সংগ্রামী বাঙ্গালীর প্রতি সম্মান
বাংলাদেশের প্রতিনিধিদলের নেতা জনাব আবদুস সামাদ আজাদ গত পনেরােই মে বুদাপেষ্টে অনুষ্ঠিত বিশ্বশান্তি পরিষদের “ঔপনিবেশিক ও বর্ণ বৈষম্যভিত্তিক নিপীড়ন” সংক্রান্ত কমিটির চেয়ারম্যান নির্বাচিত হয়েছেন। ইয়াহিয়ার বর্বর সেনাবাহিনীর আক্রমণের বিরুদ্ধে বাঙলাদেশের জনগণের সাহসিকতাপূর্ণ সংগ্রামের প্রতি সম্মান ও সমর্থন জ্ঞাপনের উদ্দেশ্যে বিশ্বশান্তি পরিষদ জনাব আজাদের প্রতি এই সম্মান প্রদর্শন করেছেন। জনাব সামাদ তাঁর ভাষায় বাঙলাদেশের ঘটনাবলীকে পাকিস্তানের আভ্যন্তরীণ ব্যাপার হিসেবে মনে না করার জন্যে বিশ্বের সকল রাষ্ট্র বিশেষ করে মুসলিম রাষ্ট্রগুলাের প্রতি আকুল আহ্বান জানান। তিনি বলেন, বাংলাদেশের আপামর মানুষ আজ ইয়াহিয়ার। সেনাবাহিনীর আক্রমণের শিকার হয়েছেন। বাংলাদেশের মানুষ মােকাবিলা করছেন এমন একটি সুদক্ষ সেনা দলের যারা গণচীন ও মার্কিন অস্ত্রে সুসজ্জিত। তিনি বাঙ্গালীর এ সংগ্রামকে মানবতার সংগ্রাম বলে অভিহিত করেন, এবং বিপন্ন মানবতার সাহায্যে এগিয়ে আসার জন্য বিশ্ববাসীর প্রতি আবেদন জানান।
বাঙলাদেশের বর্তমান ঘটনাবলীর রাজনৈতিক পটভূমি ব্যাখ্যা করে জনাব সামাদ বলেন, পাক সেনাবাহিনী বাঙলাদেশে যে গণহত্যা চালিয়েছে ইতিহাসে তার নজীর খুঁজে পাওয়া ভার। তিনি বলেন- ‘আমাদের সংগ্রামের প্রতি ভারত যেভাবে প্রকাশ্য সমর্থন জানিয়েছেন সেজন্যে ভারতবাসীদের জানাই আমাদের কৃতজ্ঞতা। এ ছাড়া পাকিস্তানের দখলকারী সেনাবাহিনীর নৃশংস অত্যাচারের বিরুদ্ধে নিন্দা জ্ঞাপনের জন্যে তিনি সােভিয়েট ইউনিয়নের জনগণের প্রতিও কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করেন।
জয়বাংলা (১) ! ১ : ৩ ॥ ২৬ মে ১৯৭১
সঙ্কট-মানব সৈয়দ নজরুল
স্বাধীন বাংলাদেশ সরকারের অস্থায়ী কর্ণধার সৈয়দ নজরুল ইসলাম বাঙ্গালীদের কাছে একজন সঙ্কট-মানব হিসেবে পরিচিত। বস্তুতঃ আওয়ামী লীগ ও বাঙ্গালী যখনই কোন সঙ্কটে পতিত হয়েছে। তখনই তার উপর অর্পিত হয়েছে পথ প্রদর্শনের দায়িত্ব। সহজ সরল নীতিনিষ্ঠ এই মানুষটি কথার চেয়ে কাজ করেন বেশী চিন্তা করেন আরও বেশী । ইংরেজী ১৯২৫ সালে ময়মনসিংহের কিশােরগঞ্জ থানার যশােদল গ্রামের এক সম্রান্ত পরিবারে তার জন্ম। কিশােরগঞ্জ ও ময়মনসিংহে প্রাথমিক ও মাধ্যমিক শিক্ষা সমাপ্ত করে তিনি ইতিহাসে অনার্স নিয়ে ভর্তি হলেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে এবং ১৯৪৫ সালে কৃতিত্বের সাথে এম-এ পাশ করেন। মেধাবী ছাত্র হিসেবে তিনি ছিলেন সকলের প্রিয়। তিনি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে আইনের ডিগ্রী লাভ করেন। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের চত্বরেই হয়েছিল তার রাজনীতির হাতেখড়ি এবং তিনি নির্বাচিত হয়েছিলেন সলিমুল্লাহ মুসলিম হলের ছাত্র সংসদের ভাইস প্রেসিডেন্ট। বাংলা ভাষাকে রাষ্ট্রভাষা করার প্রশ্নে ১৯৪৮ সালে যে সর্বদলীয় সংগ্রাম পরিষদ গড়ে উঠেছিল তিনি ছিলেন তার একজন প্রভাবশালী নেতা। এ সংগ্রাম পরিষদের পক্ষ থেকে জিন্নাহর কাছে যে প্রতিনিধিদলটি গিয়েছিল সৈয়দ নজরুল ইসলাম তাতেও অন্যতম সদস্য ছিলেন। ভাষা আন্দোলনের প্রতিটি স্তরে তার সক্রিয় ভূমিকা সৈয়দ নজরুল ইসলামকে চিরস্মরণীয় করে রাখবে। একজন সরকারী চাকুরের পুত্র উচ্চপদস্থ সরকারী চাকুরে হবেন এটাই ছিল তার আত্মীয়স্বজনের অনেকের বাসনা। কিন্তু বিধাতা যার জন্য একটা বিরাট দায়িত্ব নির্দিষ্ট করে রেখেছেন সাড়ে সাত
কোটি মানুষের একটি শাষিত বঞ্চিত জাতিকে মুক্তির পথে এগিয়ে নিয়ে যাওয়ার দায়িত্ব নির্দিষ্ট করেছেন, তিনি কি করে সরকারী চাকরী করবেন। তাই পাকিস্তানের সর্বাধিক লােভনীয় সেন্ট্রাল সুপিরিয়র সার্ভিসে প্রতিযােগিতা করে তিনি উত্তীর্ণ হয়ে ট্যাকসেশন সার্ভিসে যােগদান করে এক বছর চাকরীও করলেন কিন্তু বিবেকের দংশন ও মনের পীড়নে এই স্বাধীনচেতা মানুষটি চাকুরীতে ইস্তাফা। দিয়ে ময়মনসিংহ আনন্দমােহন কলেজে অধ্যাপনায় যােগ দিলেন। এই সামান্য সময় চাকরীতে থাকাকালেই তিনি বুঝতে পেরেছিলেন যে পশ্চিম পাকিস্তানী পুঁজিবাদ ও নব্য উপনিবেশবাদ কি ভাবে শােষণ করে বাংলাদেশকে তাই পরবর্তীকালে তাকে পশ্চিমা-শােষণবিরােধী সংগ্রামে হিমালয়ের মত অটল থাকতে দেখা গেছে। ১৯৫১ সালে সৈয়দ নজরুল ইসলাম ময়মনসিংহ বারে যােগদান করেন এবং সক্রিয় আওয়ামী লীগের সঙ্গে জড়িত হয়ে পড়েন। তার সৎ চিন্তা, সততা ও নির্ভীকতা অল্প দিনের মধ্যেই তাকে আওয়ামী লীগ নেতৃত্ব কর্মী মহলে প্রিয় করে তােলে। ১৯৫৭ সালে তিনি ময়মনসিংহ জেলা আওয়ামী লীগের প্রেসিডেন্ট নির্বাচিত হন এবং ওই বছরেই দলের প্রথম সহ-সভাপতি নির্বাচিত হন। ১৯৬২ সাল থেকে বাংলাদেশে আইয়ুবী স্বৈরাচারের বিরুদ্ধে যে গণ-আন্দোলন শুরু হয় তিনি ছিলেন তার। অন্যতম পুরােধা।
১৯৬৬ সাল। এ বছরটা ছিল আওয়ামী লীগ তথা বাংলাদেশের জন্য একটা সঙ্কটকাল। শেখ। মুজিবরের ছয় দফা বাঙ্গালী জাতির মনে একটি আশার আলাে তুলে ধরল। আইয়ুব খান ও তার দালাল মােনায়েম খান ছয় দফার জনপ্রিয়তায় সন্ত্রস্ত হয়ে উঠল। আইয়ুব প্রকাশ্যে ঘােষণা করলেন। আওয়ামী লীগ ও ছয় দফার বিরুদ্ধে অস্ত্রের ভাষা প্রয়ােগের কথা। শুরু হয়ে গেল ধরপাকড় নির্যাতন। শেখ মুজিব, তাজউদ্দীন, মােস্তাক সহ হাজার হাজার আওয়ামী লীগ কর্মী ও নেতা নিক্ষিপ্ত হলেন। কারাগারে। শুরু হয়ে গেল কুখ্যাত আগরতলা ষড়যন্ত্র মামলার প্রস্তুতি। প্রথম ভাইস প্রেসিডেন্ট সৈয়দ নজরুল ইসলাম তখন বাইরে। তিনি দৃঢ় হস্তে তুলে নিলেন দলের নেতার দায়িত্ব। প্রমাণ করে দিলেন। নেতাদের গ্রেপ্তার করে বাঙ্গালীকে স্তব্ধ করা যাবে না। ৭ই জুন ঢাকা নারায়ণগঞ্জের রাজপথে খােড়া হল। আইয়ুব মােনায়েম শাহীর কবর। এর সবই হয়েছিল অকুতােভয়, স্থিরচিত্ত সৈয়দ নজরুল ইসলামের নেতৃত্বে। |এ সময়টা অন্যান্য কারণেও আওয়ামী লীগ তথা বাঙ্গালীর জন্য ছিল সঙ্কটময়। শেখ মুজিবর রহমানের অনুপস্থিতির সুযােগে পশ্চিম পাকিস্তানী পুঁজিবাদী ও শােষণবাদীদের প্রলােভনে পড়ে আওয়ামী লীগের একশ্রেণীর সুবিধাবাদী নেতা আওয়ামী লীগকে পশ্চিমাদের হাতে তুলে দিতে এগিয়ে এল। কিন্তু সৈয়দ নজরুল ইসলাম তাদের সমস্ত চক্রান্ত ও শঠতাকে বানচাল করে দিলেন। ১৯৬৯ সাল। শেখ মুজিবর রহমান ঢাকা ক্যান্টনমেন্টে আটক। বিচারের নামে ক্যান্টনমেন্টে চলেছে এক প্রহসন।
বাংলার আকাশ বাতাস প্রকম্পিত হয়ে উঠেছিল তখন ছাত্র, তরুণ, শ্রমিকের পদভরে। আন্দোলনকে সুষ্ঠুপথে পরিচালিত করার জন্য দাবী উঠল একটা সংগ্রাম কমিটি গঠনের। গঠিত হল ডেমােক্রেটিক এ্যাকসন কমিটি (ডিএসি) বস্তুতঃ এটার গঠন ও নীতি নির্ধারণে কাজ করেছিল সৈয়দ নজরুলের বিচক্ষণতা। বলাবাহুল্য ডাকের কর্মসূচী অনুযায়ী প্রত্যাহৃত হয়েছিল কুখ্যাত আগরতলা ষড়যন্ত্র মামলা। মুক্তি পেয়েছিলেন শেখ মুজিবুর রহমান ও উক্ত মামলায় জড়িত অন্যান্য আসামীরা, পুনরায় প্রকাশিত হয়েছিল দীর্ঘ তিন বছর পর দৈনিক ইত্তেফাক। ১৯৬৯ সালে রাওয়ালপিণ্ডিতে যে গােলটেবিল বৈঠক হয়েছিল সৈয়দ নজরুল ইসলাম তাতেও গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা গ্রহণ করেছিলেন। গত ডিসেম্বরে যে নির্বাচন হয়েছিল তাতে তিনি জাতীয় পরিষদে নির্বাচিত হয়েছিলেন। পরে তিনি জাতীয় পরিষদে আওয়ামী লীগ পার্লামেন্টারী পার্টির সহকারী নেতা নির্বাচিত হয়েছিলেন, যার নেতা নির্বাচিত হয়েছিলেন শেখ মুজিবর রহমান।
জয়বাংলা মে ১: ৪
২ জুন ১৯৭১
সূত্র : গণমাধ্যমে বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধ – খন্ড – ০৩