি। শত্রু আমাদের পরাভূত করতে পারেনি। হিটলারী কায়দায় হঠাৎ আক্রমণ করে, ভয় পাইয়ে আমাদের নিষ্ক্রিয় করে দিতে চেয়েছিল। মৃত্যুর বিভীষিকা দেখিয়ে চেয়েছিল আমাদের স্তন্ধ করে দিতে। কিন্তু তা সে পারেনি। বাঙলার এক-প্রান্ত থেকে অপর প্রান্ত আজ রুখে দাঁড়িয়েছে প্রতিরােধ প্রতিজ্ঞা নিয়ে। জেগে উঠেছে বীর জনতা তার বিপুল উদ্দিপনা নিয়ে। প্রথমে আমাদের দাবী ছিল স্বায়ত্তশাসনের। কিন্তু ইয়াহিয়া আর তার জঙ্গীচক্রের বিশ্বাসঘাতকতা খুলে দেয় আমাদের দৃষ্টি। জন্ম নিয়েছে আজ গণপ্রজাতান্ত্রিক স্বাধীন বাংলাদেশ। আর এই সরকার ও জনতার সহযােগিতায় বাঙলা দেশের প্রতি অঞ্চল গড়ে উঠছে মুক্তিফৌজ। তারা প্রতিজ্ঞা বদ্ধ হচ্ছে শত্রু নিধনের। আমাদের এই যুদ্ধ একটি জাতির বাঁচা মরার যুদ্ধ। আসুন, আপনিও শরীক হন এই যুদ্ধে। শত্রুকে ধ্বংস করে রক্ষা করুন আপনার দেশের হাজার হাজার মানুষকে। আমাদের শত্রু নির্মম। আর। নির্মম হাতেই রচনা করতে হবে তার কবর।
আমাদের রণনীতি : আমরা যে রণনীতি গ্রহণ করেছি তার মূল লক্ষ্য হল যত কম ক্ষতি স্বীকার করে যত অধিক সংখ্যক শত্রু সৈন্য হত্যা করা যায়। আমাদের লক্ষ্য হল শত্রু সৈন্যকে আক্রমণের পর আক্রমণ করে তাকে সদা ব্যাস্ত রাখা। তাকে ক্লান্ত করে তােলা। তার মনবল নষ্ট করে দেওয়া। তারপর একসময় মনবলহীন ক্লান্ত শক্রকে আক্রমণ করে সমূলে উৎখাত করা। পাকিস্তান সরকার অস্ত্রপাতি তৈরি করে না। গােলাবারুদের। জন্য বিশেষভাবে সে অন্য দেশ নির্ভর। তার অর্থনীতিগত দেখা দিয়েছে তীব্র সঙ্কট। তাই দীর্ঘ প্রলম্বিত যুদ্ধ চালিয়ে যেতে গিয়ে তার সমর কৌশল ব্যর্থ হতে বাধ্য। আমাদের কাছে এ যুদ্ধ হল গণযুদ্ধ বা জনগণের যুদ্ধ। আমরা ভাড়াটে পেশাদার সৈনিক নই। অস্ত্রবল আমাদের কম । কিন্তু আমাদের মনে আছে প্রবল দেশপ্রেম। শুধু অস্ত্র দিয়ে যে যুদ্ধ হয়, তার থেকে আমাদের যুদ্ধের চেহারা আলাদা। গণ সমর্থন আমাদের যুদ্ধের মূল ভিত্তি। সমস্ত বাঙালী আজ জাতীয় চেতনায় উদ্বুদ্ধ। এ যুদ্ধ মুষ্টিমেয় পেশাদার সৈনিকের বিরুদ্ধে একটা সমগ্র জাতির স্বাধীনতা যুদ্ধ। এ যুদ্ধের কোন নির্দিষ্ট অঞ্চল নেই। আমাদের লড়াই কোন নির্দিষ্ট যুদ্ধক্ষেত্রের লড়াই নয়। যে কোন সময়, যে কোন স্থানে, সুযােগ পেলেই আমরা ঝাঁপিয়ে পড়ব শত্রু সেনার উপর। আমরা তাদের হত্যা করব। আমরা তাদের সরবরাহ ব্যবস্থাকে বানচাল করবাে। বিদেশী বিশেষজ্ঞদের মতে বাঙলাদেশে যে পাকিস্তানী সৈন্য আছে তা একটা যুদ্ধ জয়ের জন্য যথেষ্ট নয়।
রক্ত চোষা!
বাংলা দেশের বিভিন্ন অঞ্চল থেকে প্রাপ্ত খবরে জানা যায় যে, মুক্তি ফৌজের হামলায় যে হাজার হাজার পাকিস্তানী সৈন্য আহত হয়েছে তাদেরকে বাঁচানাের জন্য জঙ্গীশাহী এক বীভৎস পন্থা অবলম্বন করেছে। তারা বাংলাদেশের বিভিন্ন স্থান থেকে কিশাের এবং যুবকদেরকে ধরে নিয়ে তাদের শরীর থেকে রক্ত বের করে নিচ্ছে এবং রক্তহীন অসাড় দেই রাস্তায় ফেলে দিয়ে নিশ্চিত মৃত্যুর মুখে ঠেলে দিচ্ছে। রক্ত চোষা আর কাকে বলে।
জয়বাংলা (১) ॥ ১:১ ॥ ১১ মে ১৯৭১
বিদেশী সাংবাদিকের দৃষ্টিতে ঢাকা
নগরী ২৫শে মার্চ, সেই ভয়াল রাত্রিতে ঢাকা নগরী থেকে যে-সব বিদেশী সাংবাদিককে বের করে দেওয়া হয় তাদের মধ্যে আমেরিকার বিখ্যাত সাপ্তাহিক পত্রিকা টাইম-এর সংবাদদাতা ডান কগিনও ছিলেন। ঢাকার নারকীয় হত্যাকান্ডের কোন খবর যাতে বাইরে বিশ্বের মানুষ না জানতে পারে, একথা ভেবেই জঙ্গীশাহী ঢাকায় থাকতে দেননি কোন বিদেশী সাংবাদিককে। সর্বপ্রকার খবরের উপর পাকিস্তান সরকার চেয়েছিলেন নিষেধাজ্ঞার কাল পরদা টাঙ্গিয়ে দিতে। সারা পৃথিবীর মানুষকে বােকা বানাতে। তাদের নাদীর শাহী অত্যাচারের কুকীর্তি ঢেকে রাখতে। কিন্তু তা সম্ভব হয়নি। একাধিক সাংবাদিক মৃত্যু ভয়কে তুচ্ছ করে পরে সীমানা পেরিয়ে ঢুকে পড়েন বাঙালা দেশের মধ্যে সংগ্রহ করে আনেন, এবং এখনও আনছেন নানা খবর । আর এই সব খবর সৃষ্টি করছে বিশ্ব জনমত। ধিক্কার উচ্চারিত হচ্ছে। ইয়াহিয়া সরকারও তার জঙ্গী চক্রের বিরুদ্ধে। টাইম পত্রিকার সাংবাদিক ডান কাগিন পশ্চিম বাঙলা থেকে হুন্ডায় চড়ে প্রবেশ করেন বাঙলাদেশে। তার পর বাসে, ট্রাকে, সাইকেলে চেপে পৌছান ঢাকা শহরে। সেখান থেকে আবার খবর সংগ্রহ করে ফিরে আসেন ভারতে তিনিই প্রথম মার্কিন সাংবাদিক যিনি ঢাকায় গিয়ে নিজে চোখে দেখে বাইরের বিশ্বে ইয়াহিয়া শাহীর কুকীর্তির কথা বিশ্ব সমক্ষে তুলে রেছেন।
কগিন লিখেছেন :
ঢাকা এখনও মৃত নগরী। সামরিক আক্রমণের একমাস পরেও সরকারি দপ্তর, অফিস আদালত কিছুই চালু করা সম্ভব হয়নি। কত লােক মারা গিয়েছে তার হিসাব এখনও দেওয়া চলে না। হাজার হাজার লােক নিহত হয়েছে সামরিক আক্রমণে । ঢাকা সহরের অর্ধেক কি তার বেশী লােক পালিয়ে গিয়েছে সহর ছেড়ে। সহরে খাদ্যাভাব দেখা দিয়েছে দারুণ ভাবে! সহরের ১৮টি বাজারের মধ্যে ১৪টি পুড়িয়ে দিয়েছে পাক সামরিক বাহিনী। যে সব পথে এক সময় মানুষের ভিড়ে পথ চলা দায় হত, সে সব পথ আজ প্রায় জনশূন্য। বিজন পথে, পথ চলতে ভয় করে! সহরের বাড়ীগুলির মাথায় মাথায় উড়ছে পাকিস্তানের পতাকা। অনেক স্থানেই দেখতে পাওয়া যাচ্ছে জিন্না এমনকি ইয়াহিয়া সাহেবের বড় বড় ছবি। কিন্তু এসবই বাহ্যিক। প্রত্যেকটি বাঙালীর মনে জ্বলছে আগুন। তারা মনে করছেন, যুদ্ধে তাদের হার হয়নি। তারা আপাতত পিছিয়ে গিয়েছেন মাত্র। একজন বাঙালী আমার কথার উত্তরে বলল, “আমরা ভুলে যাব না এখনও এই স্মৃতি। আমরা কখনও ক্ষমা করবাে না ওদের।” আমি সাংবাদিক একথা জানতে পেরে সহরের অনেকে আমাকে নিয়ে চলল দেখাতে সেই সমস্ত স্থান গুলি যেখানে মাটিতে খাদ খুড়ে দেওয়া হয়েছে বহু লােককে কবর।
আমি জানতে পারলাম, ধর্ম প্রাণ মানুষও রেহাই পাইনি হত্যাযজ্ঞ থেকে। মসজিদ থেকে জুম্মার নামাজ পড়ে বের হবার সময় গুলি করে মারা হয়েছে বৃদ্ধকে। সেনা বাহিনীকে বােঝান হয়েছে বাঙালী মুসলমানকে গুলি করে হত্যা করবার মধ্যে কোন অপরাধ নেই, বরং সওয়াব হবে। কারণ বাঙালী মুসলমানরা আসলে ছদ্মবেশী হিন্দু। শুধু এই নয়, ঢাকায় একাধিক নাম করা বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক ও ৫০০ ছাত্রকে মেরে ফেলা হয়েছে। সবচেয়ে বেশী ক্ষতি হয়েছে পুরান ঢাকার। সেখানেই ঘটেছে সর্বাপেক্ষা ভয়াবহ ও জঘন্য হত্যাকান্ড। পুরান ঢাকার একাধিক অংশ বাড়ীতে পেট্রল ঢেলে তার উপর গােলা ছুড়ে ধরিয়ে দেওয়া হয় আগুন। মানুষ যখন বাইরে পালাতে যায়, তখনই তাদের উপর মেশিন গান থেকে ছোড়া হয় গুলি। কিন্তু তথাপি মানুষের মনােবল ভেঙ্গে যায়নি। যেখানেই আমি গিয়েছি সর্বত্র লক্ষ্য করেছি মানুষের অবাক করা মনােবল। তাদের সকলেরই এক প্রতিজ্ঞা কি ভাবে পাক-বাহিনীকে উৎখাদ করে দেশকে চিরতরে মুক্ত করা যাবে। কগিন মন্তব্য করেছেন, বর্ষাকাল আসছে। অন্যদিকে পাকিস্তানের অর্থনীতিতে দেখা গিয়েছে। ভয়ঙ্কর সঙ্কট। ইসলামাবাদকে হয়ত বুঝতে হবে, কেবল গায়ের জোরে একতা রক্ষা করা যায় না এবং পাকিস্তানের প্রতিষ্ঠাতা জিন্না ঠিক এমনি পাকিস্তানের কথা কখনও চিন্তা করেননি। (টাইম, ৩রা মে, ১৯৭১)
জয়বাংলা (১) ॥ ১:১ ॥ ১১ মে ১৯৭১
সূত্র : গণমাধ্যমে বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধ – খন্ড – ০৪